Home ইসলাম পারস্পরিক বিরোধে শিষ্টাচার রক্ষা জরুরি

পারস্পরিক বিরোধে শিষ্টাচার রক্ষা জরুরি

।। সাইয়েদ রাবে হাসানি নদভি (রহ.) ।।

মুসলিম উম্মাহর একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলো তাদের বৈশ্বিক ঐক্য। আর এই ঐক্যের ভিত্তি আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের আনুগত্য ও ভালোবাসা। হাদিসে এসেছে, এক মুসলিম অপর মুসলিমের জন্য দেয়ালতুল্য। যার এক অংশ দ্বারা অপর অংশ মজবুত হয়।

আরো বলা হয়েছে, সমগ্র বিশ্বের মুসলিমরা একটি দেহের মতো। এক অঙ্গ কষ্ট পেলে অন্য অঙ্গের কষ্ট হয় এবং সমস্ত অঙ্গে ব্যথা ছড়িয়ে পড়ে। এই ঐক্যই ইসলাম ও মুসলিম সমাজের অগ্রযাত্রার অন্যতম শক্তি। সুলতান সালাহ উদ্দিন আইয়ুবি (রহ.) ইউরোপের সম্মিলিত খ্রিস্টান বাহিনীর আক্রমণ তখনই প্রতিহত করতে পেরেছিলেন, যখন তিনি ইসলামের পতাকাতলে সমগ্র শাম অঞ্চলকে ঐক্যবদ্ধ করতে পেরেছিলেন। ইতিহাস সাক্ষী, মুসলমানরা কোনো প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে তখনই সাফল্য লাভ করেছে, যখন তারা একতাবদ্ধ হয়েছে।

মুসলিমসমাজের প্রত্যেকে যদি ব্যক্তিগত চিন্তা, দর্শন ও মতবাদের ওপর অটল থাকে এবং তা থেকে সৃষ্ট মতভিন্নতাকে শত্রুতার পর্যায়ে নিয়ে যায়, তাদের কেউই সাফল্য পাবে না এবং মুসলিমরা সামগ্রিক সংগ্রামে হেরে যাবে। ইসলামবিরোধীরাই এগিয়ে যাবে। সমকালীন মুসলিমদের একটি বড় রোগ হলো তাদের চিন্তা ও মানসিক বিক্ষিপ্ততা। এ কারণেই পৃথিবীতে শত কোটি মুসলিম থাকা এবং তারা পৃথিবীর মোট জনসংখ্যার এক-চতুর্থাংশ (১৯৯৭ সালের লেখা) হওয়ার পরও বৈশ্বিক রাজনীতিতে তাদের কোনো প্রভাব নেই। অন্যান্য জাতি-গোষ্ঠীর বিপরীতে তাদের উল্লেখযোগ্য কোনো অবস্থান নেই। ফলে অন্যরা মুসলমানের সঙ্গে অসম্মানজনক ও অবজ্ঞার আচরণ করে।

মুসলিম সমাজের প্রত্যেকটি দল তাদের নিজস্ব চিন্তা, পরিবেশ-পরিস্থিতি, নিজেদের নেতৃবৃন্দের মতবাদের অনুসারী। এতে তাদের সর্বত্র ও সর্বস্তরে দ্বন্দ্ব ও বিরোধ লক্ষ্য করা যাচ্ছে। মানুষের চিন্তা-ভাবনা ও কর্মপদ্ধতিতে ভিন্নতা অস্বাভাবিক কিছু নয়।

কিন্তু এই ভিন্নতা যখন ব্যক্তিগত বিরোধ, দলীয় বিবাদ ও আঞ্চলিক সংঘাতে রূপ নেয় এবং একপক্ষ অপর পক্ষের গঠনমূলক কাজকে ধ্বংসাত্মক প্রমাণের চেষ্টা করে, তখন এই বিরোধগুলোই ইসলামের অস্তিত্ব বিলোপ, তার সম্মানহানি ও প্রভাব-প্রতিপত্তি হ্রাসের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। ইসলামী সমাজের প্রত্যেক বাহু যদি অপর বাহুর বিরুদ্ধে ধ্বংসাত্মক কাজে লিপ্ত হয়, তবে এই উম্মাহর পতন কে ঠেকিয়ে রাখবে? তারা তো আত্মবিরোধেই ধ্বংস হয়ে যাবে। কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো, উম্মাহর জন্য কাজ করে এমন দলগুলোই এই ধ্বংসাত্মক কাজকে সমাজের মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য অপরিহার্য মনে করে।

চিন্তাশীল ও দূরদর্শী মুসলিম ব্যক্তিত্বদের সবচেয়ে বড় দুশ্চিন্তার বিষয় হলো, মুসলমানরা মৌলিক ও গঠনমূলক কাজ না করে তারা আত্মবিনাশী কাজে লিপ্ত। মুসলিম দেশের সরকার হোক বা ইসলামী দল হোক; বরং কোনো বহু অঞ্চলের সাধারণ মুসলিমরা পর্যন্ত শুধু নিজের বুঝ-বুদ্ধি, ও নিজের বেছে নেওয়া পথকে একমাত্র সঠিক পথ জ্ঞান করছে, অন্যদের উপেক্ষা করছে এবং পারস্পরিক সহযোগিতার পথ পরিহার প্রত্যাখ্যান করছে। ঠিক যেমন পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘যারা নিজেদের দ্বিনে মতভেদ সৃষ্টি করেছে এবং বিভিন্ন দলে বিভক্ত হয়েছে। প্রত্যেক দলই নিজ নিজ মতবাদ নিয়ে উত্ফুল্ল। ’ (সুরা রোম, আয়াত : ৩২)

আরও পড়তে পারেন-

কোনো সন্দেহ নেই, বর্তমান সময়ের মুসলিমরা নিজেদের মত ও মতবাদ বিশুদ্ধ চিন্তা করার এবং তাতে আত্মমুগ্ধ হওয়ার কারণে সামগ্রিক বিরোধ ও দ্বন্দ্বে লিপ্ত হয়েছে। তাদের বিরোধ ছড়িয়ে পড়েছে সর্বত্র। চাই তা বিশ্বাসগত বিষয় হোক, ফিকহি মতবাদ হোক, রাজনৈতিক বিষয় হোক অথবা সামাজিক কোনো বিষয় হোক। সর্ববিষয়ে নেতৃস্থানীয় মুসলিমদের মধ্যে বিরোধ আছে এবং তারা পরস্পরের সমালোচনা করে ও তাচ্ছিল্য করে। এমনকি দলীয় সংকীর্ণতার কারণে তারা প্রতিপক্ষের ব্যাপারে ভালোভাবে না জেনেই তাকে পথভ্রষ্ট বলে বসে। এমনকি তারা অন্যদের সামান্য কারণে ইসলাম থেকে বহির্ভূত বলে মত প্রকাশ করে। এমন সীমালঙ্ঘনের কারণেই ইসলামী দলগুলো আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের নামে এবং ইসলামের বৃহত্তর স্বার্থে এক হতে পারে না।

আজ আমরা না আদর্শ জীবনের অধিকারী, না আমরা অনুসরণযোগ্য এবং না আমাদের জীবনে রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর পূর্ণাঙ্গ অনুসরণ আছে, তাহলে আমরা কেন নিজেদের নবীর উত্তরসূরি দাবি করে অন্যদের সমালোচনা করি। আমরা এটা করি, কেননা আমাদের লক্ষ্য থাকে কখনো নেতৃত্ব ও খ্যাতি, কখনো দলদারি, কখনো নিজের মতাদর্শের ওপর গোঁড়ামি ইত্যাদি। আর এটাকেই নিখাঁদ ইসলাম বলে চালিয়ে দিই। এটা সরাসরি ইসলামের নামে বাড়াবাড়ি এবং ব্যক্তি স্বার্থে ইসলামকে ব্যবহারের নামান্তর।

রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর শিক্ষা হলো মুসলমান পরস্পরকে সম্মান করবে, অন্যের অধিকার আদায় করবে, ভালো কাজে পরস্পরকে সহযোগিতা করবে, অন্যের প্রতি হিংসা-বিদ্বেষ ও শত্রুতা রাখবে না, শত্রুকেও প্রাপ্য সম্মান ও মর্যাদা প্রদান করবে। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘তোমাদের মসজিদুল হারামে প্রবেশে বাধা দেওয়ার কারণে কোনো সম্প্রদায়ের প্রতি বিদ্বেষ তোমাদের যেন কখনোই সীমালঙ্ঘনে প্ররোচিত না করে। ভালো কাজ ও আল্লাহভীতিতে তোমরা পরস্পরকে সাহায্য করবে এবং পাপ ও সীমালঙ্ঘনে পরস্পরকে সাহায্য করবে না। আল্লাহকে ভয় করবে। নিশ্চয়ই আল্লাহ শাস্তিদানে কঠোর। ’ (সুরা মায়িদা, আয়াত : ২)

এই সময় মুসলমানের প্রধান কাজ হলো, পরস্পরের অন্ধ বিরোধে ইসলামের ক্ষতি না করা, প্রত্যেকে মৌলিক ও ইতিবাচক কাজে মনোযোগী হওয়া, অন্যের দোষ অনুসন্ধান ও সমালোচনা করে সময় নষ্ট না করা, পরস্পরকে শত্রুতে পরিণত করে এমন কাজ পরিহার করা।

তামিরে হায়াত থেকে

মো. আবদুল মজিদ মোল্লার ভাষান্তর

উম্মাহ২৪ডটকম: এসএ

উম্মাহ পড়তে ক্লিক করুন-
https://www.ummah24.com

দেশি-বিদেশি খবরসহ ইসলামী ভাবধারার গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে ‘উম্মাহ’র ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।