Home ইতিহাস ও জীবনী শাইখুল ইসলাম আল্লামা শাহ আহমদ শফি (রহ.), কিছু স্মৃতি কিছু অভিজ্ঞতা

শাইখুল ইসলাম আল্লামা শাহ আহমদ শফি (রহ.), কিছু স্মৃতি কিছু অভিজ্ঞতা

।। মাওলানা আবদুর রহীম ইসলামাবাদী ।।

উপমহাদেশের মুসলিম উম্মাহর আধ্যাত্মিক অভিভাবক, আল-জামিআতুল আহলিয়া দারুল উলূম মুঈনুল ইসলামের সুদীর্ঘ ৩৫ বছরের দক্ষ এবং সফল মহাপরিচালক, বাংলাদেশের নাস্তিক-মুরতাদ বিরোধী আন্দোলনের অবিসংবাদিত নেতা, উসতাযে মুহতারাম শাইখুল ইসলাম আল্লামা শাহ আহমদ শফি (রাহিমাহুল্লাহ) গত ২০২০ইং সনের ১৮ই সেপ্টেম্বর মোতাবেক ১লা সফর ১৪৪২ হিজরীতে রাজধানী ঢাকার একটি স্বনামধন্য আসগর আলী হাসপাতালে শতবর্ষী জীবনের শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি  রাজিউন। আল্লাহ তাআলা হযরতের উপর রহম করুন। হযরতের দারাজাত বুলন্দ করুন। জান্নাতের উঁচু মর্যাদা দান করুন এবং হযরতের ভুল-ত্রুটিগুলো ক্ষমা করুন। হযরতের পরিবার-পরিজন ছাত্র-মুরীদ এবং সকল ভক্তবৃন্দকে সবরে জামীল দান করুন। আমাদের সবাইকে হযরতের উত্তম বদলা দান করুন। আমীন।

হযরতের পবিত্র হায়াত ছিলো শত বছরের এক বর্ণাঢ্য জীবন। যেখানে ছিলো ইলমে নববীর শিক্ষা-দীক্ষা, দাওয়াত-তালীম এবং আত্মশুদ্ধির এক রাজকীয় আয়োজন। আল্লাহ তাআলা হযরতের সুদীর্ঘ হায়াতে দ্বীনের প্রতিটি শাখায় হযরতের কাছ থেকে খেদমত নিয়েছেন। পুরো এক শতাব্দীর মেহনতে হযরত রেখে গিয়েছেন লক্ষ-লক্ষ রূহানী সন্তান। যারা হযরতের কাছ থেকে ইলমে নববী এবং আত্মশুদ্ধির ‘মধু’  আহরণ করে ছড়িয়ে পড়েছেন পৃথিবীর দিক থেকে দিগন্তে। একদিক দিয়ে হযরতের ইনতেকালে অধম যেরকম শোকাহত এবং হৃদয়ে একাকিত্ব অনুভব করছি, অন্যদিকে হযরত রহ. এর ইলমী দস্তরখানে অংশগ্রহণ করে, হযরতের ছাত্রত্বের সৌভাগ্য অর্জন করে নিজেকে খুবই ভাগ্যবান মনে করছি। আলহামদুলিল্লাহ। জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত হযরতকে কাছ থেকে যেভাবে দেখেছি, হযরতের  ব্যক্তিত্বকে যেভাবে অনুভব করেছি, পাঠকের সামনে তা আজ তুলে ধরবো ইনশাআল্লাহ।

শাইখুল ইসলাম আল্লামা শাহ আহমদ শফি সাহেব রহ. আমার উস্তায। শাইখ ও মুরুব্বী। ১৩৯৯ হিজরী সনে (১৯৭৯ খ্রিস্টাব্দ) আমি ইলমে নববী অন্বেষণের উদ্দেশ্যে দারুল উলূম মুঈনুল ইসলাম হাটহাজারীতে আসি। তখন তিনি মাদ্রাসার একজন বিশিষ্ট উস্তায। হাদীস, তাফসীর, মানতিক -ফালসাফা ও আরবি সাহিত্য প্রভৃতি কিতাবের দরস তিনি দিতেন। প্রথম দিকে ভয়ে ভয়ে দেখা সাক্ষাৎ করতেও পারছিলাম না। তাঁর ব্যক্তিত্বের সামনে আমাদের মতো ক্ষুদ্র ছাত্রের ভয় পাওয়াই স্বাভাবিক। ১৯৮০/১৪৪৭ হিজরী সনে শাওয়াল মাসে হাটহাজারী মাদ্রাসায় আমাদের নতুন শিক্ষা বর্ষের ক্লাস শুরু হলো। তিনি আমাদের ক্লাস শুরু করলেন। ভয় কেটে গেলো। দেখলাম তিনি একজন অতি সহজ সরল মানুষ। ছাত্রদের প্রতি খুবই আন্তরিক। মেশকাত শরীফের কঠিন কঠিন পাঠগুলো তিনি আমাদের লেখিয়ে দিতেন। আমরা তার তাকরীরগুলো (আলোচনা)  লিখে নিতে লাগলাম।

তিনি নিজেই বিভিন্ন ব্যাখ্যাগ্রন্থ থেকে নোট নিয়ে আসতেন। বলতেন আর আমরা লিখে নিতাম। যারা তাঁর তাকরীরগুলো সংরক্ষণ করেছেন তারা সফল হয়েছেন। আজীবন শিক্ষকতার জীবনে হযরতের এই আলোচনাগুলো কাজে আসে। ১৯৮১/ ১৪০১ হিজরী সনে আল্লামা শাহ আহমদ শফি সাহেব রাহমাতুল্লাহি আলাইহি আমাদেরকে শামায়েলে তিরমিজী পড়ান। ১৪০২ হিজরী (১৯৮২ সনে) বার্ষিক পরীক্ষা পর্যন্ত আসরের পর ক্লাস চলে। শব্দের তাহকীক, তরজমা ও ব্যাখ্যা খুব সুন্দরভাবে করতেন। যারা তার তাকরীরগুলো মনোযোগ দিয়ে আত্মস্থ করেছেন, খাতায় লিখে নিয়েছেন তারা সফল হয়েছেন। কৃতজ্ঞদের জন্য তা বড় সম্পদ।

আরও পড়তে পারেন-

হযরত আল্লামা শাহ আহমদ শফি রহ. এর একটি বড় বৈশিষ্ট্য ছিলো যে, তিনি নিয়মিত ক্লাসে উপস্থিত থাকতেন। হেফাজতের জোরদার আন্দোলনের সময়ও তাকে দেখেছি, ক্লাস বাদ দিতেন না। হাজারো মানুষের সভা চলছে, এক ফাঁকে তিনি গিয়ে ক্লাস নিয়ে নিতেন। উস্তাদগণকেও ক্লাসে যাওয়ার জন্য বলতেন। কোনো উস্তাদ একটা ক্লাস মিস করুক, এটা তিনি সহ্য করতেন না।

তিনি যখন দারুল উলূম দেওবন্দে পড়তেন, পুরো বছরে দাওরায়ে হাদীসের একটা ক্লাসেও  অনুপস্থিত থাকেননি। সব সময় ক্লাসের সামনের বেঞ্চে বসতেন। উস্তাদগণের সামনে। হযরত মাদানী রহ. যখন দেখতেন আহমদ শফি বাঙালি সামনে নেই, তিনি ডাক দিতেন। ডেকে সামনে বসাতেন। অনেক সময় সাথীরা হযরতকে সামনে বসতে দিতেন না, হযরত মাদানী রহ. তা বুঝতেন।

তিনি ফজরের নামাযের আগেই কিতাবাদি নিয়ে ক্লাসে পৌঁছে যেতেন। হযরত মাদানী রহ. যত রাত্রেই মাদ্রাসায় আসতেন, ঘন্টা পড়তো। ক্লাস শুরু হতো। ছাত্ররা অযু করে দ্রুত ক্লাসে উপস্থিত হয়ে যেতো। দেখা যেতো আহমদ শফি প্রথম থেকেই ক্লাসের প্রথম বেঞ্চে উপস্থিত। ক্লাসের কারণে অনেক সময় নাস্তা-খাবার ইত্যাদি নিয়মিত খেতে পারতেন না। দাওরায়ে হাদীস সমাপ্ত করার পর হযরত মাদানী রহ. এর হাতে বাই’আত গ্রহণ করেন। দাওরা-তাফসীর পড়ার সময় পড়াশোনার পাশাপাশি আত্মশুদ্ধির স্তরসমূহ অতিক্রম করে হযরত মাদানী রহ. থেকে খেলাফত লাভ করেন।

আমরা হাটহাজারী মাদরাসায় পড়াকালে শুনতাম, আল্লামা আহমদ শফি রহ. এর তাহাজ্জুদ বাদ যায় না। বৃদ্ধ বয়সেও তিনি সকাল-সন্ধ্যার ছয় তাসবীহগুলো নিয়মিত আদায় করতেন। ইনতেকালের কয়েকদিন আগে আমি যখন হযরতকে দেখতে গেলাম, দুজন যুবক আলেম হযরত মাওলানা ইদরীস কান্ধলভী রহ. এর ‘তাফসীরে মাআরিফুল কুরআন’ পড়ে শোনাচ্ছেন। তিনি মনোযোগ দিয়ে তা শুনছেন।

কখনো দেখতাম হযরত মাদানী রহ. এর বুখারী এবং তিরমিযীর তাকরীরগুলো মনোযোগ সহকারে পড়তেন আবার কখনো তা ক্লাসেও নিয়ে যেতেন। দরসে গুরুত্বপূর্ণ কোনো বিষয় আসলে তা ছাত্রদেরকে লিখিয়ে দিতেন। বলতেন, এগুলো লিখে রাখো। সংরক্ষণ করো। ভবিষ্যতে শিক্ষকতা করলে এগুলো কাজে আসবে। অনেক কিতাব পড়েও এরকম আলোচনা পাবে না।

হযরত আল্লামা রশীদ আহমদ গাংগুহী রহ., হযরত শাইখুল হিন্দ মাহমুদ হাসান দেওবন্দী রহ., আল্লামা আনোয়ার শাহ কাশ্মীরী রহ., হযরত মাদানী রহ. শাইখুল হাদীস যাকারিয়াহ রহ. এর দরসী তাকরীর তিনি মুতালাআয় রাখতেন। অন্যান্য ব্যাখ্যাগ্রন্থগুলোর সাথে আকাবিরদের দরস থেকে তিনি সব সময় উপকৃত হতেন।

সময়ের সদ্ব্যবহার ছিলো তার জীবনের বড় একটি বৈশিষ্ট্য। অনর্থক কোনো সময় তিনি নষ্ট করেননি। নির্দিষ্ট সময় অনুযায়ী সব কাজ তিনি সারতেন। যার কারণে তাঁর সময়ে বরকত হয়েছে অনেক বেশি। একজন ব্যক্তি হাজারো মানুষের কাজ করেছেন।

আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে হযরতের জীবন থেকে শিক্ষা লাভ করার তাওফীক দান করুন। আমিন।

লেখক: প্রখ্যাত সাংবাদিক, লেখক ও আলেমে-দ্বীন এবং মুহতামিম- তালিমুল ইসলাম বালিকা মাদ্রাসা, ভূজপুর, ফটিকছড়ি, চট্টগ্রাম।

উম্মাহ২৪ডটকম: এসএ

উম্মাহ পড়তে ক্লিক করুন-
https://www.ummah24.com

দেশি-বিদেশি খবরসহ ইসলামী ভাবধারার গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে ‘উম্মাহ’র ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।