।। মাওলানা নূর হোসাইন ।।
বিয়ের জন্য কোনও পাত্রী পছন্দ হলে, শরিয়তসম্মত ও সুন্নত পন্থায় অগ্রসর হতে হবে। এক্ষেত্রে প্রথমেই দ্বীনদারিকে প্রাধান্য দিতে হবে। ইমাম আহমদ বিন হাম্বল (রহ.) বলেছেন, ‘কোনো পুরুষ যদি কোনও নারীকে বিয়ের প্রস্তাব দেয়, তাহলে সর্বপ্রথম তার সৌন্দর্য সম্পর্কে জিজ্ঞেস করবে। যদি এ ব্যাপারে তার প্রশংসা করা হয়, তাহলে তার দ্বীন সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করবে। দ্বীনের ক্ষেত্রে যদি প্রশংসিত হয়, তাহলে বিয়ে করবে; অন্যথায় দ্বীনের কারণে প্রত্যাখ্যান করবে।
কিন্তু এমনটি করা ঠিক নয় যে— প্রথমেই দ্বীন সম্পর্কে জিজ্ঞেস করবে, আর এ ক্ষেত্রে প্রশংসনীয় হলে সৌন্দর্য সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করবে; এরপর সৌন্দর্যের ব্যাপারে প্রশংসনীয় না হলে— ফিরিয়ে দেবে। তাহলে এ প্রত্যাখ্যান হবে সৌন্দর্যের কারণে; দ্বীনের কারণে নয়।’ -(শরহু মুনতাহাল ইরাদাত, লিল-ইমাম বুতি- ২/৬২১)।
বিবাহ পড়ানোর সুন্নাহসম্মত পদ্ধতি হলো, প্রথমে কনের কাছ থেকে ইজন বা অনুমতি নিতে হবে। এসময় কমপক্ষে দুজন সাক্ষী উপস্থিত থাকতে হবে। তখন বর উচ্চ স্বরে ‘কবুল’ অথবা ‘আমি গ্রহণ করলাম’ বা সম্মতিসূচক ‘আলহামদু লিল্লাহ’ বলবে। এরূপ তিনবার বলা উত্তম। (বুখারি, হাদিস- ৯৫)।
বিবাহের ক্ষেত্রে পাত্র-পাত্রী বা বর-কনেই মুখ্য, যারা সারা জীবন একসঙ্গে ঘর-সংসার করবে। তাই বিবাহের আগে তাদের সম্মতি থাকতে হবে। কোনো অবস্থায়ই কোনো ছেলে-মেয়ের অসম্মতিতে তাদের বিবাহ করতে বাধ্য করা উচিত নয়। আল্লাহ বলেন, ‘হে ঈমানদাররা! তোমাদের জন্য বৈধ নয় যে তোমরা বলপূর্বক নারীদের উত্তরাধিকারী হবে। ’ (সুরা নিসা, আয়াত- ১৯)।
এরপর অভিভাবক (যদি বিবাহ পড়াতে সক্ষম হন) বা যিনি বিবাহ পড়াবেন তিনি বিবাহের খুতবা পাঠ করবেন। এরপর মেয়ের অভিভাবক বরের সামনে মেয়ের পরিচয় ও মোহরের পরিমাণ উল্লেখ করবেন। তারপর তিনি বিবাহের প্রস্তাব পেশ করবেন। অথবা অভিভাবকের অনুমতি নিয়ে যিনি বিবাহ পড়াবেন তিনি হবু বরের কাছে বিবাহের প্রস্তাব তুলে ধরবেন। এটাকে ইসলামের ভাষায় ‘ইজাব’ বলা হয়।
যিনি বিবাহ পড়াবেন তিনি উপস্থিত মজলিসে হবু বরের উদ্দেশে বলবেন যে অমুকের মেয়ে অমুককে এত টাকা মোহরানায় আপনার কাছে বিবাহ দিলাম, আপনি বলুন ‘কবুল’ বা ‘আমি গ্রহণ করলাম’।
বিবাহের ক্ষেত্রে অভিভাবকের অনুমতি নিতে হবে। বিশেষ করে মেয়ের ক্ষেত্রে অভিভাবকের অনুমতি একান্তভাবে আবশ্যক। কারণ অভিভাবকের অনুমতি ছাড়া বিবাহ হয় না। নবী করিম (সা.) বলেন, ‘অভিভাবক ছাড়া কোনো বিবাহ নেই। ’ (তিরমিজি, হাদিস- ১১০১)।
প্রথমে খুতবা পাঠ করতে হবে তারপর ইজাব-কবুল (প্রস্তাব দেওয়া-নেওয়া)। শুধু বরকেই কবুল বলাতে হবে। কনের কাছ থেকে কনের অভিভাবক শুধু অনুমতি নেবেন। বর বোবা হলে সাক্ষীদ্বয়ের উপস্থিতিতে ইশারা বা লেখার মাধ্যমেও বিবাহ সম্পন্ন হতে পারে।
এভাবে বিবাহ সম্পন্ন হয়ে যাবে। এরপর উপস্থিত সবাই পৃথকভাবে সুন্নতি দোয়া পাঠ করবে : ‘বা-রাকাল্লাহু লাকা, ওয়া বা-রাকা আলাইকা, ওয়া জামাআ বায়নাকুমা ফী খায়ের।’ অর্থ- ‘আল্লাহ তোমার জন্য বরকত দিন, তোমার ওপর বরকত দিন ও তোমাদের দুজনকে কল্যাণের সঙ্গে মিলিত করুন। ’ (তিরমিজি, হাদিস- ১০৯১)।
বিয়ের ক্ষেত্রে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের আদর্শ ছিল সহজ করার প্রতি উদ্বুদ্ধ করা। বিয়ের ঘোষণা দেয়া ও বিয়ের খবর প্রচার করা। খুশি ও আনন্দ প্রকাশ করা। বরের বাড়িতে ওয়ালিমা বা বৌভাতের আয়োজন করা ও দাওয়াত দেয়া। দাওয়াতপ্রাপ্ত ব্যক্তিদেরকে উপস্থিত হওয়ার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। এমনকি কেউ রোযা থাকলে তবুও তিনি হাযির হয়ে নিমন্ত্রণকারীর জন্য দোয়া করবেন; তবে খাবার গ্রহণ করা অপরিহার্য নয়। এরপর স্বামী-স্ত্রী সৎভাবে সংসার করবে এবং সদভাবে সংসার করার যাবতীয় উপকরণ গ্রহণ করবে। সংক্ষিপ্তভাবে এটাই নবীজির আদর্শ; এবার বিস্তারিত আলোচনায় আসুন-
মোহরানা সাধ্যের মধ্যে হওয়া
মোহর ইসলামি বিয়ের একটি মৌলিক শর্ত এবং নারীর একান্ত অধিকার। কেবল কাগজে অঙ্ক ধরে রাখার জন্য নয়, বরং তা বাস্তবিকভাবে পরিশোধ করাও স্বামীর ওপর ফরজ। এর মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে স্ত্রীকে মর্যাদা ও সম্মানের প্রতীকস্বরূপ কিছু প্রদান করা।
বাইহাকী (১৪৭২১) বর্ণনা করেন যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন: “সর্বোত্তম মোহরানা হচ্ছে- সহজসাধ্য মোহরানা”। একই হাদিস আবু দাউদ (২১১৭) বর্ণনা করেছেন এ ভাষায়: “সর্বোত্তম বিবাহ হচ্ছে- সহজসাধ্য মোহরানা” (আলবানী হাদিসটিকে সহিহ আখ্যায়িত করেছেন)।
আউনুল মাবুদ গ্রন্থে বলা হয়েছে- أيسره শব্দের অর্থ হচ্ছে- মোহরানা ও অন্যান্য খরচ কমানো, যাতে করে পুরুষের জন্য সহজসাধ্য হয়। আল্লামা শাইখ আল-আযিযি বলেন- “মোহরানার পরিমাণ কম হওয়া কিংবা এমন হওয়া, যাতে করে পাত্রের জন্য প্রস্তাব গ্রহণ করা সহজ হয় এবং কনে বা স্ত্রীর জন্যও সামাজিকভাবে মর্যাদাজনক হয়।”
আরও পড়তে পারেন-
- আদর্শ সমাজ বিনির্মাণে ইসলামের ভূমিকা
- সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি যেন হুমকির মুখে না পড়ে
- সমৃদ্ধ জাতি নির্মাণে দরকার বুদ্ধিবৃত্তিক জাগরণ ও আলেমদের এগিয়ে আসা
- সালাম-কালামের আদব-কায়দা
- বিবি খাদিজা (রাযি.): ইসলাম ধর্মের ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ নারী
ইমাম আহমাদ (২৩৯৫৭) ও ইবনে হিব্বান (৪০৯৫) হযরত আয়েশা (রাযি.) থেকে বর্ণনা করেন যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেন- “কনের বরকতের আলামত হচ্ছে- বিয়ের প্রস্তাবনা সহজ হওয়া, মোহরানা সহজসাধ্য হওয়া (অর্থাৎ- উচ্চ মোহরানার জন্য পাত্রের সমর্থের বাইরে জোরাজুরি না করা) এবং গর্ভধারণ সহজ হওয়া।” (‘সহিহুল জামে’ (২২৩৫) গ্রন্থে আলবানী হাদিসটিকে সহিহ আখ্যায়িত করেছেন)।
মোহরে ফাতেমি
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন কন্যা হজরত ফাতিমা (রাযি.)-কে হজরত আলি (রা.)-এর সঙ্গে বিবাহ দেন, তখন তিনি ৫০০ দিরহাম মোহর নির্ধারণ করেন। এই মোহরই ইসলামে “মোহরে ফাতেমি” নামে পরিচিত।
বর্তমান বাজারে মোহরে ফাতেমির হিসাব:
- ৫০০ দিরহাম × ৩.০৬১৮ গ্রাম = ১.৫৩০৯ কেজি রূপা
- প্রতি ভরি রূপা ১,৭০০ টাকা হলে
- মোহরের মূল্য ≈ ২,২৩,১২৫ টাকা
তবে রূপার দাম ওঠানামা করায় এই পরিমাণ সময়ভেদে পরিবর্তিত হতে পারে।
মোহরের পরিমাণ নির্ধারণে সামর্থ্যই মূল বিবেচ্য
মোহরে ফাতেমি দেওয়া প্রশংসনীয় হলেও, এটি আবশ্যক নয়। কোনো ব্যক্তির আর্থিক সামর্থ্য না থাকলে তার পক্ষে সামর্থ্যের বাইরে মোহর ধার্য করা অনুচিত। হযরত রাসূলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেছেন- “তোমরা নারীদের মোহরানা নিয়ে বাড়াবাড়ি করো না। যদি তা সম্মান ও তাকওয়ার মানদণ্ড হতো, তাহলে রাসূল (সা.)-ই সেটি করতেন।” (সুনানে তিরমিযী, হাদিস- ১১১৪)
মোহরের ন্যূনতম পরিমাণ: শরিয়তের নির্দিষ্ট নির্দেশনা
ইসলাম মোহরের সর্বনিম্ন সীমা নির্ধারণ করেছে, যেন এটিকে গুরুত্বহীন মনে না করা হয়। সর্বনিম্ন মোহর: ১০ দিরহাম = ৩০.৬১৮ গ্রাম রূপা ≈ পৌনে ৩ ভরি রূপা
মূল্য: প্রতি ভরি রূপা ১,৭০০ টাকা হলে, সর্বনিম্ন মোহরের পরিমাণ- ৫,১০০ টাকা। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেন- “১০ দিরহামের কম কোনো দেনমোহর নেই।” (বায়হাকি শরীফ, ৭/২৪০)। স্ত্রীর সম্মতিতেও যদি ১০ দিরহামের কম মোহর নির্ধারণ করা হয়, সেটি শরিয়তসম্মত হবে না।
কোরআনে মোহরের গুরুত্ব
আল্লাহতায়ালা বিয়ের বিধান এবং মোহর সম্পর্কে বলেন: “তোমরা বিয়ে করো তোমাদের পছন্দের নারীদের থেকে, দুজন অথবা তিনজন অথবা চারজন; কিন্তু যদি আশঙ্কা করো যে তোমরা ন্যায়ের সঙ্গে আচরণ করতে পারবে না, তাহলে একজনই যথেষ্ট।” — (সুরা নিসা, আয়াত- ৩ আয়াত)।
“…তোমরা তাদের দেনমোহর প্রদান করো বিয়ের জন্য, প্রকাশ্য ব্যভিচার বা গোপন প্রণয়িনী গ্রহণকারী হিসেবে নয়।” — (সুরা মায়েদা, আয়াত- ৫ আয়াত)।
মোহর ছাড়া বিয়ে জায়েয হবে না
ইসলামিক শরিয়তের দৃষ্টিতে মোহর ছাড়া বিয়ে সম্পন্ন নয়। কেউ উদারতার ছদ্মবেশে মোহর ছাড়াই বিয়ে করলে সেটি শরিয়তসম্মত হবে না। মোহর হচ্ছে নারীর প্রাপ্য অধিকার, যা স্বামীকে অবশ্যই পরিশোধ করতে হবে।
মোহর শুধু একটি আনুষ্ঠানিকতা নয়, বরং এটি একটি ইসলামী দায়িত্ব, যা নারীকে সম্মানিত করার অন্যতম উপায়। তাই বিয়ের সময় মোহর নির্ধারণে যথাযথ গুরুত্ব দিতে হবে। সামর্থ্যের বাইরে মোহর ধার্য করা যেমন অন্যায়, তেমনি কোনো মোহর না ধরা ইসলামবিরোধী।
বিয়ের ঘোষণা দেয়া
তিরমিযি (১০৮৯) আয়েশা (রাঃ) থেকে বর্ণনা করেন যে, তিনি বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন: “তোমরা এ বিয়ের ঘোষণা দাও”। (আলবানী তাঁর ‘ইরওয়াউল গালিল’ গ্রন্থে (৭/৫০) হাদিসটিকে ‘হাসান’ আখ্যায়িত করেছেন)।
নাসাঈ (৩৩৬৯) মুহাম্মদ বিন হাতেব (রাঃ) থেকে বর্ণনা করেছেন যে, তিনি বলেন: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন: “হালাল ও হারামের মাঝে ব্যবধান হচ্ছে- বিয়েতে দফ বাজানো ও চেঁচামেচি করা” (আলবানী হাদিসটিকে ‘হাসান’ আখ্যায়িত করেছেন)।
বরের বাড়িতে ওয়ালিমা আয়োজন বা বৌভাত
বিয়ের ক্ষেত্রে ওয়ালিমার আয়োজন করা সুন্নতে মুয়াক্কাদা। এটি বিয়ের প্রচারণার অন্তর্ভুক্ত এবং আনন্দ ও খুশি প্রকাশ করার শামিল।
আনাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত যে, আব্দুর রহমান বিন আউফ (রাঃ) যখন বিয়ে করেছেন তখন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাকে বলেন: “একটি ছাগল দিয়ে হলেও তুমি ওয়ালিমার আয়োজন কর”[সহিহ বুখারী ও সহিহ মুসলিম]
মুসনাদে আহমাদের হাদিসের কারণে কোন কোন আলেম ওয়ালিমার আয়োজন করাকে ওয়াজিব বলেন। ইবনে বুরাইদা (রাঃ) তাঁর পিতা থেকে বর্ণনা করেন যে, আলী (রাঃ) যখন ফাতেমা (রাঃ) কে বিয়ের প্রস্তাব দিলেন তখন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন: “বিয়ের ক্ষেত্রে ওয়ালিমা বা ভোজানুষ্ঠান থাকতেই হবে।” (আলবানী তাঁর ‘আদাবুয যিফাফ’ নামক গ্রন্থে (৭২) বলেন: হাদিসটির সনদ যেমনটি বলেছেন ইবনে হাজার: কোন অসুবিধা নেই)।
ওয়ালিমার দাওয়াত পেলে উপস্থিত হওয়া ওয়াজিব। তোমাদের কাউকে যখন ওয়ালিমার দাওয়াত দেয়া হয় তখন সে যেন সে দাওয়াতে যায়” (সহিহ বুখারী ও সহিহ মুসলিম)।
ইবনে উছাইমীন (রহঃ) বর্ণনা করেন, প্রখ্যাত আলেমগণ বলেন: বিয়ের প্রথম দাওয়াত কবুল করা ওয়াজিব। অর্থাৎ প্রথম ওয়ালিমার। যদি নিমন্ত্রণকারী কিংবা তার প্রতিনিধি কিংবা কার্ড পাঠানোর মাধ্যমে ব্যক্তিকে সুনির্দিষ্টভাবে দাওয়াত দেয়া হয়। তবে শর্ত হচ্ছে- এ অনুষ্ঠানে যেন শরিয়ত গর্হিত কোন কিছু না থাকে। আর যদি এ অনুষ্ঠানে শরিয়ত গর্হিত কোন কিছু থাকে তাহলে এর হুকুম ব্যাখ্যাসাপেক্ষ: যদি ব্যক্তি উপস্থিত হয়ে এ গর্হিত কাজে নিষেধ করা সম্ভবপর হয় তাহলে এ ব্যক্তির জন্য উপস্থিত হওয়া ওয়াজিব। আর যদি উপস্থিত হয়ে এ গর্হিত কাজে বাধা দেয়া সম্ভবপর না হয় তাহলে এ ব্যক্তির জন্য উপস্থিত হওয়া নাজায়েয। (লিকাউল বাব আল-মাফতুহ- ১৩/১৩৩)।
গোশত ছাড়াও ওয়ালিমা অনুষ্ঠানের আয়োজন করা বৈধ। সহিহ বুখারীর বর্ণনায় (৪২১৩) আনাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত হয়েছে যে, তিনি বলেন: “নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম খায়বার ও মদিনার মাঝে তিনদিন অবস্থান করেছিলেন। এ সময় তিনি সাফিয়্যাকে (রাঃ) বিয়ে করেন। আমি মুসলমানদের সকলকে তাঁর বিয়ের ওয়ালিমার দাওয়াত দিলাম। সে ওয়ালিমাতে রুটি বা গোশত কিছুই ছিল না। সে ওয়ালিমাতে কিছুই ছিল না; শুধু নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বিলাল (রাঃ) কে চামড়ার চাটাই বিছানোর নির্দেশ দিলেন; চাটাই বিছানো হল। এরপর সে চাটাই এর ওপর খেজুর, পনির ও ঘি ছিটিয়ে দেয়া হল।”
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি আলাইহি ওয়া সাল্লামের শেখানো অভিনন্দনের মাধ্যমে বরকে অভিনন্দন জানানো মুস্তাহাব। আবু হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত যে, যখন কেউ বিয়ে করত তখন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম শুভেচ্ছা জানাতেন ও তার জন্য দোয়া করতেন এই বলে: ‘বারাকাল্লাহু লাক, ওয়া বারাকা আলাইক, ওয়া জামাআ বাইনাকুমা ফি ফাইর’ (অর্থ- আল্লাহ তোমাকে বরকত দিন, তোমার ওপর বরকত ঢেলে দিন এবং তোমাদের দুইজনকে কল্যাণের ওপর একত্রিত করুন)। (সুনানে আবু দাউদ- ২১৩০, আলবানী হাদিসটিকে সহিহ আখ্যায়িত করেছেন)।
স্বামী যখন স্ত্রীর সাথে বাসর করবেন তখন নিম্নোক্ত বিষয়গুলো পালন করা মুস্তাহাব:
– বাসর ঘরে স্ত্রীর সাথে কোমল আচরণ করা।
ইমাম আহমাদ (২৬৯২৫) আসমা বিনতে উমাইস (রাযি.) থেকে বর্ণনা করেন যে, তিনি বলেন: আমি ছিলাম আয়েশা (রাঃ) এর বান্ধবী। আমি আরও কিছু মহিলাকে সাথে নিয়ে তাকে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জন্য প্রস্তুত করে দিয়েছি ও তাঁর ঘরে প্রবেশ করিয়ে দিয়েছি। আসমা বলেন: আল্লাহর শপথ, আমরা তাঁর ঘরে মেহমানদারি হিসেবে এক পেয়ালা দুধ ছাড়া আর কিছু পাইনি: তিনি সে পেয়ালা থেকে কিছুটা পান করলেন, এরপর আয়েশাকে দিলেন। অল্পবয়সী মেয়েটি লজ্জাবোধ করল। তখন আমরা বললাম: আল্লাহর রাসূলের হাত ফিরিয়ে দিও না; গ্রহণ কর। তখন সে ইতস্তত করে হাতে নিল এবং সেটা থেকে পান করল। অতঃপর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন: তোমার বান্ধবীদেরকে দাও। আমরা বললাম: আমাদের চাহিদা নেই। তিনি বললেন: তোমরা ক্ষুধা ও মিথ্যা দুটোকে একত্র করও না। (আলবানী ‘আদাবুয যিফাফ’ গ্রন্থে (১৯) হাদিসটিকে ‘হাসান’ বলেছেন)।
– স্ত্রীর মাথায় হাত রেখে তার জন্য দোয়া করা:
সুনানে আবু দাউদ গ্রন্থে (২১৬০) আমর বিন শুয়াইব থেকে তিনি তাঁর পিতা থেকে তিনি তাঁর দাদা থেকে তিনি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে বর্ণনা করেন যে, তিনি বলেন: “তোমাদের কেউ যখন কোন নারীকে বিয়ে করে তখন সে যেন স্ত্রীর মাথার অগ্রভাগ ধরে বলে: আল্লাহুম্মা ইন্নি আসআলুকা খাইরাহা, খাইরা মা জাবালতাহা আলাইহি। ওয়া আউযু বিকা মিন শার্রিহা, ওয়া শার্রি মা জাবালতাহা আলাইহি (অর্থ- হে আল্লাহ! আমি তাঁর কল্যাণটুকু এবং যে কল্যাণের ওপর তাকে সৃষ্টি করেছেন, অভ্যস্ত করেছেন সেটা প্রার্থনা করি। আর তার অনিষ্ট থেকে ও যে অনিষ্টের ওপর তাকে সৃষ্টি করেছেন, অভ্যস্ত করেছেন তা থেকে আশ্রয় চাই)। (আলবানী হাদিসটিকে ‘হাসান’ বলেছেন)।
– কোন কোন সলফে সালেহীন স্বামী-স্ত্রী একত্রে দুই রাকাত নামায আদায় করাকে মুস্তাহাব গণ্য করেছেন:
ইবনে আবি শাইবা (১৭১৫৬) শাকীক থেকে বর্ণনা করেন তিনি বলেন: আব্দুল্লাহ বিন মাসউদের (রাঃ) কাছে এক লোক এসে বলল, আমি এক যুবতী মেয়েকে বিয়ে করেছি। আমি আশংকা করছি- সে আমাকে অপছন্দ করবে। বর্ণনাকারী বলেন, আব্দুল্লাহ বললেন: মিল-মহব্বত আল্লাহর পক্ষ থেকে আসে। দূরত্ব ও ঘৃণা শয়তানের পক্ষ থেকে আসে। আল্লাহ যা হালাল করেছেন শয়তান সেটাকে তোমাদের কাছে অপছন্দনীয় করে তুলতে চায়। যখন সে তোমার কাছে আসবে তখন তাকে তোমার পিছনে দুই রাকাত নামায পড়ার নির্দেশ দিবে।” (আলবানী ‘আদাবুয যিফাফ’ গ্রন্থে (২৪) হাদিসটিকে সহিহ বলেছেন)।
– স্বামী যখন স্ত্রী সহবাস করতে চাইবে তখন বলবে: ‘বিসমিল্লাহ। আল্লাহুম্মা জান্নিবনাস শায়তান ওয়া জান্নিবিস শায়তানা মা রাযাকতানা’। যেহেতু সহিহ বুখারীতে (৩২৭১) ইবনে আব্বাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত হয়েছে যে, তিনি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে বর্ণনা করেন তিনি বলেন: “যখন তোমাদের কেউ স্ত্রী সহবাস করতে চায় তখন যদি বলে, “বিসমিল্লাহ্। আল্লাহুম্মা জান্নিবনাশ শায়তান ও জান্নিবিশ শায়তানা মা রাযাকতানা”(অর্থ- আল্লাহর নামে শুরু করছি। হে আল্লাহ, আমাদেরকে শয়তান হতে বাঁচান এবং আমাদেরকে যদি কোন সন্তান দেন তাকেও শয়তান হতে বাঁচান) এরপর যদি তাদের কোন সন্তান হয় তাহলে শয়তান সে সন্তানের কোন ক্ষতি করতে পারবে না।”
সর্বশেষ উপদেশ হচ্ছে সদভাবে সংসার করা। স্ত্রীর ব্যাপারে আল্লাহকে ভয় করা, তথা স্ত্রীর প্রতি সদয়, প্রীতিপূর্ণ ও উত্তম ব্যবহার করা এবং স্ত্রীও স্বামীর ব্যাপারে আল্লাহকে ভয় করা তথা শ্রদ্ধা, ভালবাসা ও আনুগত্যের মধ্যে থাকা।
আল্লাহ তাআলা বলেন: “আর তোমরা তাদের সাথে সৎভাবে জীবন যাপন করবে। তোমরা যদি তাদেরকে অপছন্দ কর তবে এমন হতে পারে যে, আল্লাহ্ যাতে প্রভূত কল্যাণ রেখেছেন তোমরা তাকেই অপছন্দ করছ।” (সূরা নিসা, আয়াত- ১৯)।
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন: “যে নারী পাঁচ ওয়াক্ত নামায পড়ে, রমযান মাসে রোযা রাখে, নিজের যৌনাঙ্গ হেফাযতে রাখে, স্বামীর আনুগত্য করে; তাকে বলা হবে: তুমি জান্নাতের যে দরজা ইচ্ছা হয় সে দরজা দিয়ে জান্নাতে প্রবেশ কর।” (আলবানী ‘তাখরিজুল মিশকাত’ গ্রন্থে (৩২৫৪) হাদিসটিকে সহিহ বলেছেন)।
উম্মাহ২৪ডটকম: এমএ