Home ইসলাম প্রাণের ইজতেমা প্রেমের তাবলীগ

প্রাণের ইজতেমা প্রেমের তাবলীগ

ছবি- উম্মাহ।

।। মাওলানা আশরাফ আলী নিজামপুরী ।।

ভারতীয় উপমহাদেশে ইসলামের আনুষ্ঠানিক বিজয়ের আগেই এখানে খ্যাতনামা বহু ধর্মপ্রচারকের আগমন ঘটে। হিজরি প্রথম শতকের মাঝামাঝি সময় থেকেই এ দেশে ইসলাম প্রচারের কার্যক্রম শুরু হয়।

বিভিন্ন স্থানে মসজিদ, খানকাহ ও মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করে এ অঞ্চলে ধর্মপ্রচারক, আউলিয়া-দরবেশ ও আলেমরা ইসলামের সত্য ও সুন্দরের বাণী প্রচার করতে থাকেন।

ভারতবর্ষে ইসলাম প্রচার করে যারা ইতিহাসে কিংবদন্তি হয়ে আছেন তাদের অন্যতম হলেন-লাহোরের দাতা গঞ্জবখ্শ, পাঞ্জাবের সাইয়্যিদ জালালুদ্দীন সুরখেপাশ বুখারি, রাজস্থানের শাইখ হামিদুদ্দীন নাশুরী, মুলতানের শাইখ বাহাউদ্দীন যাকারিয়া, পশ্চিম পাঞ্জাবের শাইখ ফরিদুদ্দীন গঞ্জশকর, দিল্লির হজরত নিযামুদ্দীন আউলিয়া, আজমিরের খাজা মুঈনুদ্দীন চিশতি, পানিপথের বু’আলী শাহ কলন্দর, গুজরাটের শাইখ আবদুল ওহাব শাজলি, কাশ্মীরের সাইয়্যিদ আলী হামদানী, বিহারের শাইখ শরফুদ্দীন ইয়াহইয়া মুনিরী, চট্টগ্রামের শাহ আমানত, সোনারগাঁয়ের শাইখ শরফুদ্দীন আবু তাওয়ামা, বগুড়ার সাইয়্যিদ মাহমুদ মাহী সরওয়ার, রংপুরের মাওলানা কারামত আলী জৌনপুরী প্রমুখ।

এসব ওলি ও দরবেশদের অব্যাহত দাওয়াতি তৎপরতার ফলে ইসলামের সাম্য, সম্প্রীতি, ভ্রাতৃত্ব ও উদারতার বাণী বর্ণপ্রথা ও সামাজিক বৈষম্যের শিকার হিন্দু সম্প্রদায়ের মাঝে ব্যাপক সাড়া জাগায়।

ফলে দলে দলে নির্যাতিত হিন্দুরা ইসলাম গ্রহণ করেন। তবে কালক্রমে মুসলিম সমাজে বিভিন্ন কুসংস্কার ও হিন্দু সংস্কৃতির অনুপ্রবেশের কারণে হিন্দু-মুসলিমের পার্থক্য কঠিন হয়ে পড়ে। বিশেষ করে ভারতের নিজামুদ্দিনে মুসলিম জনগণ হিন্দুদের মতো পুজো অর্চনাও শুরু করে।

এ রকম এক পরিস্থিতিতে মাওলানা ইলয়াস (রহ.) উম্মতের সংশোধনের উদ্দেশে দাওয়াত ও তাবলিগের কার্যক্রম শুরু করেন। তার চোখে মুখে ছিল মানবতার মুক্তির অন্বেষা। তার বুকে ছিল হেদায়েতের প্রত্যাশা। তার হৃদয় টইটম্বুর ছিল উম্মতের প্রেম ও ভালোবাসা।

সেই দরদমাখা ভালোবাসা দিয়ে তিনি নতুন করে আওয়াজ তুললেন-‘মেরে ভাইয়ো, আজিযো, দোস্ত বুযুর্গ’। যে কোনো কাজে ভালোবাসাই মূল; আন্তরিকতা, ইখলাস ও নিষ্ঠাই সফলতার চালিকাশক্তি। মাওলানা ইলয়াস (রহ.)-এর ভেতর তা কতটুকু ছিল তা আজ বিশ্বজুড়ে বিস্তৃত দাওয়াতের কাজের দিকে তাকালেই অনুধাবন করা যায়।

কত রাত যে তার নির্ঘুম কেটেছিল এ দাওয়াতের কাজের জন্য! মাওলানার ইন্তেকালের পর তার খুব কাছের এক বন্ধু তার স্ত্রীর কাছে মাওলানার জীবনের বিশেষ কোনো ঘটনা জানতে চাইলে অন্দরমহল থেকে বলে পাঠানো হয় বিয়ের পর যখন আমি স্বামীর ঘরে এলাম তখন দেখতে পেলাম, রাতে তিনি খুব কম সময় ঘুমাতেন।

রাতের বেশিরভাগ সময় জায়নামাজে কাটাতেন, কান্নাকাটি করতেন এবং বিছানায় শুয়েও অস্থিরভাবে কেবল এপাশওপাশ করতেন। একদিন আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘কী ব্যাপার! রাতে আপনার ঘুম হয় না কেন?’ তিনি আমার দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন, ‘কী বলব! আমার কষ্টের কথা বললে এখন তো আমি একা জেগে থাকি; তখন দুজনকেই জেগে থাকতে হবে। আমার মতো অস্থিরতায় তোমারও নিশি পার করতে হবে।’

মাওলানা ইলয়াস তার এ মেহনতকে কখনো ‘তাবলিগ জামাত’ বলে নামকরণ করেননি। মূলত তিনি এর জন্য কোনো নাম দেওয়ার প্রয়োজনই অনুভব করেননি কখনো। নিতান্ত নিঃস্বার্থ একটি দল নিজের খেয়ে, নিজের সময় ব্যয় করে দ্বীনের কাজ করবে, মানুষকে ধর্মের পথে আহ্বান করবে এমনই ছিল তার কর্মসূচি এবং চিন্তাধারা। সে লক্ষ্যেই তিনি সময়ের বড় বড় আলেমদের মাঝে ছড়িয়ে দিয়েছিলেন এ দাওয়াতি কাজের প্রয়োজনীয়তা।

বড় বড় আলেমদের মধ্যে অনেকেরই এ কাজে প্রথমে দ্বিধা ও সংশয় ছিল। পরে যাচাই-বাছাই করার পর তারা তা গ্রহণ করলেন। এমনকি স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশগ্রহণ করলেন। মাওলানা ইলয়াস (রহ.) প্রথমে এ ব্যাপারে দারুল উলুম দেওবন্দ ও মাজাহেরুল উলুম সাহারানপুরের মুরুব্বিদের অকুণ্ঠ সমর্থন আদায় করেন।

এরই ধারাবাহিকতায় মাওলানা আশরাফ আলী থানবী (রহ.), আল্লামা সাইয়্যিদ হুসাইন আহমদ মাদানী (রহ.), মাওলানা মাহমূদুল হাসান গাঙ্গোহী (রহ.), মাওলানা মনযূর নু’মানী (রহ.), আল্লামা সাইয়্যিদ আবুল হাসান আলী নদভী (রহ.)সহ প্রমুখ আলেমদের অংশগ্রহণ এ কাজকে আরও বেগবান করে তোলে। ফলে দাওয়াতের কাজ শুধু ভারতীয় উপমহাদেশেই সীমাবদ্ধ থাকেনি; ছড়িয়ে পড়ে সারা বিশ্বে। ‘তাবলিগ জামাত’ নামে খ্যাতি লাভ করে পৃথিবীতে।

‘তাবলিগ জামাত’ আজ বিশ্বব্যাপী আলোচিত একটি নাম। দ্বীনহারা মানুষকে দ্বীনের পথে ফিরিয়ে আনার মহৎ উদ্দেশ্য নিয়ে ১৯২৬ সালে উত্তর ভারতে মেওয়াত অঞ্চল থেকে যাত্রা শুরু করে তাবলিগ জামাত। প্রথমদিকে ভারতের অখ্যাত মেওয়াত পল্লিতে তাবলিগ জামাতের কাজ শুরু হলেও বাইরের দুনিয়া তখনো জানত না আসলে কী বিপ্লব ঘটে যাচ্ছে মেওয়াতে।

গ্রামটি ছিল অবহেলিত, কুসংস্কারে ভরপুর, শিরকের আড্ডাখানা। তাবলিগ জামাতের কার্যক্রমের ফলে মেওয়াতের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর জীবনে আসে ব্যাপক পরিবর্তন। দ্বীন ও ইমানের ছায়ায় তারা হয়ে ওঠে একেকজন আলোকিত মানুষ।

১৯৪৬ খ্রিষ্টাব্দে প্রথম ভারতের বাইরে তাবলিগের কাজ শুরু হয়। ভারত বিভক্তির পর ১৯৪৮ খ্রিষ্টাব্দে মাওলানা মুহাম্মদ ইউসুফ (রহ.) বাংলাদেশে তাবলিগি সফরে আসেন। সে সময় ঢাকার কাকরাইল মসজিদে এসেছিলেন তিনি। এর আগে তাবলিগের কাজ প্রাথমিক পর্যায়ে শুরু হলেও হযরতজি মাওলানা মুহাম্মদ ইউসুফ (রহ.)-এর আগমনের মাধ্যমেই কাকরাইল মসজিদকেন্দ্রিক আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশে তাবলিগ জামাতের কার্যক্রম শুরু হয়।

১৯৫০ খ্রিষ্টাব্দে মাওলানা আবদুল আজিয (রহ.) এবং অন্যান্য মুরব্বিরা কাকরাইল মসজিদকে বাংলাদেশের মারকাজ বা সদর দপ্তর হিসাবে নির্ধারণ করেন। তখন থেকে ‘কাকরাইল মসজিদ’ পরিণত হয় বাংলাদেশে তাবলিগ আন্দোলনের কেন্দ্রবিন্দুতে। এরপর থেকেই কাকরাইল মসজিদে আগমন ঘটতে থাকে ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের। বাংলাদেশ ও বিশ্বের বিভিন্ন স্থান থেকে ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের আগমনে ধন্য হয় কাকরাইল মসজিদ।

স্থান সংকুলান না হওয়ার কারণে ১৯৫২ খ্রিষ্টাব্দে শুরু হয় মসজিদ সম্প্রসারণের কাজ। ক্রমান্বয়ে সম্প্রসারণ কাজ চলতে থাকে। আগের মূল মসজিদটি এখন আর নেই। নতুন কাঠামোতে গড়ে তোলা হয়েছে এখনকার কাকরাইল মসজিদ। এখন কয়েক হাজার মুসল্লি নামাজ আদায় করতে পারেন একসঙ্গে। কাকরাইল মসজিদের আদিনাম ছিল ‘মালওয়ালী মসজিদ’।

আরও পড়তে পারেন-

বাংলাদেশে তাবলিগ জামাতের আজীবন আমির ছিলেন হজরত মাওলানা আবদুল আযীয (রহ.)। ১৯৪৪ খ্রিষ্টাব্দে মাওলানা আবদুল আযীয (রহ.)-এর উদ্যোগে বাংলাদেশে তাবলিগের প্রথম বিশ্ব ইজতেমা অনুষ্ঠিত হয়। প্রথম যুগে ইজতেমা অনুষ্ঠিত হতো কাকরাইল মসজিদে। কয়েক বছর পর ১৯৪৮ খ্রিষ্টাব্দে ইজতেমা অনুষ্ঠিত হয় চট্টগ্রামের হাজি ক্যাম্পে এবং ১৯৫০ খ্রিষ্টাব্দে নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জে। এভাবে বিভিন্ন জায়গায় কয়েক বছর পরপর ইজতেমা অনুষ্ঠিত হতে থাকে।

ক্রমশ ইজতেমায় মুসল্লিদের সংখ্যা বাড়তেই থাকে। মুসল্লিদের সংকুলান না হওয়ায় অবশেষে ১৯৬৭ খ্রিষ্টাব্দে ঢাকা টঙ্গির তুরাগতীরের বালুময় জায়গা ইজতেমার জন্য নির্ধারণ করা হয়। তখন থেকেই ইজতেমায় দেশি-বিদেশি ধর্মপ্রাণ মানুষের উপস্থিতি ব্যাপকভাবে বেড়ে যায় এবং বিশ্ব ইজতেমা প্রকৃত অর্থেই বিশ্ব ইজতেমা এবং দেশের সর্ববৃহৎ ধর্মীয় সমাবেশে পরিণত হয়। ভারতের মুম্বাই ও ভুপালে এবং পাকিস্তানের রায়বেন্ডে ইজতেমা অনুষ্ঠিত হলেও জনসমাগমের দিক থেকে টঙ্গীর বিশ্ব ইজতেমাই বড় এবং বিশ্ব দরবারে বিশ্ব ইজতেমা বলতে বাংলাদেশের টঙ্গীতে অনুষ্ঠিত ইজতেমাকে বোঝায়।

১৯৭২ খ্রিষ্টাব্দে তদানীন্তন সরকার টঙ্গিতে ইজতেমার জন্য জমি বরাদ্দ দেওয়ায় বিশ্ব ইজতেমার পরিধি আরও বড় হয়ে ওঠে। ১৯৯৬ খ্রিষ্টাব্দে তৎকালীন সরকার এ জায়গায় ১৬০ একর জমি স্থায়ীভাবে ইজতেমার জন্য বরাদ্দ দেয় এবং অবকাঠামোগত কিছু উন্নয়ন ঘটায়।

বর্তমান ইজতেমা মাঠের অবকাঠামোগত যথেষ্ঠ পরিমাণ উন্নতি হয়েছে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের প্রায় কয়েক লাখ মুসলমান এ ইজতেমায় যোগ দেন। বহির্বিশ্ব থেকে তাবলিগ জামাতের সদস্যরা দাওয়াতের কাজে যেমন বাংলাদেশে আসেন, তেমনি বাংলাদেশের মুসলমানও বিশ্বের বিভিন্ন দেশ সফর করেন।

সূচনালগ্ন থেকেই বাংলাদেশে এ মেহনতের প্রতি যারা পূর্ণাঙ্গ সমর্থন ও পৃষ্ঠপোষকতা দিয়ে এসেছিলেন তাদের মধ্যে ফখরে বাঙ্গাল মাওলানা তাজুল ইসলাম (রহ.), মাওলানা শামসুল হক ফরিদপুরী (রহ.), মুফতি আযম ফয়যুল্লাহ (রহ.), মাওলানা মুহাম্মাদুল্লাহ হাফেজ্জী হুজুর (রহ.), আল্লামা শাহ আহমদ শফি (রহ.) প্রমুখ অন্যতম।

অবশেষে প্রেক্ষাপটকে সামনে রেখে একটি কথা বলতে হয়, নিঃসন্দেহে আলেমরা নবি-রাসূলদের প্রকৃত ওয়ারিশ। সুতরাং নির্ভরযোগ্য আলেম ওলামাদের থেকে সম্পর্ক বিছিন্ন করে কোনো দ্বীনি কাজ বিশুদ্ধ পদ্ধতিতে চলে না, চলতে পারে না।

লেখক: মুহাদ্দিস, আল-জামিয়াতুল আহলিয়া দারুল উলুম মুঈনুল ইসলাম হাটহাজারী, চট্টগ্রাম, বাংলাদেশ।

উম্মাহ২৪ডটকম: এমএ

উম্মাহ পড়তে ক্লিক করুন-
https://www.ummah24.com

দেশি-বিদেশি খবরসহ ইসলামী ভাবধারার গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে ‘উম্মাহ’র ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।