Home ধর্মতত্ত্ব ও দর্শন মানব জীবনে তাকওয়ার গুরুত্ব ও তাৎপর্য

মানব জীবনে তাকওয়ার গুরুত্ব ও তাৎপর্য

- মাওলানা কবীর আহমদ (দা.বা.)।

।। আল্লামা কবীর আহমদ ।।

জীবনের সবক্ষেত্রে আল্লাহর হুকুম এবং রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের তরীকা মেনে চলা, এটাই হলো পূর্ণাঙ্গ ইবাদত। জীবনের শুরু থেকে নিয়ে শেষ পর্যন্ত ঘরে-বাইরে, দিনে-রাতে, প্রকাশ্যে- অপ্রকাশ্যে সবকিছু আল্লাহর হুকুম এবং রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের তরীকা মোতাবেক করা সম্ভব হবে যদি অন্তরে আল্লাহর ভয় অর্থাৎ তাকওয়া থাকে।

মানুষকে যত বুঝানো হোক, যত শাসন করা হোক, যত শাস্তি দেওয়া হোক বা যত রকম ভয় দেখানো হোক; এগুলো দ্বারা মানুষকে দ্বীনদার বানানো সম্ভব নয়। যদি আল্লাহর ভয় মানুষের ভেতর না আসে। তাকওয়া বা আল্লাহর ভয় ভেতরে না আসলে মানুষ আল্লাহর হুকুম মানার জন্য উদ্বুদ্ধ হয় না।

তাইতো আল্লাহ রাব্বুল আলামীন কুরআনে কারীমে ইরশাদ করেন- يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا اتَّقُوا اللَّهَ حَقَّ تُقَاتِهِ وَلَا تَمُوتُنَّ إِلَّا وَأَنتُم مُّسْلِمُونَ অর্থাৎ- হে মুমিনরা তোমরা যথাযথ ভাবে আল্লাহকে ভয় করো। আর পূর্ণাঙ্গ মুসলমান না হয়ে তোমরা মৃত্যুবরণ করো না। (আলে ইমরান- ১০২)।

এখানে আল্লাহ তাআলা দু’টো কথা বলেছেন, একটা হলো তাকওয়া বা আল্লাহকে ভয় করার কথা আর দ্বিতীয়টা খাঁটি মুসলমান হওয়ার কথা। এর মধ্যে খাঁটি মুসলমান হওয়ার কথা বলার আগে আল্লাহকে যথাযথভাবে ভয় করার কথা বলা হয়েছে।

এর মধ্যে ইঙ্গিত পাওয়া যায় যে, তাকওয়া বা আল্লাহকে ভয় করার বিষয়টা আগে। যার মধ্যে তাকওয়া যথাযথভাবে এসে যায় সে খাটি মুসলমান হয়ে যায়। তাকওয়া মানুষের সব আমলকে দুরস্ত করে দেয়, মানুষকে খাটি মুসলমান বানিয়ে তোলে।

তাকওয়ার তাৎপর্য

তাকওয়া কী জিনিস? আমরা অনেকেই এর সঠিক মর্মার্থ উপলব্ধি করতে পারি না। তাকওয়া শব্দটি আরবি। এর মূল ধাতু ‘ وقاية’ অর্থ বাঁচা, মুক্তি নিষ্কৃতি, সতর্কতা, ভয়-ভীতি ইত্যাদি।

পরিভাষায় তাকওয়া বলা হয়, মনে আল্লাহর ভয় রেখে অথবা সর্বদা তার স্মরণে জাগ্রত রেখে আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্য রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রদর্শিত পথে জীবন পরিচালিত করা। মোটকথা জীবনের কোন ক্ষেত্রে মহান আল্লাহর হুকুম যেন লঙ্ঘিত না হয়। এরকম সতর্কতার সাথে চলার নামই হলো তাকওয়া।

হযরত উমর রাযি. এর ঘটনা

একবার হযরত উমর রাযি. হযরত উবাই ইবনে কাব রাযি. কে তাকওয়ার ব্যাখ্যা দিতে অনুরোধ করলেন। তিনি জবাবে বলেন, আপনি কি কখনও কাঁটা ঘেরা সরু পথ অতিক্রম করেছেন?

উমর (রাযি.) উত্তরে বললেন, হ্যাঁ।

উবাই ইবনে কাব রাযি. তারপর জিজ্ঞাসা করলেন তখন আপনি কীভাবে পথ অতিক্রম করেছিলেন?

উমর রাযি. বললেন, আমি খুব সতর্কতার সাথে সে পথ অতিক্রম করেছিলাম। হযরত উবাই ইবনে কাব রাযি. বললেন, একেই বলা হয় তাকওয়া (ইবনে কাসীর ১/১৬৪, মাআরেফুল কুরআন কান্ধলবী- ১/৩৫)।

সমাজকে অপরাধমুক্ত করতে হলে এবং একটি সুস্থ সমাজব্যবস্থা গড়ে তুলতে হলে, এই তাকওয়ার কোনো বিকল্প নেই। লোক চক্ষুর অন্তরালে পুলিশী প্রহারা যেখানে অনুপস্থিত, রাষ্ট্রীয় গোয়েন্দা বাহিনী যেখানে অপরাগ, স্যাটেলাইটের তীক্ষ্ণ দৃষ্টি যেখানে অসহায়, সেখানে তাকওয়া বা খোদাভীতিই একজন মানুষকে অপরাধ থেকে বিরত রাখতে পারে।

আরেকটি ঘটনা: হযরত উমর রাযি. তাঁর খিলাফত আমলে প্রজা সাধারণের অবস্থা সরেজমিনে দেখার উদ্দেশ্যে রাতে বিভিন্ন সময় ছদ্মবেশে ঘুরে বেড়াতেন। একবার তিনি ঘুরতে ঘুরতে এক রাখালের কাছে গেলেন, সে বকরি চড়াচ্ছিল তাকে গিয়ে বলল; আমি একজন পথিক আমার খুব ক্ষুধা ও তৃষ্ণা লেগেছে তুমি আমাকে বকরি থেকে একটু দুধ দুইয়ে দাও। আমি তা পান করব।

রাখাল বলল, আমিতো রাখালী করছি আমার দায়িত্ব বকরি চরানো, দুধ দেওয়ার কোনো অধিকার আমার নাই। এবার তিনি বললেন দেখ এক কাজ করো। তুমি একটা বকরি আমার নিকট বিক্রি করে দাও, তুমিও কিছু পয়সা পেলে, আমারও প্রয়োজন সারলো। মালিকও দেখলো না, তখন রাখাল জবাব দিল ওহে আল্লাহর বান্দা! তাহলে আল্লাহ কোথায়।

একেই বলা হয় তাকওয়া বা খোদাভীতি। অর্থাৎ, ঘরে-বাইরে মাঠে-ময়দানে, বনে-জঙ্গলে সকল স্থানে সর্বাবস্থায় একজন মানুষের অন্তরে এই অবস্থা জাগ্রত থাকা যে, আমি যা করছি আল্লাহ তা দেখছেন। (কিতাবুয যুহদ ইমাম আবু দাউদ- ২৬২ হাদীস নং২৯৩)।

তাকওয়া অর্জনের উপায়

এক. আল্লাহ পাক আমার সবকিছু দেখেন এই চিন্তা রেখে আল্লাহর দৃষ্টিকে ফাঁকি দেওয়া যাবে না। আল্লাহর জানার বাইরে কোনো কিছু করা যাবে না। কোনো কিছু আল্লাহর কাছে গোপন নয়- এই বিশ^াস যদি থাকে তাহলে প্রকাশ্যে হোক বা গোপনে কোনভাবে মানুষ অন্যায় করতে পারবে না। গোপনেও কোন পাপ করতে গেলে মনে হবে দুনিয়ার কোন চোখ না দেখলেও আল্লাহর চোখ দেখছে, দুনিয়ার কেউ না জানলেও আল্লাহ জানেন, তিনিতো সব কিছুর খবর রাখেন। এরূপ চিন্তা করলে ভেতরে তাকওয়া আসতে থাকবে এবং সে অপরাধ থেকে বিরত হতে পারবে। এই জন্য আল্লাহ বলেন- وَاتَّقُوا اللَّهَ إِنَّ اللَّهَ خَبِيرٌ بِمَا تَعْمَلُونَ তোমরা আল্লাকে ভয় করো নিশ্চয় তিনি তোমাদের কৃতকর্ম সম্পর্কে সম্যক অবগত ( সূরা হাশর- ১৮)।

দুই. প্রত্যেকটা কাজের সময় এই চিন্তা করা যে, আমার কিন্তু এটার পুঙ্খানুপুঙ্খ হিসাব দিতে হবে। হিসাবে আটকে গেলে শাস্তি পেতে হবে। এভাবে প্রত্যকটা পদে পদে পরকালের চিন্তা করতে থাকলে তাকওয়া হাসিল হতে থাকবে।

আরও পড়তে পারেন-

যেমনটা আল্লাহ পাক ইরশাদ করেন- يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا اتَّقُوا اللَّهَ وَلْتَنظُرْ نَفْسٌ مَّا قَدَّمَتْ لِغَدٍ হে মুমিনরা তোমরা তাকওয়া অর্জন করো। আর প্রত্যেকেই যেন চিন্তা করে দেখে সে পরকালের জন্য কী করেছে। (প্রাগুক্ত)।

তিন. তাকওয়া অর্জনের আরেকটা পদ্ধতি হলো, নেককার লোকদের সাথে অর্থাৎ মুত্তাকীদের সাথে উঠা-বসা করা, তাদের সোহবতে থাকা। কুরআনে কারীমে আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন, يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا اتَّقُوا اللَّهَ وَكُونُوا مَعَ الصَّادِقِينَ হে মুমিনরা তোমরা তাকওয়া হাসিল করো এবং সৎ লোকদের সাথে থাকো। (সূরা তাওবা- ১১৯)। জনৈক কবি বলেন-

صحبت صالح ترا صالح کند

صحت طالع ترا طالع کند

সৎ সঙ্গে সর্গবাস, অসৎ সঙ্গে সর্বনাশ।

মুত্তাকীর পরিচয়

পবিত্র কুরআনে কারীমে আল্লাহ তাআলা বলেন, পুণ্য তো কেবল এটা নয় যে, তোমরা পূর্ব পশ্চিম দিকে চেহারাকে ফিরাবে; বরং পুণ্য হলো (সেই ব্যক্তির কার্যাবলী) যে ঈমান রাখে আল্লাহর উপর, শেষ দিনের ও ফিরিশতাদের প্রতি এবং কিতাব ও নবীগণের প্রতি, আর আল্লাহর ভালোবাসায় নিজ সম্পদ দান করে আত্মীয়-স্বজন, ইয়াতীম, মিসকীন, মুসাফির ও সওয়ালকারীদেরকে এবং দাস মুক্তিতে এবং সালাত কায়েম করে ও যাকাত আদায় করে এবং প্রতিশ্রুতি দিলে তা পূরণ করে এবং সংকটে, কষ্টে ও যুদ্ধকালে ধৈর্য ধারণ করে। এরাই সত্যবাদি এবং এরাই মুত্তাকী (সূরা বাকারা- ১৭৭)।

তাকওয়ার ফযীলত

আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন- ان اکرمکم عند الله اتقاکم নিশ্চয় আল্লাহর নিকট তোমাদের মধ্যে সব চেয়ে উত্তম ঐ ব্যক্তি যার তাকওয়া সবার চাইতে বেশি। (সূরা হুযরাত- ১৩)।

অন্য আয়াতে ইরাশাদ করেন- وَمَنْ يَتَّقِ اللَّهَ يُكَفِّرْ عَنْهُ سَيِّئَاتِهِ وَيُعْظِمْ لَهُ أَجْرًا যে আল্লাহকে ভয় করে, আল্লাহ তার পাপ মোচন করেন এবং তাকে মহা পুরস্কার দেন। (সূরা তালাক- ৫)।

আরো ইরশাদ করেন- ‏‏وَمَن يَتَّقِ اللَّهَ يَجْعَل لَّهُ مَخْرَجًا وَيَرْزُقْهُ مِنْ حَيْثُ لَا يَحْتَسِبُ আর যে আল্লাহকে ভয় করে, আল্লাহ তার জন্য নিষ্কৃতির পথ বের করে দেবেন এবং তাকে কল্পনাতীত জায়গা থেকে রিযিক দান করবেন। (সূরা তালাক- ২-৩)।

আরেক জায়গায় বলেন- مثل الجنة التي وعد المتقون فيها أنهار

ঐ জান্নাতের দৃষ্টান্ত যার প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছে মুত্তাকীদেরকে, যার মধ্যে রয়েছে এমন পানির নহর যা কখনও নষ্ট হওয়ার নয় এবং অপরিবর্তিত দুধের নহর ও এমন শরাবের নহর যা পানকারীদের জন্য সুপেয় ও স্বচ্ছ মধুর নহর। তাতে তাদের জন্য রয়েছে সব রকমের ফলমূল এবং প্রতিপালকের পক্ষ থেকে ক্ষমা (সূরা মুহাম্মদ- ১৫)।

উক্ত আয়াতগুলোতে তাকওয়া অবলম্বনকারীদের পাঁচটি জিনিসের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে।

১। গুনাহ মোচন।
২। নেক আমলের প্রতিদান বৃদ্ধি করন।
৩। দুনিয়ার যাবতীয় সংকট বিপদাপদ থেকে নিষ্কৃতি প্রদান।
৪। এমন জায়গা থেকে রিযিক প্রদান করা হবে, যা কল্পনাও করা যায় না।
৫। অফুরন্ত নেয়ামত সমৃদ্ধ জান্নাত।

আর এই পাঁচ জিনিস যদি হাসিল হয়ে যায়, তাহলে ইহকাল ও পরকালে সেই প্রকৃত সুখী মানুষ। শান্তি ও স্বস্তি তার জন্যই। সুতরাং এতেই প্রতিয়মান হয় যে তাকওয়ার গুরুত্ব অপরিহার্য।

লেখক: মুহাদ্দিস ও শিক্ষা পরিচালক- জামিয়া আহলিয়া দারুল উলূম মুঈনুল ইসলাম হাটহাজারী, চট্টগ্রাম।

উম্মাহ২৪ডটকম: এমএ

উম্মাহ পড়তে ক্লিক করুন-
https://www.ummah24.com

দেশি-বিদেশি খবরসহ ইসলামী ভাবধারার গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে ‘উম্মাহ’র ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।