Home প্রবন্ধ-নিবন্ধ বৃদ্ধাশ্রম বনাম নৈতিক দায়বোধ

বৃদ্ধাশ্রম বনাম নৈতিক দায়বোধ

।। অধ্যাপক ডা: শাহ মো: বুলবুল ইসলাম ।।

ক’দিন আগে মাননীয় তথ্যমন্ত্রী বৃদ্ধাশ্রম পরিদর্শনে গিয়েছিলেন। সেখানে তিনি এর বাসিন্দাদের সাথে কথা বলেছেন, সহানুভূতি প্রকাশ করেছেন। একই সাথে দুঃখ প্রকাশ করেছেন এই বলে যে, ছেলে-মেয়েরা বৃদ্ধ বাবা মায়ের প্রতি তাদের দায়িত্ব যথাযথ পালন করছে না। এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় আইন প্রণয়নের কথাও তিনি বলেছেন। সরকারের একজন দায়িত্বশীল ব্যক্তির এ ধরনের মনোভাব আশা সঞ্চারী অবশ্যই। কিন্তু সাথে সাথে এ কথাও মনে হয়, আইন পাস করলেই কি সমস্যার সমাধান হয়ে যায়? আমাদের দেশে বহু কল্যাণমুখী আইন তৈরি হয়েছে জনগণের স্বস্তির জন্য। জনগণ স্বস্তি পেয়েছে কি? এক দিকে যেমন আইনের প্রায়োগিক বাধা তৈরি হয়েছে; অপর দিকে ফাঁকফোকর গলে বেরিয়ে যাওয়ার অজস্র কৌশলও বের করা হয়েছে। আইনের সুফল জনগণের কাছে সোনার হরিণ হয়েই রয়ে গেছে।

বৃদ্ধাশ্রম আমাদের জীবনাচারে, আমাদের সামাজিক সাংস্কৃতিক জীবনে এক নবতর সংযোজন। আজ থেকে ২০-২৫ বছর আগে এই ব্যবস্থার কথা খুব একটা শোনা যায়নি। আমাদের পারিবারিক এবং সামাজিক জীবনাচারে নৈতিকতা এবং দায়বদ্ধতার কারণে বয়স্কদের সম্মান করা হতো; তাদেরকে পরিবারের আবশ্যকীয় অংশ মনে করা হতো। তারা ছিলেন নতুন এবং পুরনো প্রজন্মের সংযোগ।

সামাজিক সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য, গৌরবের ধারাবাহিকতা পরবর্তী প্রজন্মে সঞ্চালিত করার একমাত্র মাধ্যম। আর এ ক্ষেত্রে উৎস হিসেবে কাজ করেছে নীতিনৈতিকতা সম্পন্ন শিক্ষা; যা উৎসারিত হয়েছে ধর্মীয় মূল্যবোধ ও চেতনা থেকে।

পিতা-মাতার প্রতি সদাচরণ, তাদের প্রতি শ্রদ্ধা ও বিনয়ী আচরণ সব ধর্মেরই একটি শিক্ষা। সনাতন ধর্মে বলা হয়েছে ‘পিতা-মাতার সেবাই ধর্ম, এটা নিছক দায়িত্ব নয়।’ হিন্দু ধর্মে বলা হয়েছে ‘পিতা স্বর্গ, পিতা ধর্ম, পিতাহি পরমনতপ:। পিতরী প্রতিমাপুণ্যে স্বর্গদেবতা’। আরো উল্লেখ করা হয়েছে ‘জননী জন্মভূমিশ্চ স্বর্গাদপি গরিয়সি।’ মহাভারতের শান্তি পর্বে বলা হয়েছে ‘পিতা-মাতা অসন্তুষ্ট হলে জীবন সুখের হয় না, পিতা-মাতার সেবাই ধর্ম।’

ত্রিপিটকে বলা হয়েছে, ‘পিতা-মাতার সেবাই উত্তম সেবা’। বাইবেলের ইফিসিয়েন্স পর্বে (৬:১-৩) বলা হয়েছে ‘তোমার পিতা-মাতাকে শ্রদ্ধা করো, সেবা করো। এতে তোমার জীবন শান্তিতে ভরে উঠবে।’ এ ছাড়াও এক্সোডাস ১০:১১ অধ্যায়ে বলা হয়েছে ‘পিতা-মাতাকে শ্রদ্ধা করো, সম্মান করো, তোমার আয়ুষ্কাল বৃদ্ধি পাবে’।

ইসলামে পিতা-মাতার প্রতি সন্তানের দায়িত্ব ও কর্তব্য সম্পর্কে রয়েছে বিস্তারিত নির্দেশনা। বস্তুত বাস্তব অবকাঠামোয় ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক, রাষ্ট্রীয় এবং আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলের জন্য ইসলাম এক পরিপূর্ণ দিকনির্দেশনা। যে নির্দেশনায় গড়ে ওঠে দায়িত্বশীল ও ন্যায়নিষ্ঠ মানুষ। গড়ে ওঠে সুবিচার ও ন্যায়ের আলোয় উদ্ভাসিত পারিবারিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনা; যেখানে শিশু থেকে শুরু করে বয়স্ক ব্যক্তিসহ সমাজের সর্বস্তরের জনগণের নিরাপত্তা, অধিকার ও সম্মানবোধের নিশ্চয়তা নিশ্চিত করা হয়েছে। এ ক্ষেত্রে কোথাও পরিবার, কোথাও সমাজ, কোথাও বা রাষ্ট্রকে সম্পৃক্ত করা হয়েছে। বয়স্কদের জন্য রয়েছে সম্মানজনক জীবনের নিশ্চয়তা। এটা দায়িত্ববোধ থেকে উৎসারিত। এখানে করুণার কোনো স্থান নেই, স্থান নেই বৃদ্ধাশ্রমের। আল্লাহ পাকের নির্দেশনা ‘তোমরা একমাত্র আল্লাহর ইবাদত করবে তার সঙ্গে কাউকে অংশীদার বানাবে না। পিতা-মাতার সাথে সবিনয় আচরণ করবে। তাদের একজন বা উভয়কেই তোমাদের জীবদ্দশায় যদি পাও তাদের সাথে ব্যবহারে ‘উফ’ শব্দটিও করবে না। তাদের সাথে অত্যন্ত বিনয়ীভাবে নিচুস্বরে কথা বলবে।’ (১৭:২৫)

বার্ধক্যজনিত কারণে যদি কখনো তারা অসহিষ্ণু আচরণ করেন তবুও তাদের সাথে রূঢ় ব্যবহার করা যাবে না। সবসময় সর্বাবস্থায় তাদেরকে প্রগাঢ় শ্রদ্ধায় বিনীত আচরণের নির্দেশ রয়েছে ইসলামে। আল্লাহ আরো বলেছেন, ‘আমি পিতা-মাতার প্রতি সদাচরণের নির্দেশ দিয়েছি। তোমরা আমার প্রতি ও পিতা-মাতার প্রতি কৃতজ্ঞ হও।’ (৩১:১৪)।

আরও পড়তে পারেন-

অর্থাৎ আল্লাহর সন্তষ্টির পূর্বশর্তই হচ্ছে পিতা-মাতার সন্তুষ্টি। রাসূল সা: বলেছেন, সন্তানের জন্য পিতা-মাতা বেহেশত বা দোজখের সিঁড়ি। তিনি অভিসম্পাত করেছেন ওই সব ব্যক্তির প্রতি যারা পিতা-মাতাকে জীবিত পেয়েও বেহেশত থেকে বঞ্চিত। তিনি বলেছেন ‘মায়ের পায়ের নিচে সন্তানের বেহেশত’। হজরত আবু বকর (রা:) বলেছেন তিনি রাসূল সা: কে বলতে শুনেছেন ‘তিনটি কাজ মানুষের সব ভালো আমলকে ধ্বংস করে দেয়। প্রথমত, আল্লাহর সাথে কাউকে শরিক করা, দ্বিতীয়ত, পিতা-মাতার অবাধ্য হওয়া, তৃতীয়ত, জিহাদের ময়দান থেকে পালিয়ে যাওয়া।’ (বুখারি : ৬২৫)।

পিতা-মাতার মৃত্যুর পর তাদের মাগফিরাতের জন্য দোয়া করা, তাদের ভালো কাজগুলোকে সচল রাখা, তাদের বন্ধু-বান্ধবদের খোঁজখবর নেয়ারও তাগিদ দেয়া হয়েছে ইসলামে।

পৃথিবীর প্রতিটি ধর্মাচরণে পিতা-মাতার প্রতি দায়িত্ববোধের কঠোর নির্দেশ দেয়া হয়েছে। এসবের আলোকে নৈতিক শিক্ষার বলয়ে প্রজন্মকে গড়ে তুলতে পারলে বৃদ্ধাশ্রম শব্দটি ভেসে যেতে বাধ্য নৈতিকতা ও দায়িত্ববোধের সুচারু ব্যবস্থাপনায়। নীতিনৈতিকতা বর্জিত শিক্ষায় গড়ে ওঠা প্রজন্ম এসব দায়বোধ ও কর্তব্যের প্রয়োজনীয়তাকে বুঝে উঠতে পারে না। তাদের কাছে বৃদ্ধ পিতা-মাতা উপরি বোঝা। তাদের চিন্তায় পিতা-মাতার উপযুক্ত স্থান বৃদ্ধাশ্রম। তারা এ সত্যকেও বুঝতে অক্ষম যে তারাও একদিন এভাবেই তাদের সন্তান-সন্ততির দ্বারা বৃদ্ধাশ্রমে নিক্ষিপ্ত হবে।

বস্তুত বৃদ্ধাশ্রম ভোগবাদী সমাজের সন্তানদের দায় এড়ানোর একটা বিধিবদ্ধ ব্যবস্থা যা পশ্চিমা দুনিয়ার পরিবারকে, পারিবারিক ঐতিহ্যকে ভেঙে খানখান করে দিয়েছে। মুসলিম-অমুসলিম নির্বিশেষে বৃদ্ধাশ্রম মানব সভ্যতার একটি কলঙ্ক। কিছু অত্যুৎসাহী প্রভাবশালী ক্ষমতাশ্রয়ী তথাকথিত প্রগতিবাদীদের কল্যাণে আমরা ধীরে ধীরে এগিয়ে যাচ্ছি এই কলঙ্ক তিলকের দিকে। নৈতিকতাবোধ সম্পন্ন শিক্ষাকে পাশ কাটিয়ে বস্তুবাদী শিক্ষার পরিণতি এটাই। পরিবার ও সমাজকে ভাঙনের হাত থেকে বাঁচাতে হলে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ের পাঠক্রমে নৈতিকতা ও নীতিবোধের অন্তর্ভুক্তি ছাড়া গত্যন্তর নেই।

লেখক : চক্ষুরোগ বিশেষজ্ঞ। Email- shah.b.islam@gmail.com

উম্মাহ২৪ডটকম: এমএ

উম্মাহ পড়তে ক্লিক করুন-
https://www.ummah24.com

দেশি-বিদেশি খবরসহ ইসলামী ভাবধারার গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে ‘উম্মাহ’র ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।