Home ওপিনিয়ন কিভাবে আপনি আপনার অপ্রয়োজনীয় খরচ কমাবেন?

কিভাবে আপনি আপনার অপ্রয়োজনীয় খরচ কমাবেন?

।। সাইফুল হোসেন ।।

খরচ করতে প্রচণ্ড ভালো লাগে। কাউকে টাকা নিয়ে বাজারে পাঠান, দেখবেন, নিমেষেই খরচ করে ফেলেছে। তবে একটা বিষয় আমাদের সবার মনে রাখা দরকার যে আমরা কিভাবে অপ্রয়োজনীয় খরচ থেকে বের হয়ে আসতে পারি। প্রথম কথা হচ্ছে, আমাদের মাইন্ড-সেটকে এমনভাবে ঠিক করে নিতে হবে যে আমরা অপ্রয়োজনীয় খরচ করবো না। সত্যি কথা বলতে, জিনিসপত্রের দাম বেড়ে এমন জায়গায় চলে গেছে যে, যদি এখন অপ্রয়োজনীয় খরচ করে ফেলেন, খরচ করার লোভ সামলাতে না পারেন, তাহলে সত্যি আপনি মহা বিপদে পড়বেন। তাই আমাদের অপ্রয়োজনীয় খরচ থেকে দূরে সরে আসতে হবে। আর সেজন্য আপনি মাত্র নীচের দশটি কাজ করুন। এই দশটি কাজ যদি আপনি সতর্কতার সাথে বিবেচনা করেন তাহলে দেখবেন, আপনার জীবনে অপ্রয়োজনীয় খরচ একেবারে শূন্যের কোঠায় নেমে এসেছে।

এক, বাজেটিং করা। আপনি আপনার আয় কত সেটা ভালোভাবেই জানেন। কিন্তু খরচ কোন খাতে কত করবেন এটা আপনি ঠিকমত নাও জানতে পারেন। আপনি লিখে ফেলুন। এখন আপনি বুঝতে পারবেন কতটুকু আপনি দৈনন্দিন প্রয়োজনে ব্যয় করছেন, কতটুকু আপনি অন্যান্য খরচে ব্যয় করছেন, কতটুকু আপনি আপনার বাবা-মার জন্য পাঠাচ্ছেন, শিক্ষার জন্য আপনি কতটুকু খরচ করছেন ইত্যাদি। বাজেটিং করা হচ্ছে প্রথম কাজ, যে কাজটা করলে আপনি আপনার আয় ও ব্যয়ের একটা পরিষ্কার ধারণা পান এবং বেশি খরচ হয়ে যাচ্ছে কিনা সেটাও আপনি খেয়াল করতে পারেন।

দুই, নিডস এবং ওয়ান্টসের প্রতি খুবই যত্নশীল হওয়া। আপনারা জানেন নিডস কাকে বলে। যেটা আপনার অতীব প্রয়োজন, যেটা না হলে আপনার চলছেই না, সেটা হচ্ছে আপনার নিডস বা চাহিদা। আর ওয়ান্টস বা ইচ্ছা হচ্ছে সেটা যা আপনার না হলে চলে কিন্তু জীবনে মূল্য সংযোজন করে। যেমন একটা টেলিভিশন, আপনার না হলেও চলে। কিন্তু আপনি কিনলে আপনার ভালো লাগবে। এটা হচ্ছে আপনার ওয়ান্টস। সুতরাং এখন যেহেতু আপনি অপ্রয়োজনীয় খরচ বাদ দিতে চাচ্ছেন, তাই নিডসের প্রতি আপনি যত্নশীল হবেন, পাশাপাশি ওয়ান্টস এর ব্যাপারে খুবই সতর্ক হবেন। আপনি কোন জিনিস কেনার আগে নিজেকে বারবার প্রশ্ন করবেন। যেটা আপনার না হলে চলবে সেটা কেনা থেকে বিরত থাকবেন।

তিন, পরিকল্পনা করা। আপনি যখন যে জিনিস কিনতে চান না কেন, নিজেকে প্রশ্ন করবেন যে ওটা আপনার দরকার কিনা? দরকার হলে আপনি লিখে ফেলুন। আপনি কি কি কিনবেন এবং কোন দামের মধ্যে কিনবেন সেটা লিখবেন। এরপর যখন আপনি কিনতে যাবেন তখন শুধু ওই জিনিসটাই কিনবেন। পরিকল্পনার বাইরে কোন কিছু কিনবেন না। যতই কম দামে আপনি পান না কেন, আপনি পরিকল্পনার বাইরে কিছু কিনবেন না। হতে পারে এক বছর পরে আপনার একটা জিনিস লাগবে এবং এখন দামটা অনেক কম, এইজন্য আপনি কিনে ফেলবেন না। আপনি আপনার পরিকল্পনার বাইরে একচুলও নড়বেন না।

চার, খরচ বা এক্সপেন্ডিচার ট্র্যাক করা। আপনি যখন কোন খরচ করবেন তখন খরচটাকে ট্র্যাক করবেন। দেখবেন যে আপনার বাজেটের সাথে যায় কিনা। যদি বাজেটের বাইরে চলে যায়, আপনি আপনার নিজের মনকে কিনতে নিষেধ করবেন। পুরো মাসের জন্য খরচ ট্র্যাক করার পর আপনি সেটাকে রিভিউ করবেন। আপনার যে খরচ করার কথা, সেটাই কি আপনি খরচ করছেন? যদি মনে করেন বাজেটের বাইরে চলে যাচ্ছে্‌ সেটা আবার এডজাস্ট করে নিবেন। আপনি কোনোভাবেই বাজেটের বাইরে যাবেন না। কারণ, আপনি চান অপ্রয়োজনীয় খরচ থেকে নিজেকে দূরে রাখতে।

পাঁচ, সাবস্ক্রিপশন এবং খুচরা লোভ থেকে নিজেকে দূরে রাখা। আপনি হয়তো কোন সিনেমা দেখার জন্য সাবস্ক্রাইব করেছেন। কোন পত্রিকা পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করেছেন। কোন নাটক দেখার জন্য আপনি কোন চ্যানেলকে সাবস্ক্রাইব করে রেখেছেন, এসবের পেছনে আপনার পয়সা খরচ হচ্ছে। কিন্তু দেখবেন যে, এটার ইউটিলাইজেশন আপনি সেভাবে করছেন না। যেগুলো আপনি একদমই ব্যবহার করছেন না বা খুব কম ব্যবহার করছেন কিন্তু প্রতি মাসে টাকা দিচ্ছেন ঐগুলো আপনি বাদ দিয়ে দিন। এটা আপনার অপ্রয়োজনীয় খরচ। খুচরা লোভ আছে, দেখবেন অনেকেই হঠাৎ করে অনলাইনে খাবার অর্ডার করে থাকেন। যদিও দরকার নেই। অনলাইনে কম মূল্যের কিছু দেখলেন, অর্ডার করে দিলেন। প্রডাক্টটি চলে এলো, আপনার পকেট থেকে টাকা চলে গেল। সুতরাং, এই খরচগুলো আমি বলবো, একেবারেই অপ্রয়োজনীয় খরচ। সুতরাং, এখান থেকে শত হাত দূরে থাকুন। যদি একেবারেই না পারেন তাহলে খরচটাকে কমিয়ে আনুন।

ছয়, তুলনা করে শপিং করুন। এটা আবার কিভাবে করবেন? তুলনা বলতে ধরুন, আপনি একটা জিনিস কিনতে গিয়েছেন। দোকানদার যে দাম বলুক না কেন, আপনার পছন্দ হয়েছে এবং আপনি কিনেছেন। আমি বলব এটা করবেন না, অনেকগুলো দোকান যাচাই করে কিনুন, আপনার ঠকার সম্ভাবনা কম থাকবে, আপনার খরচের মাত্রাটা কমে আসবে। দেখবেন, যখন আপনি কোন জিনিস তুলনা করে কিনছেন, তখন আপনি বেস্ট অফারটা নিতে পারছেন কম দামে। আবার কেনার সময় আপনি দেখতে পারেন যে, কোথাও ডিসকাউন্ট চলছে কিনা বা কোথাও কম দামে বিক্রি করছে কিনা। আমি বলছি আপনি দরদাম করে অনেকগুলো জায়গায় দেখে তুলনা করে তারপরে জিনিসটা কিনুন। দেখবেন আপনার খরচ সাশ্রয় হবে।

সাত, নিজেই কাজটা করুন। দেখুন, আমাদের প্রত্যেকদিন বাসায় কোন না কোন ঝামেলা লেগে থাকে। আপনার কমোড নষ্ট হচ্ছে, ইলেকট্রিক সুইচ সমস্যা করছে, বাসার বিভিন্ন ধরণের টুকটাক কাজ কিন্তু আপনার থাকে। এখনকার দিনে, কোন একটা ইলেকট্রিশিয়ান বা কোন একটা মিস্ত্রিকে আপনি ডাকলে দেখবেন, পাঁচশো বা এক হাজার টাকার কম তাকে মজুরি দিতে পারবেন না। এই ক্ষেত্রে একটা পরামর্শ হচ্ছে যে, এই ছোট ছোট কাজগুলো বিশেষ কঠিন কোন কাজ না। এটা নিজে শিখে নিতে পারেন, একটু কষ্ট করলে এটা শেখা যায়। যদি এই কাজটা শেখা যায়, মাসে আপনি কয়েক হাজার টাকা খরচের হাত থেকে আপনি বাঁচতে পারেন। সুতরাং এই কাজগুলো শিখে নিজে করুন, অনেক অপ্রয়োজনীয় খরচ কমিয়ে ফেলুন।

আট, ক্রেডিট কার্ড পরিত্যাগ করা। ক্রেডিট কার্ড বা ডেবিট কার্ড যাই হোক না কেন, এটা দিয়ে কিনতে খুব ভাল লাগে। কিন্তু যখন আপনি ইন্টারেস্ট সহ বা অন্যান্য চার্জ সহ পরিশোধ করেন, তখন আপনি মূল কষ্টটা বুঝতে পারেন। আমরা জানি যে প্লাস্টিক মানি খরচকে বাড়িয়ে ফেলে। ক্যাশ টাকা দিয়ে কেনার চেষ্টা করবেন। ক্রেডিট কার্ড যত থাকবে, তত আপনার খরচ বাড়বে। আমাদের দেশে অসংখ্য মানুষ এখন ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার করে। পাশ্চাত্যে এই ব্যবহার আরও বেশি। কানাডাতে, আমেরিকাতে প্রত্যেকটা বাসায় দশ-বারোটা করে ক্রেডিট কার্ড আছে। আমরাও সেদিকে যাচ্ছি। ক্রেডিট কার্ড যত আপনার সহজলভ্য হবে ততই দেখবেন, আপনার খরচ বেড়ে যাচ্ছে এবং অপ্রয়োজনীয় জিনিস কিনে আপনি আপনার ঘর ভর্তি করে ফেলছেন। সুতরাং, ক্রেডিট কার্ড ব্যবহারে প্রচণ্ড সতর্ক হউন। যদি পারেন ক্রেডিট কার্ড থেকে দূরে থাকুন, এমনকি ডেবিট কার্ড থেকেও। নগদে কিনলে টাকার খরচের ব্যথা আপনি বুঝতে পারেন, ক্রেডিট কার্ড দিয়ে বা ডেবিট কার্ড দিয়ে কিনলে এই কষ্টটা বোঝা যায় বেশ পরে।

আরও পড়তে পারেন-

নয়, ইউটিলিটির ব্যাপারে খুব সচেতন থাকা। আপনি দেখুন আপনার বাসায় পানি কী পরিমাণ খরচ হচ্ছে, গ্যাস কী পরিমাণ খরচ হচ্ছে। সবচেয়ে বেশি দেখার বিষয় হচ্ছে, আপনার বাসায় ইলেকট্রিসিটি কী পরিমাণ খরচ হচ্ছে। টেলিভিশন সংক্রান্ত যে সেবা আপনি নেন, সেখানের কী অবস্থা। কারণ দেখবেন ইন্টারনেট কানেকশান বাবদ প্রতি মাসে আপনার কাছ থেকে পনেরশো টাকা নিচ্ছে কিন্তু এটা হয়তো অন্য আর একজন এখন এক হাজার টাকায় অফার করছে। আপনি দেখবেন সারাদিন হয়তো এসি চলছে। এটি যদি কমানো যায় তাহলে আপনার ইউটিলিটি বিল অনেক কমে আসবে। এইসব ব্যাপারে আপনি নিজে সচেতন হন এবং পরিবারের প্রত্যেকটি সদস্যকে সচেতন করুন। তাহলে দেখবেন, প্রতি মাসে খরচ অনেক কমে এসেছে। মনে রাখবেন, এক টাকা খরচ কমানো মানে এক টাকা বেশি সেভ করতে পারা।

দশ, ‘ইম্পালসিভ’ ক্রয় থেকে দূরে থাকা এবং কম খরচ বা বিনা খরচের বিকল্প যেগুলো আছে সেদিকে ঝুঁকে পড়া। সারা সপ্তাহে আমরা যে খরচ করি, সেটা যদি আমরা রিভিউ করি তাহলে দেখবেন যে, অনেকগুলো ‘ইম্পালসিভ বাইং’ হয়ে গিয়েছে- যে কেনাটা দরকার ছিল না, কিন্তু বিভিন্ন কারণে সেটি কেনা হয়েছে। যখন আপনি রিভিউ করবেন, তখন এই বিনা কারণে কেনা জিনিসগুলো আপনার চোখের সামনে আসবে। যখন ধরা পড়বে, তারপরে আপনি এই ধরনের ইম্পালসিভ বাইং-এ আর যাবেন না। অনেক কিছু আছে, যেটা কম খরচে পাওয়া যায়। মাথার মধ্যে একটা চিন্তা রাখবেন, আপনি কম খরচে কিভাবে চলতে পারেন। বড় খরচ অ্যাভয়েড করে কিভাবে কম খরচে সেই সমান উপযোগ আপনি পেতে পারেন সেটা দেখুন।

আলোচিত পয়েন্টগুলো দেখুন, প্রতিটা জায়গায় সবার জন্য চিন্তার কিছু ব্যাপার আছে। মূলত, আপনি যদি এখান থেকে কিছু টাকা সাশ্রয় করতে পারেন, তাহলে লাভবান আপনিই হবেন, আমি না। কিন্তু আপনার অসর্তকতার জন্যে আপনার কাছ থেকে অনেক টাকা চলে যাচ্ছে। আপনিই আবার অভিযোগ করছেন, আপনার অনেক টাকা চলে যাচ্ছে, ফলে আপনার সঞ্চয় থাকছে না। সুতরাং, অপ্রয়োজনীয় খরচের হাত থেকে বাঁচুন, কিছু টাকা বেশি সঞ্চয় করুন। সেই সঞ্চয় আবার বিনিয়োগ করুন। আপনি ধীরে ধীরে আর্থিক স্বাধীনতার পথে অগ্রসর হবেন।

লেখক: অর্থনীতি বিশ্লেষক, ফাইন্যান্স ও বিজনেস স্ট্রাটেজিস্ট; ইউটিউবার ও সিইও, ফিনপাওয়ার লিডারশীপ ইন্টারন্যাশনাল। ইমেইল: hossain.shaiful@gmail.com

উম্মাহ২৪ডটকম: এমএ

উম্মাহ পড়তে ক্লিক করুন-
https://www.ummah24.com

দেশি-বিদেশি খবরসহ ইসলামী ভাবধারার গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে ‘উম্মাহ’র ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।