।। ডা. ফরহাদ উদ্দিন হাছান চৌধুরী ।।
আমি ২০১৮ সালে যুক্তরাজ্যের লিভারপুল স্কুল অব ট্রপিক্যাল মেডিসিন থেকে মাস্টার্স করে দেশে ফিরি। এর পরের বছর ২০১৯ সালে দেশে ডেঙ্গুর সবচেয়ে বড় আউটব্রেক হয়। সে সময় প্রথম দেশে ডেঙ্গু রোগী এক লাখ ছাড়িয়েছিল, মারা যায় ১৬৪ জন রোগী। ২০১৯ সালে ঢাকা মেডিকেল ছিল ডেঙ্গু রোগীর জন্য একধরনের আশ্রয়কেন্দ্র। তখন আমি ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগের ‘ভি’ ইউনিটের রেজিস্ট্রার হিসেবে দায়িত্বরত ছিলাম। ইনফেকশাস ডিজিজে পড়াশোনার কারণে সংক্রামক ব্যাধি ম্যানেজমেন্টের প্রতি আমার একধরনের আগ্রহ কাজ করত। অসংখ্য রোগী সামলাতে হয়েছে। তবে সবাই মিলে চেষ্টা ছিল পূর্ণাঙ্গ সেবা নিশ্চিত করার. ডেঙ্গু রোগীদের ক্রিটিক্যাল ফেইজে সঠিকভাবে ম্যানেজ করার কারণে আমাদের রোগী মৃত্যুর হার কম ছিল। তারপরও দু’জনের মৃত্যু ঘটে।
সাধারণত আমরা দেখি, কেউ ডেঙ্গু আক্রান্ত হলে মানুষজন জিজ্ঞেস করে- প্ল্যাটিলেট কত?
প্ল্যাটিলেট কম হলে চিন্তার শেষ নেই। কীভাবে প্ল্যাটিলেট বাড়ানো যায়, তা নিয়ে সবার চিন্তা। প্ল্যাটিলেট দেওয়ার রক্ত চেয়ে ফেসবুকে আহ্বানও প্রায় চোখে পড়ে। আসলে ডেঙ্গু রোগীর প্ল্যাটিলেট কমে জটিলতা হওয়ার চেয়ে বেশি জটিলতা হতে পারে প্রেশার কমে গিয়ে। প্ল্যাটিলেট ট্রান্সফিউশন ব্যয়বহুল। অনেক সময় চারজন ডোনার লাগে। অনেকে চারজন ডোনার ম্যানেজ করতে পারে না। আবার সিঙ্গেল ডোনার প্ল্যাটিলেট ট্রান্সফিউশন অনেক ব্যয়বহুল।
আমার এখনো মনে আছে, ২০১৯ সালে আমাদের ইউনিটে একজন তরুণ রোগী ভর্তি ছিল, প্রতিদিনই তার প্ল্যাটিলেট কমছিল। একসময় তার প্ল্যাটিলেট কমে ২০০০-এ নেমে আসে। তবে আর্থিক অচ্ছলতার কারণে সেই রোগীর প্ল্যাটিলেট দেওয়ার সামর্থ্য ছিল না।
প্ল্যাটিলেট কমার কারণে তার শরীরের বিভিন্ন জায়গায় লাল লাল র্যাশ উঠেছিল। কিন্তু খুবই মজার বিষয়, সেই রোগীর ব্লাড প্রেশারের কোনো সমস্যা হয়নি। প্রথমদিকে প্রেশার কমেছিল, তখন আমরা স্যালাইন দিয়ে তা ঠিক করেছি। প্ল্যাটিলেট দুই হাজারে নেমে এলেও তার কোনো ব্লিডিং হয়নি। তার হিমোগ্লোবিনও কমেনি, প্রেশারও কমেনি। আমরা তাকে কোনো ব্লাড বা প্ল্যাটিলেট ট্রান্সফিউশন করিনি। ডেঙ্গু রোগীর ক্রিটিক্যাল ফেইজ থাকে ২৪-৪৮ ঘণ্টা।
এই যে ২৪-৪৮ ঘণ্টা, অর্থাৎ ক্রিটিক্যাল ফেইজ চলে যাওয়ার পর প্ল্যাটিলেট বাড়তে শুরু করে। সেই সময় ফ্লুইড ম্যানেজমেন্টটা জরুরি। ওই সময় ওভার বা আন্ডার ফ্লুইড ম্যানেজ করা যাবে না। রোগীর ঠিক যতটুকু ফ্লুইড দরকার, তার একটি ক্যালকুলেশন আছে, সেটি মেনে চিকিৎসা দিতে হবে। প্রতি কেজি হিসাব করে, রোগীর ক্লিনিক্যাল অবস্থা-প্রেশার, পালস হিসাব করে, কোথাও প্লাজমা লিকেজ হয়েছে কি না, দেখে চিকিৎসা দিতে হবে। রোগীর অবস্থা বুঝে আমরা ফ্লুইড দিয়ে দিতাম।
প্ল্যাটিলেট দুই হাজারে নেমে আসা সেই রোগীর ক্রিটিক্যাল ফেইজে আমরা সঠিকভাবে ফ্লুইড ম্যানেজমেন্ট করি। সাধারণত ক্রিটিক্যাল ফেইজের ৪৮ ঘণ্টা পর রিকভারি ফেইজে ডেঙ্গু রোগী সুস্থ হওয়া শুরু করে। রোগী খাওয়াদাওয়া শুরু করে, প্রেশার স্ট্যাবল থাকে, প্লাজমা লিকেজের চিহ্ন থাকে না।
আমাদের সেই রোগীর রিকভারি ফেইজ যখন শুরু হয়, তার তিন দিনের মাথায় রোগীর প্ল্যাটিলেটের মাত্রা ৫০ হাজার হয় এবং রোগীটাকে আমরা হাসপাতাল থেকে ছেড়ে দিই। সেই সময় আমাদের টিমের সবাই খুব খুশি হয়েছিলাম।
আরও পড়তে পারেন-
- ঋণ বা ধারকর্য পরিশোধে ইসলামের বিধান
- ইতিহাসে আল্লামা আহমদ শফী
- মেধাবী, আন্তরিক ও নিষ্ঠাবান শিক্ষক ছাড়া শিক্ষার মানোন্নয়ন সম্ভব নয়
- ইগো প্রবলেম নিয়ে যত কথা
- সামাজিক সম্পর্ক সুদৃঢ় রাখতে ইসলামের নির্দেশনা
ডেঙ্গু জ্বর যখন থাকে, তখন সমস্যা হয় না। জ্বর ছাড়ার পর সময়টা ক্রিটিক্যাল ফেইজ। তখন প্রেশার কমে, পেটে-ফুসফুসে পানি জমে, রোগীর লিভার অথবা অন্য কোনো অঙ্গে সমস্যা হতে পারে, রক্তক্ষরণ হতে পারে। প্ল্যাটিলেটের মাত্রা অত্যন্ত কমতে পারে। জ্বর শুরুর তিন থেকে সাত দিনের মধ্যে রোগী ক্রিটিক্যাল সময়ে যেতে পারে। সে সময় সতর্ক থাকতে হবে। প্রেশার মনিটর করতে হবে। শুধু প্ল্যাটিলেট নিয়ে উদ্বিগ্ন থাকলে হবে না।
২০১৯ সালে ডেঙ্গু নিয়ে ঢাকার অসংখ্য রোগী ঢাকা মেডিকেলে ভর্তি হয়েছিল। হাসপাতালের বারান্দা, সিঁড়ির কাছে ফাকা জায়গা কানায় কানায় পূর্ণ ছিল। আউটব্রেক শুরুর পর আমরা নিজেদের উদ্যোগে ইন্টার্ন চিকিৎসক, ট্রেইনি চিকিৎসক, মেডিকেল অফিসার- সবাইকে ট্রেনিং দিয়েছি। প্রেশার কমে গেলে কী করব, প্ল্যাটিলেট কমে গেলে কী করব- ন্যাশনাল গাইডলাইন অনুসারে প্রতিটা ম্যানেজমেন্ট আমরা সাজিয়েছি। সব চিকিৎসকের কাছে ন্যাশনাল গাইডলাইনের পকেটবুক ছিল।
ক্রিটিক্যাল ফেইজে ডেঙ্গু রোগীকে সেফ করার জন্য একজন চিকিৎসককে সব সময় সতর্ক থাকতে হয়। সে সময় যেকোনো রোগীর জটিলতা হলে, তা সামলানোর জন্য আমরা মানসিকভাবে ও কাগজে-কলমে প্রস্তুত ছিলাম। প্রত্যেক রোগীকে নিয়মিত ফলোআপ করতাম। কোনো রোগীর জটিলতা হলে আমরা আমাদের চিকিৎসকদের হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে তার তথ্য পাঠাতাম। সিনিয়র চিকিৎসকেরা সেই রোগী দেখতেন।
ডেঙ্গু রোগীর শুধু প্ল্যাটিলেট কমে যাওয়ার কারণে রক্তক্ষরণ হয় না, বিভিন্ন কারণে হয়। অনেক ক্ষেত্রে রক্তক্ষরণ হলে শুধু প্ল্যাটিলেট না দিয়ে ব্লাড ট্রান্সফিউশন করাই ভালো। ২০১৯ সালে আমরা প্ল্যাটিলেট কমে যাওয়া অনেক রোগী ডিল করেছি। এর পরের বছরগুলোতে ডেঙ্গুর প্রকোপ কমলেও গত বছরও ডেঙ্গু রোগী বেড়েছিল। তখনো প্ল্যাটিলেট কম থাকা রোগীদের ফ্লুইড ম্যানেজমেন্টের মাধ্যমে সুস্থ করেছি আমরা।
২০১৯ সালের পর এবার ডেঙ্গু পরিস্থিতি ভয়াবহ হচ্ছে। জুলাইয়ের ১৩ দিনেই ডেঙ্গু ১৭ হাজার ছাড়িয়েছে। মৃত্যুও বাড়ছে। হাসপাতালগুলোতে রোগীর চাপ বাড়ছে। ডেঙ্গু থেকে নিজেকে সুরক্ষিত রাখতে সবাইকে সতর্ক হতে হবে। জ্বর হলে ডেঙ্গু পরীক্ষা করতে হবে। কারও যদি ডেঙ্গু হয়, তাহলে ভয় না পেয়ে সতর্ক থাকতে হবে। সব ডেঙ্গু রোগীর হাসপাতালে ভর্তির প্রয়োজন নেই। অধিকাংশ রোগী বাড়িতে থেকেই সুস্থ হয়ে যায়। তবে কিছু লক্ষণের বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে।
কোনো ডেঙ্গু রোগী বাসায় থাকা অবস্থায় যদি তীব্র পেটে ব্যথা, অনবরত বমি, প্রেশার কমে যাওয়া, অত্যধিক দুর্বল হয়ে যাওয়া, রক্তক্ষরণ, শ্বাসকষ্ট, আবোলতাবোল কথা বললে হাসপাতালে ভর্তি করতে হবে।
– ডা. ফরহাদ উদ্দিন হাছান চৌধুরী, মেডিসিন ও ইনফেকশাস ডিজিজ বিশেষজ্ঞ, পিএইচডি গবেষক, অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়, যুক্তরাজ্য।
অনুলিখন: তাওছিয়া তাজমিম।
সূত্র- টিবিএস।
উম্মাহ২৪ডটকম: এমএ