Home ইসলাম শয়তানের ক্ষতি থেকে বাঁচার ১০ আমল

শয়তানের ক্ষতি থেকে বাঁচার ১০ আমল

।। মুফতি আব্দুল্লাহ আল ফুআদ ।।

শয়তান মানুষের চির শত্রু। মানুষ সৃষ্টির সূচনালগ্ন থেকেই মানুষের প্রতি তার এ শত্রুতা ও অনিষ্টতা চলমান। প্রকাশ্যে অপ্রকাশ্যে নানাভাবে সে মানুষকে ক্ষতি করে। ঈমান-আমল নষ্ট করার পাশাপাশি মানুষের স্বাভাবিক জীবন-যাপনেও সমস্যা তৈরি করে।

আবার জাদু-টোনার মাধ্যমে কিছু বিভ্রান্ত মানুষ অন্যের শারীরিক, মানসিক ও সাংসারিক ক্ষতি সাধনেও এই শয়তানকে ব্যবহার করে থাকে। তাই শয়তানের সামগ্রিক কুপ্রভাব থেকে বেঁচে থাকা আমাদের সবার জন্যই জরুরি। এ লেখায় কোরআন-হাদিসের দৃষ্টিকোণ থেকে শয়তানের অনিষ্টতা থেকে রক্ষার ১০টি পন্থা তুলে ধরা হলো—
আল্লাহর কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করা

মানুষকে ক্ষতি করতে শয়তান সার্বক্ষণিক মুখিয়ে থাকে। তাই বৈধ যেকোনো কাজ ও ইবাদতের শুরুতে আল্লাহর কাছে শয়তান থেকে আশ্রয় প্রার্থনা করা উচিত।

আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘শয়তানের কুমন্ত্রণা যদি তোমাকে প্ররোচিত করে, তবে তুমি আল্লাহর আশ্রয় প্রার্থনা করো, তিনি সর্বশ্রোতা ও সর্বজ্ঞ।’ (সুরা: আরাফ, আয়াত:২০০)
কোরআন ও হাদিসে বেশ কিছু জায়গার ক্ষেত্রে শয়তান থেকে আশ্রয় প্রার্থনার কথা বলা হয়েছে। বিশেষ করে কোরআন তিলাওয়াতের শুরুতে, মসজিদে প্রবেশের আগে, স্ত্রী সহবাসের আগে, রাগ নিয়ন্ত্রণে, খারাপ স্বপ্ন দেখলে, পায়খানা-প্রস্রাবখানায় প্রবেশের সময়, ঘর থেকে বের হওয়ার সময়, কাউকে বিদায় দিতে ও বদ নজর থেকে মুক্তি পেতে।

আরও পড়তে পারেন-

কোরআন তিলাওয়াত করা

কোরআন তিলাওয়াত শুনলে শয়তান পালিয়ে যায়।

যে ঘরে কোরআন তিলাওয়াত হয়, ওই ঘরে শয়তান প্রভাব বিস্তার করতে পারে না। বিশেষ করে সুরা বাকারা ও আয়াতুল কুরসি শয়তানের কুপ্রভাব থেকে ঘর ও ব্যক্তিকে রক্ষা করে। আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘তোমরা নিজেদের ঘরবাড়িগুলো (আমলশূন্য রেখে) কবরে পরিণত কোরো না। অবশ্যই যে বাড়িতে সুরা বাকারা পাঠ করা হয়, সে বাড়ি থেকে শয়তান পলায়ন করে।’ (মুসলিম, হাদিস : ৭৮০)

আয়াতুল কুরসির ব্যাপারে নবীজি বলেন, ‘তুমি যখন শয্যা গ্রহণ করবে, তখন আয়াতুল কুরসি পড়বে।

তাহলে আল্লাহর পক্ষ থেকে সর্বদা তোমার জন্য একজন রক্ষক থাকবে এবং সকাল পর্যন্ত শয়তান তোমার কাছে আসতে পারবে না।’ (বুখারি, হাদিস : ২৩১১)
ইবাদতে ইখলাস অবলম্বন করা

কেবল আল্লাহ তাআলার সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে তার আদেশ-নিষেধ যথাযথ পালন করার নাম ইখলাস। ইখলাস অবলম্বনকারীকে শয়তান প্ররোচিত করতে পারে না। পবিত্র কোরআনে মানুষকে পথভ্রষ্ট করার ব্যাপারে আল্লাহর কাছে শয়তানের প্রতিজ্ঞা এভাবে বিবৃত হয়েছে, ‘সে (শয়তান) বলল, হে আমার পালনকর্তা, আপনি যেমন আমাকে পথভ্রষ্ট করেছেন, আমিও তাদের সবাইকে পৃথিবীতে নানা সৌন্দর্যে আকৃষ্ট করব এবং তাদের সবাইকে পথভ্রষ্ট করব। তাদের মধ্যে আপনার ইখলাস অবলম্বনকারী বান্দারা এর ব্যতিক্রম।’ (সুরা: হিজর, আয়াত : ৩৯-৪০)

সুতরাং দুনিয়া ও আখিরাতে শয়তানের চক্রান্ত থেকে রক্ষা পেতে হলে আমল ও ইবাদতে ইখলাস অবলম্বন করতে হবে।

ফজরের নামাজ আদায় করা

কষ্টসাধ্য ফজিলতপূর্ণ নামাজ হলো ফজর। রাত শেষে দিনের শুরুতে আল্লাহ তাআলার মহান এই হুকুম যে পালন করে সে শয়তানি প্রভাব থেকে অনেকটাই মুক্ত থাকে। কারণ ফজরের নামাজের মাধ্যমে শয়তানকে দিনের শুরুতেই পরাজিত করে ফেলা হয়। রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘তোমাদের কেউ যখন ঘুমিয়ে পড়ে তখন শয়তান তার ঘাড়ের পশ্চাদংশে তিনটি গিঁট দেয়।

প্রতি গিঁটে সে এ বলে চাপড়ায়, তোমার সামনে রয়েছে দীর্ঘ রাত, অতএব তুমি শুয়ে থাকো। অতঃপর সে যদি জাগ্রত হয়ে আল্লাহকে স্মরণ করে একটি গিঁট খুলে যায়, অজু করলে আরেকটি গিঁট খুলে যায়, অতঃপর সালাত আদায় করলে আরেকটি গিঁট খুলে যায়। তখন তার প্রভাত হয় উত্ফুল্ল মনে ও অনাবিলচিত্তে। অন্যথায় সে সকালে উঠে কলুষ কালিমা ও আলস্য নিয়ে।’ (বুখারি, হাদিস : ১১৪২)

যথাসম্ভব একাকী না থাকা

একাকী থাকা ব্যক্তিকে শয়তান নানাভাবে প্ররোচিত করতে পারে। তাই ইসলামে জামাতে নামাজ আদায়ে বিশেষ গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘যে গ্রামে বা প্রান্তরে তিনজন লোকও অবস্থান করে অথচ তারা জামাত কায়েম করে নামাজ আদায় করে না, তাদের ওপর শয়তান সওয়ার হয়ে যায়। কাজেই জামাতের সঙ্গে নামাজ পড়া তোমাদের জন্য অপরিহার্য। কারণ দলত্যাগী বকরিকে বাঘে ধরে খায়।’ (আবু দাউদ, হাদিস : ৫৪৭)

সফর অবস্থায় কমপক্ষে তিনজনের সংঘবদ্ধ থাকার কথা উল্লেখ করে রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘একজন আরোহী হচ্ছে একটি শয়তান (শয়তানের মতো), দুজন আরোহী দুটি শয়তান, আর তিনজন আরোহী হচ্ছে কাফেলা।’ (তিরমিজি, হাদিস : ১৬৭৪)

সর্বদা আল্লাহকে স্মরণ করা

যারা আল্লাহকে স্মরণ করে শয়তান তাদের কাছে আসতে পারে না। মানুষ যখন আল্লাহর স্মরণ থেকে উদাসীন থাকে, তখন শয়তান তার সঙ্গী হয়ে যায়। তাই সর্বদা তাসবিহ-তাহলিল পাঠ করার পাশাপাশি আল্লাহকে স্মরণ রাখার যেকোনো পন্থা অবলম্বন করা। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘যে ব্যক্তি দয়াময় আল্লাহর স্মরণ থেকে চোখ ফিরিয়ে নেয়, আমি তার জন্য এক শয়তান নিয়োজিত করে দিই, অতঃপর সে-ই হয় তার সঙ্গী। শয়তানরাই মানুষকে সৎ পথে বাধা দান করে, আর মানুষ মনে করে যে তারা সৎ পথেই আছে।’ (সুরা : জুখরুফ, আয়াত : ৩৬-৩৭)

যথাসম্ভব হাই রোধ করা

হাই তুললে শয়তান হাসতে থাকে এবং মুখ দিয়ে মানুষের ভেতরে প্রবেশ করে খুব সহজেই প্ররোচিত করে ফেলতে পারে। তাই শয়তানের প্ররোচনা ও কুপ্রভাব থেকে রক্ষা পেতে হলে যথাসম্ভব হাই রোধ করতে হবে। আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘হাই আসে শয়তানের পক্ষ থেকে। সুতরাং কারো যখন হাই আসে, সে যেন তা প্রতিহত করতে চেষ্টা করে। কারণ কেউ যদি হাই তুলে ‘হা’ বলে, তবে শয়তান তা দেখে হাসতে থাকে।’ (বুখারি, হাদিস : ৬২২৩)

অন্য হাদিসে এসেছে, ‘তোমাদের কারো যদি হাই আসে, তবে তার হাত দিয়ে যেন মুখ চেপে ধরে। কারণ শয়তান ভেতরে প্রবেশ করে।’ (মুসলিম, হাদিস : ২৯৯৫)

ঘরে প্রবেশ ও প্রস্থানে আল্লাহর নাম নেওয়া

ঘরে প্রবেশ ও বের হওয়ার সময় আল্লাহর নাম স্মরণ করা। এতে শয়তান থেকে দূরে থাকা সহজ হয়। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, কোনো ব্যক্তি তার ঘরে প্রবেশকালে আল্লাহর নাম স্মরণ করলে শয়তান তার সঙ্গীদের বলে, ‘তোমাদের রাত যাপন ও রাতের আহারের কোনো ব্যবস্থা হলো না।’ কিন্তু কোনো ব্যক্তি তার ঘরে প্রবেশকালে আল্লাহকে স্মরণ না করলে শয়তান বলে, ‘তোমরা রাত যাপনের জায়গা পেয়ে গেলে। সে আহারের সময় আল্লাহকে স্মরণ না করলে শয়তান বলে, তোমাদের রাতের আহারের ও শয্যা গ্রহণের ব্যবস্থা হয়ে গেল।’ (মুসলিম, হাদিস : ২০১৮)

বিসমিল্লাহ বলে ডান হাতে খাবার খাওয়া

যে খাবারে বিসমিল্লাহ পড়া হয় না সে খাবারে শয়তান অংশ নেয়। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘শয়তান সেই খাদ্যকে নিজের জন্য হালাল করে নেয়, যাতে ‘বিসমিল্লাহ’ বলা হয় না।’ (মিশকাত, হাদিস : ৪১৬১)

শয়তান তার কাজকর্মে বাম হাতকে প্রাধান্য দেয় তাই পানাহারসহ যেকোনো বৈধ কাজে ডান হাত ব্যবহার করার নির্দেশ দিয়েছেন নবীজি (সা.)। তিনি বলেন, ‘তোমাদের কেউ যেন তার ডান হাত দ্বারা পানাহার করে এবং ডান হাত দ্বারা আদান-প্রদান করে। কেননা শয়তান বাম হাত দ্বারা পানাহার করে এবং বাম হাত দ্বারাই আদান-প্রদান করে।’ (সিলসিলা সহিহাহ, হাদিস : ১২৩৬)

রাত্রিকালীন করণীয় ও সচেতনতা

শয়তান রাতে সবচেয়ে বেশি সক্রিয় থাকে। শয়তানের কুপ্রভাব থেকে রক্ষা পেতে হলে রাত্রিকালীন কিছু করণীয় ও সচেতনতা অবলম্বন করতে হবে। রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘যখন রাতের আঁধার নেমে আসে অথবা যখন সন্ধ্যা হয়, তখন তোমাদের শিশুদের (বাইরে যাওয়া থেকে) আটকে রাখো। কারণ এ সময় শয়তান ছড়িয়ে পড়ে। তবে রাতের কিছু সময় অতিক্রান্ত হয়ে গেলে তাদের ছেড়ে দাও এবং ‘বিসমিল্লাহ’ বলে ঘরের দরজাসমূহ বন্ধ করো।

কারণ শয়তান বদ্ধদ্বার খুলতে পারে না। আর ‘বিসমিল্লাহ’ পড়ে তোমাদের মশকগুলোর (চামড়ার তৈরি পানির পাত্রবিশেষ) মুখ বন্ধ করো এবং ‘বিসমিল্লাহ’ বলে তোমাদের পাত্রগুলোও ঢেকে রাখো। (ঢাকার কিছু না পেলে) কোনো কিছু আড়াআড়িভাবে হলেও পাত্রের ওপর রেখে দাও। (আর ঘুমানোর সময়) বাতিগুলো নিভিয়ে দাও।’ (বুখারি, হাদিস : ৫৬২৩)

আল্লাহ তায়ালা শয়তানের প্ররোচনা ও অনিষ্টতা থেকে আমাদের বেঁচে থাকার তাওফিক দান করুন।

উম্মাহ২৪ডটকম: এমএ

উম্মাহ পড়তে ক্লিক করুন-
https://www.ummah24.com

দেশি-বিদেশি খবরসহ ইসলামী ভাবধারার গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে ‘উম্মাহ’র ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।