Home ওপিনিয়ন কারাগার থেকে চিঠি

কারাগার থেকে চিঠি

।। হামিদ মীর ।।

ইসলামাবাদের একটি বিখ্যাত মহাসড়কের নাম সোহরাওয়ার্দী মহাসড়ক। এ মহাসড়কটি মূলত হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর নামে নামকরণ করা হয়েছে, যিনি ১৯ এপ্রিল ১৯৪৬ সালে অল ইন্ডিয়া মুসলিম লীগের দিল্লিতে অনুষ্ঠিত বৈঠকে অখণ্ড বাংলার প্রধানমন্ত্রী হিসেবে এ প্রস্তাব পেশ করেন যে, বাংলা ও আসামকেও পাকিস্তানে যুক্ত করা হোক। কায়েদে আজমের মৃত্যুর পর তিনি আওয়ামী লীগ গঠন করেন এবং তিনি ১৯৫৬ সালে এক বছরের জন্য পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীও হন।

১৯৬২ সালে জেনারেল আইউব খানের সামরিক সরকার সোহরাওয়ার্দীকে গাদ্দার অভিহিত করে গ্রেফতার করে। এ গ্রেফতারি এমন এক সামরিক স্বৈরশাসকের নির্দেশে পরিচালিত হয়, যিনি ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ সরকারের বেতনভুক্ত কর্মচারী ছিলেন, পক্ষান্তরে সোহরাওয়ার্দী ব্রিটিশ শাসকের ইচ্ছা মোতাবেক বাংলাকে ভারতে যুক্ত করার পরিবর্তে পাকিস্তানে যুক্ত করার সিদ্ধান্ত নেন, যার ফলে বাংলা ভাগ হয়ে যায়। কায়েদে আজমের পাকিস্তানে হোসেন সোহরাওয়ার্দীকে গাদ্দার অভিহিত করে গ্রেফতার করা হলে তিনি কারাগার থেকে জেনারেল আইউব খানের নামে একটি চিঠি লেখেন। ওই চিঠিতে তিনি তার প্রাক্তন অধীনস্থকে স্মরণ করিয়ে দিয়ে বলেন, যখন আপনি আর্মি চিফ এবং আমি প্রধানমন্ত্রী ছিলাম, তখন আপনি আমার দেশপ্রেম নিয়ে প্রশ্ন তোলেননি কেন? আপনি সংবাদমাধ্যমকে আমার ব্যাপারে যা কিছু বলেছেন, সেটা ওই সব কারণ থেকে ভিন্ন, যা আপনি আমাকে লিখিতভাবে জানিয়েছেন। আপনি আমার প্রধানমন্ত্রী হওয়ার আগে থেকে আমার পাকিস্তানবিরোধিতা দাঁড় করানোর চেষ্টা করেছেন।

আপনি অভিযোগ আরোপ করেছেন, পাকিস্তানবিরোধী গোষ্ঠীর সাথে আমার সম্পর্ক রয়েছে। কিন্তু আপনি ওই পাকিস্তানবিরোধী গোষ্ঠীর পরিচয় স্পষ্ট করেননি। আপনি আমার বিরুদ্ধে দেশ ভাঙার অপবাদ দিয়েছেন। অথচ আমি পাকিস্তানের অখণ্ডতায় বিশ্বাসী। সোহরাওয়াদী লেখেন, পাকিস্তান আমার দেশ, কোনো আশ্রয়স্থল নয়। আমি এখানে রাজনৈতিক আশ্রয় নিইনি। বরং আমি কায়েদে আজম ও লিয়াকত আলি খানের মতো একজন অভিবাসী এবং সেই লাখ লাখ অভিবাসীর একজন যারা কায়েদে আজমের অঙ্গীকারের ফলে পাকিস্তান এসেছে। সামনে অগ্রসর হয়ে চিঠিতে সোহরাওয়ার্দী জেনারেল আইউবকে বলেন, আপনি আমাকে পাকিস্তানবিরোধী কোনো ষড়যন্ত্রের অভিযোগে গ্রেফতার করেননি। বরং আপনি আমাকে এ জন্য গ্রেফতার করেছেন যে, আপনি নতুন যে আইন জারি করতে যাচ্ছেন, তা আমি মেনে নেব না। আপনি জানেন, আওয়ামী লীগ ভূমি সংস্কারের পক্ষে। আমি পূর্ব পাকিস্তানে কৃষকদের অধিকারের জন্য দীর্ঘ আন্দোলন করেছি। আর এ কারণে পশ্চিম পাকিস্তানের বড় বড় জমিদার আমার বিপক্ষে। সোহরাওয়ার্দী আফসোস নিয়ে বলেন, আপনি আমাকে ভারতের অ্যাজেন্ট আখ্যায়িত করছেন। অথচ মহাত্মা গান্ধীর হত্যাকারী নাথুরাম গডসে স্বীকার করেছে, সে গান্ধীর পর আমাকেও হত্যা করতে চাচ্ছিল। সোহরাওয়ার্দী লেখেন, কলকাতার উগ্রপন্থী হিন্দু আমাকে কয়েক বার হত্যার চেষ্টা করেছে। এরপরও আমি তাদের সাথে যোগ দিয়ে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে কিভাবে ষড়যন্ত্র করতে পারি? পরিশেষে সোহরাওয়ার্দী লেখেন, আজ আমাকে নিজের দেশপ্রেমের প্রমাণ দিতে গিয়ে বড় লজ্জা অনুভব হচ্ছে।

হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর কারাগার থেকে লেখা এ চিঠি বেগম শায়েস্তা সোহরাওয়ার্দী ইকরামুল্লাহ তার Huseyn Shaheed Suhrawardy: A Biography গ্রন্থে যুক্ত করেছেন। সোহরাওয়ার্দী ১৯৫৬ সালের শাসনতন্ত্রের পুনর্বহাল চাচ্ছিলেন, আর জেনারেল আইউব খান ১৯৬২ সালে প্রেসিডেন্ট শাসনব্যবস্থা জারি করার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। তার বাঙালি আইনমন্ত্রী বিচারপতি (অব.) মুহাম্মদ ইবরাহিমও তার প্রেসিডেন্ট আইনের বিরোধিতা করেন এবং মন্ত্রিত্ব থেকে পদত্যাগ করেন। এরপর সামরিক স্বৈরশাসক বিচারপতি মুহাম্মদ মুনীরকে পেয়ে যান। তিনি তাকে আইনমন্ত্রী বানিয়ে পাকিস্তানে একটি প্রেসিডেন্ট শাসনব্যবস্থা জারি করেন। আর এ আইনটিই পাকিস্তান ভাঙার আসল কারণে পরিণত হয়। প্রেসিডেন্ট শাসনব্যবস্থা জারি করার পর জেনারেল আইউব খান পূর্ব পাকিস্তান গেলে বিভিন্ন স্থানে সোহরাওয়ার্দীর মুক্তির জন্য বিক্ষোভ করা হয়। জনতার তীব্র চাপের পর সোহরাওয়ার্দীকে মুক্তি দেয়া হয়। সোহরাওয়ার্দী তার চিকিৎসার জন্য বিদেশ চলে যান এবং সেখানে রহস্যপূর্ণ অবস্থায় ইন্তেকাল করেন।

আরও পড়তে পারেন-

পাকিস্তানের অপর এক প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টো প্রেসিডেন্ট শাসনব্যবস্থাকে সমর্থন দিলে মৃত্যুদণ্ড থেকে বেঁচে যেতেন। জেনারেল আইউব খান যখন পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট শাসনব্যবস্থা জারি করেন, তখন ভুট্টো সেই সামরিক শাসনের অংশীদার ছিলেন। তিনি প্রেসিডেন্ট শাসনব্যবস্থার অধঃপতন খুব কাছ থেকে দেখেছেন। ১৯৬৭ সালে তিনি জেনারেল আইউব খানের সরকার থেকে পদত্যাগ করেন এবং পাকিস্তান পিপলস পার্টি গঠন করেন। তিনি ১৯৭১ সালের সামরিক অভিযানের সমর্থন করেন, ভারতের বন্দিশালা থেকে হাজার হাজার যুদ্ধবন্দিকে মুক্তির ব্যবস্থা করেন এবং পাকিস্তানের পারমাণবিক কর্মসূচিও শুরু করেন। কিন্তু জেনারেল জিয়াউল হক তাকে আদালতের মাধ্যমে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে দেন। ভুট্টো কারাগারে বসে দু’টি বই এবং স্বীয় কন্যা বেনজির ভুট্টোর নামে দীর্ঘ চিঠিসহ আরো কিছু বক্তব্যও লেখেন, যা আদালতে উপস্থাপন করা হয়। ৬ মার্চ, ১৯৭৮ সালে তিনি লাহোর হাইকোর্টে তার বক্তব্য দাখিল করেন, যা তিনি কারাগারে বসে নিজে লিখেছিলেন। এ দীর্ঘ বক্তব্যও মূলত জেনারেল জিয়াউল হকের নামে লেখা একটি চিঠি। তার ওই বক্তব্যকে পাকিস্তান পিপলস পার্টি ১৯৭৯ সালের পর বেশ কয়েকবার গ্রন্থাকারে প্রকাশও করেছিল।

সম্প্রতি বশির রিয়াজ ‘মেরা পাকিস্তান’ নামে এ গ্রন্থটি আবার প্রকাশ করেছে। এ গ্রন্থে জুলফিকার আলী ভুট্টো এ বিষয়টি উন্মোচন করেছেন যে, ২৮ আগস্ট, ১৯৭৭ সালে জেনারেল জিয়াউল হক জেনারেল ফয়েজ আলী চিশতীর উপস্থিতিতে আমার সাথে এক দীর্ঘ সাক্ষাৎ করেন। ওই সাক্ষাতে তিনি বলেন, আপনার মতো মেধাবী ও অভিজ্ঞ ব্যক্তি সংসদীয় শাসনব্যবস্থাকে কেন বেছে নিলেন?

জেনারেল জিয়া ভুট্টোকে বলেন, আপনি আমাকে এমন এক শাসনব্যবস্থার রূপরেখা প্রণয়ন করে দেন, যা পাকিস্তানে চলবে। অন্য ভাষায় জেনারেল জিয়া চাচ্ছিলেন, ভুট্টো ১৯৭৩ সালের সংবিধানের স্থলে আবার প্রেসিডেন্ট শাসনব্যবস্থা আনতে সম্মতি প্রকাশ করবেন। ভুট্টো জীবন বাঁচাতে ১৯৭৩ সালের সংবিধানকে কুরবানি দিতে পারতেন, কিন্তু তিনি জেনারেল জিয়ার সামনে তা অস্বীকার করেন এবং ফাঁসির কাষ্ঠে ঝুলেন। ভুট্টো ফাঁসির দড়িতে চুমু দিয়ে নিজের ভুলের কাফফারা আদায় করেছেন, কিন্তু পাকিস্তানের রাজনীতিবিদরা নিজেদের ভুল থেকে শিক্ষা গ্রহণের জন্য প্রস্তুত নন।

সব রাজনীতিবিদ জানতেন যে, সাবেক সেনাপ্রধান জেনারেল কমর জাভেদ বাজওয়া সংবিধানে আঠারোতম সংশোধনীকে শেখ মুজিবুর রহমানের ছয় দফার চাইতেও বেশি ভয়ঙ্কর মনে করতেন। সব রাজনীতিবিদ জানতেন যে, তিনি ব্যক্তিগত বৈঠকগুলোতে বারবার পাঁচ হাজার ব্যক্তিকে ফাঁসিতে ঝোলানোর খায়েশ প্রকাশ করতেন। কিন্তু এতদসত্ত্বেও তেহরিকে ইনসাফ, মুসলিম লীগ (এন) ও পিপলস পার্টি এক হয়ে ২০১৯ সালে বাজওয়ার চাকরির মেয়াদ বৃদ্ধি করায়। আর ওই মেয়াদ বৃদ্ধিই এমন সঙ্কট সৃষ্টি করে, যার দ্বারা আজ পাকিস্তান বিপর্যস্ত। সঙ্কটের একটি সমাধান সংবিধানে দেওয়া হয়েছে। সেটা হচ্ছে সময়ের ভেতরেই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়া। কিন্তু রাষ্ট্রের কিছু চ্যাম্পিয়ন ব্যক্তি নির্বাচন থেকে পলায়ন করতে চাচ্ছেন। ইসলামাবাদ হাইকোর্ট ইমরান খানের তোশাখানা মামলায় দণ্ড বাতিল করে মুক্তির নির্দেশ দিয়েছেন। কিন্তু তাকে আরো একটি মামলায় গ্রেফতার করা হয়েছে। পরিস্থিতি বলছে, ইমরান খানের কিছু প্রতিপক্ষও কারাগারে যাওয়ার তালিকায় রয়েছেন। এ রাজনীতিবিদরা যতই দুর্বল হোক না কেন, পরিশেষে তারা জিতে যান। অবশ্য তাদের জয়ের মূল্য দেন জনগণ।

[পাকিস্তানের জাতীয় পত্রিকা দৈনিক জং ৩১ আগস্ট, ২০২৩ হতে]

ভাষান্তর : ইমতিয়াজ বিন মাহতাব
ahmadimtiajdr@gmail.com
– হামিদ মীর, পাকিস্তানের প্রখ্যাত সাংবাদিক ও কলামিস্ট।

উম্মাহ২৪ডটকম: এমএ

উম্মাহ পড়তে ক্লিক করুন-
https://www.ummah24.com

দেশি-বিদেশি খবরসহ ইসলামী ভাবধারার গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে ‘উম্মাহ’র ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।