Home প্রবন্ধ-নিবন্ধ রোবট ইতোমধ্যেই মানুষকে হত্যা করতে শুরু করেছে!

রোবট ইতোমধ্যেই মানুষকে হত্যা করতে শুরু করেছে!

ব্রুস স্নিয়ার, ডাভি ওট্টেনহাইমার: রোবট বিপ্লব শুরু হয়েছে অনেক আগেই, হত্যারও সূত্রপাত তখন থেকে। উদাহরণটা দেওয়া যাক ১৯৭৯ সালের। ওই বছরের ২৫ জানুয়ারি যুক্তরাষ্ট্রের ফোর্ড মোটর কোম্পানির কারখানায় একটি রোবটের যান্ত্রিক ত্রুটি দেখা দেয়। গুদাম থেকে গাড়ির যন্ত্রাংশ বয়ে আনার কাজ করতো রোবটটি। কিন্তু, কারখানার মানব কর্মীরা মনে করেন, ত্রুটির কারণে সেটি যথেষ্ট দ্রুত কাজ করছে না। কাজে গতি আনতে ২৫ বছরের এক কর্মী রবার্ট উইলিয়ামসকে গুদামের তাকের ওপর উঠে যন্ত্রাংশ আনতে বলেন তার সহকর্মীরা। দুর্ভাগ্য উইলিয়ামসের। কারণ, রোবটটি তখন নীরবে কাজ করছিল। উইলিয়ামস তাকের ওপর উঠতেই তার মাথায় এক টন ওজনের রোবটটির একটি বাহু আঘাত করে। আঘাতে চূর্ণ হয় তার খুলি, মারা যান সঙ্গেসঙ্গে।

রোবটের হাতে মানুষের মৃত্যুর এটাই প্রথম ঘটনা বলে জানা যায়। কিন্তু, সে তো সবে শুরুমাত্র।

১৯৮১ সালে জাপানের কাওয়াসাকি হেভি ইন্ডাস্ট্রিজের কারখানায় প্রায় একইভাবে মারা যান কেনজি উরাদা নামের আরেক কর্মী। তিনি যখন যান্ত্রিক ত্রুটি কবলিত একটি রোবট পরীক্ষা করতে যাচ্ছিলেন, ঠিক তখনই সেটি চলতে শুরু করে, আর তার সামনে পড়ে নিহত হন উরাদা।

নিজ বই ‘হোয়েন রোবটস কিল: আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স আন্ডার ক্রিমিনাল ল’-তে এমন বর্ণনাই দিয়েছেন গ্যাব্রিয়েল হ্যালেভি। তার বর্ণনা অনুযায়ী, ‘সামনে থাকা হুমকি অপসারণে, ওই কর্মীকে পাশের একটি মেশিনের মধ্যে ঠেলে দেওয়াই সবচেয়ে কার্যকর উপায়- এমন সিদ্ধান্ত নেয় রোবটটি।’

১৯৯২ থেকে ২০১৭ সালের মধ্যে, শুধুমাত্র যুক্তরাষ্ট্রেই কর্মস্থলে রোবটের হাতে মারা পড়েছেন ৪১ জন। তবে এটা নথিভুক্ত সংখ্যা, প্রকৃতপক্ষে তা বেশিই হবে। বিশেষত যদি আপনি কারখানায় রোবটের ব্যাপক ব্যবহারের কারণে বিপুল সংখ্যক মানব কর্মীর চাকরি হারানোর বাস্তবতার সাথে তুলনা করেন, তাহলে সহজেই এটি উপলদ্ধি করবেন।

২০০৭ সালে রোবটিক একটি বিমান-বিধ্বংসী কামান দক্ষিণ আফ্রিকার ৯ সেনাকে হত্যা করে। সফটওয়্যারের ত্রুটির কারণে কামানের মুখ এলোমেলোভাবে ঘুরতে ঘুরতে গোলাবর্ষণ করে, পুরো ঘটনাটি ঘটে এক সেকেন্ডেরও কম সময়ে। কিন্তু, এরমধ্যেই সেটি কয়েক ডজন প্রাণঘাতী গোলাবর্ষণ করে ফেলে।

২০১৮ সালে শল্যপাচারের সময় স্টিফেন পেতিত নামের এক রোগীকে অবহেলায় হত্যার মামলায়- চিকিৎসকদের পাশাপাশি অপারেশনে যুক্ত থাকা একটি মেডিকেল রোবটকেও দোষী সাব্যস্ত করেন যুক্তরাজ্যের একটি আদালত।

এতক্ষণে নিশ্চয় বুঝতে পারছেন, রোবটেরা –- ‘বুদ্ধিমান’ হোক বা নাই হোক — অনেক দশক ধরেই মানবহত্যা করে আসছে।

আরও উন্নত কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার (এআই) বিকাশ– যন্ত্রের মাধ্যমে মানুষের ক্ষতি হওয়ার এই হুমকিকে কেবল বাড়িয়েই তুলেছে। দেশে দেশে এই হুমকি যেন পাল্লা দিয়ে বাড়ছে। যেমন যুক্তরাষ্ট্রের রাস্তায় এরমধ্যেই চলছে ‘চালকহীন’ গাড়ি; আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা ব্যবহার করছেন রোবট কুকুর। আবার কম্পিউটার-চালিত ব্যবস্থাগুলোকে বিভিন্ন উপকরণ ব্যবহারের সক্ষমতা দেওয়া হয়েছে – ফলে তারা ভার্চুয়াল জগতের বাইরের বাস্তব জগতকে সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত করার শক্তি পেয়েছে।

‘সর্বশক্তিমান, অতি-বুদ্ধিমান এআই’ – এর আবির্ভাব নিয়ে, এর হুমকি নিয়ে অনেক আলোচনা হচ্ছে। কিন্তু, এটি তাত্ত্বিক আলোচনা, যা নিয়ে উদ্বেগ করার বিলাসিতা মানবজাতির নেই। কারণ, এরমধ্যেই আমাদের দুয়ারে বিদ্যমান সমস্যাগুলো এসে কড়া নাড়ছে।

বর্তমান সমস্যা সমাধানের মাধ্যমেই ভবিষ্যৎকে সুরক্ষিত করা যাবে। আর এজন্য কোম্পানিগুলো যেন নিরাপদ প্রযুক্তি উদ্ভাবন করে বা নিরাপত্তা বাড়ানোর বিভিন্ন উপায় গ্রহণ করে – তা কঠোর নীতিমালার মাধ্যমে নিশ্চিত করতে হবে। আমরা আজো সে পর্যায়ে পৌঁছাতে পারিনি।

ঐতিহাসিকভাবে দেখা গেছে, বড় দুর্ঘটনার হওয়ার পরই যথাযথ নীতিমালার প্রয়োজনীয়তা উপলদ্ধি করেছেন নীতিনির্ধারকরা। এ ধরনের বিপর্যয় দূরদৃষ্টিতে অনুধাবন করা এবং তা যেন না ঘটে – তেমন ব্যবস্থা নেওয়াই হবে এআই যুগের সাথে সামঞ্জ্যস্যপূর্ণ। শুরুতেই হত্যার ঘটনাগুলো উল্লেখ করার কারণটাও তাই। এখন সময় এসেছে আজ ও আগামীর দুর্যোগ ঠেকানোর।

সুদূর অতীত থেকে দেখা যায়, যুক্তরাষ্ট্রের শিল্প কারখানায় ব্যবহৃত স্টিম বয়লারগুলো একসময় খুবই ঝুঁকিপূর্ণ ছিল। বিস্ফোরণে অনেকে হতাহতও হতেন। কিন্তু, ১৯০৫ সালের গ্রুভার জুতা কারখানার বিপর্যয়ের পর থেকে স্টিম বয়লারের নিরাপদ নকশা ও উৎপাদনের কঠোর নীতিমালা কার্যকর হয়।

১৯১১ সালের ট্রায়াঙ্গল শার্টওয়েস্ট কারখানায় ঘটে এক ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড। ১৪৬ পোশাক শ্রমিক নিহত হওয়ার পর থামে আগুনের তাণ্ডব। জনমনে নেমে আসে শোক ও ক্ষোভের ছায়া। এই দুর্ঘটনার পর মার্কিন কর্তৃপক্ষ কারখানায় স্প্রিংকলার ব্যবস্থা ও জরুরী নির্গমণ পথ রাখার বিধিমালা প্রণয়ন করেন।

সঠিক বিধিমালা কার্যকর থাকলে ১৯১২ সালের টাইটানিক জাহাজডুবিতে বিপুল মানুষের মৃত্যু এড়ানো যেত। এই দুর্ঘটনার পরেই অবশ্য জাহাজে রেডিও থাকা, যথেষ্ট সংখ্যক লাইফবোট রাখা এবং সুরক্ষা পরিদর্শনকে বাধ্যতামূলক করা হয়।

আরও পড়তে পারেন-

যুক্তরাষ্ট্রের একটি সফল কর্তৃপক্ষ – ফেডারেল এভিয়েশন অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (এফএএ)। বেসামরিক বিমান চলাচল নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি এই সংস্থা দেশটির এভিয়েশন শিল্পের তদারকিও করে। প্রতিষ্ঠার পর থেকে অনেক পরিবর্তনের মধ্যে দিয়ে গেছে এফএএ, বিমান শিল্পের সুরক্ষা উন্নয়নেও অগ্রণী ভূমিকা রেখেছে। তাদের নীতিমালার কারণেই যাত্রীবাহী বিমান নির্মাণ শিল্পে সুরক্ষামূলক প্রযুক্তি উদ্ভাবন নতুন গতি পায়, প্রনীত হয় আইনও। এরমধ্যে, উল্লেখযোগ্য ছিল, ১৯২৬ সনের এয়ার কমার্স অ্যাক্ট। যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধি পরিষদ এই আইন পাসের সময় উপলদ্ধি করেছিলেন, দেশের অর্থনীতি ও জনজীবনে বিমান পরিবহনকে নিরাপদভাবে যুক্ত করতে এই শিল্পের কঠোর তদারকি দরকার। এসব আইনের সুবাদেই আজ যুক্তরাষ্ট্রে প্রতিটি বিমান দুর্ঘটনার চুলচেরা তদন্ত হয়, আর সে অনুযায়ী নিত্যনতুন সুরক্ষা ব্যবস্থাও নেওয়া হয়।

এদিকে যুক্তরাষ্ট্রে বিদ্যমান শিল্প আইনগুলো অনুসারে, শিল্প রোবটের বিধিমালাগুলো করা হয়েছে। এসব বিধিমালায় গত কয়েক দশক ধরেই বিভিন্ন সংযোজন ও সংস্কার হচ্ছে। ১৯৭০ সনের অকুপেশনাল সেফটি অ্যান্ড হেলথ অ্যাক্ট’ – কারখানা যন্ত্রপাতির সুরক্ষার মানদণ্ড প্রতিষ্ঠা করে। ১৯৭৪ সনে রোবটিক ইন্ডাস্ট্রিজ অ্যাসোসিয়েশনকে অন্তর্ভুক্ত করে প্রতিষ্ঠিত হয় – অ্যাসোসিয়েশন ফোর অ্যাডভান্সিং অটোমেশন। প্রতিষ্ঠার পর থেকেই এ সংস্থা– বিভিন্ন ধরনের রোবটের জন্য নির্দিষ্ট সুরক্ষা মানদণ্ড তৈরি করে চলেছে। এসব মানদণ্ডের আওতায় – শিল্প রোবটের নিরাপদ নকশা, সুরক্ষামূলক ব্যবস্থা ও কঠোরভাবে ঝুঁকি যাচাইয়ের বিধান আছে।

কিন্তু, তাও যথেষ্ট নয়। প্রযুক্তি এখন প্রতিনিয়ত বদলাচ্ছে। এই অবস্থায়, আমাদের সমাজে ও অর্থনীতিতে রোবটের ব্যবহার নিয়ে – বিভিন্ন দেশের সরকারকে আরও স্বচ্ছ নীতিমালা প্রণয়ন করতে হবে। কীভাবে রোবট ব্যবহৃত হবে– থাকা চাই তার সুনির্দিষ্ট দিকনির্দেশনা। আইনের বাধা না থাকলে- রোবটের বাণিজ্যিক ব্যবহার মঙ্গলময় হবে না। মনে রাখা দরকার, সব ধরনের সতর্কতার পরেও দুর্ঘটনা ঘটতেই পারে। কিন্তু, এভিয়েশন ও কর্মস্থলে সুরক্ষার অতীতের উদ্যোগগুলো প্রমাণ করেছে যে, দুর্ঘটনা তখনই এড়ানো সম্ভব হয়, যখন তা নিয়ে মুক্তভাবে আলোচনা এবং বিশেষজ্ঞদের মূল্যায়নের সুযোগ থাকে। একইসঙ্গে, যখন তার ভিত্তিতে আইনপ্রণেতারা পদক্ষেপও নেন।

এআই ও রোবটিক্স কোম্পানিগুলো চায় না এমনটা হোক। যেমন চ্যাটজিপিটির উদ্ভাবক সংস্থা- ওপেনএআই প্রকাশ্যেই এ শিল্পের সুরক্ষা বিধিমালা শিথিল করার চেষ্টা চালিয়েছে বলে জানা গেছে। টাইমসে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন জানায়, ইউরোপীয় ইউনিয়নের কর্মকর্তারা চ্যাটজিপিটিকে ‘উচ্চ ঝুঁকি’র শ্রেণিতে রাখতে চেয়েছিলেন, কিন্তু তা না করতে ইইউ’তে তদ্বির করে কোম্পানিটি।

ওপেনএআই এ প্রচেষ্টা না চালালে– ইইউ আরও কঠোর শর্ত দিত, যার আলোকে নিশ্চিত হতো স্বচ্ছতা ও মানব নজরদারি।

বৃহৎ বাণিজ্যিক সংস্থাগুলোর শুধুমাত্র নিজেদের মুনাফার স্বার্থে কম্পিউটার প্রযুক্তি উদ্ভাবনের নজির আছে। এভাবে তারা নিজেদের ত্রুটির বোঝা সমাজের ওপর পার করে দেয়। নাহলে দাবি করে, সুরক্ষামূলক আইনগুলো তাদের ব্যবসায়িক ক্ষতি করছে। আগেও আমরা এ ধরনের অসার আলাপ শুনেছি, আগামীতেও শুনব। এসব দাবি-দাওয়ার বিষয়ে আমাদের গভীর সন্দেহ রাখা দরকার।

অতীতের আলোকেই আগামীকে সাজাতে হয়। আর অতীত আমাদের বলে, রোবটদেরও ত্রুটি হয়, অনেক সময় তাদের মানব পরিচালকদের যেকারণে মৃত্যুও হয়েছে।

মানব সভ্যতা ভবিষ্যতের দিকে যতই এগুবে, রোবটরা ততোই আমাদের জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে উঠবে। তাই এগুলো তৈরির বেলায় গাফিলতি বা শিথিলতা থাকার পরিণামও মারাত্মক হতে বাধ্য। প্রযুক্তিতে যখন সঠিক সুরক্ষামূলক ব্যবস্থাগুলো যুক্ত হয়, কেবল তখনই সত্যিকার প্রযুক্তি বিপ্লব ঘটে। অতীতের দুর্ঘটনাগুলো থেকে শিক্ষা নিয়ে আমরা সুরক্ষার আইনগুলোকে বলিষ্ঠ করতে পারি, নকশার ত্রুটি দূর করার উদ্যোগ নিতে পারি, বা আরও অকালমৃত্যু ঠেকানোর উদ্যোগ নিতে পারি।

তবে এজন্য রাজনৈতিক সদিচ্ছার দরকার। বড় কর্পোরেশনগুলোর প্রভাব পৃথিবীময়। তাদের প্রভাবমুক্ত হয়ে বিশ্বের সরকারগুলো যেন – জনস্বার্থে ও জনকল্যাণে – এআই ও রোবট শিল্পের নিরাপদ আইন করতে পারে, তা সব পক্ষকেই নিশ্চিত করতে হবে।

সূত্র- দ্য আটলান্টিক, ভায়া- টিবিএস।

উম্মাহ২৪ডটকম: এমএ

উম্মাহ পড়তে ক্লিক করুন-
https://www.ummah24.com

দেশি-বিদেশি খবরসহ ইসলামী ভাবধারার গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে ‘উম্মাহ’র ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।