Home ফিকহ ও মাসায়েল ওমরার ফযীলত এবং বিস্তারিত মাসআলা

ওমরার ফযীলত এবং বিস্তারিত মাসআলা

।। মাওলানা তাজুল ইসলাম আশরাফী ।।

ওমরাহ শব্দের আভিধানিক অর্থ হলো ভ্রমণ করা। জীবনে একবার ওমরাহ করা সুন্নতে মুয়াক্কাদা।

ওমরাহ শব্দের আভিধানিক অর্থ হলো ভ্রমণ করা। জীবনে একবার ওমরাহ করা সুন্নতে মুয়াক্কাদা। এটা যখনই করা হোক, তার জন্য প্রতিদান ও বরকত রয়েছে।

শরিয়তের বিধান মতে, ওমরাহর নিয়ম হলো-আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশে সুন্নত বা নফল ওমরাহ পালনের নিয়ত করে হজের মতো ‘মিকাত’ তথা ইহরাম বাঁধার নির্ধারিত জায়গা থেকে বা তার আগেই ইহরামের নিয়ত করতে হয়।

অতঃপর বাইতুল্লাহ শরিফে এসে সাত চক্কর তওয়াফ করে সাফা-মারওয়া পাহাড়দ্বয়ের সাঈ করতে হয়। সর্বশেষ হলক (মাথা মুণ্ডানো) কিংবা কসর (চুল ছোট করা)-এর মাধ্যমে ইহরাম খুলতে হয়।

ওমরাহ কেন পালন করতে হয়

কুরআন ও হাদিসে ওমরাহর অনেক ফযীলত বর্ণিত হয়েছে। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন, ‘তোমরা আল্লাহর উদ্দেশে হজ ও ওমরাহ পরিপূর্ণভাবে পালন করো।’ (সুরা বাকারা- ১৯৬)।

হযরত আবু হুরায়রা (রাযি.) সূত্রে বর্ণিত; তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেছেন, ‘এক ওমরাহ থেকে পরবর্তী ওমরাহ পর্যন্ত মাঝখানের গোনাহগুলোর জন্য কাফফারা স্বরূপ।’ (বোখারী- ১৬৮৩, মুসলিম- ৩৩৫৫)।

ওমরাহ দারিদ্র্য বিমোচন করে। হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রাযি.) সূত্রে বর্ণিত; তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেছেন, ‘তোমরা হজ ও ওমরাহ আদায় করো। কেননা, হজ ও ওমরাহ দারিদ্র্য বিমোচন ও গোনাহ দূর করে দেয় ঠিক সেভাবে, যেভাবে হাঁপরের আগুন লোহা, সোনা ও রুপা থেকে ময়লা দূর করে দেয়।’ (তিরমিযী- ৮১০)।

  • উমরাহ খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি ইবাদাত; যার অর্থ কোনো স্থানের যিয়ারত করা।
  • ইসলামী শরী‘আতের পরিভাষায় আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য বছরের যে কোনো সময় মসজিদুল হারামে গমন করে নির্দিষ্ট কিছু কর্মকাণ্ড সম্পাদন করাকে উমরাহ বলা হয়।
  • আবু হুরায়রাহ রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘‘উমরাহ; এক উমরাহ থেকে পরবর্তী উমরাহর মধ্যবর্তী সময়ে যা কিছু পাপ (সগীরা) কাজ ঘটবে তার জন্য কাফফারা (প্রায়শ্চিত্ত করে)’’। (সহীহ বুখারী, হাদীস নং ১৬৫০)।
  • আবদুল্লাহ ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমা থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘‘নিশ্চয় রমযান মাসের উমরাহ একটি হজের সমান’’। (মিশকাত, হাদীস নং ২৫০৯)।
  • রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘‘রমযান মাসে উমরাহ পালন করা -আমার সাথে হজ করার ন্যায়’’। (সহীহ বুখারী, হাদীস নং ১৮৬৩; সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ২৫৬ ও ৩০৩৯)।
  • রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর জীবনদশায় ৪ বার উমরাহ করেছেন। (মিশকাত, হাদীস নং ২৫১৮)।

মসজিদুল হারামে প্রবেশ করা থেকে শুরু করে তাওয়াফ, সা‘ঈ ও হালাল হয়ে উমরাহ সম্পন্ন করতে ২-৩ ঘন্টা সময় লাগে মাত্র।

 উমরাহর ফরয, ওয়াজিব ও সুন্নাত-

ফরযওয়াজিবসুন্নাত
ইহরাম করামীকাত থেকে ইহরাম করাউল্লেখযোগ্য সুন্নাতগুলো হল:
তাওয়াফ করাকসর/হলক্ব করাহাজারে আসওয়াদ চুম্বন করা
সাঈ করা পুরুষদের ওপর সুন্নাত হচ্ছে এ তাওয়াফের প্রথম তিন চক্করে ‘রমল’ করা
  পুরুষদের জন্য সুন্নাত হচ্ছে এ তাওয়াফের সব কয়টি চক্করে ইদতেবা করা
  ইয়েমেনী কোণ স্পর্শ করা
 * তাওয়াফের পর দু’রাকাত সালাত

ইহরামের মীকাত

  • মীকাত হলো সীমা। হজ ও উমরাহ পালনের উদ্দেশ্যে মক্কা গমনকারীদের কা‘বা ঘর হতে একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ দূরত্ব থেকে ইহরাম করতে হয়, ঐ জায়গাগুলোকে মীকাত বলা হয়।
  • মীকাত দুই ধরনের (১) মীকাতে যামানী (সময়ের মীকাত) (২) মীকাতে মাকানী (স্থানের মীকাত)।
  • হজের মীকাতের সময় হলো ৩টি মাস; শাওয়াল, জিলক্বদ ও যিলহজ মাস। তবে কিছু আলেমের মতে এটি ১০ যিলহজ পর্যন্ত। উমরাহর মীকাতের সময় হলো বছরের যে কোনো সময়। (সূরা আল-বাকারা- ১৯৭)।
  • মীকাতের জন্য ৫টি নির্ধারিত স্থান রয়েছে:
মীকাতের নামঅন্য নামমক্কা থেকে দূরত্বযাদের জন্য
যুল হুলায়ফাআবিয়ারে আলী৪২০ কিমিমদীনাবাসী ও যারা এ পথ দিয়ে যাবেন।
আল জুহফাহরাবিগ১৮৬ কি.মি.সিরিয়া, লেবানন, জর্দান, ফিলিস্তিন, মিশর, সুদান, মরক্কো ও সমগ্র আফ্রিকা।
ইয়ালামলামআস-সা‘দিয়া১২০ কি.মিযারা নৌপথে ইয়েমেন, ভারত, বাংলাদেশ, পাকিস্তান, চীন, মালয়েশিয়া, দক্ষিণ এশিয়া, ইন্দোনেশিয়া থেকে আসবেন।
কারনুল মানাযিলসাইলুল কাবির৭৮ কি.মি.কাতার, কুয়েত, সংযুক্ত আরব আমিরাত, বাহরাইন, ওমান, ইরাক ও ইরান। আর যারা বাংলাদেশ থেকে আকাশ পথে জিদ্দা যাবেন তাদের জন্যও এটি মীক্কাত।
যাতু ইরক১০০ কি.মিইরাক (বর্তমানে এটা প্রযোজ্য হয় না)
  • বাংলাদেশ থেকে যারা বিমান যোগে জেদ্দা বিমানবন্দরে অবতরণ করবেন তাদের মীকাত হলো ‘কারনুল মানাযিল’ (সাইলুল কাবীর)। আর নৌপথ যোগে যারা জাহাজে ভ্রমণ করবেন তাদের মীকাত হবে ‘ইয়ালামলাম’। তবে আজকাল নৌপথ বেশি ব্যবহৃত হয় না।

যারা মীকাতের সীমানার অভ্যন্তরে বসবাস করেন তাদের অবস্থানের জায়গাটাই হল তাদের মীকাত। অর্থাৎ যে যেখানে আছেন সেখান থেকেই হজের ইহরাম করবেন। তবে মক্কার হারাম এলাকার ভেতরে বসবাসকারী ব্যক্তি যদি উমরাহ করতে চান তা হলে তাকে হারাম এলাকার বাইরে গিয়ে যেমন তান‘ঈম তথা আয়েশা মসজিদ বা অনুরূপ কোনো হালাল এলাকায় গিয়ে ইহরাম করবেন। (সহীহ বুখারী, হাদীস নং ১৪২৯; সহীহ মুসলিম- ৮৪১)।

 ইহরামের তাৎপর্য

  • ইহরাম শব্দের আভিধানিক অর্থ- হারাম করা, সীমাবদ্ধ বা অনুমতিহীন। ইহরামের মাধ্যমে উমরাহ/হজের আনুষ্ঠানিকতা শুরু হয়।
  • হজ ও উমরাহ পালন করার সময় ইহরাম করা বাধ্যতামূলক। ইহরাম করা অবস্থায় নির্দিষ্ট কিছু কর্মকাণ্ড সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ হয়ে যায়।
  • ইহরাম অবস্থায় সকল পুরুষ একই রকমের পোশাক পরিধান করেন, যাতে করে ধনী-গরীবে কোনো ভেদাভেদ না থাকে। ইহরাম শ্রেণি, জাতি ও সংস্কৃতির পার্থক্য দূর করে দেয়।
  • ইহরামের কাপড় সিল্ক অথবা যে পশুর মাংস হারাম তার পশম দিয়ে তৈরি করা না হয় এবং কাপড় এতটা স্বচ্ছ হবে না যাতে শরীরের ভেতরের অংশ দেখা যায়।
  • পুরুষের জন্য ইহরামের পোশাক; সেলাইবিহীন দুই খণ্ড কাপড় (সাদা রং অগ্রাধিকার)। যে কাপড় দিয়ে শরীরের উপরের অংশ আবৃত করা হয় তাকে বলে ‘রিদা’, আর যে কাপড় দিয়ে শরীরের নিচের অংশ আবৃত করা হয় তাকে ‘ইযার’ বলে।
  • মহিলারা তাদের স্বাভাবিক পোশাকের মতো সেলাইযুক্ত হালকা যে কোনো রংয়ের পছন্দনীয় পোশাক পরিধান করবেন (তা হবে শালিন, পরিস্কার, সুগন্ধিমুক্ত এবং খুব টকটকে রংচংয়ে ও আকর্ষণীয় হবে না)। সাথে সাথে ইসলামী শরী‘আহ অনুসারে অবশ্যই যথাযথ পর্দা পরতে হবে।

আপনি যদি বাংলাদেশ থেকে প্রথমেই মক্কায় যান এবং উমরাহ পালন করেন তাহলে আপনি ‘কারনুল মানাযিল’ মীকাত থেকে ইহরাম করবেন। আর আপনি যদি প্রথমে মদীনা যান এবং মদীনা থেকে মক্কায় যান তাহলে সেক্ষেত্রে আপনি ‘যুল হুলায়ফা’ মীকাত থেকে ইহরাম করবেন।

 ইহরামের পদ্ধতি

  • ইহরামের কাপড় পরিধানের আগে সাধারণ পরিচ্ছন্নতার কাজ সেরে নিন – নখ কাটা, লজ্জাস্থানের চুল পরিস্কার, গোঁফ ছোট করা। তবে দাঁড়ি ও চুল কাটবেন না। পরিচ্ছন্নতার এ কাজগুলো করা মুস্তাহাব। (সহীহ বুখারী, হাদীস নং ১৪৬৪)।
  • এরপর গোসল করুন, আর যদি গোসল করা সম্ভব না হয় তাহলে অযু করুন। ঋতুবর্তী মহিলারা গোসল করে সাধারণ কাপড় পরে নিবেন এবং উমরাহ/হজ এর সকল বিধি-বিধান পালন করবেন, তবে ঋতু শেষ না হওয়া পর্যন্ত মসজিদে হারামে প্রবেশ করবেন না, তাওয়াফও করবেন না এবং নামাযও আদায় করবেন না। ঋতু শেষ হলে তাওয়াফ করে নিবেন ও নামায আদায় করবেন।
  • পুরুষরা ইহরামের কাপড় পড়ার আগে চুলে তেল বা ‘তালবিদ’ দিতে পারেন এবং শরীরে, মাথায় ও দাঁড়িতে সুগন্ধী ব্যবহার করতে পারেন; তবে ইহরাম বাঁধার পর পারবেন না। সুগন্ধী যেন আবার ইহরামের কাপড়ে না লাগে সে ব্যাপারে সতর্ক থাকতে হবে। লেগে গেলে তা ধুয়ে ফেলবেন। মহিলারা কখনই কোনো অবস্থাতেই সুগন্ধি ব্যবহার করবেন না। মহিলাদের সুগন্ধি ব্যবহার করা হারাম। (সহীহ বুখারী, হাদসি নং ১৬৩৫)।
  • পুরুষরা ইহরামের কাপড় সুবিধা মতো উপায়ে পরতে পারেন তবে এমনভাবে পরবেন যাতে নাভির উপর থেকে হাটুর নিচ পর্যন্ত আবৃত হয়ে যায় এবং ইহরামের কাপড় দিয়ে কাঁধ ও শরীর আবৃত থাকে।
  • মহিলারা মুখমণ্ডল এবং হাতের কব্জি খোলা রাখবেন, নেকাব বা বোরকা দ্বারা মুখমণ্ডল সবসময় ঢাকা রাখা যাবে না। তবে গায়ের মাহরাম পুরুষদের সামনে বা মাঝে গেলে তখন মুখমণ্ডল আবৃত করবেন।
  • উত্তম হলো, কোনো ফরয সালাতের পূর্বে ইহরামের কাপড় পরা ও সালাত আদায় করা। আর ফরয সালাতের সময় না হলে তাহিয়্যাতুল ওযুর ২ রাকাত সালাত পড়া। সালাতের পর ইহরামের নিয়ত না করে বিমানে উঠবেন। যেহেতু নিয়ত করেন নি তাই তালবিয়াহ পাঠ থেকে বিরত থাকুন।
  • যে কোনো ফরয সালাতের পর ইহরাম করা মুস্তাহাব। যদি কোনো ফরয সালাতের পর ইহরাম করা হয়, তাহলে স্বতন্ত্র সালাতের প্রয়োজন নেই। অন্য সময় ইহরাম বাঁধলে ২ রাকাত সালাত আদায় করে নিবেন। এ দু’রাকাত সালাত কি ইহরামের সালাত না তাহিয়াতুল অযুর -এ ব্যাপারে আলেমদের মাঝে মতভেদ আছে। তবে বিশুদ্ধতম ও গ্রহণযোগ্য মত হলো, এটি তাহিয়্যাতুল অযু হিসাবে আদায় করা হবে। ইহরামের জন্য আলাদা কোনো সালাত নেই। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ফরয সালাত আদায়ের পর ইহরামের নিয়ত করেছিলেন। (সুনান নাসাঈ)।
  • মীকাতের কাছাকাছি যখন পৌঁছাবেন তখন ইহরাম করার জন্য প্রস্তুতি নিবেন। পুরুষরা শরীরে তৃতীয় কোনো কাপড় থাকলে তা খুলে রাখবেন, মাথা থেকে টুপি সরিয়ে ফেলবেন। তবে শীত নিবারনের জন্য গায়ে চাদর বা কম্বল ব্যাবহার করতে পারেন।
  • মীকাতের স্থান থেকেই উমরাহর নিয়ত করবেন অর্থাৎ ইহরাম করবেন; এমনটি করা ওয়াজিব। মীকাতের কাছাকাছি পৌঁছলে বিমানের পাইলট ঘোষণা দিয়ে জানিয়ে দেবেন। জলদি ইহরাম বাঁধুন কারণ বিমান খুব দ্রুত মীকাত অতিক্রম করে চলে যাবে। অনেকে জেদ্দা বিমানবন্দরে পৌঁছালে নিয়ত করেন ও তালবিয়াহ পাঠ করেন, এমন কাজ করার কোনো নিয়ম নেই।

আপনি যখন মীকাতে কাছাকাছি পৌঁছাবেন কেবল তখনই শুধুমাত্র উমরাহর নিয়ত (হজ এর নয়, যেহেতু আপনি তামাত্তু হজ পালনকারী) করবেন, এমনকি ঋতুবর্তী মহিলারাও মীকাত থেকে উমরাহর নিয়ত করবেন। আপনি মনে মনে বলুন: لَبَّيْكَ عُمْرَةً “লাব্বাইকা উমরাহ’’ অর্থাৎ আমি উমরাহ করার জন্য হাযির’’। অথবা বলুন, اللهم لَبَّيْكَ عُمْرَةً “আল্লাহুম্মা লাব্বাইকা উমরাহ’’। অর্থাৎ হে আল্লাহ আমি উমরাহ করার জন্য হাযির।”

আরও পড়তে পারেন-

এবার স্বশব্দে তাওহীদ সম্বলিত তালবিয়াহ পাঠ শুরু করুন এবং মসজিদে হারামে তাওয়াফ শুরুর আগ পর্যন্ত এ তালবিয়াহ পাঠ চলতে থাকবে।

لَبَّيْكَ اَللهم لَبَّيْكَ، لَبَّيْكَ لَا شَرِيْكَ لَكَ لَبَّيْكَ، إِنَّ الْحَمْدَ وَالنِّعْمَةَ لَكَ وَالْمُلْكَ، لَا شَرِيْكَ لَكَ

‘‘লাব্বাইক আল্লাহুম্মা লাব্বাইক, লাব্বাইকা লা শারিকা লাকা লাব্বায়িক, ইন্নাল হামদা ওয়ান্নি‘মাতা লাকা ওয়াল মুলক, লা শারিকা লাক’’।

‘‘আমি হাযির, হে আল্লাহ! আমি হাযির। আমি হাযির, তোমার কোনো শরীক নেই, আমি হাযির। নিশ্চয় সকল প্রশংসা ও নি‘আমত তোমারই এবং রাজত্বও তোমারই, তোমার কোনো শরীক নেই’’। (সহীহ বুখারী, হাদীস নং ৫৪৬০, ৫৯১৫; সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ১১৮৪)।

উমরাহ সম্পন্ন করতে না পারার ভয় থাকলে (যদি কোনো প্রতিবন্ধকতা, বাধা অথবা অসুস্থতার কারণে না পারেন) তবে এ দো‘আ পাঠ করবেন:

فَإِنْ حَبَسَنِيْ حَابِسٌ فَمَحِلِّيْ حَيْثُ حَبَسْتَنِيْ

‘‘ফা ইন হাবাসানী হা-বিসুন, ফা মাহিল্লী হায়ছু হাবাসতানি’’।

‘‘যদি কোনো প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হই, তাহলে যেখানে তুমি আমাকে বাধা দিবে, সেখানেই আমার হালাল হওয়ার স্থান হবে’’। (মিশকাত, হাদীস নং ২৭১১)।

  • তালবিয়াহ একটু উচু স্বরেই পাঠ করা উত্তম। তবে তালবিয়াহ খুব উচ্চস্বরে অথবা সমস্বরে পাঠ করবেন না যা অন্যদের বিরক্তির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। আর মহিলারা তালবিয়াহ পাঠ করবেন নিচু স্বরে অথবা মনে মনে। এখন আপনার ইহরাম করা হয়ে গেছে; এ ইহরাম করার কাজটি ছিল ফরয।
  • তালবিয়াহর মাধ্যমে তাওহীদ চর্চা দৃশ্যমান। একে হজের স্লোগান বলা হয়। তালবিয়াহ বেশি বেশি পড়া মুস্তাহাব। দাঁড়িয়ে, বসে, শুয়ে, অযু, বে-অযু; সর্বাবস্থায় তালবিয়াহ পড়া যায়। (ইবন খুযাইমাহ. হাদীস নং ২৬২৮; সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ২১৯০)।
  • কেউ যদি মীকাত অতিক্রম করে ফেলেন কিন্তু ইহরাম করতে বা উমরাহর নিয়ত করতে ব্যর্থ হন তাহলে আবার উক্ত মীকাতের স্থানে ফিরে গিয়ে ইহরাম করতে হবে। যদি এটা করা সম্ভব না হয় তবে মীকাতের কথা মনে হওয়ার সাথে সাথেই ইহরাম করতে হবে। এমতাবস্থায় এ নিয়ম লঙ্ঘনের জন্য হারাম এলাকার মধ্যে কাফ্ফারা স্বরূপ একটা দম (পশু যবেহ) অবশ্যই করতে হবে। এ পশুর মাংস সম্পূর্ণ মিসকিন ও গরিবদের মাঝে বিলিয়ে দিতে হবে। এ মাংস থেকে কোনো অংশ নিজে গ্রহণ করতে পারবে না।
  • অনেকে ইহরাম না করে মীকাত অতিক্রম করে ফেললে আয়েশা মসজিদে গিয়ে উমরাহর নিয়ত করেন ও ইহরাম বাঁধেন – যার কোনো ভিত্তি নেই।

 ইহরাম ও তালবিয়ার ক্ষেত্রে প্রচলিত ভুলত্রুটি ও বিদ‘আত

  • উমরাহ বা হজের নিয়ত থাকা পরও ইহরাম না বেঁধে মীকাত অতিক্রম করা।
  • মীকাতের আগেই ইহরাম করা ও উচ্চস্বরে হজ বা উমরাহর নিয়ত করা।
  • এ কথা মানা, কথা না বলে মৌনতার সাথে হজ-উমরাহ পালন করা উত্তম।
  • যাত্রা শুরুর সময় বিমানবন্দরে পৌঁছেই ইহরাম করার আগেই তালবিয়াহ পাঠ শুরু করা, অথবা দল বেঁধে সমবেত কণ্ঠে তালবিয়াহ পাঠ করা।
  • কোনো এক নির্দিষ্ট নিয়মে ইহরামের কাপড় পরতে হবে এ কথা মান্য করা।
  • ইহরামের কাপড় ডান বগলের নিচ দিয়ে এবং বাম কাঁধের উপর দিয়ে পরা। বস্তুত এটা কেবল প্রথম তাওয়াফের সুন্নাত। অন্য সময় কাঁধ ঢেকে রাখতে হবে।
  • ইহরাম অবস্থায় তালবিয়ার স্থলে উচ্চস্বরে সমবেত কণ্ঠে তাকবীর পাঠ করা।
  • তালবিয়ার আগে বা পরে ‘আলহামদুল্লিাহ ইন্নি উরিদুল…’ দো‘আ পাঠ করা।
  • ইহরাম বেঁধে আয়েশা/তান‘ঈম মসজিদে সালাত আদায় করতে যাওয়া।
  • কিছু বইয়ের নির্দেশনা অনুসারে নির্দিষ্ট কিছু শর্তে বিশেষ ধরনের জুতা পরা।
  • ইহরাম ছাড়া মীকাতে ঢুকে আয়েশা মসজিদে গিয়ে উমরাহর নিয়ত করা।
  • ইহরামের কাপড় পরে এ কথা মানা যে সুরা-কাফিরুন ও সুরা-ইখলাস দিয়ে ইহরামের দুই রাকাত সালাত আদায় করতে হবে।
  • মীকাত এলাকায় ভেতরে প্রবেশের পর মীকাত সীমানার বাইরে যাওয়া। যাওয়ার পর সেখান থেকে ইহরাম না করে ফিরে আসা।
  • জেদ্দা বিমানবন্দরে প্রবেশের ও অবতরনের তথাকথিত দো‘আ পাঠ করা।

 ইহরাম অবস্থায় যেসব কাজ করতে বাধা নেই-

  • হাতঘড়ি, চশমা, হেডফোন, বেল্ট, মানিব্যাগ, শ্রবণযন্ত্র ব্যবহার করা যাবে। মহিলারা আংটি ও গলায় চেইন পরতে পারবেন।
  • ছাতা, বাস ও গাড়িসহ তাবু, সিলিংয়ের ছায়ায় আশ্রয় নেওয়া যাবে।
  • লাগেজ, ম্যাট্রেস ইত্যাদি মাথায় বহন করা।
  • জখম/ আহত স্থানে ব্যান্ডেজ পরা যাবে।
  • চশমা, ঘড়ি, টাকা ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র বহন করার জন্য সেলাইযুক্ত ছোট ব্যাগ ব্যবহার করা যাবে।
  • পরিষ্কার পরিচছন্নতার জন্য পরিধানের ইহরাম কাপড় পরিবর্তন করা যাবে। ইহরামের কাপড় ধৌত করা যাবে।
  • গোসল করা যাবে। অনিচ্ছাকৃত ও অপ্রত্যাশিত ভাবে শরীরের কোনো চুল/লোম উঠে যাওয়া।
  • গৃহপালিত পশু জবাই করা যাবে, মাছ ধরা যাবে।
  • মানুষের জন্য ক্ষতিকর কোনো প্রাণী কর্তৃক আক্রান্ত হলে তা তাড়িয়ে দেওয়া বা আত্মরক্ষার জন্য প্রয়োজনে হত্যা করা; যেমন- বন্য কুকুর, ইঁদুর, কাক, সাপ, বিচ্ছু, চিল, মশা, মৌমাছি ও পিঁপড়া ইত্যাদি। (নাসাঈ, হাদীস নং ২৮৩৫; তিরমিযী, হাদীস নং ৮৩৮)।
  • আত্মরক্ষার জন্য চোর/ডাকাতকে আঘাত করা।
  • ঠান্ডা থেকে বাঁচার জন্য শরীর আবৃত করার জন্য কম্বল, মাফলার ব্যবহার করা যাবে।

 ইহরামরত অবস্থায় যেসব বিষয় নিষিদ্ধ

  • চুল, নখ ও দাঁড়ি কাটা। (তবে মাথায় চিরুনি করার সময় যদি কোনো চুল অনিচ্ছাকৃতভাবে পড়ে যায় বা উঠে যায় কিংবা অসুস্থতা ও উকুনের কারণে যদি চুল ফেল দিতে হয় অথবা ভুলক্রমে কেউ যদি নক বা চুল কাটে, তাহলে সেটা ক্ষমাযোগ্য)
  • দেহে, কাপড়ে, খাবার ও পানিতে সুগন্ধি ব্যবহার করা। সুগন্ধিযুক্ত সাবান, শ্যাম্পু ও পাউডার ব্যবহার করা। [ইহরাম করার আগের কোনো সুগন্ধি যদি দেহে থাকে তবে তাতে কোনো দোষ নেই, তবে কাপড়ের সুগন্ধি ধুয়ে ফেলতে হবে]। (সহীহ সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ৪/৩৮৭,৩৮৮)।
  • হারাম এলাকার মধ্যে কোনো গাছ কাটা, পাতা ছেড়া বা উপড়ে ফেলা। এটাও হজে আসা সকল মুসলিমের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য, সে ইহরাম অবস্থায় থাক বা না থাক।
  • হারামের সীমানার মধ্যে কোনো ধরনের স্থলচর প্রাণী শিকার করা বা বন্দুক তাক করা অথবা ধাওয়া করার মাধ্যমে শিকারে সহযোগিতা করা। এটা হজে আসা সকল মুসলিমের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য, সে ইহরাম অবস্থায় থাক বা না থাক। (সূরা আল-মায়েদা- ৯৬, ৯৭)।
  • অন্যের খোঁয়া যাওয়া কোনো জিনিস বা পরিত্যাক্ত কোনো বস্তু কুড়িয়ে নেওয়া। তবে মূল মালিক জানা থাকলে তার কাছে পৌঁছে দেওয়ার উদ্দেশ্যে তুলে নেওয়া যাবে। এটাও ইহরাম ও ইহরাম ছাড়া উভয় অবস্থার জন্যই প্রযোজ্য।
  • কোনো অস্ত্র বহন করা বা অন্য কোনো মুসলিমের সঙ্গে ঝগড়া-বিবাদে লিপ্ত হওয়া, সংঘর্ষে জড়িয়ে যাওয়া অথবা খারাপ ভাষায় গালিগালাজ করা। (সূরা আল-বাকারাহ- ১৯৭)।
  • বিয়ে করা বা বিয়ের প্রস্তাব পাঠানো বা অন্য কারো জন্য বিয়ের আয়োজন করা, যৌন সঙ্গম, হস্তমৈথুন, স্ত্রীকে উত্তেজনার সাথে আলিঙ্গন বা চুমু খাওয়া বা স্পর্শ করা বা মহিলাদের প্রতি এমন কোনো ইঙ্গিত করা যা আকাঙ্খার উদ্রেক করে। (সহীহ মুসলিম, হাদীস নং- ৫/২০৯)।
  • মহিলারা ইহরাম অবস্থায় হাত গ্লাভস বা নেকাব (শক্ত করে বাঁধা মুখোশ) পরা। তবে সামনে কোনো বেগানা পুরুষ চলে আসলে মাথার কাপড়ের কিছু অংশ দিয়ে মুখ ঢেকে নিবেন।
  • ইহরাম অবস্থায় পুরুষরা তাদের মাথায় ইহরামের কাপড় অথবা টুপি অথবা মাথার কভার দিয়ে আবৃত করতে পারবে না। আর যদি অনিচ্ছাকৃত বা ভুলক্রমে কেউ মাথা ঢেকে ফেলে তাহলে মনে হওয়ার সাথে সাথে তা খুলে ফেলতে হবে। তবে এজন্য কোনো কাফফারা আদায় করতে হবে না। (সহীহ মুসলিম ৪/৫৪৩, ২২৮৭)।
  • এছাড়া পুরুষরা ইহরাম অবস্থায় সেলাইযুক্ত কাপড় যেমন- গেনজি, শার্ট, প্যান্ট, আন্ডারওয়ার পরতে পারবে না। (সহীহ সহীহ মুসলিম, হাদীস নং- ৪/৩৩১)।

 ইহরামের বিধান লঙ্ঘনের কাফফারা

  • ইহরাম অবস্থায় কারো সঙ্গে যৌন সঙ্গম করলে তার ইহরাম ভেঙে যাবে। হজ/উমরাহ সম্পূর্ণ বাতিল হয়ে যাবে। কিন্তু তবুও তাকে হজ/উমরাহর বাকি সব বিধান সম্পন্ন করতে হবে এবং তাকে কাফফারা হিসেবে হারাম এলাকার মধ্যে একটি ফিদইয়া/দম (পশু জবাই) করতে হবে এবং একনিষ্ঠভাবে আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করতে হবে। আবার পরবর্তীতে তাকে হজ/উমরাহর জন্য আসতে হবে বা পুনরায় হজ/উমরাহ করতে হবে।
  • কেউ যদি কাউকে ইহরাম অবস্থায় কোনো একটি নিষিদ্ধ কাজ করতে বাধ্য করে অথবা অন্য কোনো কারণে বাধ্য হয়ে ইহরাম অবস্থায় নিষিদ্ধ কোনো কাজ করে তাহলেও তাকে কোনো ফিদইয়া দিতে হবে না।
  • ইহরাম অবস্থায় স্বপ্নদোষ হলে তাতে ইহরাম নষ্ট হবে না। ফরয গোসলের মাধ্যমে নাপাক ধুয়ে পরিষ্কার করতে হবে। এ জন্য অতিরিক্ত আরেকটি ইহরাম কাপড় রাখা উত্তম।
  • কেউ যদি সজ্ঞানে বা ইচ্ছাকৃতভাবে ইহরাম অবস্থায় নিষিদ্ধ কোনো কাজ করে তাহলে কাফ্ফারা (ফিদইয়া/দম) আদায় করতে হবে। (সূরা আল-বাকারাহ- ১৯৬)।
  • ফিদইয়া/দম: হারাম এলাকার মধ্যে কাফ্ফারাস্বরূপ একটি পশু (উট বা গরুর এক সপ্তমাংশ/ পূর্ণ এক ছাগল/ পূর্ণ এক ভেড়া) যবেহ করা যা কোরবানির উপযুক্ত এবং সম্পূর্ণ মাংস মিসকিন ও গরীবদের মাঝে বিতরণ করে দেওয়া অথবা তিন দিন সাওম রাখা অথবা ৬ জন গরীব লোককে এক বেলা খাওয়ানো (প্রত্যেককে অন্তত অর্ধ সা‘ বা ১.২০ কেজি পরিমাণ খাবার দেওয়া)। (সহীহ বুখারী ও মুসলিম)।
  • ইহরামের বিধিবিধান ও ফিদইয়া/দম বিষয়ে আরও বিস্তারিত ও খুটিনাটি বিষয় জানতে কয়েকটি বই পড়ুন।
  • মক্কার হারাম এলাকার সীমা: পূর্বে ১৬ কিলোমিটার (জা‘রানা), পশ্চিমে ১৫ কিলোমিটার (হুদায়বিয়াহ), উত্তরে ৭ কিলোমিটার (তান‘ঈম), দক্ষিণে ১২ কিলোমিটার (আদাহ), উত্তর-পূর্বে ১৪ কিলোমিটার (নাখলা উপত্যকা)।
  • জিবরীল আলাইহিস সালামের মাধ্যমে ইবরাহীম আলাইহিস সালাম মক্কার সম্মানে হারাম এলাকার সীমানা নির্ধারণ করেন। হারামের সীমানার মধ্যে নিরাপত্তা দেওয়া হয়েছে। হারামের সীমানার মধ্যে অমুসলিমদের প্রবেশের কোনো অনুমতি নেই।

লেখক: শায়খুল হাদিস- তিলপাড়া মদিনাতুল উলুম ইসলামিয়া মাদ্রাসা, খিলগাঁও, ঢাকা ও মিফতাহুল উলূম মাদ্রাসা, বাড্ডা, ঢাকা এবং ব্যবস্থাপনা পরিচালক- সানমুন ট্যুরস এন্ড ট্রাভেলস, নয়াপল্টন, ঢাকা।

উম্মাহ২৪ডটকম: এমএ

উম্মাহ পড়তে ক্লিক করুন-
https://www.ummah24.com

দেশি-বিদেশি খবরসহ ইসলামী ভাবধারার গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে ‘উম্মাহ’র ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।