Home ফিকহ ও মাসায়েল ওয়াজ-মাহফিল আয়োজনে শরীয়তের আলোকে যেসব দিক খেয়াল রাখা জরুরি

ওয়াজ-মাহফিল আয়োজনে শরীয়তের আলোকে যেসব দিক খেয়াল রাখা জরুরি

।। মাওলানা মুফতি রাশেদুল ইসলাম ।।

ওয়াজ শব্দের শাব্দিক অর্থ উপদেশ, নসিহত। আল্লাহ তাআলা কুরআন শরীফে বিভিন্নভাবে ওয়াজ শব্দটা ব্যবহার করেছেন। যেমন- এক জায়গায় আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন- আল্লাহ তোমাদেরকে উপদেশ দেন, যাতে তোমরা শিক্ষা গ্রহণ করো। (সূরা নাহল- ৯০)।

অন্যত্র ইরশাদ করেন- তুমি উপদেশ দিতে থাকো কারণ, উপদেশই মুমিনদের উপকারে আসে। (সূরা যারিয়াত- ৫৫)।

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উপদেশের মাধ্যমে মানুষকে দ্বীনের পথে আহ্বান করতেন। তিনি এক হাদিসে ইরশাদ করেন- সদুপদেশই দ্বীন। (মুসলিম শরীফ, হাদিস নং- ৫৫)।

রাসূলুল্লাহ (সা.)এর উত্তরাধিকারী হিসেবে মানুষকে সদুপদেশ দেওয়া ওলামায়ে কেরামের দায়িত্ব। আল্লাহ তাআলা বলেন- তোমাদের মধ্যে এমন একদল যেন থাকে যারা কল্যাণের দিকে আহ্বান করবে এবং সৎকাজের নির্দেশ দিবে ও অসৎকাজে নিষেধ করবে। আর তারাই সফলকাম। (সূরা আলে ইমরান- ১০৪)।

সুতরাং বুঝা গেল ওয়াজ তথা দ্বীনি উপদেশ প্রদান ইসলামে নতুন কোন সংযোজন নয়; বরং আল্লাহ কর্তৃক নির্দেশিত ও রাসূল (সা.) কর্তৃক প্রদর্শিত পন্থা ।

যুগ যুগ ধরে ওয়ায মাহফিল তার নিজস্ব গতি ও নিয়মে চলে আসছে। মুসলমানদের ঈমান-আকাইদ, আমলী সংশোধন, আত্মিক পরিশুদ্ধি এবং সচেতন হওয়ার ক্ষেত্রে ওয়াজ মাহফিলের গুরুত্ব অপরিসীম। মানুষ ও সমাজের ইতিবাচক পরিবর্তনে বর্তমানে মসজিদ, মাদরাসা কেন্দ্রিক, প্রতিটি গ্রাম-গঞ্জে, পাড়া-মহল্লায় এবং জনসমাগমস্থলের মোড়ে মোড়ে বিভিন্ন সামাজিক সংগঠন, যুব সংঘ, সংস্থা, পরিষদ, ব্যক্তি ও ব্যবসায়ীদের উদ্যোগে আয়োজিত মাহফিলের ইতিবাচক ভূমিকা অনেক। মদ, জুয়া, যাত্রা, নর্তকী ও গানের কনসার্টের বিপরীতে ওয়াজ মাহফিলের আয়োজন সত্যিই খুব প্রশংসার দাবি রাখে। তবে মাহফিলগুলো যাতে নিছক রেওয়াজ ও লোক দেখানো বার্ষিক অনুষ্ঠান পালনের উদ্দেশ্যে না হয়, সেদিকে অবশ্যই খেয়াল রাখতে হবে।

বর্তমানে প্রচলিত ওয়াজ-মাহফিলের আয়োজন কিছু ফায়দার দিকে লক্ষ করে যদিওবা মুস্তাহাব হওয়ার দাবি রাখে, কিন্তু শরীয়তের স্বতঃসিদ্ধ একটি উসূল হলো- কোন মুস্তাহাব কাজ আঞ্জাম দেওয়ার জন্য যখন বিভিন্ন প্রকারের শরীয়ত বিরোধী কাজের সম্মুখীন হতে হয়, তখন উক্ত মুস্তাহাব কাজটি আর মুস্তাহাব হিসেবে বাকি থাকে না; বরং মাকরুহ ও নাজায়েয হয়ে যায়। ফুকাহায়ে কেরাম এ বিষয়ে বিভিন্ন জায়গায় সুস্পষ্ট বর্ণনা করেছেন- যেমন এক জায়গায় বলেছেন- إذا تردد أمر بين البدعة و السنة فترك السنة أولى অর্থাৎ যখন কোন কাজ বিদআত এবং সুন্নাত হওয়ার মাঝে সংশয়, হয় তখন উক্ত কাজ ছেড়ে দেওয়াই উত্তম।

ফুকাহায়ে কেরাম আরো বলেছেন- دفع الضرر مقدم من جلب المنفعة অর্থাৎ যখন কোন কাজে লাভ- ক্ষতি উভয়টির আশঙ্কা থাকে, তখন যে পথ অবলম্বন করলে ক্ষতি দূর করা যায় সেটি অবলম্বন করাই উত্তম।

মুফতি আযম মুফতি ফয়যুল্লাহ (রহ.) বলেন, বর্তমান সময়ে মাহফিল আয়োজন করতে যে সমস্ত ক্ষতির সম্মুখীন হতে হয়, সেগুলোর দিকে লক্ষ করলে মাহফিল আয়োজন করা হারাম হওয়া উচিত। তবে কিছু ফায়দার দিকে লক্ষ করে মাহফিল আয়োজন মুস্তাহাব বটে। কিন্তু উসূলে ফিকহের একটি স্বতঃসিদ্ধ উসূল হলো- যখন মুস্তাহাব আর হারামের মাঝে বৈপরীত্য হয় তখন হারাম প্রাধান্য পায়।

সুতরাং ফুকাহায়ে কেরামের এ সমস্ত বক্তব্যের ভিত্তিতে এ কথা সুস্পষ্টভাবে বলা যায়, যে বর্তমানে প্রচলিত মাহফিল আয়োজন করতে গিয়ে উপস্থিত অনুপস্থিত সকলের জন্যই ওয়াজ শোনার ব্যবস্থা করার জন্য, দূরদূরান্ত পর্যন্ত মাইক ছড়িয়ে দেওয়া মোটেও কাম্য নয়। এতে নফল নামায, তিলাওয়াতে কুরআন, যিকির-আযকার, অসুস্থ ব্যক্তির বিশ্রাম এবং সাধারণ মানুষের রাতের ঘুমে বিঘ্ন ঘটে। ইসলাম যেখানে পশু পাখির অধিকারের বিষয়েও আমাদেরকে সতর্ক করেছে সেখানে কোন অসুস্থ মুসলমান কিংবা অমুসলমানকে কষ্ট দেওয়া কারও ব্যক্তিগত কাজে ব্যাঘাত ঘটানো কীভাবে বৈধ হতে পারে? বর্তমান উচ্চ আওয়াজের যুগে যদি কেবল মাহফিলের মাঠেই মাইক সীমিত রাখা হয় তবুও হয়তো তা ছড়িয়ে যাবে আশেপাশের কিছু এলাকা জুড়ে। হয়তো তাতেও কারো কষ্ট হবে! অপরদিকে মাহফিলের আয়োজনের কথা যখন নানাভাবে মাইকিং, পোস্টার ইত্যাদি সম্ভাব্য সকল পদ্ধতিতে জানিয়ে দেওয়া হলো, তখন যার মনে এই ওয়াজ শোনার আগ্রহ সৃষ্টি হবে সে তো মাহফিলেই শরিক হবে। বিধায় দূর-দূরান্ত পর্যন্ত মাইক ছড়িয়ে দেওয়া কখনো জায়েয হবে না; বরং আগত শ্রোতাদের উপস্থিতি যতদূর পর্যন্ত বিস্তৃত হবে মাইকের সংযোগও ততদূর পর্যন্ত দেওয়া যেতে পারে।

আরও পড়তে পারেন-

দূর-দূরান্ত পর্যন্ত মাইক ছড়িয়ে দেওয়ার কারণে কেউ যদি আপত্তি তুলেন তাকে মাহফিল বিরোধী, কুরআনের আওয়াজ সহ্য হয় না ইত্যাদি বলে ট্যাগ লাগানো শরীয়তের বিধান মতে জায়েয হবে না। বরং এ কথা গুলো বলার দ্বারা মুসলমানকে কষ্ট দেওয়ার কারণে যে বলবে সে হারাম কাজে লিপ্ত হয়ে কবিরা গুনাহকারী হিসেবে সাব্যস্ত হবে। এবং দূরদুরান্ত পর্যন্ত মাইক লাগালে যদিওবা মহিলারা ঘরে বসে ওয়াজ শুনতে পায় এবং গভীর রাত পর্যন্ত মাহফিল চললে দূর-দূরান্ত থেকে আগন্ত লোকদের সহজে গন্তব্যস্থলে পৌঁছে যাওয়া সম্ভব হয়। এটি যদিওবা ভালো এবং প্রশংসনীয় চিন্তাধারা কিন্তু তাতে অনেক মানুষের কাজে বিঘ্ন ঘটার কারণে তা বৈধ হবে না।

ওয়াজ মাহফিল আয়োজন করার ক্ষেত্রে নিম্নোক্ত বিষয়াবলীর প্রতি লক্ষ রাখা উচিত-

১. মাহফিলের সময়সীমা- গভীর রাত পর্যন্ত ওয়াজ করার নিয়ম চালু না রেখে রাত নয়টা থেকে দশটার মধ্যেই মাহফিল শেষ করে দেওয়া। কারণ, সারা রাতব্যাপী ওয়াজ হলে মানুষের ওয়াজের প্রতি আগ্রহ থাকে না। হুযূর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হাদিস শরীফে ততক্ষণ পর্যন্ত ওয়াজ করতে বলেছেন যতক্ষণ লোকদের আগ্রহ থাকে। (বুখারী, হাদিস- ৬৩৩৭)।

২. ওয়াজের মাঝে সময়মতো ইশার নামাযের জামাত পড়ে নেওয়া। যাতে মাহফিলের মাইক দ্বারা পার্শ্ববর্তী এলাকার মসজিদের জামাতের কোন ধরনের সমস্যা না হয় এবং মাহফিলে আগত মুসল্লীগণ ইশার জামাতের ব্যাপারে পেরেশান না হয় এবং ইশার নামাযের পর দীর্ঘ সময় ওয়াজ না করা। কারণ, রাসূলুল্লাহ (সা.) রাতে তাড়াতাড়ি শুয়ে যাওয়া পছন্দ করতেন এবং ইশার নামাযের পর আলাপচারিতা অপছন্দ করতেন। (বুখারী, হাদিস- ১১৮)।

তাছাড়া রাতে দেরিতে ঘুমানো শরীরের জন্যও ক্ষতিকর। তাহাজ্জুদ ও ফজরের নামায আদায়ের জন্য রাতে তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়া সবচেয়ে বেশি সহায়ক ভূমিকা রাখে। দীর্ঘ রাত পর্যন্ত ওয়াজ চলতে থাকলে শ্রোতাদের ফজরের নামায আদায়ে ব্যাঘাত ঘটার প্রবল আশঙ্কা দেখা দেয়। আর যে ওয়াজের কারণে ফজরের নামায কাযা হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে, তা কখনো জায়েয হবে না।

৩. মাহফিলে এমন আলোচকদেরই দাওয়াত করা, যারা শুধু আল্লাহর সন্তুষ্টি, মানুষের কল্যাণ ও দায়িত্ববোধ থেকে ওয়াজ করতে চান। পাশাপাশি কুরআন হাদিসের পর্যাপ্ত জ্ঞান রাখেন। বিনম্র ও সুন্দরভাবে উপস্থাপন করতে পারেন এমন দায়িত্বশীল বিচক্ষণ আলেমদেরই দাওয়াত করা উচিত।

৪. ওয়াজের নামে যারা বিভিন্ন শ্রেণি-গোষ্ঠীর সমালোচনা, দৃষ্টিকটূ আচরণ, অঙ্গভঙ্গি, অহেতুক উত্তেজনার সৃষ্টি, বানোয়াট ভিত্তিহীন কিচ্ছা-কাহিনী বলে শ্রোতাদের কখনো হাসায় আবার কখনো কাঁদায় তাদেরকে দাওয়াত থেকে বিরত থাকা উচিত।

৫. মাহফিলের মধ্যে কোন হক্কানী পীর শ্রোতাদের যিকিরের মশক করাতে চাইলে, মাইক ছাড়াই করাবো মাইকে যিকির করা শরীয়তের দৃষ্টিতে পছন্দনীয় নয়।

৬. বয়ানের মধ্যে বক্তাদের জন্য উচিত ইসলামের পাঁচটি গুরুত্বপূর্ণ ফরযে আইন, তথা আকাইদ, ইবাদত, মুআমালাত, (লেনদেন) মুআশারাত, (সামাজিকতা) এবং আখলাক (আত্মশুদ্ধি) বিষয়ে আলোচনা করা এজন্য মাহফিল কর্তৃপক্ষ কর্তৃক বক্তাদেরকে ওয়াজের বিষয়ে বণ্টন করে দেওয়াই ভালো।

৭. মাহফিলে কোন জাহেল মূর্খকে বক্তা না বানানো। কারণ, হাদিস শরীফে এই বিষয়কে হুযূর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কেয়ামতের আলামত বলেছেন। (বুখারী, হাদিস- ৫৯)।

৮. প্রকাশ্য ফাসেক বেআমল কোন লোককে মাহফিলের সভাপতি বা পরিচালক কিংবা বিশেষ অতিথি ইত্যাদি বানানো থেকে বিরত থাকা উচিত।

৯. মাহফিলের কোন ছবি এবং কোন প্রকার ভিডিও ধারণ করা থেকে বিরত থাকা। শরীয়তে এটি হারাম। এতে দ্বীনি মাহফিলের লক্ষ্য- উদ্দেশ্য বরবাদ হয়ে যায়। দ্বীনের খেলাফ কর্মকাণ্ড প্রচার প্রসার লাভ করে।

১০. চলাচলের রাস্তা বন্ধ করে মাহফিল আয়োজন করা থেকে বিরত থাকা। এতে জনসাধারণের কষ্ট হয় যা শরীয়ত বিরোধী কাজ।

১১. বিশেষভাবে মাদরাসাকেন্দ্রিক যে মাহফিলগুলো হয়, উক্ত মাহফিল আয়োজন করার জন্য মাদরাসা কর্তৃপক্ষ মাদরাসার ছাত্রদেরকে ধান-চাউল, টাকা-পয়সা কালেকশন করার জন্য জনসাধারণ, মানুষের বাড়িতে, দোকানে পাঠানো থেকে বিরত থাকা উচিত। এ কাজের দ্বারা সাধারণ মানুষ পেরেশানির শিকার হোন, মাদরাসা শিক্ষা ব্যবস্থার উপর অসন্তুষ্টি প্রকাশ করেন, এমনকি ওলামা, তলাবা এবং দ্বীনি মাদরাসার ব্যাপারে অপমানজনক বাক্য ব্যবহার করে থাকেন।

যার ফলে ওলামা, তলাবা ও সাধারণ মানুষের কাছে অপমানিত হোন। এমনকি মাদরাসার ছাত্রদের অন্যের প্রতি মুখাপেক্ষিতা, কৃত্রিমতা ইত্যাদি স্বভাব তৈরি হয়। (ইজহারুল মুনকারাতিশ শায়েআ ফিল মাদারিস ওয়াল জালছাতির রায়িজা -মুফতি আযম ফয়যুল্লাহ (রহ.), পৃষ্ঠা- ৯-১০)।

মোটকথা, ওয়াজ মাহফিল যদি সুসংগঠিত ও পরিকল্পিত হয় তাহলে সমাজে নীতি-নৈতিকতার চর্চা বৃদ্ধি পাবে। অপরাধ প্রবণতা কমবে। সুন্দর ও আদর্শ কল্যাণ সমাজ গড়ে তোলা সম্ভব হবে। কারণ, ঈমান, আমল, আদর্শ ও আচার-আচরণ শিক্ষার বড় একটি অংশ সাধারণ মানুষ ওয়াজ মাহফিল থেকে পেয়ে থাকে। ঈমানের বলে বলিয়ান ও আদর্শ মুসলিম হওয়ার দিকনির্দেশনা দেয়া হয় এদেশের ওয়াজ মাহফিলে। সমাজের মানুষের দ্বীনি চেতনা জাগ্রত করার ক্ষেত্রে ওয়াজ মাহফিলের ভূমিকা অনেক। সুতরাং এর আয়োজকগণ বিনিময় পাবেন, ইনশাআল্লাহ। তবে সাথে সাথে উপরিউক্ত বিষয়গুলোর প্রতি লক্ষ রাখা জরুরি এবং যে সমস্ত বিষয় মানুষকে কষ্টে ফেলে তা থেকে বিরত থাকা উচিত। তাহলেই আমাদের ওয়াজ মাহফিলগুলো হবে আরো সুন্দর, আরো সার্থক।

লেখক: সিনিয়র উস্তাদ ও মুফতি দারুল উলূম হাটহাজারী।

উম্মাহ২৪ডটকম: এমএ

উম্মাহ পড়তে ক্লিক করুন-
https://www.ummah24.com

দেশি-বিদেশি খবরসহ ইসলামী ভাবধারার গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে ‘উম্মাহ’র ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।