Home প্রবন্ধ-নিবন্ধ ইসরায়েলের আত্ম-প্রবঞ্চনার যুদ্ধ!

ইসরায়েলের আত্ম-প্রবঞ্চনার যুদ্ধ!

গাজা শহরের একটি আবাসিক ভবনে ইসরায়েলি হামলার পর বিলাপ করছেন এক ফিলিস্তিনি নারী। ২৫ অক্টোবর তোলা ছবি/ রয়টার্স।

মারওয়ান বিশারা (আল জাজিরা): তৃতীয় সপ্তাহে পা রেখেছে গাজায় ইসরায়েলের যুদ্ধ। এরমধ্যেই হত্যা করা হয়েছে ৫,৬০০-র বেশি ফিলিস্তিনিকে। আহত করা হয়েছে অজস্র মানুষকে, বাস্তুচ্যুতের সংখ্যা ১০ লাখ ছাড়িয়ে গেছে। আন্তর্জাতিক কিছু মহল এরমধ্যে যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানালেও – তাতে গাজার ২০ লাখের বেশি বাসিন্দার দুর্দশা বন্ধের কোন লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না।

ইসরায়েল তার প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই ফিলিস্তিনিদের মানুষ হিসেবে গণ্য করে না। বিষয়টিকে দিনে দিনে আরও বেশি আত্মস্থ করেছে জায়নবাদি রাষ্ট্র। ফলে গত ৭ অক্টোবরের হামাস যোদ্ধাদের হাতে বেসামরিক ইসরায়েলিদের হত্যার প্রতিশোধ নিতে এক অন্ধ আক্রোশ ও প্রাগৈতিহাসিক ঘৃণায় মত্ত ইসরায়েলি সমাজ।

এই অন্ধ আক্রোশকে এখন গণহত্যার পথে চালিত করছেন আত্মপ্রেমী ও চরমপন্থী এক ব্যক্তি: বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু – যিনি একজন দ্বিচারী, মজ্জাগত মিথ্যাবাদী। রাষ্ট্র ক্ষমতায় টিকে থাকতে যিনি সমস্ত কিছুই করেছেন এবং করবেন।

গত ৭ অক্টোবরে হামাসের হামলা ঠেকাতে – ইসরায়েলের সামরিক ও রাজনৈতিক যে ব্যর্থতা– সেজন্য নেতানিয়াহুর গোয়ার্তুমি, দুর্নীতি ও নির্মমতাই দায়ী। ফিলিস্তিনের জমিনে দখলদারিত্বকে স্থায়ী রূপ দিয়ে এবং গাজার লাখো মানুষকে খোলা আকাশের নিচের এক কারাগারে অবরুদ্ধ রেখে – বিনা বাধায় ফিলিস্তিনের ঐতিহাসিক সব জমিনকে ইসরায়েলের বৃহত্তর ভূখণ্ডের অংশ করতে পারবেন– এমনটাই ধরে নেন।

তার ধারণা ছিল, পশ্চিম তীরে ইহুদি বসতিগুলোর বিস্তার ঘটিয়ে ফিলিস্তিনিদের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বর্ণবাদী বান্টুস্তানে বন্দি করে রাখলে – তারা অসহায় চেয়ে চেয়ে দেখবে। কোন পাল্টা-আঘাত করবে না।

গাজায় ইসরাইলি হামলায় ক্ষতিগ্রস্ত একটি অর্থোডক্স গির্জা – ছবি : আলজাজিরা

শেষপর্যন্ত গত ৭ অক্টোবর এ গোয়ার্তুমির উপযুক্ত ফল পান নেতানিয়াহু। কারণ গোয়ার্তুমি কেবল নির্বুদ্ধিতার জন্ম দেয়। দম্ভ পরিণত হয় অপমানে, এবং চরম ব্যর্থতা জন্ম দেয় প্রহসনের। যেমনটা আরবি শব্দ ব্যবহার করে ইসরায়েলিরা বলে থাকে, ফাসলা (ব্যর্থতা) পরিণত হয় ফাদিহা’য় (কেলেঙ্কারিতে)।

আক্রমণ ঠেকাতে নিজ নিজ ব্যর্থতার দায় স্বীকার করেছেন ইসরায়েলের সামরিক বাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর প্রধানরা। কিন্তু, নেতানিয়াহু কোন দায় নিজের ঘাড়ে নেননি। যদিও, জাতীয় এই ট্রাজেডির জন্য অধিকাংশ ইসরায়েলি তাকেই দোষ দিচ্ছে।

এই পরিস্থিতিতে, পদত্যাগের বদলে – অপমানিত ও নির্লজ্জ এই প্রধানমন্ত্রী ওরফে যুদ্ধকালীন নেতা – সুর্নিদিষ্ট কোন কৌশল ছাড়া এক বিকৃত যুদ্ধ চালানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।

পশ্চিমা বিশ্বের যেসব নেতারা আগে নেতানিয়াহুর সাথে কিছুটা দূরত্ব বজায় রাখতেন, গণহত্যামূলক এই আগ্রাসনে তাদেরকেই এবার পাশে পেয়েছেন। অথচ কিছুদিন আগেও এই পশ্চিমা নেতারা– কট্টর বর্ণবাদী উন্মাদ ও ফ্যাসিস্টদের নিয়ে জোট গঠন করে জেলের বাইরে থাকার জন্য, ইসরায়েলের বিচার বিভাগের ক্ষমতা ক্ষুন্ন করার জন্য নেতানিয়াহুর সমালোচনা করতেন, এখন তাদেরকেই এ যুদ্ধের মদতদাতার ভূমিকায় দেখা যাচ্ছে।

এদের মধ্যে সর্বাগ্রে আছেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন; এ বছরের বেশিরভাগ সময় যিনি নেতানিয়াহুকে তিরস্কার করেছেন – তিনিই এখন নেতানিয়াহুকে আলিঙ্গন করেছেন এবং তাকে আরব ও ইসরায়েলি উভয় জনগণের আক্রোশ থেকে রক্ষা করছেন।

গাজায় নেতানিয়াহুর পরিচালিত মানবতাবিরোধী, গণহত্যামূলক যুদ্ধ সমর্থনে যুক্তরাষ্ট্রকে অঙ্গীকারবদ্ধ করেছেন বাইডেন। দিয়েছেন মার্কিন অস্ত্র সহায়তা, এমনকী হামাসের বিরুদ্ধে অভিযানে নগরযুদ্ধ পরিচালনার কারিগরি সহায়তাও দিচ্ছে তার প্রশাসন। কূটনৈতিক পর্যায়েও নেতানিয়াহুকে সব রকমের বাড়তি সুবিধা দিচ্ছে তার দেশ। এই সংঘাতে ইরানের জড়িয়ে পড়া ঠেকিয়ে ইসরায়েলকে সুরক্ষা দিতে পূর্ব ভূমধ্যসাগরে দুটি বিমানবাহী রণতরী মোতায়েনের নির্দেশও দেন বাইডেন।

একইভাবে, ইউরোপের বেশিরভাগ নেতারাই এবছরের অধিকাংশ সময় নেতানিয়াহুর প্রতি শীতল মনোভাব দেখালেও, এখন তারা নেতানিয়াহু সরকারকে এবং গাজায় পরিচালিত যুদ্ধকে সমর্থন দিচ্ছেন। তারা যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানাতে নারাজ এবং ক্রমবর্ধমান ইসরায়েলি যুদ্ধাপরাধকে ‘আত্মরক্ষার অধিকার’ বলে খোলা ছাড়পত্র দিচ্ছেন।

ইসরায়েলের এসব পশ্চিমা ভাঁড়েরা সব ধরনের অন্যায় উপায়ে আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন করতে ভালোবাসেন। ইসরায়েলের আত্মরক্ষার অধিকার থাকতে পারে, কিন্তু দশকের পর দশক ধরে চালিয়ে আসা সামরিক দখলদারিত্ব রক্ষার কোন অধিকার নেই, দীর্ঘকাল ধরে যেকাজে সহায়তা করেছে পশ্চিমারা। বরং আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী, ইসরায়েলের বর্ণবাদী ব্যবস্থার অধীনে বসবাসকারী শোষিত, নিপীড়িত ফিলিস্তিনি জনগণেরই আছে প্রতিরোধ চালিয়ে যাওয়ার অধিকার।

চলমান এ গণহত্যামূলক যুদ্ধ – যেটি পরিচালনা করছেন একজন ব্যর্থ প্রধানমন্ত্রী এবং যাকে নৈতিক সমর্থন দিচ্ছে তার পশ্চিমা মিত্ররা – সেটি কোনভাবেই আত্মরক্ষার লড়াই নয়; বরং একটি আত্ম-প্রবঞ্চনার যুদ্ধ। কারণ ইসরায়েলের ভ্রান্ত ধারণা, চিরকাল পেশিশক্তির জোরেই সে নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারবে।

কিন্তু, ফিলিস্তিনিদের পাইকারিভাবে হত্যা করা কি কখনো ইসরায়েলকে আরও উন্নত নিরাপত্তা দিয়েছে? উত্তর হলো– কোনদিন তা হয়নি, এবং হবেও না।

গাজার ওপর প্রাচীন যুগের মতো নিষ্ঠুর অবরোধ আরোপ করা হয়েছে, আর বোমাবর্ষণের তাণ্ডব চালিয়ে স্থল আগ্রাসনের পথ তৈরি করা হচ্ছে। কিন্তু, এতে আঞ্চলিকভাবে তীব্র প্রতিক্রিয়ার মুখে পড়বে ইসরায়েল। অনেকেরই আশঙ্কা, জায়নবাদী রাষ্ট্রের এই গণহত্যার পদক্ষেপ যুক্তরাষ্ট্রকে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের দিকে ঠেলে দেবে।

পশ্চিমা নেতারা আবেগতাড়িত মিথ্যাচার করে – ২০০১ সালে যুক্তরাষ্ট্রে আল কায়েদার হামলার সাথে হামাসের ইসরায়েলকে আক্রমণের তুলনা দিতে থাকলে এমন পরিণতি এড়াতে পারবেন না। কারণ, যুক্তরাষ্ট্রের ‘সন্ত্রাসবিরোধী’ যুদ্ধে ৯/১১ এর চেয়েও বেশি মার্কিন নাগরিক নিহত হয়েছে বিশ্বজুড়ে। একইসঙ্গে, প্রাণ গেছে লাখ লাখ নিরীহ মুসলমানের। ‘সন্ত্রাসবিরোধী’ এ লড়াই এমন অরাজকতার বীজ বুনে দেয়– যা আরও যুদ্ধ লড়ে বা সেনা পাঠানোর মাধ্যমেও গত দুই দশকে থামানো যায়নি।

আরও পড়তে পারেন-

দিনশেষে ‘সন্ত্রাসবিরোধী’ যুদ্ধ কেবল একটা জিনিসই প্রমাণ করেছে, আর সেটা হলো– কোন একটি অঞ্চলের সকল জনগণকে সামষ্টিক শাস্তি প্রদানসহ আন্তর্জাতিক আইনের অন্যান্য লঙ্ঘন- কখনো চরমপন্থাকে প্রশমিত করে না; বরং তারা সহিংসতার অনন্ত অনলে ঘৃতাহুতি দেয়। গাজায় ইসরায়েলের যুদ্ধ-বিষয়ক সাম্প্রতিক এক সংবাদ সম্মেলনে জাতিসংঘের সন্ত্রাসবাদ-বিরোধী বিশেষ র‍্যাপোর্টিয়ার ফিনৌলা নি আওলেইন যা গুরুত্ব দিয়ে তুলে ধরেছেন।

গাজার ফিলিস্তিনিদের ওপর ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর যুদ্ধাপরাধ যখন বাড়ছে, সেই ক্ষণে ইসরায়েলিদের স্বচ্ছ দৃষ্টিতে ভেবে দেখা উচিত – উপনিবেশবাদ ও দখলদারি তাদের কোথায় নামিয়ে এনেছে। অনন্ত ইসরায়েলি নিপীড়ন, বর্ণবাদ ও ফিলিস্তিনিদের নির্বিচার হত্যা বৃহত্তর অস্থিতিশীলতা, উগ্রবাদ ও সহিংসতার অনুকূল পরিবেশ তৈরি করেছে ফিলিস্তিন-সহ সমগ্র মধ্যপ্রাচ্যে।

গাজায় গণহত্যামূলক এ যুদ্ধ শান্তি প্রতিষ্ঠা করবে না, ইসরায়েলি সমাজকে নিরাপদ করবে না, এবং এই যুদ্ধের সমর্থক পশ্চিমা বিশ্বকেও না।

লেখক: কাতার-ভিত্তিক আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম আল জাজিরার জ্যেষ্ঠ রাজনৈতিক বিশ্লেষক মারওয়ান বিশারা। বিশ্ব রাজনীতি নিয়ে লেখালেখির জন্য তিনি প্রখ্যাত, এবং মার্কিন পররাষ্ট্রনীতি, মধ্যপ্রাচ্য ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষণে বিশ্বের অন্যতম স্বীকৃত একজন বিশেষজ্ঞ। আল জাজিরায় যোগদানের আগে অধ্যাপনা করেন ফ্রান্সের প্যারিসে আমেরিকান ইউনিভার্সিটিতে।

উম্মাহ২৪ডটকম: এসএ

উম্মাহ পড়তে ক্লিক করুন-
https://www.ummah24.com

দেশি-বিদেশি খবরসহ ইসলামী ভাবধারার গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে ‘উম্মাহ’র ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।