Home ওপিনিয়ন যুদ্ধের পর গাজায় শান্তি আনার যে প্রহসন করছে যুক্তরাষ্ট্র

যুদ্ধের পর গাজায় শান্তি আনার যে প্রহসন করছে যুক্তরাষ্ট্র

৫ নভেম্বর ২০২৩ দখলীকৃত পশ্চিম তীরে সাক্ষাৎ করেন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন ও ফিলিস্তিনি প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাস। ছবি- রয়টার্স।

।। মারওয়ান বিশারা ।।

যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যপ্রাচ্য নীতি এবং গাজায় ইসরায়েলের যুদ্ধ একই মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ। ফিলিস্তিনে একের পর এক যুদ্ধাপরাধ করে যাচ্ছে ইসরায়েল। এ অবস্থায় দেশটিকে যুক্তরাষ্ট্র যেভাবে রক্ষা করতে চাইছে, তাতে গোটা অঞ্চল আরেকটি যুদ্ধের মধ্যে পড়ার হুমকি তৈরি হয়েছে।

এক মাস আগে গাজায় ইসরায়েলি বাহিনী রক্তক্ষয়ী আক্রমণ শুরু করার পর বাইডেন প্রশাসন মধ্যপ্রাচ্যে দুটি বিমানবাহী রণতরীসহ এলিট নৌবাহিনী পাঠিয়েছে। এর উদ্দেশ্য যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিপক্ষদের সতর্ক করা এবং কঠিন পরিস্থিতির মধ্যেও মিত্রদের নির্ভার রাখা।

গাজায় ইসরায়েলি হামলায় প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষ হতাহত হচ্ছে। এ অবস্থায়ও আরব কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠকে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন ইসরায়েলের যুদ্ধ নিয়ে সব ধরনের সমালোচনা পাশ কাটিয়েছেন। বৈঠকে তিনি তোতা পাখির মতো কেবল ইসরায়েলের মিথ্যা বিবৃতিই আওড়েছেন। যুদ্ধবিরতি-সংক্রান্ত আলোচনাও প্রত্যাখ্যান করেছেন। এসবই যুদ্ধে ইসরায়েলের প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের শর্তহীন সমর্থনের বিষয়টি স্পষ্ট করে।

এদিকে আরব নেতাদের সঙ্গে যখন ব্লিঙ্কেনের বৈঠক চলছিল, তখনও গাজায় অব্যাহত ছিল ইসরায়েলি হামলা। ইসরায়েল যখন গাজার হাসপাতাল, স্কুল, মসজিদ, আবাসিক ভবনে বোমা হামলা বাড়াচ্ছে, ঘনবসতিপূর্ণ গাজা উপত্যকায় যখন তারা স্থল অভিযানের দিকে জোরালোভাবে অগ্রসর হচ্ছে, তখন বাইডেন প্রশাসন যুদ্ধ থামানোর বিষয়ে কথা বলার চেয়ে ভবিষ্যতের শান্তি নিয়েই কথা বলতে আগ্রহী।

যুদ্ধ শুরুর পর থেকে এক মাসের মধ্যে তিনবার মধ্যপ্রাচ্য সফর করলেন ব্লিঙ্কেন। সর্বশেষ গত সপ্তাহের সফরেও গাজায় ইসায়েলের যুদ্ধের ফলাফল এবং এ নিয়ে আরব দেশগুলোর ক্ষোভ ও হতাশা কমাতে ব্যর্থ হয়েছেন তিনি। তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করা প্রত্যেক আরব নেতাই ইসরায়েলের এই ‘যুদ্ধাপরাধের’ নিন্দা জানান। এক মাস ধরে চলা এ যুদ্ধে এ পর্যন্ত ১০ হাজারেরও বেশি মানুষ নিহত হয়েছে, যাদের মধ্যে বেশিরভাগই শিশু ও নারী।

আরও পড়তে পারেন-

ব্লিঙ্কেন মূলত যুদ্ধ থেকে নজর সরিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছেন। তিনি আরব নেতাদের যুদ্ধবিরতির বিষয়ে কথা না বলার জন্য মানানোর চেষ্টা করছেন। এর বদলে তিনি বহুল আকাঙ্ক্ষিত ‘দীর্ঘমেয়াদি শান্তি’ নিয়ে আলোচনার কথা বলছেন।

আরব রাষ্ট্রের চেয়ে বরং অধিকৃত পশ্চিম তীরের রামাল্লায় ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের (পিএ) কাছ থেকে পাওয়া উষ্ণ অভ্যর্থনাই বেশি উপভোগ্য ছিল ব্লিঙ্কেনের কাছে।

পিএর প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাস মার্কিন এই প্রতিনিধিকে স্বাগত জানান এবং তিনি যুদ্ধপরবর্তী শান্তি মীমাংসার প্রেক্ষাপটে গাজার নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার বিষয়ে আগ্রহ প্রকাশ করেন, যা সত্যি বিস্ময়ের।

গাজায় ২৩ লাখ মানুষ ইসরায়েলি অবরোধ ও ভয়াবহ বোমা হামলার মধ্যে বেঁচে থাকার জন্য লড়াই করছে। পিএ গাজায় ইসরায়েলের যুদ্ধাপরাধের নিন্দা জানিয়েছে এবং জাতিসংঘে আরব কূটনীতিকদের প্রচেষ্টায় নেতৃত্ব দিয়েছে ঠিকই, কিন্তু এটি যুদ্ধের বিরুদ্ধে পশ্চিম তীরের ফিলিস্তিনিদের সব ধরনের প্রতিবাদ ঠেকিয়ে রেখেছে।

পশ্চিম তীরেও যে পরিস্থিতি অনুকূল তা নয়। রামাল্লাসহ বিভিন্ন পশ্চিম তীরের বিভিন্ন অংশে অভিযান বাড়িয়েছে ইসরায়েলি বাহিনী। গ্রেপ্তার করা হয়েছে হাজার হাজার ফিলিস্তিনিকে। এরপরও পিএ মুখ বুজে রয়েছে।

উত্তেজিত ইহুদি বসতি থেকেও ফিলিস্তিনি গ্রামগুলোতে হামলা হয়েছে। এরপরও প্রেসিডেন্ট আব্বাস যেন এ ব্যাপারে উদাসীন।

আব্বাসের এই ভূমিকার পেছনের কারণ হলো বাইডেন প্রশাসনের প্রতি অন্ধ বিশ্বাস। তিনি বিশ্বাস করেন, বাইডেন প্রশাসন ফিলিস্তিনের মানুষের জন্য শান্তি নিশ্চিত করতে পারে এবং তারা এটি করতে আগ্রহী। আব্বাস আশা করেন, তিনি যদি পশ্চিম তীরকে আরেকটু শান্ত রাখতে পারেন, তাহলে হামাসমুক্ত গাজার নিয়ন্ত্রণ তার হাতেই ন্যস্ত হবে।

কী এক প্রহসন!

ইসরায়েলি যুদ্ধবিমান ও ট্যাঙ্কের পিঠে ভর করে পিএ গাজার নিয়ন্ত্রণ নেবে, এমনটা ভাবা স্পষ্টতই বোকামি। আব্বাস ও তার সহযোগীরা এই ভেবে অবশ্যই ভ্রমের মধ্যে রয়েছেন যে ইসরায়েল পশ্চিম তীর এবং গাজা উভয়কেই তাদের অযোগ্য শাসনের হাতে তুলে দেওয়ার জন্য রক্ত ও সম্পদ ব্যয় করছে। প্রকৃতপক্ষে ইসরায়েলি সরকার অনির্দিষ্টকালের জন্য উপত্যকাটির সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখার বিষয়ে তাদের পরিকল্পনার কোনো অংশই গোপন রাখছে না।

তারা যদি সত্যিই বিশ্বাস করে যে যুদ্ধপরবর্তী বিজয়ী ইসরায়েল তাদের রাজধানী হিসেবে পূর্ব জেরুজালেমসহ একটি স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে সাহায্য করবে, তাহলে তারা বোকার স্বর্গে বাস করছে।

নির্বাচনের বছরে মার্কিন প্রেসিডেন্ট বাইডেন স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য কেন রাজনৈতিক মূলধন ব্যয় করবেন? তার প্রশাসন যদি ইসরায়েলকে দুই দিন বা এমনকি দুই ঘণ্টার মানবিক বিরতিতেও সম্মত করাতে না পারে, যদি না ফিলিস্তিনিদের জীবন বাঁচাতে পারে, তাহলে কীভাবে ইসরায়েলের সরকার ও সমাজকে দ্বিরাষ্ট্রীয় সমাধান মেনে নেওয়ার বিষয়ে রাজি করাতে পারবে?

যেসব ফ্যাসিস্ট ও ধর্মান্ধ ইসরায়েলি ঐক্য সরকার গঠন করে আইনসভায় নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়েছে, তারা আজ ফিলিস্তিনিদের ভূখণ্ড ফিরিয়ে দেওয়ার বদলে তাদের বিতাড়িত করার নতুন উপায়ের কথাই ভাবছে। ফিলিস্তিনিদের নিজস্ব রাষ্ট্র উপহার দেওয়ার বিন্দুমাত্র ইচ্ছা তাদের নেই।

চলমান পরিস্থিতিতে সবচেয়ে ভাল দৃশ্যকল্পটি এটাই হতো, যদি দেখা যেত ইসরায়েলকে পিএ-শাসিত পশ্চিম তীরের অর্ধেক রাষ্ট্র গ্রহণের জন্য চাপ দিচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র। আর এর বিনিময় হচ্ছে পুরো আরবদের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণ ও আরো মোটা অঙ্কের মার্কিন সহায়তা।

প্রায় ২০ বছর আগে ইরাকে মার্কিন আগ্রাাসনের প্রাক্কালে সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশ ‘একটি দ্বিরাষ্ট্রীয় সমাধানের ভিশন’ প্রস্তাব করেছিলেন এবং যুদ্ধের পর সেই লক্ষ্য অর্জনের জন্য ইউরোপীয়দের সঙ্গে একটি আন্তর্জাতিক কর্মপরিকল্পনাও তৈরি করেছিলেন। এর ফলাফল কী হলো? আমরা দেখলাম আরো রক্তক্ষয়ী দখলদারিত্ব, অবৈধ বসতি স্থাপন ও অবরোধ, সেই সঙ্গে চিরকালের যুদ্ধ, যা এই অঞ্চলের সর্বনাশ ডেকে আনল।

প্রকৃতপক্ষে যুক্তরাষ্ট্রের নিঃশর্ত সমর্থনের সুবাদে আজ বা আগামীতে যুক্ত হওয়ার মতো কোনো ইসরায়েলি শান্তি অংশীদার নেই। এমন কেউ নেই যে দখলদারিত্ব কিংবা বর্ণবাদী ব্যবস্থার অবসান ঘটাতে পারে।

কেবল আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সরাসরি সম্পৃক্ততা ও প্রতিরোধের মাধ্যমে ইসরায়েলকে বাধ্য করা যেতে পারে, যেমনটা ঔপনিবেশিক এলাকা ছেড়ে দিতে ফ্রান্স ও দক্ষিণ আফ্রিকাকে করা হয়েছিল।

মারওয়ান বিশারা: আল জাজিরার জ্যেষ্ঠ রাজনৈতিক বিশ্লেষক।

উম্মাহ২৪ডটকম: এমএ

উম্মাহ পড়তে ক্লিক করুন-
https://www.ummah24.com

দেশি-বিদেশি খবরসহ ইসলামী ভাবধারার গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে ‘উম্মাহ’র ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।