Home ওপিনিয়ন বুমেরাং ইফেক্ট: লিপস্টিক দেওয়াটাই নারীর ভালো থাকা প্রমাণ করে না

বুমেরাং ইফেক্ট: লিপস্টিক দেওয়াটাই নারীর ভালো থাকা প্রমাণ করে না

- প্রতিকী ছবি।

।। শাহানা হুদা রঞ্জনা ।।

বৃহত্তর রংপুরের মানুষ হিসেবে কী একটা বিপদে পড়েছি। অনেকেই ফোন করে জানতে চাইছেন একজন ‘বাহে নারী’হিসেবে আমি কতবার লিপস্টিক ব্যবহার করি এবং কতবার স্যান্ডেল বদলাচ্ছি। কারণ আমাদের এলাকার মানুষের সুখে থাকা বোঝাতে বাণিজ্যমন্ত্রী সাহেব বলেছেন, নিত্যপণ্যের দামের ঊর্ধ্বগতির কারণে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষ কষ্টে থাকলেও কৃষিভিত্তিক অর্থনীতির অঞ্চল তার নির্বাচনী এলাকার মানুষ বেশ ভালো আছেন। সেই ভালো থাকার প্রমাণ হিসেবে তিনি দাবি করেছেন, তার এলাকার নারীরা এখন লিপস্টিক মাখছেন।

মন্ত্রী বলেছেন, “আমার এলাকায় কৃষিভিত্তিক অর্থনীতি, আলুভিত্তিক অর্থনীতি। লোকজনের কোনো কষ্ট নেই। মহিলারা দিনে তিনবার করে লিপস্টিক লাগাচ্ছেন, চারবার করে স্যান্ডেল পাল্টাচ্ছেন।”

মন্ত্রী মহোদয়ের দেওয়া এই বক্তব্য দারুণ আলোড়ন তুলেছে সব মহলে। কারণ ওনার দেওয়া এই বক্তব্যের সাথে প্রকৃত উন্নয়ন প্যারাডাইমের কোন মিল তো নাই-ই, বরং বিপরীত কথা প্রমাণিত হয়। কারণ অর্থনীতিবিদরা বলেন, মন্দায় বাড়ে লিপস্টিক বিক্রি।

অর্থনৈতিক সংকটের সময় নারীদের লিপস্টিকের মতো ছোটখাটো প্রসাধন সামগ্রী কেনার প্রবণতা বাড়ে। নারীরা ব্যয়বহুল জিনিস কেনাকাটার পরিবর্তে সাশ্রয়ী ছোট পণ্যগুলো কেনার চেষ্টা করেন। শুধু লিপস্টিকই নয়। অন্তর্বাস ও ডেটিং সাইট থেকেও অর্থনীতিবিদরা মন্দার পূর্বাভাস পান। এক্ষেত্রে মন্ত্রী সাহেবের আলুভিত্তিক অর্থনীতির হিসাবটা ঠিক হলেও লিপস্টিকের কথাটি উল্টো হয়ে গেছে।

তারা আলুর দাম পাচ্ছে, কোনো কষ্ট নেই, মহিলারা ৩ বার লিপস্টিক লাগাচ্ছে: বাণিজ্যমন্ত্রী
কারণ গত অক্টোবর মাসে দেশের সার্বিক মূল্যস্ফীতির হার ছিল ৯ দশমিক ৯৩ শতাংশ। খাদ্য মূল্যস্ফীতির হার ছিল ১২ দশমিক ৫৬ শতাংশ, যা গত ১১ বছর ৯ মাসের মধ্যে সর্বোচ্চ। খাদ্য মূল্যস্ফীতির হার কিছুতেই কমানো যাচ্ছে না। অর্থাৎ বেঁচে থাকার জন্য কেবল খাদ্য কিনতেই সীমিত আয়ের মানুষদের হিমশিম খেতে হচ্ছে। মধ্যবিত্তরা সঞ্চয় ভাঙছেন বাধ্য হয়ে।

মন্ত্রী মহোদয় মন্তব্য করার পর নারীরা ক্ষেপেছেন কেন শুধু লিপস্টিকের কথাই বলা হলো তা নিয়ে। একে নারীর সাজের প্রতি কটাক্ষ বলে মনে করছেন অনেকে। আর পুরুষরা ক্ষেপেছেন মন্ত্রী মহোদয় কেন শুধু নারীদের লিপস্টিক আর স্যান্ডেল পরা নিয়ে কথা বললেন? পুরুষদের সুখে থাকার কোন প্রসঙ্গ নেই কেন? বিষয়টি আলোচনায় থাকতেই পারতো। গ্রিনস্প্যানের তত্ত্বের ওপর ভিত্তি করে ‘পুরুষদের অন্তর্বাস সূচক’ নামে একটি অর্থনৈতিক সূচকও রয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে অর্থনীতিতে মন্দা হলে পুরুষরাও নাকি অন্তর্বাস কম কেনেন। অন্তর্বাস বিক্রি কমার অর্থ হলো পুরুষরা এতটাই চাপে পড়ে গেছে যে তারা অন্তর্বাস পরিবর্তনের কথাও ভাবছেন না।

পুরুষের অন্তর্বাস বিক্রি থেকে অর্থনীতির পূর্বাভাস দেওয়া সম্ভব বলে মনে করেন যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভের সাবেক প্রধান অ্যালান গ্রিনস্প্যান। ২০০৭ থেকে ২০০৯ সালের বৈশ্বিক মন্দার সময় যুক্তরাষ্ট্রে পুরুষদের অন্তর্বাস বিক্রি উল্লেখযোগ্যভাবে কমে যায়। অন্যদিকে ২০১০ সালে অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারের সময় অন্তর্বাসের বিক্রি বাড়ে। তবে এক্ষেত্রে ভালো যে উনি বক্তব্য প্রদানকালে পুরুষদের অন্তর্বাস প্রসঙ্গ টেনে আনেননি।

লিপস্টিকের ব্যবহার বাড়ার সাথে অর্থনৈতিক মন্দার কী সম্পর্ক থাকতে পারে এটাও অনেককে ভাবাচ্ছে। মন্দায় লিপস্টিক বিক্রি বেড়ে যাওয়ার কারণ হচ্ছে মানুষ নিজের আর্থিক কষ্টের কথা ভুলে থাকতে নিজের প্রতি বেশি যত্নশীল হয়, নিজেকে পরিপাটি রাখার চেষ্টা করে। এ সময় লিপস্টিকের চাহিদা বাড়ে, কারণ সাজগোজ করার জন্য নারীরা বেশি দামি জিনিস কেনা কমিয়ে দেন। কিন্তু একেবারে কেনাকাটা বন্ধ করেন না। যেহেতু তুলনামূলক কম টাকায় লিপস্টিক কিনতে পারেন, তাই এর ব্যবহার বেড়ে যায়।

প্রমাণ হিসেবে বলা যায়, যুক্তরাষ্ট্রে নাইন-ইলেভেন বা টুইন টাওয়ার ধ্বংসের পরে যে অর্থনৈতিক মন্দা দেখা দিয়েছিল, তখন লিপস্টিক বিক্রি বেড়েছিল ১১ শতাংশ। প্রসাধন কোম্পানি এস্টে লডারের চেয়ারম্যান লিওনার্দ লডার একই প্রবণতা দেখেছিলেন ২০০৮ সালের মন্দার সময়। ফলে বেশ জোরেশোরেই প্রতিষ্ঠা পায় ‘দ্য লিপস্টিক এফেক্ট’ নামের এ তত্ত্বের। পরবর্তীকালে টেক্সাস ক্রিশ্চিয়ান ইউনিভার্সিটির দুই অধ্যাপক সারাহ হিল ও ক্রিস্টোফার রডেনহেফার এ নিয়ে গবেষণা করে একে আরও জোরদার করেছিলেন। ১৯২৯ সালের বিশ্বমন্দার সময় একই ঘটনা ঘটেছিল, সেই হিসাবও অর্থনীতিবিদেরা বের করেছেন।

অর্থনীতি চাঙা হবে নাকি কোনো মন্দা আসতে চলছে সেই পূর্বাভাস অর্থনীতিবিদরা বিভিন্নভাবে ব্যাখ্যা করে থাকেন। তবে এই লিপস্টিক ও অন্তর্বাস তত্ত্বটি আমাদের কাছে বেশ নতুন। আর বাণিজ্যমন্ত্রীর উদাহরণটা উল্টা হওয়াতে আরো বেশি করে আলোচনা হচ্ছে।

৯/১১-র পর অর্থনৈতিক মন্দার সময় প্রসাধন প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান এস্টে লডারের চেয়ারম্যান লিওনার্দ লডার লিপস্টিক সূচক তৈরি করেন। এই সূচক অবশ্য পুরুষের অন্তর্বাস সূচকের উল্টো। ২০০১ সালের মন্দার সময় যুক্তরাষ্ট্রে লিপস্টিক বিক্রি ১১ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছিল। এর আগে, ৩০ এর দশকের গ্রেট ডিপ্রেশনের সময় যুক্তরাষ্ট্রে সামগ্রিকভাবে প্রসাধনী বিক্রি ২৫ শতাংশ পর্যন্ত বৃদ্ধি পেয়েছিল।

অন্তর্বাস, ডেটিং সাইট কিংবা লিপস্টিক থেকে অর্থনীতিবিদরা যেভাবে মন্দার পূর্বাভাস পান
তবে আমরা যদি নিজেদের অবস্থার সাথে মিলিয়ে লিপস্টিক থিউরিটি বোঝার চেষ্টা করি, তাহলে দেখবো যে যখন আমাদের মন খারাপ থাকে, তখন আমরা অনেকেই সাজগোজ করে তা ঢাকার চেষ্টা করি। দ্রুত ঠোঁটে রং মেখে বের হয়ে যাই। লিপস্টিকের মতো উজ্জ্বল কিন্তু কম দামি জিনিস ব্যবহার করে নিজের খারাপ অবস্থা প্রাথমিকভাবে ঢেকে রাখার চেষ্টা করি।

গবেষণায় এটিও দেখা গেছে যে, লিপস্টিক যত উজ্জ্বল রঙের হয়, বিষাদ বা অবসাদ তত বেশি ঢেকে রাখা সম্ভব হয়। এক্ষেত্রে সবচেয়ে ভালো কাজ করে লাল রঙের লিপস্টিক। এতে কেউ যখন কারো দিকে প্রথমবারের মতো তাকায়, তখন তার সব মনোযোগ ঠোঁটে চলে যায় এবং চেহারায় বা পোশাকে ফুটে ওঠা অন্য মালিন্য ঢাকা পড়ে যায়।

মন্দায় পুরুষের অন্তর্বাস ব্যবহার কমে যাওয়ার ব্যাপারটাও কিন্তু বেশ ইন্টারেস্টিং লাগছে আমাদের কাছে। অন্তর্বাস তত্ত্বের ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে মার্কিন কেন্দ্রীয় ব্যাংক–ব্যবস্থা ফেডারেল রিজার্ভের (ফেড) তৎকালীন চেয়ারম্যান অ্যালান গ্রিনস্প্যান দেখেছিলেন, মন্দার সময় মানুষ অন্তর্বাস কেনা কমিয়ে দেয়। তখন কাপড় কেনা দায় হয়ে যায়, নতুন অন্তর্বাস কেনা মানুষের জন্য বাড়তি ঝামেলায় পরিণত হয়।

আরও পড়তে পারেন-

আমেরিকার পুরুষদের মধ্যে নতুন নতুন অন্তর্বাস কেনার ঝোঁক রয়েছে। তবে সাম্প্রতিক সমীক্ষার তথ্য বলছে, বিগত কয়েক মাসে যুক্তরাষ্ট্রের পুরুষদের মধ্যে অন্তর্বাস কেনার পরিমাণ অনেক কমে গেছে আর তা দেখেই মন্দার আশঙ্কা করছেন দেশটির অর্থনৈতিক বিশেষজ্ঞরা। মন্দাকালীন অবস্থা বোঝার জন্য যুক্তরাষ্ট্রে পুরুষের অন্তর্বাস সূচক ব্যবহার করা হয়। ২০০৭ ও ২০০৯ সালে মন্দার কারণে যুক্তরাষ্ট্রে পুরুষের অন্তর্বাস বিক্রি উল্লেখযোগ্য পরিমাণ কমে গিয়েছিল। (প্রথম আলো) গ্রিনস্প্যানের তত্ত্বের ওপর ভিত্তি করে পুরুষদের অন্তর্বাস সূচক নামে একটি অর্থনৈতিক সূচকও রয়েছে।

এদিকে মন্ত্রী মহোদয়ের এলাকার মেয়েরা নাকি চারবার করে স্যান্ডেল বদলাচ্ছেন। কিন্তু কেন ঐ এলাকার নারীদের চারবার স্যান্ডেল বদলাতে হচ্ছে? এই তথ্যই বা মন্ত্রী মহোদয় কোথায় পেলেন? তবে একইভাবে স্যান্ডেলের থিউরিও সত্য। এটিও অর্থনীতিতে মন্দার সাথে সম্পর্কিত।

দেশে মন্দা শুরু হলে কাজের অভাব হয়, বেকারের সংখ্যা বাড়ে। কাজে থাকা লোকজনও নতুন করে চাকরি হারায়। ফলে বেকাররা চাকরি খুঁজতে শুরু করেন। নানা জায়গায় ধর্না দিতে হয় বলে লোকজনকে প্রচুর হাঁটতে হয়। এতে স্যান্ডেলের ক্ষয় হয় এবং ঘনঘন স্যান্ডেল পাল্টাতে হয়। (রাজু নূরুল: উন্নয়ন সংগঠক, বেলজিয়ামের ব্রাসেলসে উন্নয়ন নীতিপরামর্শ বিষয়ে অধ্যয়নরত)। কিন্তু সমস্যাটা হচ্ছে মন্ত্রী মহোদয় শুধু নারীদের স্যান্ডেল বদলানোর কথা বলেছেন। পুরুষও তো চাকরি খুঁজেন, তাদেরও তো জুতা ক্ষয় হয়।

মন্দা এসেছে বা আসছে বোঝানোর জন্য আরো বেশ কিছু ইন্টারেস্টিং থিউরি আছে অর্থনীতিতে। ব্রিটিশ বহুজাতিক ব্যাংক বার্কলেস ক্যাপিটালের পরিচালক ও সাবেক আবাসন খাত বিশেষজ্ঞ অ্যান্ড্রু লরেন্স ১৯৯৯ সালে ‘স্কাইস্ক্র্যাপার ইনডেক্স’ বা ‘আকাশচুম্বী ভবনের সূচক’ তৈরি করেন। লরেন্সের ব্যাখ্যা অনুসারে, আকাশচুম্বী বহুতল ভবনের সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ার অর্থ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি শীঘ্রই হ্রাস পেতে চলেছে।

গ্রেট ডিপ্রেশন শুরুর সময় ১৯৩০ সালে এম্পায়ার স্টেট বিল্ডিং নির্মাণের কাজ শেষ হয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যখন মন্দায় পড়ছে তখনই ৭০ এর দশকের শুরুতে সিয়ার্স টাওয়ার (বর্তমানে উইলিস টাওয়ার) ও ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারের টুইন টাওয়ার উদ্বোধন করা হয়। ২০০৯ সালের অক্টোবরে ইমার নামের আবাসন নির্মাণ প্রতিষ্ঠান বুর্জ খলিফার বাইরের অংশের কাজ শেষ করার দুই মাস পরেই দুবাই সরকারকে খেলাপি হতে চলেছিল।

এছাড়া মন্দার সময় মানুষ একা হয়ে পড়ে বলে সঙ্গী খুঁজে। ডেটিং সাইটগুলোতেও তাই বাড়ে ভিড়। ২০০৯ সালের মন্দার সময় ডেটিং সাইট ম্যাচ সাত বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ চতুর্থ ত্রৈমাসিক আয় করে।

কাজেই মন্ত্রী মহোদয়রা যখন কিছু বলবেন, তখন জেনে বলা উচিৎ, নয়তো বুমেরাং হয়ে যেতে পারে লিপস্টিক ও স্যান্ডেল বদলানো থিউরির মতো। আর সবশেষ কথা হচ্ছে, লিপস্টিক দেওয়াটাই নারীর সুখে থাকা বা ভালো থাকা প্রমাণ করে না।

লেখক: যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ ও কলামিস্ট।

সূত্র- টিবিএস।

উম্মাহ২৪ডটকম: এমএ

উম্মাহ পড়তে ক্লিক করুন-
https://www.ummah24.com

দেশি-বিদেশি খবরসহ ইসলামী ভাবধারার গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে ‘উম্মাহ’র ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।