Home শিক্ষা ও সাহিত্য প্রসঙ্গ: নতুন পাঠ্যক্রম

প্রসঙ্গ: নতুন পাঠ্যক্রম

।। অধ্যাপক ডা: শাহ মো: বুলবুল ইসলাম ।।

২০৪১ সালের মধ্যে স্মার্ট এবং উন্নত দেশে পরিণত হওয়ার লক্ষ্যে নতুন শিক্ষাক্রম প্রণয়ন করা হয়েছে। এটি আমাদের জন্য আত্মশ্লাঘার বিষয়। মেধা, মনন, চিন্তার প্রসারতা সব কিছু দিয়ে নিজেকে, দেশকে, সর্বোপরি বিশ্বকে সৃজনশীল সেবা দেয়ার প্রজন্ম তৈরির এ মহাপরিকল্পনা নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয় উদ্যোগ। এটি ভবিষ্যৎ বাস্তবমুখী চিন্তার বহিঃপ্রকাশ। কিন্তু এ ধরনের একটি মহাপরিকল্পনার বাস্তবায়ন মোটেও সহজ নয়। এটি একটি দীর্ঘমেয়াদি কষ্টসাধ্য প্রয়াস। কর্তৃপক্ষ অবশ্য এ ব্যাপারে সাধুবাদ পাওয়ার যোগ্য। এই পাঠ্যক্রম জনসমক্ষে আসার পরপর শুরু হয় তুমুল বিতর্ক। অভিভাবকরা মাঠে নেমেছেন, প্রতিবাদ সমাবেশ করেছেন। শিক্ষকদের উল্লেখযোগ্য একটি অংশ এ ব্যাপারে নেতিবাচক মনোভাব পোষণ করেছেন বলে সংবাদ বেরিয়েছে। আপত্তি জানিয়েছেন শিক্ষা অনুরাগীরা।

কোনো একটি নতুন বিষয়ে পক্ষ-বিপক্ষ থাকা স্বাভাবিক। আলোচনার টেবিলে বসে যৌক্তিকভাবে ব্যাপারগুলোর সমাধান একটি সুস্থ প্রক্রিয়া। প্রকৃতি, পরিবেশ, দেশ ও আন্তর্জাতিক পরিবর্তন চাহিদা সব কিছু সামনে রেখে পাঠ্যসূচির পরিবর্তন একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। এই প্রক্রিয়ায় নতুন পাঠ্যক্রমে দেশের আর্থসামাজিক অবস্থা অভিভাবকদের সচেতনতা ও সাংস্কৃতিক চেতনাবোধ এই পাঠ্যসূচিতে যথাযোগ্যভাবে মূল্যায়িত হয়নি। পর্যালোচনা করা হয়নি প্রাথমিক পর্যায়ে বার্ষিক পরীক্ষা তুলে দিলে এর সুদূরপ্রসারী প্রভাব কি হবে বা কতটুকু হবে। বিবেচনায় নেয়া হয়নি গত বছর ৯ লাখ ৪০ হাজার ৮০৭টি আসনের বিপরীতে ভর্তি হয়েছিল দুই লাখ ৭৬ হাজার ৬৪১ শিক্ষার্থী। অর্থাৎ প্রায় ৭০ শতাংশ আসনে প্রার্থী ছিল না। এ বছর সাত লাখের বেশি আসন খালি থাকবে বলে অনুমান করা হচ্ছে। যখন বছর শেষে পরীক্ষা থাকবে না তখন এ হার বেড়ে যাওয়া এবং শ্রেণিবিমুখ হয়ে শিক্ষার্থীদের বিপথে যাওয়ার প্রবণতা বৃদ্ধির শঙ্কা রয়েছে। অভিভাবকের আশঙ্কা ও দুশ্চিন্তা এখানে।

চলতি মাসের ১৫ তারিখের সংবাদে প্রকাশ, নবম শ্রেণীর পাঠ্যবই এখনো ছাপা শুরু হয়নি। তাহলে কিভাবে নতুন বছরে নতুন পাঠ্যসূচির আওতায় পঠন প্রক্রিয়া শুরু হবে? এ শিক্ষানীতি প্রণয়ন করতে গিয়ে নীতি-নির্ধারকরা সম্ভবত এর ঝুঁকির দিকটি খেয়াল করেননি। এ শিক্ষাক্রম বাস্তবায়ন করতে হলে শিক্ষক-শিক্ষার্থী এবং অভিভাবকের মতামত, চাহিদা ও পরামর্শ আমলে নেয়া দরকার। প্রয়োজন ভৌত অবকাঠামোর সঠিক ব্যবস্থাপনা। এগুলো আমলে না নিয়ে তাড়াহুড়ো করে একটি নতুন পাঠ্যক্রম চালু করা কতটা বাস্তবসম্মত হয়েছে, তা আবারো ভেবে দেখা প্রয়োজন বৈকি। এমনিতে আমাদের দেশে শিক্ষার উন্নয়নের নামে একের পর এক এক্সপেরিমেন্ট চালানো হয়েছে শিশুদের নিয়ে। তাই অভিভাবক, শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও শিক্ষানুরাগীরা এর পুনরাবৃত্তি দেখতে চান না।

আরও পড়তে পারেন-

সম্প্রতি প্রকাশিত তৃতীয় থেকে পঞ্চম শ্রেণীর শিক্ষার্থীদের ওপর একটি জরিপ এ ক্ষেত্রে গুরুত্বের দাবিদার। এদের মধ্যে ইংরেজি বর্ণ চেনে না ১৬ শতাংশ শিক্ষার্থী। পঞ্চম শ্রেণীপড়ুয়া ৬৮ শতাংশ বাংলায় কোনো রচনা লিখতে পারে না। চতুর্থ শ্রেণীপড়ুয়া ১০ পর্যন্ত ইংরেজি সংখ্যাগুলো লিখতে পারে না ৭২ শতাংশ শিক্ষার্থী। তিন অঙ্গের যোগ-বিয়োগ-গুণ-ভাগ করতে পারে না ৭২ শতাংশ শিক্ষার্থী। এটা তখন, যখন প্রতিটি শ্রেণীতে বার্ষিক পরীক্ষা নেয়া হচ্ছে। এ পরীক্ষা তুলে নেয়া হলে শিক্ষার্থীদের ক্লাসে আসার আগ্রহ হারিয়ে যাওয়ার সমূহ আশঙ্ক। আমাদের এ কথা অবশ্য মনে রাখতে হবে; আমরা ছক বাঁধা গ্রেড পাওয়ার প্রতিযোগিতা থেকে বেরিয়ে আসতে চাই। শিক্ষা শেষে চাকরিপ্রার্থীদের দীর্ঘ সারি তৈরির বৃত্ত ভাঙতে চাই। চাকরিপ্রার্থীর পরিবর্তে দৃঢ় মনোবলসম্পন্ন জীবনযুদ্ধে লড়াকু মনোভাবের প্রজন্ম দেখতে চাই। দেখতে চাই নতুন দিগন্ত উন্মোচনের সাহসী পুরুষ। দেশপ্রেমে উজ্জীবিত নৈতিকতায় ভাস্বর এক প্রজন্ম। এর দায়িত্ব যারা শিক্ষা অধিদফতর, মন্ত্রণালয়ের সাথে সম্পৃক্ত তাদের। কিন্তু বাকি তিনটি মৌলিক বিষয় অভিভাবক, শিক্ষার্থী এবং শিক্ষকদের মতামত ও সম্পৃক্ততা অবশ্য আমলে নিতে হবে। নইলে আগামী ১০ বছর পর সার্টিফিকেটধারী শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা পৌঁছুবে বর্তমান ২৫ লাখের জায়গায় ৫০ লাখে। এ দায়ভার কে নেবে?

নতুন শিক্ষাক্রমে মাধ্যমিকে বিজ্ঞান পরীক্ষায় মোট নম্বরের ১০ শতাংশ বরাদ্দ করা হয়েছে, যা আগে ছিল ৩১ শতাংশ। বিজ্ঞান শিক্ষাকে গুরুত্ব না দেয়ার সুদূরপ্রসারী ফল কী দাঁড়াবে তা ভেবে অভিভাবকরা দিশেহারা। এ ব্যাপারে শঙ্কিত শিক্ষক এবং শিক্ষাবিদরাও। পৃথিবীর বিভিন্ন উন্নত দেশে মাধ্যমিক পর্যায়ে ছাত্রছাত্রীরা পছন্দের বিষয় বেছে নিতে পারে। সেভাবে নিজেকে তৈরি করে। বিভিন্ন উন্নত দেশের পাঠ্যক্রমের পর্যালোচনায় এটি দেখা যায়। বিজ্ঞান শিক্ষার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ শিক্ষা তথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরোর (ব্যানবেইস) একটি প্রতিবেদন দেশের বিজ্ঞান শিক্ষার যে তথ্য দিয়েছে তা রীতিমতো শঙ্কার। প্রতিষ্ঠানটির তথ্যমতে, ২০১৮-২২ সাল পর্যন্ত এইচএসসি পরীক্ষায় বিজ্ঞানের পরীক্ষার্থীর হার ছিল যথাক্রমে ৩১ শতাংশ, ৩১ দশমিক ৯৪ শতাংশ, ৩০ দশমিক ৯২ শতাংশ, ২৮ দশমিক ১৯ শতাংশ ও ৩১ দশমিক ৯৩ শতাংশ। উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে একই সময়ে বিজ্ঞান শিক্ষার্থীর হার ছিল যথাক্রমে ২২ দশমিক ১৯ শতাংশ, ২৩ দশমিক ৩৫ শতাংশ, ২৩ দশমিক ৪২ শতাংশ, ২২ দশমিক ৫০ শতাংশ ও ২৪ দশমিক ৫৪ শতাংশ। অর্থাৎ উপরের দিকে বিজ্ঞান শিক্ষার্থীর হার কমে যাচ্ছে। স্নাতক পর্যায়ে ২০১৮ সালে এ হার ছিল ১৭ দশমিক ৪৮ শতাংশ, ২০১৯ সালে ১৬ দশমিক ০৬ শতাংশ, ২০২০ সালে ২৩ দশমিক ২৮ শতাংশ।

বিজ্ঞান বিষয়ে উচ্চ শিক্ষার ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীর হার কমছে তখন, যখন মাধ্যমিক পর্যায় থেকে বিজ্ঞান শিক্ষায় পছন্দ-অপছন্দের ব্যাপারে শিক্ষার্থীদের স্বাধীনতা ছিল। এর ফলে তারা মাধ্যমিক পর্যায় থেকে বিজ্ঞান বিষয়ে বিস্তৃত ধারণা নিতে পারত। নতুন শিক্ষানীতিতে এটি সঙ্কুচিত হয়ে যাওয়ায় উচ্চ মাধ্যমিক এবং স্নাতক পর্যায়ে বিজ্ঞান শিক্ষার্থীর হার কমে যাওয়ার আশঙ্কা উড়িয়ে দেয়া যায় না। গত ২০২২-২৩ শিক্ষাবর্ষে সরকারি কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থী ভর্তির পরিসংখ্যান এ সন্দেহের সত্যতা প্রমাণ করে। ২০২২-২৩ শিক্ষাবর্ষে কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে এক লাখ ৫৪ হাজার ৮৯৫টি আসনের বিপরীতে ভর্তি হয়েছিল ৯৮ হাজার ৪৬ শিক্ষার্থী। এ হিসাবে সরকারি কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে ৩৬.৭০ শতাংশ আসন ফাঁকা রেখে চলতে হয়েছে। যা জাতীয় মানবসম্পদে উল্লেখযোগ্য ক্ষতি। যখন সর্বত্র বিজ্ঞান পড়ার আমেজ, তখন এ অবস্থা। বিজ্ঞান শিক্ষাকে গুরুত্ব না দিলে বিজ্ঞানমনস্ক প্রজন্ম তৈরির চিন্তা অধরা থেকে যাবে।

অপর দিকে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পদার্থবিদ্যা, রসায়ন ও জীববিজ্ঞান পড়ানোয় নিয়োগপ্রাপ্ত শিক্ষকরা কী করবেন? হয় তাদের সাধারণ বিষয়ে শিক্ষার্থীদের পাঠদান করাতে হবে; নয়তো বেকার হতে হবে। তাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের কঠোর অনুশীলন রাতারাতি মূল্যহীন হয়ে পড়ার আশঙ্কা দেখা হবে; বিশেষ করে বেসরকারি স্কুলগুলোতে। অর্থাৎ নতুন পাঠ্যক্রম ভবিষ্যতে তৈরি করবে বহুমাত্রিক সমস্যা। সবচেয়ে বড় সমস্যা হবে বিজ্ঞানমনস্ক প্রজন্ম তৈরির নামে এই পাঠ্যক্রম শুরু হলে ১০ বছর পর তৈরি হবে সার্টিফিকেটসর্বস্ব একটি বিশাল প্রজন্ম। আজ যারা নতুন পাঠ্যক্রম নিয়ে বেশি উৎসাহী; তারা তখন না থাকার সম্ভাবনা সমাধিক। কিন্তু জাতিকে বইতে হবে এর দায়ভার ৪০-৫০ বছর। নতুন পাঠক্রম সম্পর্কে বিদেশের উদাহরণ টানা হয়েছে। যেসব দেশের কথা বলা হয়েছে সেখানকার আর্থসামাজিক অবস্থা অভিভাবকদের সচেতনতার সাথে এগুলোর সাথে আমাদের আর্থ-সামাজিক অবস্থা অভিভাবক সচেতনতার কোনো তুলনা হয় না।

আমাদের শিক্ষার্থীদের নিয়ে বিগত ১৫-২০ বছরে অনেক পরীক্ষা-নিরীক্ষা হয়েছে। শিক্ষার্থীদের আর নতুন কোনো এক্সপেরিমেন্টের গিনিপিগ বানানো যুক্তিসঙ্গত হবে না। সংশ্লিষ্ট সব মহলের সাথে আলোচনা করে একটি সঙ্গত এবং কার্যকরী পাঠ্যক্রম এখন সময়ের দাবি। যেন আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মে ছক বাঁধা গ্রেড পাওয়ার প্রতিযোগিতা বন্ধ হয়। শিক্ষা শেষে তারা যেন সার্টিফিকেট হাতে নিয়ে বেকারের সারিকে আরো দীর্ঘ না করে। পরিবার সমাজ দেশ ও বিশ্ব যেন তাদের অবদানে আলোকিত হতে পারে।

লেখক : চক্ষুরোগ বিশেষজ্ঞ। Email-shah.b.islam@gmail.com

উম্মাহ২৪ডটকম: এমএ

উম্মাহ পড়তে ক্লিক করুন-
https://www.ummah24.com

দেশি-বিদেশি খবরসহ ইসলামী ভাবধারার গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে ‘উম্মাহ’র ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।