Home অন্যান্য খবর কর্মীকে বিশ্বাস করতে না পারলে কী করবেন?

কর্মীকে বিশ্বাস করতে না পারলে কী করবেন?

একজন নেতার কাছে সবচেয়ে বড় ও অত্যাবশ্যক একটি পুঁজি হলো ‘বিশ্বাস’। যখন কর্মীরা তাদের নেতাকে বিশ্বাস করে, তাদের পারফরম্যান্স আরও ভালো হয়। তারা কাজের সঙ্গে বেশি সম্পৃক্ত হয়, কর্মক্ষমতা বাড়ে এবং সৃজনশীল হয়ে ওঠে। বসের উপর আস্থা রাখতে পারলে কর্মীদের দুশ্চিন্তা এবং বার্নআউটও কম হয়। একজন ভালো নেতা এ সুবিধাগুলো বুঝতে পারেন এবং নিজের টিকের সদস্যদের ও সহকর্মীদের বিশ্বাস অর্জনের জন্য পরিশ্রম করেন।

কিন্তু কখনো কখনো কখনো বিপরীত দিক থেকেও বিশ্বাসে ঘাটতি থাকতে পারে এবং শীর্ষস্থানে যারা থাকেন তারাই তখন নিজ কর্মীকে অবিশ্বাস করার মতো অস্বস্তিকর পরিস্থিতিতে পড়েন।

রিমোট ও হাইব্রিড ওয়ার্কের এই যুগে বসদের যে কর্মীদের প্রতি বিশ্বাসের ঘাটতি থাকবে তাতে খুব অবাক হওয়ার কিছু নেই; অন্তত সম্প্রতি প্রকাশিত মাইক্রোসফট ওয়ার্ক ট্রেন্ডস ইনডেক্সে এটাই উঠে এসেছে। কিন্তু নেতা যদি কোনো কর্মীকে বিশ্বাস করতে না পারেন তাতে কর্মস্থলে একাধিক খাতে ক্ষতি হতে পারে। এতে নেতার মধ্যে দুশ্চিন্তা-উদ্বেগ ও হতাশা সৃষ্টি হয়, তারা দ্বিধাবোধ করেন এবং মাইক্রোম্যানেজিং (সবদিক নিয়ন্ত্রণ করা) এর দিকে ঝুঁকে পড়েন। দুর্ভাগ্যবশত, নেতার অবিশ্বাসের প্রতিকূল প্রভাব নেতা ও কর্মীর সম্পর্কের বাইরেও পড়ে এবং পুরো টিমেরই নৈতিকতা, সৃজনশীলতা ও পারফরম্যান্স হ্রাস পায়।

কর্মীর প্রতি বিশ্বাস না থাকলে কী করবেন? 

কর্মস্থলে নেতা-কর্মীর মধ্যে সুস্থ ও কর্মক্ষম সম্পর্কের জন্য দুই পক্ষেরই বিশ্বাস খুবই জরুরি। দলের কোনো সদস্যকে অবিশ্বাস করার মতো নাজুক পরিস্থিতিতে যদি কখনো পড়েন, তাহলে নিচের এই ৫টি ধাপে পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারেন সমস্যাটি সমাধানের জন্য।

১. অবিশ্বাসের উৎস খুঁজে বের করা 

‘আমি তাদেরকে বিশ্বাস করি না’ বা ‘তারা বিশ্বাসযোগ্য নয়’- এ ধরনের কথাবার্তা আমরা প্রায়ই শুনতে পাই। এখানে আমরা বিশ্বাস বলতে এমন পরিস্থিতি বুঝাই যে, হয় কাউকে সব ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ বিশ্বাস করতে হবে, আর নাহয় কোনোভাবেই বিশ্বাস করা যাবে না। আমরা কেউই ছাড় দিতে বা মাঝামাঝি কোনো অবস্থানের সুযোগ রাখি না। কিন্তু ‘বিশ্বাস’ এমন একটি বিষয় যা পরিস্থিতি অনুযায়ী বিচার করতে হয়, এর কোনো চিরন্তন সংজ্ঞা নেই। আপনি কোনো ব্যক্তিকে প্রতিটি ক্ষেত্রে অবিশ্বাস করতে পারবেন না; উদাহরণস্বরূপ: আপনার হয়তো দলের কোনো সদস্যের প্রযুক্তিগত দক্ষতা নিয়ে অনাস্থা থাকতে পারে, কিন্তু একইসঙ্গে ক্লায়েন্টদের কাছে তার আইডিয়া উপস্থাপনের দক্ষতা নিয়ে সন্দেহ করা উচিত নয়। 

গবেষণায় দেখা গেছে, ‘বিশ্বাস’ বিষয়টির মধ্যে তিনটি উপাদান রয়েছে- যোগ্যতা বা সক্ষমতা, ধারাবাহিকতা ও চরিত্র। 

কারো যোগ্যতায় বিশ্বাস রাখা মানে তারা কাজ করতে সক্ষম বলেই বিশ্বাস রাখা। ধারাবাহিকতা বলতে এখানে বোঝানো হচ্ছে যে, ঐ ব্যক্তি আসলে নির্ভরযোগ্য- তারা মুখে যা বলে তা-ই করে দেখাতে পারবে, তাদের আচরণে একটা সামঞ্জস্য আছে। আর সবশেষে, তাদের চরিত্রে বিশ্বাস রাখা মানে এই বিশ্বাস রাখা যে তাদের মধ্যে বিশুদ্ধতা রয়েছে এবং তারা নিজের ও অন্যের প্রয়োজনের দিকে নজর রাখে, যত্ন নেয়। একটা তিন-পায়ার টুলের প্রতিটি পায়াই যেমন অত্যাবশ্যক, বিশ্বাসের প্রতিটি উপাদানও একটি সম্পর্কের ক্ষেত্রে ঠিক তেমনি গুরুত্বপূর্ণ।

আপনি একসময় যাকে ভাবতেন, ‘সে তো বিশ্বাসযোগ্য নয়’, সেই পরিপ্রেক্ষিতে আবারও নিজেকে প্রশ্ন করুন যে, এখানে বিশ্বাসের কোন উপাদানের ঘাটতি আছে? এই ব্যক্তি আসলে কি করেছে বা কি করেনি যাতে আমার মধ্যে অবিশ্বাস জন্ম নিল? কোনটা অনুমান, আর কোনটা সত্য- এই দুইয়ের মধ্যে পার্থক্য খুঁজে বের করুন এবং আচরণের সমস্যাগুলো ঠিক করুন।

২. সুনির্দিষ্ট পরিস্থিতি বা অ্যাসাইনমেন্ট চিহ্নিত করা

কোন কোন ক্ষেত্রে আপনি কর্মীদের ওপর আস্থা রাখেন তার একটি তালিকা তৈরি করুন এবং কম ঝুঁকিপূর্ণ উপায়ে কিভাবে এই আস্থা আরও বাড়ানো যায় তার উপায় খুঁজুন। বিষয়টিকে এভাবে ব্যাখ্যা করা যেতে পারে:

– আপনার যদি কোনো কর্মীর টিমের মধ্যেই কার্যকরীভাবে যোগাযোগ চালিয়ে যাওয়ার দক্ষতায় বিশ্বাস থাকে, তাহলে তাদেরকে ক্রস-ফাংশনাল মিটিংগুলোতে কিংবা বড় পরিসরের আলোচনায় যুক্ত করুন।

– যদি কোনো কর্মীর প্রযুক্তিগত দক্ষতায় বিশ্বাস থাকে তাহলে তাকে টিমের নতুন কোনো সদস্যের মেন্টরিং করার দায়িত্ব দিন অথবা জটিল কোনো টাস্কে যুক্ত করুন।

– যদি কোনো কোনো কর্মীর সমস্যা সমাধানে দক্ষতার ওপর বিশ্বাস থাকে, তাহলে তাদেরকে জটিল কাজগুলোর দায়িত্ব দিন কিংবা সমস্যা সমাধানের ক্ষেত্রে তাদের নিজস্ব বিচারবুদ্ধি প্রয়োগের স্বাধীনতা দিন।

কর্মীদের নেতৃত্ব দেওয়া এবং তাদেরকে দায়িত্বশীল করে তোলার প্রক্রিয়ায় স্পষ্ট ও ঘন ঘন যোগাযোগ বজায় রাখুন। একটি টাস্কের উদ্দেশ্য এবং কী ফলাফল প্রত্যাশা করছেন, কেমন মানের চাইছেন, ডেডলাইন কবে, টাস্ক-সম্পর্কিত সিদ্ধান্ত নেওয়ায় তাদের হাতে ক্ষমতা কতটুকু- এই সবকিছু নিয়ে আলোচনা করুন।

আবার কর্মীদের বিশ্বাস আদায় করতে গেলে নেতাকেও একই রকম সমর্থন দিতে হবে, কর্মীদের সাথে সরাসরি কথা বলতে হবে। শিডিউলে থাকা আনুষ্ঠানিক মিটিং এর বাইরেও কর্মীরা যাতে নির্দ্বিধায় আপনার সঙ্গে আলোচনা করতে এগিয়ে আসে, সেই দরজাও খোলা রাখতে হবে।

যখন আমরা অনুভব করি যে একটা মানুষকে বিশ্বাস করতে পারছি না, তখন আমাদের মনে ভয় কাজ করে যে আবারও তাকে বিশ্বাস করলে কী পরিণাম হবে; ফলে বসের নিয়ন্ত্রণ আরও বেড়ে যায়। তাই কাউকে তার বিশ্বাসযোগ্যতা প্রমাণের সুযোগ আগে দিতে হবে। বস হয়ে কর্মীদের অতিরিক্ত নিয়ন্ত্রণ করতে চাইলে কর্মীদের সৃজনশীলতা, কার্যক্ষমতা এবং কর্তৃত্ববোধ কমে যায়, যা তাদেরকে এমন আচরণ করতে বাধ্য করতে পারে যা আপনার বিশ্বাস আরও ভেঙে দিতে পারে।

৩. অবিশ্বাসের বিষয়গুলো নিয়ে ফিডব্যাক দেওয়া

আগের একটি পয়েন্টে বিশ্বাসের তিনটি উপাদানের কথা বলা হয়েছে, এর মধ্যে কোনটি সবচেয়ে কম আছে কর্মীর মধ্যে, তার কোন আচরণে আপনার সবচেয়ে বেশি বিশ্বাসভঙ্গ হয়েছে তা স্পষ্টভাবে চিহ্নিত করুন। উদাহরণস্বরূপ, ধরা যাক আপনি বুঝতে পেরেছেন যে আপনার অবিশ্বাসের উৎস হলো কাজে নিয়মিত না হওয়া। কিন্তু এর পেছনে কর্মীর কোন আচরণটি দায়ী? ডেডলাইন মিস করেছে নাকি কথা দিয়েও কাজ করেনি নাকি আপনার যোগাযোগে সাড়া দেয়নি?

কর্মীর যেসব আচরণে আপনার সমস্যা মনে হয়, সেগুলো প্রতিটি পয়েন্ট ধরে বর্ণনা করুন, এর ক্ষতিকর প্রভাব তাকে জানান এবং কিভাবে এগুলো পেছনে ফেলে আরও কর্মক্ষম হওয়া যাবে তা নিয়ে আলোচনা করুন।

উচ্চমানের ফিডব্যাক টিমের সদস্যদের সঙ্গে বসের সম্পর্ক জোরদার করে এবং বিশ্বাস স্থাপন করে। মনে রাখবেন, কেউই নিজেদেরকে বিশ্বাসের অযোগ্য বলে ভাবে না, তাই আলোচনা চলাকালীন কাউকে সরাসরি বলা যাবেনা যে বস হয়ে আপনি তাদেরকে ‘বিশ্বাস’ করেন না।

৪. নেতা হিসেবে নিজে ভূমিকা রাখা

যখন অবিশ্বাস নিয়ে জটিলতা তৈরি হয়, এমন পরিস্থিতিতে একজন নেতার কী করণীয় সেটিও লক্ষ্য রাখতে হবে। সম্পর্ক ভালো রাখতে ও কাজে ভালো ফলাফল পেতে চাইলে প্রতিটি মানুষের অংশগ্রহণ দরকার। তাই বস বা নেতা হিসেবে নিজের অবস্থান, ভূমিকাও জানিয়ে দিতে হবে। যখন কর্মীরা তাদের দায়িত্ব-কর্তব্য ও বসের প্রত্যাশা সঠিকভাবে বুঝে নেয় না, তখন বিশ্বাসভঙ্গের ঝুঁকি থাকে। এমনও হতে পারে যে আপনি যথেষ্ট দিকনির্দেশনা দেননি বা স্পষ্টভাবে বোঝাতে পারেননি?

আরও পড়তে পারেন-

বিশ্বাসের বিষয়টি পারস্পরিক হতে হয়। কেউ যদি আপনাকে বিশ্বাস করে, আপনার উচিত এর বিনিময়ে তাকে আরও বেশি বিশ্বাস করা। আপনার বিশ্বাস অর্জন করতে অন্যের কী করা উচিত সেদিকে মনোযোগ দেওয়ার পরিবর্তে যদি ভাবেন, আপনি কোনটিকে বিশ্বাস অর্জন বলে মনে করেন তার ইঙ্গিত দেওয়া উচিত, তাহলে ব্যাপারটা কেমন হয়? সম্প্রতি নিজে কোনো ভুল করে থাকলেও সে বিষয়ে সৎ মতামত প্রদানের মাধ্যমে নিজের চরিত্র তাদের সামনে ফুটিয়ে তুলতে পারেন।

দৃষ্টিগোচরতার অভাবেও অবিশ্বাস তৈরি হতে পারে। আজকাল কর্মীদের সাথে নেতাদের যে বিক্ষিপ্ত যোগাযোগ ঘটে তাতে নেতিবাচক ও ভিত্তিহীন অনুমানের অনেক সুযোগ থাকে। তাই মুখোমুখি আলোচনা করলে বিষয়গুলো অনেক সহজ হয়ে যায়।

৫. যে বিশ্বাস ভঙ্গ হয়েছে তা অপূরণীয় কিনা নিজেকে প্রশ্ন করা

কোনো সম্পর্কের মধ্যে, বিশ্বাস যদিও একটা অনুভব করার মতো বিষয়, কিন্তু কখনো কখনো পরিস্থিতি এমন হয় যে ওই অবিশ্বাসের জায়গা থেকে বেরিয়ে আসা কঠিন হয়; যেমন- টিমের কেউ মিথ্যা বলেছে বা গোপনীয়তা ভঙ্গ করেছে, অথবা অসম্মানকর আচরণ করেছে। কেউ কেউ একেবারে সীমা লঙ্ঘন করলে সেক্ষেত্রে তদন্ত থেকে শুরু করে চাকরিচ্যুতও হতে পারে।

আবার কখনো যদি এমন হয় যে অবিশ্বাসমূলক আচরণ ততটা গুরুতর নয়, কিন্তু আপনি নিজে ভালো সম্পর্ক রাখতে চাইলেও তাতে লাভ হচ্ছে না, সেক্ষেত্রে এইচআর-এর সঙ্গে আলোচনা করে দুই পক্ষ সরে আসার সুযোগও থাকে।

কোনো প্রতিষ্ঠানের নেতৃত্বে থেকে যদি কর্মীদেরকে বিশ্বাসের বিষয়ে সমস্যায় পড়েন, তাহলে উপরোক্ত ধাপগুলো অনুসরণ করে পরিকল্পনা তৈরি করে সেই মোতাবেক এগোতে পারেন এবং সিদ্ধান্ত নিতে পারে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই বিশ্বাস আবার স্থাপন করা যায় এমন চিন্তা নিয়ে কাজ করলে, উভয় পক্ষই সময় নিলে কর্মী-নিয়োগকর্তার মধ্যে সুন্দর সম্পর্ক গড়ে তোলা সম্ভব।

সূত্র- হার্ভার্ড বিজনেস রিভিউ

উম্মাহ২৪ডটকম: এমএ

উম্মাহ পড়তে ক্লিক করুন-
https://www.ummah24.com

দেশি-বিদেশি খবরসহ ইসলামী ভাবধারার গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে ‘উম্মাহ’র ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।