Home ফিকহ ও মাসায়েল ফিহকী আলোচনা: নামায আদায়ে নারী-পুরুষের পার্থক্যসমূহ

ফিহকী আলোচনা: নামায আদায়ে নারী-পুরুষের পার্থক্যসমূহ

।। আল্লামা মুফতি জসিমুদ্দীন ।।

প্রশ্ন: পুরুষ ও মহিলার সালাত কি একই রকম, না ভিন্ন? আমাদের এলাকার এক ব্যক্তি বললেন, পুরুষ-মহিলার নামাযে কোনো পার্থক্য নেই। পুরুষরা যেভাবে সালাত আদায় করে মহিলারা সেভাবেই আদায় করবে। এ ব্যক্তির দাবি কতটুকু সঠিক? দলীলসহ জানতে চাই।

– আসমা আনসারী, পল্লবী, মিরপুর, ঢাকা।

ফতোয়া: পুরুষ ও মহিলার নামাযের পদ্ধতি এক নয়; কিছুটা পার্থক্য রয়েছে। একাধিক সহীহ হাদীস দ্বারা তা প্রমাণিত। পক্ষান্তরে ‘পুরুষ ও মহিলার নামায এক’ এ দাবীর স্বপক্ষে একটি সুনিশ্চিত মারফূ সহীহ হাদীসও নেই।

প্রমাণ হিসেবে প্রথমে পদ্ধতিগত ভিন্নতা প্রকাশক কিছু হাদীস তুলে ধরা হলো তারপর প্রশ্নোক্ত ব্যক্তির দাবি নিয়ে কিছু বিশ্লেষণ পেশ করা হবে। ইনশা আল্লাহ।

১. পুরুষরা নামাযে ইমামকে সশব্দে লোকমা দিতে পারলেও মহিলারা সশব্দে লোকমা দিতে পারবে না। লোকমা দিতে চাইলে হাতের উপর হাত চাপড়িয়ে সতর্ক করতে পারবে। হযরত আবু হুরায়রা রা. রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে বর্ণনা করেন-

التسبيح للرجال , والتصفيق للنساء

“ইমামের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য) পুরুষের বেলায় তাসবীহ (সুবহানাল্লাহ) বলা। মহিলারা তাসফীক (হাতের তালু দিয়ে আওয়ায করা।’’ (সহীহ বুখারী, হাদীস- ১২০৪)। 

২. পুরুষরা জামাআতের প্রথম কাতারে দাঁড়াবে। আর পুরুষদের উপস্থিতিতে মহিলাদের জন্য প্রথম কাতারে দাঁড়ানোর অনুমতি নেই। হযরত আবু হুরায়রা রা. রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে বর্ণনা করেন-

خَيْرُ صُفُوفِ الرِّجالِ أوَّلُها، وشَرُّها آخِرُها، وخَيْرُ صُفُوفِ النِّساءِ آخِرُها، وشَرُّها أوَّلُها

“পুরুষের সর্বোত্তম কাতার হচ্ছে প্রথমটি আর সবচেয়ে অনুত্তম হচ্ছে শেষেরটি। পক্ষান্তরে নারীদের সর্বোত্তম কাতার হচ্ছে শেষেরটি এবং সবচেয়ে অনুত্তম কাতার হচ্ছে প্রথমটি।” (সহীহ মুসলিম, হাদীস- ৮৭১)।

৩. পুরুষদের মসজিদে উপস্থিত হওয়া আবশ্যক। আর মহিলাদের উপস্থিত না হওয়াই কাম্য। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন-

صلاة المرأة في بيتها أفضل من صلاتها في حجرتها، وصلاتها في مخدعها أفضل من صلاتها في بيتها

“নারীদের জন্য ঘরের আঙ্গিনায় নামায আদায়ের চেয়ে তার গৃহে নামায আদায় করা উত্তম। গৃহের যেকোনো স্থানে নামায আদায় করা থেকে গোপন কক্ষে নামায আদায় উত্তম।” (সহীহ ইবনে খুযায়মা, হাদীস-১৬৮৮, আবু দাউদ, হাদীস- ৫৭০, হাদীস সহীহ )।

৪. জুমুআর নামায পুরুষদের উপর ফরয। মহিলাদের উপর ফরয নয়। যা সহীহ হাদীস ও উম্মতের সকলের ঐকমত্য দ্বারা প্রমাণিত। হযরত ত্বারিক ইবনে শিহাব রা. রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে বর্ণনা করেন-

الجُمُعةُ حقٌّ واجبٌ على كلِّ مسلمٍ في جماعةٍ، إلَّا أربعةً: عبدٌ مملوكٌ، وامرأةٌ، أو صَبِيٌّ، أو مريضٌ.

“জুমুআর নামায একটি অবধারিত বিষয়, যা প্রত্যেক মুসলমানের উপর জামাতের সাথে আদায় করা ওয়াজিব। তবে চার শ্রেণীর লোকের জন্য ওয়াজিব নয়। ক্রীতাদাস, নারী, শিশু ও রোগী। (সুনানে আবু দাউদ, ১০৬৭ সহীহ)।

৫. মহিলারা নামাযে সর্বাত্মক জড়সড় হয়ে থাকবে। অপরদিকে পুরুষদের ক্ষেত্রে জড়সড় নয় বরং কয়েক স্থানে অঙ্গসমূহ ফাঁকা রাখার আদেশ বর্ণিত হয়েছে। হযরত ইয়াযীদ ইবনে আবী হাবীব বলেন-

أن رسول الله – صلى الله عليه وسلم – مر على امرأتين تصليان فقال اذا سجدتما فضما بعض اللحم الى الأرض فإن المرأة ليست في ذلك كالرجل.

“একবার রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নামাযরত দুই মহিলার পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন। তখন তাদেরকে (সংশোধনের উদ্দেশ্যে) বললেন যখন সিজদা করবে তখন শরীর জমিনের সাথে মিলিয়ে দিবে। কেননা মহিলাগণ নামাযের ক্ষেত্রে পুরুষদের মত নয়।” (সালিহ, কিতাবুল মারাসিল, ইমাম আবু দাউদ, পৃ. ১১৭, সুনানে কুবরা বায়হাকী-২/২২৩)।

হাদীসটি ইমাম আবু দাউদ রহ. এর নিকট দলীলযোগ্য। সনদে ইরসাল থাকলেও তা এখানে প্রভাবক নয়। কারণ, হাদীসটির স্বপক্ষে যথার্থ তালাক্কী ও শাহিদ রয়েছে। লা-মাযহাবী আলেম মাওলানা সিদ্দীক হাসান খান সাহেবও হাদীসটিকে দলীলযোগ্য স্বীকার করেছেন। (আউনুল বারী ১/৫২০)।

মুহাদ্দিস মুহাম্মাদ বিন ইসমাইল আলইয়ামানী ‘সুবুলুস সালাম শারহু বুলুগিল মারাম’ গ্রন্থে (১/৩৫১ ৩৫২) এই হাদীসকে দলীল হিসেবে গ্রহণ করেছেন। প্রসিদ্ধ মুহাদ্দিস শায়েখ শুয়াইব আরনাউত রাহ. হাদীসটির সনদ সম্পর্কে বলেন, বণর্না কারী সকল রাবী সিকাহ বা নির্ভরযোগ্য । (মারাসিলে আবু দাউদ পৃঃ ১১৭ টিকা) ।

বিষয়টি বোঝার জন্য সংক্ষেপে এখানে কয়েকটি সহীহ হাদীস পেশ করা হলো। অন্যথায় এ বিষয়ক আরও হাদীস রয়েছে।

মুহাদ্দিসীন ইমামদের নিকট পুরুষ-মহিলার নামাযের পদ্ধতিগত ভিন্নতা একটি সুপ্রসিদ্ধ বিষয়। অনেকে নিজ নিজ কিতাবে স্বতন্ত্র অধ্যায় স্থাপন করে মহিলার নামাযের বিবরণ উল্লেখ করেছেন। যা থেকে সুস্পষ্টভাবে উভয়ের পদ্ধতিগত ভিন্নতা প্রমাণিত হয়। যেমন: ইমাম বায়হাকী রাহ. সুনানে কুবরা গ্রন্থে – “باب ما يستحب للمرأة من ترك التجافي في الركوع والسجود” (রুকূ সিজদায় মহিলাদের শরীর মিলিয়ে রাখা মুসতাহাব) নামে একটি স্বতন্ত্র অধ্যায় কায়েম করেছেন।

বোঝার বিষয় হলো, পুরুষ ও মহিলার নামাযে পদ্ধতিগত ভিন্নতা না থাকলে ভিন্নতা প্রকাশক এতগুলো হাদীস বর্ণিত হতো না এবং মুহাদ্দিস ইমামগণ মহিলাদের জন্য নামাযের ভিন্ন পরিচ্ছেদও লিখতেন না।

পুরুষ ও মহিলার নামাযের ভিন্নতা সুপ্রতিষ্ঠিত হওয়া সত্ত্বেও কিছু ব্যক্তি মনে করেন, পুরুষ ও মহিলার নামাযের পদ্ধতি এক; কোনো পার্থক্য নেই। তারা এ দাবীর সপক্ষে আজও কোনো পরিষ্কার মারফূ হাদীস পেশ করতে পারেনি। বরং যা উল্লেখ করেছে তা খোদ মুহাদ্দিসগণের নিকটেই ব্যাখ্যাসাপেক্ষ ও অস্পষ্ট। দাবীর স্বপক্ষে তারা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও সাহাবায়ে কেরামের কোনো সরাসরি বক্তব্য না পেয়ে একজন তাবেঈর আমল পেশ করে থাকেন। যেমন- وكانت أم الدرداء تجلس في صلاتها جلسة الرجل وكانت فقيهة. “উম্মে দারদা (রাহ.) তার সালাতে পুরুষের মতই বসতেন। আর তিনি একজন ফকীহা ছিলেন।” (সহীহ বুখারী- ১/২৮৪)।

উম্মে দারদা পুরুষের মত বসতেন তবে তিনি বাম নিতম্বের দিকে ঝুঁকে বসতেন। )ফাতহুল বারী-ইবনে রজব- ২/৩৫৫)।

তারীখের কিতাবগুলোতে রয়েছে, উম্মে দারদা খুব অল্প বয়সী ও ইয়াতীমাহ ছিলেন। তাই তিনি পুরুষের কাতারে দাঁড়িয়ে নামায আদায় করতেন এবং পুরুষদের ক্বিরাতের মজলিসেও বসতেন। এরপর তিনি বড় হলে একদিন তাকে আবু দারদা রা. মহিলাদের কাতারে যুক্ত হতে বলেন। এ থেকে বোঝা যায়, তিনি নামাযে যদি পুরুষদের মত বসেও থাকেন, তবে সেটা পুরুষদের দেখে দেখে করতেন ঐ বয়সে, যখন তিনি সাবালিকা হননি। (সিয়ারু আলামিন নুবালা ৪/২৭৮, তারীখুল ইসলাম ২/১০২৫, তাহযীবুল কামাল ৩৫/৩৫৪)।

খোদ এই হাদীস থেকেই প্রমাণিত হয় যে, উম্মে দারদা রা. হুবহু পুরুষের মত বসতেন না। এতে পুরুষের নামাযের চেয়ে ভিন্নতাই প্রমাণিত হয়।

তদুপরি উম্মে দারদা (রহ.)এর আমলটাকে বিবেচনা করা হলেও, এতগুলো সহীহ হাদীসের বিপরীতে একজন তাবেঈয়ার কথা দলীলযোগ্য হতে পারে না। এ ছাড়া তারা নিম্নের ব্যাপক অর্থবোধক হাদীসটিও প্রমাণস্বরূপ উল্লেখ করে থাকে।

ﻓَﻘَﺎﻝَ : ﺍﺭْﺟِﻌُﻮﺍ ﺇِﻟَﻰ ﺃَﻫْﻠِﻴﻜُﻢْ، ﻓَﻌَﻠِّﻤُﻮﻫُﻢْ ﻭَﻣُﺮُﻭﻫُﻢْ، ﻭَﺻَﻠُّﻮﺍ ﻛَﻤَﺎ ﺭَﺃَﻳْﺘُﻤُﻮﻧِﻲ ﺃُﺻَﻠِّﻲ، ﻭَﺇِﺫَﺍ ﺣَﻀَﺮَﺕِ ﺍﻟﺼَّﻼَﺓُ، ﻓَﻠْﻴُﺆَﺫِّﻥْ ﻟَﻜُﻢْ ﺃَﺣَﺪُﻛُﻢْ، ﺛُﻢَّ ﻟِﻴَﺆُﻣَّﻜُﻢْ ﺃَﻛْﺒَﺮُﻛُﻢْ

“…তিনি বললেন, তোমরা তোমাদের পরিবার-পরিজনের নিকট ফিরে যাও। তাদের (কুরআন) শিক্ষা দাও, সৎ কাজের আদেশ কর এবং যেভাবে আমাকে সালাত আদায় করতে দেখেছ ঠিক তেমনভাবে সালাত আদায় কর। সালাতের ওয়াক্ত হলে, তোমাদের একজন আযান দেবে এবং যে তোমাদের মধ্যে বড় সে ইমামতি করবে।” ( সহীহ বুখারী, হাদীস-৬০০৮)।

হাদীসটির পর্যালোচনা:

হাদীসটির মাধ্যমে নারী পুরুষের নামায এক ও অভিন্ন প্রমাণ করার বিষয়টি যথার্থ নয়। ফলে যারাই প্রমাণ করার চেষ্টা করেছেন তারা নবোদ্ভাবিত ব্যাখ্যার আশ্রয় নিয়েছেন। যা একাধিক সহীহ হাদীস, সাহাবায়ে কেরামের এবং সংখ্যাগরিষ্ঠ আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআতের সর্বসম্মত সিদ্ধান্তের বিপরীত।

নিম্নোল্লিখিত মৌলিক কয়েকটি দিক লক্ষ করলে আমরা সহজেই বুঝতে পারবো-

১) এ হাদীসটি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পুরুষদেও খেতাব করে বলেছেন। হাদীসের মধ্যেই তা স্পষ্ট করে বলা আছে।

২) হাদীসটির শেষাংশে রয়েছে যে, নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আযান ও ইমামতের নির্দেশ দিয়েছেন। এই নির্দেশটি আরো স্পষ্ট করে যে, এখানে নারী পুরুষ উভয়কেই সম্বোধন করা হয়নি।  কারণ সকলেই একমত , নারীদের উপর আযান ও ইমামতের দায়িত্ব অর্পন করা হয়নি। 

৩) হাদীসটিতে صلوا  (তোমরা পুরুষরা নামায আদায় করো) ক্রিয়াপদটি আরবি ভাষায় ব্যবহৃত হয়েছে বহুবচনে পুরুষকে সম্বোধন করার জন্য। অর্থাৎ হে পুরুষেরা, তোমরা  আমার মত নামায আদায় করো। মহিলাদের সম্বোধন করা হলে  صلین বলা হতো।

প্রকাশ থাকে যে, শরীআতের অনেক নুসূসের মধ্যে পুরুষকে সম্বোধন করা হয়েছে; কিন্তু বিধানটি নারীদেরকেও শামিল করে। এটা হলো দ্বিতীয় পর্যায়ের বিষয়। অন্য দলীলের আলোকে বিবেচনা করে এ সিদ্ধান্তে উপনীত হতে হয় যে, এই বিধানটি শুধুই পুরুষের জন্য; না এই বিধানে নারীও শামিল।

এ নীতির আলোকে উক্ত মাসাআলায় অন্য দলীল বিবেচনা করা হলে এটাই স্পষ্ট হয় যে, নারী পুরুষের নামাযে ভিন্নতা এবং বিবিধ পার্থক্য বিদ্যমান। যা একাধিক সহীহ হাদীস দ্বারা প্রমাণিত (যা পূর্বের আলোচনায় উল্লেখিত হয়েছে)। তাই “ كما رأيتموني أصلي” হাদীসটির বিধান নারীদের শামিল করবে না।

৪) সাহাবায়ে কেরাম রাযিয়াল্লাহু আনহুম, তাবেয়ীন, পরবর্তী প্রসিদ্ধ ইমাম, মুজতাহিদীন ফুকাহাদের রাহ. কোনো একজনও উক্ত হাদীসের ব্যাপকতায় মহিলাদের শামিল করেননি। মুহাদ্দিসিনে কেরামও হাদীসটির ব্যাখ্যায় মহিলাদের অন্তর্ভূক্ত করে বলেননি যে, নারী পুরুষের নামায এক; কোনো ভিন্নতা নেই। শায়খ আলবানি রাহ. তার কিতাবে জমহুরের মতের বিপরীত শুধু ইবনে হাযম যাহেরী রহ. এর মত উপস্থাপন করেছেন। ইবনে হাযম যাহেরী রাহ. খাইরুল কুরুনেরও মানুষ ছিলেন না! তার জন্ম ৩৯৪ হি. ইন্তেকাল ৪৫৬ হি.। অর্থাৎ ইবনে হাযম যাহেরীর রাহ. পুরুষ ও মহিলার নামাযে পার্থক্য না থাকার মতটি নবোদ্ভাবিত!

৫) হাদীসটিতে যদি হুবহু রাসূল (সা.)এর মত নামায আদায় করতে মহিলাদের নির্দেশ দেওয়া হয়ে থাকে, তাহলে রাসূল (সা.)এর নামাযের অন্যান্য আমল, যেমন: টাখনু খোলা রেখে নামাজ আদায়, আযান, ইকামত, ইমামতি ও উচ্চৈঃস্বরে কিরাআত পড়া ইত্যাদি বিষয়ও কি রাসূলুল্লাহ সাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মহিলাদের শিখাতে বলেছেন? যদি উত্তর হয় ‘না’ তাহলে বোঝা  গেলো, হাদীসে মহিলাদের নামায আলোচ্য বিষয় নয়।

হাদীসটিতে মহিলাদের নামাযও শামিল থাকলে রাসূল সাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নামাযের পার্থক্যগুলো বলে দিতেন যে, মহিলারা আস্তে কিরাআত পড়বে, টাখনু ঢাকবে, চুল খোলা রাখবে না, আযান ইকামাত দিবে না, পুরুষের মত বসবে না ইত্যাদি।

কারণ এগুলো তো রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নামাযের বিপরীত চিত্র, যা মালিক বিন হুয়াইরিস (রাযি.) দেখেছেন। মালিক বিন হুয়াইরিস (রাযি.)এর যত রেওয়ায়েত আছে একটি রেওয়াতেও এ সকল পার্থক্যের কথা বর্ণিত হয়নি।

৬) রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ‘আদেশ সূচক’ বাক্যে বলেছেন صلوا “তোমরা নামায পড়” । সকলের ঐকমত্যেই আদেশটি দ্বারা ওয়াজিব সাবস্ত হয়েছে। হাদীসটির বার্তাকে যদি ব্যাপকার্থে আদেশ হিসেবে গ্রহণ করা হয়, তাহলে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সুন্নাত, মুসতাহাব বিষয়গুলোও ওয়াজিবে পরিণত হয়ে যাবে এবং নামাযে সুন্নাত, মুসতাহাব বলে কিছু থাকবে না। অথচ একাধিক সহীহ হাদীসের মাধ্যমে প্রমাণিত যে, নামাযের স্বতন্ত্র সুন্নাত, মুসতাহাব রয়েছে। এ থেকে প্রমাণ হয়, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ হাদীসটিতে ব্যাপকভাবে আদেশ দেননি; বরং নির্দিষ্ট কিছু বিধানের জন্য আদেশ করেছেন।

আরও পড়তে পারেন-

বিশিষ্ট মুহাদ্দিস ইমাম ইবনে হিব্বান (রহ.) এ হাদীসটি উল্লেখ করে বলেন, “হাদীসটি খাস তথা বিশেষ বিশেষ বিধানের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য, সর্বক্ষেত্রে নয়” (৪/৫৪১)।

  * لَفْظَةُ أَمْرٍ تَشْتَمِلُ عَلَى كُلِّ شَيْءٍ كَانَ يَسْتَعْمِلُهُ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فِي صَلَاتِهِ، فَمَا كَانَ مِنْ تِلْكَ الْأَشْيَاءِ خَصَّهُ الْإِجْمَاعُ أَوِ الْخَبَرُ بِالنَّفْلِ، فَهُوَ لَا حَرَجَ عَلَى تَارِكِهِ فِي صَلَاتِهِ،…

এ ছাড়া পূর্বের হাদীসগুলো বিবেচনা করলেও বোঝা যায় যে, আলোচ্য হাদীস সবার জন্য নয় এবং সর্বক্ষেত্রে নয়।

এই হলো তাদের দলীল। যা তুলনামূলক বিচারে গ্রহণযোগ্য নয়। এখন প্রশ্ন জাগে, তাহলে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হাদীসটিতে কীসের আদেশ দিয়েছেন? অথবা হাদীসটির সঠিক ব্যাখ্যা কী হবে?

হাদীসটির সুপ্রসিদ্ধ ও স্বীকৃত ব্যাখ্যা হলো, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উক্ত হাদীসে নামাযের মৌলিক বিষয়গুলোর প্রতি ইঙ্গিত করেছেন। যেমন: কিয়াম-কিরাআত, রুকূ-সেজদা, কওমা-জলসা, তাহরীম-তাসলীম ইত্যাদি। এ সবগুলো হুকুম আদায় করতে হবে একাগ্রতা, স্থির ও ধীরতার সাথে। কোনো প্রকার তাড়াহুড়ো করা যাবে না। যখন যা প্রযোজ্য রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অনুকরণেই করতে হবে।

প্রখ্যাত হাদীসবিশারদ মোল্লা আলী কারী (রহ.) বিষয়টি স্পষ্ট করে আলোচনা করেছেন। তিনি বলেন- صلوا كما رأيتموني أصلي أي في مراعاة الشروط والأركان أو فيما هو أعم منهما. অর্থাৎ- “তোমরা যেভাবে আমাকে নামাজ আদায় করতে দেখেছ সেভাবে নামায আদায় করবে হুকুমটি আরোপিত হবে নামাযের শর্ত ও রোকন জাতীয় আমলগুলো যথাযথ আদায়ের ক্ষেত্রে।” (মিরকাতুল মাফাতীহ, ৩৫১/২)।    

সর্বোপরি পুরুষ ও মহিলার নামাযের পার্থক্য মুসলিম উম্মাহর ধারাবাহিক তালাক্বী ও কর্মধারার মাধ্যমে প্রমাণিত এবং প্রায় দেড় হাজার বছরের অবিচ্ছিন্ন কর্মধারার মাধ্যমে সুপ্রতিষ্ঠিত। বর্তমানে নতুন করে ভিন্নতার দাবি তোলা একটি মুনকার কাজ ; যা পরিত্যাজ্য।

পুরুষ-মহিলার নামাযে পার্থক্যপূর্ণ বিধানসমূহ

প্রশ্ন: পুরুষ-মহিলার নামাযের মাঝে কোন কোন বিষয়ে পার্থক্য রয়েছে? শরঈ দলীলের আলোকে জানালে কৃতজ্ঞ হবো। -ইয়াসীর আরাফাত, নরসিংদী।

ফতোয়া: পুরুষ ও মহিলার নামাযের পদ্ধতি এক নয় যা একটি প্রতিষ্ঠিত কথা। সালাফের যামানা থেকেই পদ্ধতিগত এ ভিন্নতা অনুসৃত। গুরুত্বপূর্ণ অনেক বিধানেই এ পার্থক্য রয়েছে।

কিছু পার্থক্য তো সরাসরি হাদীসে সুস্পষ্টরূপে বর্ণিত হয়েছে। কিছু পার্থক্য সাহাবায়ে কেরাম রা. থেকে স্পষ্টরূপে প্রমাণিত। যারা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে সরাসরি অনুশীলনের মাধ্যমে নামায শিখেছেন। ফলে তাদের নামায ছিলো রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামেরই নামায।

আর কিছু পার্থক্য ফুকাহায়ে কিরাম ঐ সকল হাদীসের ব্যাপকতা থেকে স্বীকৃত পদ্ধতিতে উদঘাটন করেছেন।

পার্থক্যের বিবরণের পূর্বে একটি মৌলিক নীতি স্মরণ রাখলে আলোচনা বুঝতে সহজ হবে ইনশাআল্লাহ।

সর্বজন স্বীকৃত যে, মুসলমান মা-বোনদের ক্ষেত্রে শরীআতের ব্যাপক নীতি হলো, প্রত্যেক কাজে তারা তাদের সতর ও পর্দার প্রতি বিশেষ লক্ষ্য রাখবে। সতর ও পর্দার পূর্ণ হেফাযতের সাথে জীবনযাপন তাদের উপর শরঈ ফরয। মহিলাদের নামাযের ক্ষেত্রে প্রায় পুরো শরীর সতর ও পর্দার অন্তর্ভুক্ত। তাই তাদের সতর ও পর্দা যাতে অধিক রক্ষা হয়, সে দিকটি শরীআতে বিশেষ বিবেচনায় রাখা হয়েছে। এবং তাদের সতর ও পর্দার পূর্ণ হেফাযতের লক্ষ্যেই শরঈ বিধি-বিধান পালন করতে গিয়ে কোনো কোনো ক্ষেত্রে পুরুষ ও মহিলার মাঝে পার্থক্য সৃষ্টি হয়েছে। যা সর্বসম্মত ও স্বতঃসিদ্ধ।

হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসঊদ রা. রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে বর্ণনা করেন- المرأةُ عَورة. “মহিলারা হচ্ছে পর্দানশীন (যা আবরণে ঢেকে রাখা হয়)”। (তিরমিযী, হাদীস-১১৭৩, সহীহ)।

নামায সংক্রান্ত অনেক হাদীসে নারীদের সতর এবং পর্দার বিষয়টিই গুরুত্ব পেয়েছে। ফলে নারীদের ওড়না পরিধান করা, নামাযে সারা শরীর ঢেকে রাখা আবশ্যক করা হয়েছে এবং জামাআতে শরীক না হয়ে ঘরে একাকী নামায পড়া উত্তম বলা হয়েছে। 

মোদ্দাকথা মহিলাদের নামাযের ভিন্ন পদ্ধতির বড় একটি লক্ষ্য হলো সতর রক্ষা। ইমাম বায়হাকী রাহ. বিষয়টি স্পষ্ট করে উল্লেখ করেছেন- جماع ما يفارق المرأة فيه للرجل من أحكام الصلاة راجع الستر، وهي انما مأمورة بكل ما هو أستر لها. অর্থাৎ- “নারীদের পর্দা এবং সতরের হেফাযতের জন্যই নারী-পুরুষের নামাযের পার্থক্য সূচিত হয়েছে। সুতরাং যেভাবে নামায আদায় করলে তাদের পর্দা এবং সতরের অধিক হেফাজত হবে সেভাবেই নামায আদায় করতে নির্দেশ করা হয়েছে”। (সুনানে বায়হাকী- ২/২২২)।

নিম্নে সংক্ষেপে পুরুষ মহিলার নামাযের পদ্ধতিগত ভিন্নতা তুলে ধরা হলো-

১. কিয়াম ও তাকবীরে তাহরীমা:

ক. পুরুষগণ দাঁড়ানো অবস্থায় দু’পায়ের মাঝখানে চার আঙুল পরিমাণ ফাঁকা রাখবে। মহিলাগণ ফাঁকা রাখবে না। বরং মিলিয়ে রাখবে।

হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. কে মহিলাদের নামাযের পদ্ধতি সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হলে উত্তরে তিনি বলেছেন,   تجتمع وتحتفز. “(মহিলা) খুব জড়সড় হয়ে অঙ্গের সাথে অঙ্গ মিলিয়ে নামায আদায় করবে”। (মুসান্নাফে ইবনে আবি শায়বা, ১/৩০২)

খ. তাকবীরে তাহরীমার সময় পুরুষ কানের লতি পর্যন্ত হাত উঠাবে আর মহিলাগণ হাত উঠাবে বুক বরাবর।

হযরত ওয়ায়েল ইবনে হুজর (রাযি.) বর্ণনা করেন। হযরত রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেন- يا وائل بن حجر، إذا صليت فاجعل يديك حذاء أذنيك، والمرأة تجعل يديها حذاء ثدييها অর্থাৎ- “হে ওয়ায়েল ইবনে হুযর, যখন তুমি নামায শুরু করবে তোমার উভয় হাত কান পর্যন্ত উঠাবে। আর মহিলাগণ তাদের বুক বরাবর হাত উঠাবে”। (আল মুজামুল কাবীর, হাদিস -২৮, হাদীসটি হাসান)।

আবদু রাব্বিহ বিন যাইতুন (রাহ.) বলেন- رأيت ام الدرداء ترفع يديها حذو منكبيها حين تفتح الصلاة. অর্থাৎ- “আমি উম্মে দারদা রা. কে দেখেছি তিনি যখন নামায শুরু করতেন কাঁধ পর্যন্ত হাত উঠাতেন”। (মুসান্নাফে ইবনে আবি শায়বা, ৫/৪২১)।

২. হাত বাঁধা:

ক. তাকবীরে তাহরীমার সময় পুরুষরা জামা, চাদর ইত্যাদি থেকে হাত বের করে রাখবে। আর মহিলারা দুই হাত কাপড় দিয়ে ঢেকে রাখবে। যাতে পর্দা সুনিশ্চিত হয়। এবং মহিলারা নিজেদের হাত যথাসম্ভব জড়সড় করে রাখবে। বিশিষ্ট তাবেঈ আতা বিন আবি রাবাহ রহ. বলেন- تجمع المرأة يديها في قيامها ما استطاعت. অর্থাৎ- “মহিলাগণ নামাযে দাঁড়ানো অবস্থায় তাদের উভয় হাতকে যথাসম্ভব একত্রিত করে রাখবে”। (মুসান্নাফে আবদুর রাযযাক- ৫০৬৭)।

قال العلامة ابن عابدين ¬ في رد المحتار (1/ 504):  ولا تخرج يديها من كميها.

খ. পুরুষদের নাভীর নিচে হাত বাঁধতে হয়। কিন্তু মহিলাদের হাত বাঁধতে হয় বুকের উপর। বাম হাতের পিঠের উপর ডান হাত স্বাভাবিকভাবে রেখে দেবে, শক্তভাবে ধরবে না।

ইমাম আবুল কাসেম ইবরাহীম বিন মুহাম্মাদ সামারকান্দী রহ. (৯০৭ হি.) বলেন- والمرأة تضع على صدرها بالاتفاق. অর্থাৎ- ফুকাহায়ে কেরাম ঐকমত্য যে, মহিলাগণ তাদের হাতকে বুকের উপর রাখবে। (মুসতাখলাসুল হাকায়িক পৃ./১৫৩)।

মোল্লা আলী কারী রহ. বলেন- والمرأة تضع على صدرها إتفاقا لأن مبنى حالها على سترها. অর্থাৎ- “ফুকাহায়ে কেরাম ঐকমত্য যে, মহিলাগণ তাদের উভয় হাতকে বুকের উপর রাখবে। কারণ মহিলাদের সতরের দিকটা লক্ষ রাখাই হলো আসল উদ্দেশ্য। (ফাতহু বাবিল ইনায়াহ ১/২৪৩)।

৩. রুকূ:

মহিলাগণ পুরুষদের মত মাথা, পিঠ ও কোমর সমান্তরাল করে রুকূ করবে না। পুরুষদের ন্যায় সম্পূর্ণ মাথা নিচু করবে না; বরং হাত হাঁটু পর্যন্ত পৌঁছে পরিমাণ নত হবে। খুব জড়সড় হয়ে উভয় হাত কনুইসহ শরীরের সাথে মিলিয়ে রাখবে। হাতের আঙুল একত্রিত করে হাঁটুর উপর রেখে দিবে, ভর দিবে না।

হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. কে এ বিষয়ে জিজ্ঞাসা করা হলে উত্তরে তিনি বলেন- تجتمع وتحتفز. “(মহিলা) খুব জড়সড় হয়ে অঙ্গের সাথে অঙ্গ মিলিয়ে নামায আদায় করবে”। (মুসান্নাফে ইবনে আবি শায়বা ১/৩০২)

৪. সেজদা:

মহিলাগণ জড়সড় হয়ে সেজদা করবে। সেজদা অবস্থায় পেট, রান, উভয় বাহু, কোমর এবং দেহের সকল অঙ্গ প্রত্যঙ্গ পরস্পরের সাথে মিলিয়ে রাখবে। হাঁটুর কাছাকাছি সেজদা করবে। দু’ পা ডান দিকে বের করে দিবে।

প্রসিদ্ধ তাবেঈ ইয়াযিদ ইবনে আবি হাবীব রাহ. থেকে বর্ণিত- إن رسول الله صلى الله عليه وسلم مر على امرأتين تصليان فقال: إذا سجدتما فضما بعض اللحم إلى الأرض فإن المرأة ليست في ذلك كالرجل. অর্থাৎ- “একবার রাসূল সা. দুই মহিলার পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন। তখন তাদেরকে (সংশোধনের উদ্দেশ্য) বললেন- “যখন সেজদা করবে তখন শরীর জমিনের সাথে মিলিয়ে দিবে। কেননা মহিলারা এ ক্ষেত্রে পুরুষদের মত নয়”। (কিতাবুল মারাসিল, ইমাম আবু দাউদ, পৃ ১১৭ হাদীস সলিহ)।

হযরত আলী রা. বলেন- إذا سجدت المرأة فلتحتفز و التصق فخذيها ببطنها. অর্থাৎ- “মহিলারা যখন সিজদা করবে তখন যেন খুব জড়সড় হয়ে সিজদা করে এবং উভয় উরু পেটের সাথে মিলিয়ে রাখে”।) মুসান্নাফে আবদুর রাযযাক-৩/১৩৮, হাদীসের সনদ জায়্যিদ)।

হযরত ইবনে আব্বাস রা. কে মহিলাদের নামায সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করে হলে তিনি বলেন- تجتمع وتحتف. অর্থাৎ- “খুব জড়সড় হয়ে অঙ্গের সাথে অঙ্গ মিলিয়ে নামায আদায় করবে”। (মুসান্নাফে ইবনে আবি শায়বা ১/৩০২)।

হযরত হাসান বসরী (যিনি বসরাবাসীদের ইমাম) ও কাতাদা রহ. বলেন- إذا سجدت المرأة فإنها تنضم ما استطاعت ولا تتجافى لكي لا ترفع عجيزتها. অর্থাৎ- “মহিলা যখন সেজদা করবে তখন সে যথাসম্ভব জড়সড় হয়ে থাকবে। অঙ্গ প্রত্যঙ্গ ফাঁকা রেখে সেজদা দিবে না, যেন কোমর উঁচু হয়ে না থাকে”। (মুসান্নাফে ইবনে আবী শায়বা-১/৩০৩)।

৫. বৈঠক:

বৈঠকে মহিলা পুরুষের মত সোজা হয়ে বসবে না বরং দু’ পা ডান দিকে বের করে দিয়ে বাম নিতম্বদেশের উপর বসবে।

হযরত ইবনে উমর রা. কে জিজ্ঞেস করা হলো, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের যামানায় মহিলারা কীভাবে নামায আদায় করতেন? তিনি বলেন- كن يتربعن، ثم أُمرن أن تحتفزن . অর্থাৎ- “আগে তারা চারজানু হয়ে বসতেন। পরে তাদেরকে জড়সড় হয়ে বসতে বলা হয়েছে।” (জামিউল মাসানীদ-ইমাম আবু হানীফা ১/৪০০, মুসনাদে আবী হানীফা বিরিওয়াতিল হাসকাফী-৩৭ হাদীস সহীহ)।

অন্য হাদীসে হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উমার রা. বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেছেন- إذا جلست المرأة في الصلاة وضعت فخذها على فخذها الأخرى، وإذا سجدت ألصقت بطنها في فخذيها كأستر ما يكون لها… অর্থাৎ- “মহিলা যখন নামাযের মধ্যে বসবে তখন (ডান) উরু, অপর উরুর উপর রাখবে। আর যখন সেজদা করবে তখন পেট, রানের সাথে মিলিয়ে রাখবে। যা তার সতরের জন্য অধিক উপযোগী।” (কিতাবুল মারাসিল, ইমাম আবু দাউদ, পৃ ১১৭ হাদীস সালিহ)।

ইমাম খালেদ ইবনে লাজলাজ শামী (রাহ.) বলেন- كذا النساء يؤخرن أن يتربعن إذا جلس في الصلوة، ولا يجلس جلوس الرجال على أوراكهن، يتقى ذلك على المرأة مخافة أن يكون منها الشيء. অর্থাৎ- “মহিলাদেরকে আদেশ করা হত তারা যেন নামাযে দুই পা ডান দিক দিয়ে বের করে নিতম্বের উপর বসে। পুরুষদের মত না বসে। এতে শারীরিক কোন অবয়ব প্রকাশিত হওয়ার আশংকা মহিলাগণ থেকে মুক্ত থাকতে পারবে। (মুসান্নাফে ইবনে আবি শায়বা, ২/৫০৬)।

৬. সতর:

নামাযে পুরুষ ও মহিলার সতর এক নয়; বরং ভিন্ন। মহিলাদের জন্য বাড়তি সতরের বিধান রয়েছে। হযরত আয়েশা রা. বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন- لا يَقبَلُ اللهُ صلاةَ حائضٍ إلَّا بخِمار অর্থাৎ- “কোনো প্রাপ্তবয়স্ক মহিলা ওড়না ছাড়া নামায আদায় করলে আল্লাহ তার নামায কবুল করেন না”। (সুনানে আবু দাউদ, ৬৪১ সহীহ)।

হযরত আয়েশা রা. বলেন- لا بد للمرأة من ثلاثة أثواب تصلي فيهن: درع، وجلباب، وخمار. অর্থাৎ- যে কোনো মহিলার জন্য তিনটি কাপড় অনিবার্য যেগুলোতে সে নামায পড়বে। লম্বা ও ঢিলে-ঢালা জামা, (শরীর আবৃত রাখার জন্য) লম্বা চাদও ও ওড়না। (তাবাকাতে ইবনে সাআদ- ৮/৭১, সুনানে আবু দাউদ, হাদীস-৬৩৯, মুওয়াত্তা, হাদীস- ৪৭৩, মুসান্নাফে আবদুর রাযযাক, হাদীস-৫০৩১)।

হযরত মুজাহিদ রাহ.বলেন- أيما امرأة صلت ولم تغط شعرها، لم تقبل لها صلاة. অর্থাৎ- “যে মহিলা মাথার চুল না ঢেকে নামায পড়বে তার নামায কবুল হবে না।” (মুসান্নাফে ইবনে আবি শায়বা, হাদীস-৬২১২)।

হযরত হাসান বসরী রাহ.বলেন- إذا بلغت المرأة الحيض ولم تغط أذنها ورأسها، لم تقبل لها صلاة. অর্থাৎ- “কোনো মেয়েলোক যদি সাবালিকা হয় আর তার কান ও মাথা আবৃত না করে তাহলে তার নামায কবুল হবে না।” (মুসান্নাফে ইবনে আবি শায়বা-৬২২৪)।

৭. জুমুআর নামায:

জুমুআর নামায পুরুষদের উপর ফরয। মহিলাদের উপর ফরয নয়।  যা সহীহ হাদীস ও উম্মতের সকলের ঐকমত্য দ্বারা প্রামাণিত। হযরত ত্বারিক ইবনে শিহাব রা. রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে বর্ণনা করেন- الجُمُعةُ حقٌّ واجبٌ على كلِّ مسلمٍ في جماعةٍ، إلَّا أربعةً: عبدٌ مملوكٌ، وامرأةٌ، أو صَبِيٌّ، أو مريضٌ. অর্থাৎ- “জুমুআর নামায একটি অবধারিত বিষয়, যা প্রত্যেক মুসলমানের উপর জামাতের সাথে আদায় করা ওয়াজিব। তবে চার শ্রেণীর লোকের জন্য ওয়াজিব নয়। ক্রীতাদাস, নারী, শিশু ও রোগী। (সুনানে আবু দাউদ, হাদীস- ১০৬৭ সহীহ)।

৮. জামাআত:

পুরুষদেরকে মসজিদে উপস্থিত হওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। পক্ষান্তরে মহিলাদেরকে অন্দরমহলে নামায পড়তে উৎসাহিত করা হয়েছে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন- صلاة المرأة في بيتها أفضل من صلاتها في حجرتها، وصلاتها في مخدعها أفضل من صلاتها في بيتها. অর্থাৎ- “নারীদের জন্য ঘরের আঙ্গিনায় নামায আদায়ের চেয়ে তার গৃহে নামায আদায় করা উত্তম । এবং গৃহের যেকোনোস্থানে নামায আদায় করা থেকে গোপন কোনো কক্ষে নামায আদায় করা উত্তম।” (সুনানে আবু দাউদ, হাদীস- ৫৭০, হাদীস সহীহ)।

৯. আযান-ইকামাত:

মহিলারা আযান ইকামাত ছাড়া নামায পড়বে। তাকবীর, কিরাআত ইত্যাদি নিঃশব্দে পড়বে। হযরত ইবনে উমর রা. থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, ليس على النِّساءِ أذانٌ ولا إقامةٌ. অর্থাৎ- “মহিলাদের উপর আযান ও ইকামাত কোনটিই নেই।” (সুনানে বায়হাকী-১৯২০, হাদীস সহীহ)।

লেখক: মুফতি, মুহাদ্দিস, মুফাসসির এবং সহকারী পরিচালক, আল জামিয়াতুল আহলিয়া দারুল উলূম মুঈনুল ইসলাম হাটহাজারী, চট্টগ্রাম।

উম্মাহ২৪ডটকম: এমএ

উম্মাহ পড়তে ক্লিক করুন-
https://www.ummah24.com

দেশি-বিদেশি খবরসহ ইসলামী ভাবধারার গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে ‘উম্মাহ’র ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।