Home সোশ্যাল মিডিয়া শিশুদের শৈশবে ভয়ঙ্কর থাবা

শিশুদের শৈশবে ভয়ঙ্কর থাবা

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে হেনস্থার শিকার হয়েছে কিংবা এর ফলে আত্মহত্যার দিকে ধাবিত হয়েছে এমন শিশুদের পরিবারের কাছে ক্ষমা চেয়েছেন মার্ক জুকারবার্গ। টেক জায়ান্ট মেটার এই প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) নিজেও তিন সন্তানের বাবা।

যুক্তরাষ্ট্রের সিনেটের শুনানি চলাকালে তিনি বলেন, ‘আপনারা যে পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়েছেন, তার জন্য আমি দুঃখিত।’

যুক্তরাষ্ট্রের ওই পরিবারগুলোর অভিযোগের সাথে নিজের অভিজ্ঞতার সামঞ্জস্য খুঁজে পাচ্ছিলেন পশ্চিমবঙ্গের দক্ষিণ কলকাতার এক অভিভাবক। সম্প্রতি তার ১২ বছরের মেয়ে ‘অস্বাভাবিক আচরণের’ অভিযোগে স্কুলে ডেকে পাঠানো হয়েছিল তাকে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই অভিভাবক বলেছেন, ‘স্কুলের শৌচাগারের এক কোণায় বসে কেঁদে যাচ্ছিল আমার মেয়ে। প্রথমে শিক্ষিকারা ভেবেছিলেন বাড়িতে অশান্তির কারণে এটা হয়েছে। আমি আর আমার স্ত্রী অবাক হয়ে যাই। স্কুলে জানাই, বাড়িতে কোনো সমস্যা হয়নি। অনেক পরে জানতে পারি, ফেসবুকে ক্রমাগত ট্রোল সহ্য করতে পারেনি।’

মেয়ের সুস্থতার জন্য মনোবিদের দ্বারস্থ হয়েছেন তারা। তিক্ত অভিজ্ঞতার কথা জানিয়েছেন মধ্য কলকাতার আরেক অভিভাবকও।

তিনি বলেন, ‘আমাকে স্কুল থেকে ডেকে পাঠানো হয়েছিল। আমার ছেলে কুরুচিকর ভিডিও শেয়ার করেছে বন্ধুদের সাথে যা তার শিক্ষকের চোখে পড়েছে। প্রথমে বিশ্বাস করতে চাইনি। পরে দেখলাম, ইনস্টাগ্রামে কোনো এক ব্যক্তি তাকে একটা আপত্তিকর রিল পাঠিয়েছিল। সেই রিল আমার ছেলে শেয়ার করেছে বন্ধুদের সাথে। মোবাইল দিয়েছিলাম স্কুলের লেখাপড়ার জন্য। ছেলেবেলা হারিয়ে যাবে বুঝিনি।’

এই প্রসঙ্গে তার অভিজ্ঞতার কথা জানিয়েছেন সাইকিয়াট্রিস্ট এবং কলকাতা ন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজের অ্যাসোসিয়েট প্রফেসর ডা. শর্মিলা সরকার।

তিনি বলেন, ‘অনলাইনে হেনস্থার শিকার হয়েছে এমন শিশুদের সংখ্যা বেড়েছে। সম্প্রতি ক্লাস এইটে পড়া একটি মেয়ের সাথে ইন্সটাগ্রামে এক ব্যক্তির আলাপ হয়। মেয়েটির অ্যাটেনশন ডেফিসিট/হাইপার অ্যাক্টিভিটি ডিসঅর্ডার- এর সমস্যা ছিল। ক্রমশ ওই ব্যক্তির সাথে সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ে মেয়েটি।’

ডা. সরকার বলেন, ‘অপরিচিত সেই লোক তাকে ব্যক্তিগত ছবি পাঠাতে বলে, না বুঝেই পাঠিয়ে দেয়ার পর ব্ল্যাকমেল করা শুরু হয় তাকে। এরপর এক সময় ভীষণ ভয় পেয়ে বাড়িতে জানায় মেয়েটি। সাইবার আইন মেনে পদক্ষেপ নেয়া হয় বটে, কিন্তু মেয়েটি ততদিনে মানসিক অবসাদে ভুগতে শুরু করেছে।’

‘এই পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে কারো যাওয়া উচিৎ নয়’

ফিরে আসা যাক মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সেই শুনানির প্রসঙ্গে যার মূল বিষয় ছিল, অনলাইনে বুলিং, মানসিক এবং যৌন হয়রানি থেকে শিশুদেরকে কীভাবে রক্ষা করা যায়।

ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোর উদ্দেশে তিনি কিছু বলতে চান কিনা জিজ্ঞাসা করা হলে জাকারবার্গ উপস্থিত অভিভাবকদের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করেন। বলেন, ‘এই পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে কারও যাওয়া উচিৎ নয়।’

তিনি একা নন, টিকটকের সিইও শাও জি চিউ, স্ন্যাপ-এর সিইও ইভান স্পিগল, এক্স-এর সিইও লিন্ডা ইকারিনো এবং ডিসকর্ডের জ্যাসন সিট্রন- বহুল জনপ্রিয় এই পাঁচ জনপ্রিয় প্ল্যাটফর্মের কর্মকর্তাদের একাধিক ‘অস্বস্তিকর’ প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয়েছিল সেই শুনানিতে। সামাজিক মাধ্যমে যে ধরনের ‘কন্টেন্ট’ রয়েছে, সে বিষয়ে জবাবদিহি করতে হয়েছিল তাদের।

ইউএস সেনেটর টম কটনের জেরার মুখে এক সময় টিকটকের সিইও শাও জি চিউ বলে ওঠেন,‘তিনটি ছোট সন্তানের বাবা হিসেবে আমি বুঝতে পারছি, যে বিষয় নিয়ে এখানে আলোচনা করছি, তা ভয়ংকর এবং অনেক বাবা-মায়ের জন্য দুঃস্বপ্ন।’

যুক্তরাষ্ট্রের সিনেট যখন উত্তপ্ত এই শুনানিকে ঘিরে, আর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম সরব জুকারবার্গ-এর ‘ক্ষমা চাওয়া’র বিষয়ে, তখন দেখে নেয়া যাক ভারতে শিশুদের হেনস্তার ঘটনা কতখানি তীব্র?

ভারতে অনলাইনে হেনস্থার ঘটনা

ভারতে শিশুদের মধ্যে মোবাইল অ্যাডিকশন বেড়েছে, পাল্লা দিয়ে বেড়েছে অনলাইনে শিশুদের ওপর অপরাধের ঘটনাও।

কম্পিউটার সিকিউরিটি ফার্ম ‘ম্যাকাফি’-র ২০২২ সালের রিপোর্ট বলছে ভারতে প্রায় ৮৫ শতাংশ শিশু সাইবার বুলিয়িংয়ের অভিযোগ করেছে। সমীক্ষায় জানানো হয়েছিল গোটা বিশ্বের মধ্যে এ ধরনের ঘটনা সবচেয়ে বেশি ঘটে ভারতে।

‘সাইবার বুলিং ইন প্লেইন সাইট’ শীর্ষক এই রিপোর্টে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, জার্মানি, অস্ট্রেলিয়া, ভারত, কানাডা, জাপান, ব্রাজিল এবং মেক্সিকো-সহ ১০টি দেশের ওপর চালানো সমীক্ষার কথা বলা হয়েছে। রিপোর্টে উঠে আসে ভারতে প্রতি তিনজনের মধ্যে একজন শিশু সাইবার বুলিয়িং, যৌন হেনস্থা, রেসিজম ও হুমকির শিকার।

কোভিড মহামারি চলাকালীন এ জাতীয় অপরাধের ঘটনা বহুমাত্রায় বৃদ্ধি পেয়েছে বলে সাম্প্রতিক সমীক্ষায় জানা গিয়েছে।

চাইল্ড রাইটস অ্যান্ড ইউ এবং পাটনার চাণক্য জাতীয় আইন বিশ্ববিদ্যালয় যৌথভাবে একটি সমীক্ষা চালিয়েছিল। গত বছর প্রকাশ পাওয়া ওই সমীক্ষায় উত্তরদাতাদের মধ্যে এক-তৃতীয়াংশ (৩৩ দশমিক ২ শতাংশ) অভিভাবক অভিযোগ করেছেন তাদের সন্তানদের অনলাইন প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করতে গিয়ে ‘ফিশিং’-এর শিকার হতে হয়েছে, তাদের যৌন ইঙ্গিতপূর্ণ তথ্য পাঠানো হয়েছে, অনলাইনে যৌনতা-বিষয়ক আলোচনায় লিপ্ত হয়েছে।

সমীক্ষায় অংশগ্রহণকারী অভিভাবকদের দেয়া তথ্য অনুযায়ী, ওই অভিজ্ঞতার শিকার হওয়া ৪০% মেয়েদের এবং ৩৩% ছেলেদের বয়স ১৪-১৮-এর মধ্যে।

সেনেটের শুনানি চলাকালীন জুকারবার্গের ক্ষমা প্রার্থনার বিষয়ে চাইল্ড রাইটস অ্যান্ড ইউ-এর আঞ্চলিক পরিচালক (পূর্ব) তৃণা চক্রবর্তী বলেন,‘শুধুমাত্র ক্ষমা চাওয়া নয়, সোশ্যাল মিডিয়া প্লাটফর্মে এই জাতীয় সমস্যা যাতে না হয়, তার জন্য পরবর্তী পদক্ষেপ কী নেয়া হচ্ছে সেটি সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। এই ধরনের সমস্যা প্রতিরোধের ওপর জোর দিতে হবে তাদের।’

তিনি বলেন,‘ফেসবুকের মতো সমাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের বিপুল ক্ষমতা। মানুষের কাছে সহজেই পৌঁছতে পারে এগুলো। এটি ব্যবহার করে তারা সচেতনতা বাড়াতে প্রচারণা চালাতে পারে যাতে অনলাইনে শিশুরা যে সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে তা প্রতিরোধ করা যায়। শিশুদের নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করতে ওই সংস্থাগুলো উচিৎ তাদের অগ্রাধিকার দেয়া।’

তিনি জানিয়েছেন, একইসাথে অভিভাবক, শিক্ষক এবং শিশুদের নিয়ে কাজ করে এমন সংস্থাগুলোকে সমবেতভাবে এগিয়ে আসতে হবে যাতে ভবিষ্যতে এ জাতীয় ঘটনা বন্ধ করা যায়।

শিশু অধিকার নিয়ে দীর্ঘদিন কাজ করছেন সত্যগোপাল দে।

তিনি বলেন, ‘সোশ্যাল মিডিয়া প্লাটফর্মে যাতে বুলয়িইং, মানসিক এবং যৌন নিগ্রহের মতো ঘটনা বন্ধ করার জন্য তৎপর হতে হবে। এই যুগে কম্পিউটার, স্মার্ট ফোন বাচ্চাদের হাত থেকে কেড়ে নিতে পারব না। কিন্তু প্রযুক্তির মাধ্যমে তাকে শিশুদের ব্যবহারের উপযোগী করে তুলতে পারি। নিশ্চিত করতে পারি, যাতে ইন্টারনেট ব্যবহার করার সময় একটা সুরক্ষিত পরিবেশ পায়।’

প্রযুক্তিবিদরা কী বলছেন?

ভারতের একটি নামকরা তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থায় কর্মরত সৌম্যক সেনগুপ্ত। তিনি বলেন, মেটা জানিয়েছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমকে সুরক্ষিত করতে তাদের কিছু বিশেষ ব্যবস্থা রয়েছে এবং এটিকে আরো নিরাপদ করার জন্য নতুন টেকনিক তারা ব্যবহার করবে।

সেনগুপ্ত বলেন,‘সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমকে শিশুদের জন্য নিরাপদ করতে গেলে তাদের আশ্বস্ত করতে হবে যাতে বুলিং বা হেনস্থা হলে তারা নির্ভয়ে রিপোর্ট করে। এবং রিপোর্ট করার পর দ্রুত এবং কড়া পদক্ষেপ নিতে হবে ওই সংস্থাকে।

আরও পড়তে পারেন-

ইউজার বিহেভিয়ার অ্যানালাইসিস করে ‘টার্গেটেড অ্যাড’ সম্প্রচারের কথা বলেন আরেক আইটি বিশেষজ্ঞ সন্দীপ সরকার।

তিনি বলেন, ‘একবার কোনো খেলনার নাম সার্চ করলে যেমন ফিডে একই রকম অ্যাড আসতে থাকে, সেইভাবে শিশুদের বা অল্পবয়সী ব্যবহারকারীদের আচরণ দেখে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলো টার্গেটেড অ্যাড থাকবে, যেখানে তুলে ধরা হবে কী ধরনের সমস্যা আসতে পারে তার কথা, কিংবা সমস্যায় পড়লে কী করতে হবে। একইসাথে অভিভাবকদেরও সচেতন করার জন্য ভিডিও বা পোস্ট থাকা প্রয়োজন।’

মনোবিদদের মতামত

সাইবার বুলিং- এর শিকার শিশু এবং এর দ্বারা প্রভাবিত বাচ্চাদের বয়সসীমা কিন্তু অনেকটা এগিয়ে এসেছে বলে জানিয়েছেন মনোরোগ বিশেষজ্ঞরা।

পেরেন্টিং কনসালটেন্ট পায়েল ঘোষ বলেন,‘ওই বয়সসীমা বিপজ্জনকভাবে আট থেকে নয় বছরে নেমে এসেছে। কারপুলে যাতায়াতের সময় ওই বয়সের বাচ্চাদের কথোপকথন শুনলে বোঝা যাবে তারা এর সাথে পরিচিত।

সাম্প্রতিক অভিজ্ঞতার কথা ভাগ করেছেন তিনি। তার কথায়, ‘নয় বছরের এক বাচ্চা তার এক বন্ধুকে একটি নির্দিষ্ট অশালীন ভঙ্গির কথা উল্লেখ করে সোশ্যাল মিডিয়ায় চ্যাটে লিখেছিল। আমি জিজ্ঞাসা করেছিলাম সে ওই অঙ্গভঙ্গির মানে জানে কি না।’

উত্তরে বাচ্চাটি বলেছিল, মানে না জানলেও কাউকে অপদস্থ করতে ওই ভঙ্গিমা যে ব্যবহার করা হয়, তা সে জানে।

ওই বিশেষজ্ঞ বলেন, ‘আমি তাকে এর অর্থ বুঝিয়ে বলার পর সে বুঝতে পারে, ওই আচরণ একেবারেই ঠিক নয়। পরবর্তীকালে ওই ভঙ্গি বা শব্দটি ব্যবহার করেনি সে। কাজেই, শিশুমন যে বুঝে সে কাজ করছে তা একেবারেই নয়। এই উচিৎ-অনুচিত। এর পার্থক্যটা এভাবে বুঝিয়ে দেয়ার কর্তব্যটা আমাদের।’

বিনোদনের নামে এক অপরিচিত দুনিয়া চোখের নিমেষে খুলে যাচ্ছে ওই শিশুদের কাছে, যা একেবারেই শিশুদের যোগ্য নয়। সে বিষয়েও বলেন পায়েল ঘোষ।

এক অভিভাবক রাতে ফোন করে পরদিন জরুরি ভিত্তিতে দেখা করতে চান তার সাথে।

তিনি বলেন, ‘বাচ্চাটির মা অত্যন্ত শঙ্কিত ছিলেন কারণ তার ছেলে অস্বাভাবিক আচরণ করছে। যৌন ইঙ্গিত রয়েছে তার আচরণে। বেশ কিছুক্ষণ কথা বলার পর আমি জানতে পারি, ইনস্টাগ্রামে পাঠানো কোনো রিলে সে এই দৃশ্য দেখছে।

এই সমস্যা বোঝার কী উপায়?

জানতে চাইলে সাইকিয়াট্রিস্ট এবং কলকাতা ন্যাশানাল মেডিক্যাল কলেজের অ্যাসোসিয়েট প্রফেসর ডা. শর্মিলা সরকার বলেন, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের মালিকদের সচেতন হতে হবে। সচেতন হতে হবে অভিভাবকদেরও।

সন্তান কী করছে, কোন সাইট ব্যবহার করছে, কার সাথে কথা বলছে অভিভাবকদের জানতেই হবে, কারণ প্রশ্নটা বাচ্চাদের নিরাপত্তার।

শর্মিলা সরকার, ‘বাচ্চাদের বোঝাতে হবে, সমাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বা জীবনের অন্যক্ষেত্রে কোনো সমস্যার সম্মুখীন হলে, বাবা-মা তাদের পাশে আছেন। ভয় না পেয়ে তারা যেন সেটা জানায়। স্কুলকেও কিন্তু এ বিষয়ে প্রচার করতে হবে। সূত্র: বিবিসি।

উম্মাহ২৪ডটকম: এসএ

উম্মাহ পড়তে ক্লিক করুন-
https://www.ummah24.com

দেশি-বিদেশি খবরসহ ইসলামী ভাবধারার গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে ‘উম্মাহ’র ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।