Home অর্থনীতি রোজার আগেই খাদ্য সরবরাহ, বাজারে পণ্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে উদ্যোগ নিতে হবে

রোজার আগেই খাদ্য সরবরাহ, বাজারে পণ্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে উদ্যোগ নিতে হবে

।। মনোয়ারুল হক ।।

খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতার প্রয়োজনীয়তার কথা আমরা অনেকদিন ধরে বলছি। আবার খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতার সাথে খাদ্য নিরাপত্তার বিষয়টি নিয়েও বহু আলোচনা আছে। এ দুটি প্রত্যয়কে একইসাথে উচ্চারিত এবং বাংলাদেশ দুটি ক্ষেত্রেই শতভাগ সফলতা অর্জন করেছে বলে ক্ষমতাসীন রাজনীতিকদের মুখ থেকে শুনছি। উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণতা আর নিরাপত্তার বিষয়টি ভিন্ন। খাদ্য নিরাপত্তার সাথে দারিদ্র্যের নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে। খাদ্য পাওয়া এবং ভোগ করার অধিকারই খাদ্য নিরাপত্তা। বিশ্বের প্রায় ২০০ কোটি মানুষ বিভিন্ন ধরনের দারিদ্র্যেতার কারণে খাদ্য নিরাপত্তার আওতার বাইরে থেকে যায়। আমাদের মতো বৈষম্যপূর্ণ সমাজ ব্যবস্থায় খাদ্য নিরাপত্তার বিষয়টি কোনো স্থায়ী রূপ লাভ করতে পারে না। এরকম পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার জন্য আমাদের দেশে নানাবিধ নিরাপত্তামূলক কর্মসূচি আছে। ভিজিএফ, ভিজিডি, ওএমএস ইত্যাদি কর্মসূচির মধ্য দিয়ে দরিদ্র মানুষের খাদ্য সহায়তা দেওয়া হয়। যদিও জাতিসংঘ ঘোষিত খাদ্য নিরাপত্তার বিষয়টি নির্দিষ্ট করা হয়েছে খাদ্যের পর্যাপ্ততা, সহজলভ্যতা এবং খাদ্যের ব্যবহারের উপর। এই তিনটির সাথে এখন স্থায়িত্বকেও যোগ করা হয়েছে। এই বিষয়গুলোকে বিবেচনায় নিলে বাংলাদেশের অবস্থান নির্ণয়ের জন্য কোনো গবেষণার প্রয়োজন হয় না।

সম্প্রতি বিশ্ব খাদ্য ও কৃষিবিষয়ক বাৎসরিক প্রতিবেদন ২০২৩ প্রকাশ করেছে জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও)। গত ডিসেম্বরের শেষের দিকে প্রকাশিত প্রতিবেদনে ২০২১ সাল পর্যন্ত বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে। প্রতিবেদন অনুযায়ী বাংলাদেশ এখনও খাদ্য আমদানিকারক দেশের তালিকার উপরের দিকেই আছে। শীর্ষ আমদানিকারক চীন, ফিলিপাইন, তৃতীয় অবস্থানে বাংলাদেশ।

২০২১-এ কোভিড পরিস্থিতি কৃষিতে খুব বেশি প্রভাব ফেলতে না পারলেও দেশের চলমান অকাল বন্যায় হাওড়ের ফসল প্রায় প্রতিবছরই ক্ষতির মুখে পড়ে। অন্যান্য অঞ্চলেও ফসলহানির ঘটনা ঘটে, ফলে তাৎক্ষণিক চাল আমদানির সিদ্ধান্ত নিতে হয়। গম উৎপাদনে কখনোই মনোযোগ আকর্ষণ করার মতন উৎপাদন আমরা করতে পারিনি। প্রধান কারণ আন্তর্জাতিক বাজারে চাহিদা অনুসারে গম প্রাপ্তি ও উৎপাদন ব্যয়ের সঙ্গে অসংগতি। সেকারণে গমে আমরা আমদানিনির্ভর অনেকদিন ধরেই। এখন ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের কারণে গম আমদানির খরচ বেড়েছে অনেকগুণ। এফএওর প্রতিবেদন বলছে, ২০২১ সালে ১ কোটি সাড়ে ১৩ লাখ টন খাদ্যপণ্য আমদানি করেছে বাংলাদেশ। আমদানি করা মোট ২২টি খাদ্যপণ্যের মধ্যে গমের পরিমাণই ৭০ লাখ টন। চালের পরিমাণ ২৫ লাখ ৮০ হাজার টন। এই একই বছর চালের উৎপাদন ছিল ৫ কোটি ৭০ লাখ টন। চাল উৎপাদনে বাংলাদেশের অবস্থান শীর্ষ তিনের মধ্যে। প্রথম চীন, দ্বিতীয় ভারত, তৃতীয় আমরা। বাংলাদেশের এই অবস্থান টানা কয়েক বছর ধরেই।

বাংলাদেশের চালের বাজার স্থিতিশীল নয়। কোনো না কোনো কারণে বাজার অস্থিতিশীল হয়ে পড়ে। চাহিদা ও জোগানের মধ্যে হয়তো কারসাজি কাজ করে। ফলে সাধারণ মানুষের ভোগান্তি বাড়ে। সরকারের নানা দফতর দৌড়ঝাঁপ শুরু করে। কিছু আড়তে পুলিশি তৎপরতা চালানো হয়—সুফল পাওয়া যায় বলে তেমন মনে হয় না।

খাদ্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধির অন্যতম সময় রোজার মাস। সিয়াম সাধনার এই মাসে চাহিদা বৃদ্ধি পায়। যদিও এটা মূল সিয়ামের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ নয়।

রোজা সন্নিকটে। ফলে মূল্যবৃদ্ধির পদধ্বনি ইতোমধ্যে শুনতে শুরু করেছে ভোক্তারা। অর্থাৎ মূল্যস্ফীতির সঙ্গে এখন যোগ হচ্ছে রোজার মাস। এরকম পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার জন্য সরকারের আগাম কিছু সতর্কতা অবলম্বন করার প্রয়োজন হয়। এর আগের বছরগুলোতে দেখেছি বাজারে চালের দাম বাড়ার পরিপ্রেক্ষিতে সরকার দ্রুত চাল আমদানির সিদ্ধান্ত নেয়। আমাদের দেশে আমদানির জন্য সহজ ও সুবিধাজনক জায়গা হলো ভারত। ভারত সেবার চাল দিতে পারেনি তাদের মজুত-স্বল্পতার কারণে।

আরও পড়তে পারেন-

পেঁয়াজের ক্ষেত্রে প্রায় প্রতিবছর আমাদের এ ধরনের সমস্যায় পড়তে হয়। ভারতের বাইরে অন্য দেশ থেকে আমদানি করতে হলে আমদানি খরচ বেড়ে, যায় ফলে সরকার বাধ্য হয় শুল্ক ছাড় দিতে, যা আমাদের জাতীয় অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।

তবে এখানে আরও একটি বিষয় উল্লেখ করা দরকার। বাজারে পণ্য সরবরাহ সংকট মোকাবিলা করতে জরুরি আমদানির জন্য উন্মুক্ত পদ্ধতি অবলম্বন করা হয় না। অভিযোগ রয়েছে, হাতেগোনা কয়েকটি প্রতিষ্ঠান এই আমদানির সুযোগ পায়। সবার জন্য উন্মুক্ত করা গেলে আমদানিকারকদের প্রতিযোগিতার প্রভাব বাজারে পড়ত।

দেশে এখন ‘নতুন সরকার’- নতুন সম্ভাবনা’। সকল গণমাধ্যম ও প্রচারমাধ্যমে নতুন সরকারের প্রায় সবাই নানা প্রতিশ্রুতি ও সম্ভাবনার কথা বলছেন। বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রী জানালেন, সরকার ভারতের সাথে একটা বাণিজ্য কোটা প্রাপ্তির চেষ্টা চালাচ্ছে; বার্ষিক কোটাভুক্ত নির্দিষ্ট কিছু পণ্য যেকোনো পরিস্থিতিতে আমরা যেন ভারত থেকে আমদানি করতে পারি। চাল, গম, আদা, পেঁয়াজ, রসুন, চিনি, ছোলা ও ডালের মতো নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্যপণ্যের প্রধান সরবরাহকারী দেশ ভারত। এই ৮টি পণ্যের কোটা সুবিধা চায় বাংলাদেশ।

গত ডিসেম্বরে ভারত-বাংলাদেশ বাণিজ্যমন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠক হয় দিল্লিতে। বৈঠকে ভারতের বাণিজ্যমন্ত্রী পিয়ুশ গয়াল বাংলাদেশের কাছে জানতে চেয়েছিলেন এই আটটি পণ্যের প্রতিটির চাহিদার পরিমাণ কত। বৈঠক থেকে ফিরে বিদায়ী বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি সাংবাদিকদের সাথে মতবিনিময়ে স্বীকার করেছেন, পণ্যের পরিমাণ আমরা যথাযথ উল্লেখ করতে পারিনি। আমরা তাৎক্ষণিক যে পরিমাণ উল্লেখ করেছি, তা তাদের সরবরাহ রেকর্ডের সাথে মেলেনি। তবে ভারতের বাণিজ্যমন্ত্রী পণ্যের সঠিক চাহিদার ওপর জোর দিয়েছেন। ভারত যুক্তি দিয়েছে, কোটার জন্য নির্দিষ্ট করে রাখা পণ্য বাংলাদেশ নিতে না পারলে ভারতীয় ব্যবসায়ীদের ক্ষতির মুখে পড়তে হবে।

আমাদের মনে রাখা দরকার, বৈশ্বিক ভূরাজনৈতিক অন্যান্য প্রয়োজনের বাইরেও খাদ্য নিরাপত্তার জন্য হলেও ভারতকে আমাদের পাশে পেতে হবে। ভারতে সাথে আমাদের সম্পর্কের নানা টানাপড়েন রয়েছে এটা সত্য। তাদের আধিপত্যবাদি মানসিকতার শিকার আমরা অনেকভাবে। ভারতের সাথে আমাদের ন্যায্য হিস্যার অনেক প্রশ্ন এখনও অমীমাংসিত। তবে বৈরিতা কোন সমাধান আনবে না। আমাদের দেশের রাজনীতিতে ভারত বিরোধীতার একটি ধারা বেশ প্রবল। ভারত-বিরোধীতার সাথে ধর্মকে যুক্ত করে নানামুখী উসকানি প্রায়শই পরিলক্ষিত হয়, যা দুই দেশের সম্পর্কের ক্ষেত্রে বিশ্বাস-অবিশ্বাসের জন্ম দেয়। যথাযথ রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক তৎপরতা যেকোনো ধরনের উসকানির বিপরীতে পারস্পরিক আস্থা ও বিশ্বাসের সম্পর্ক তৈরি করতে পারে।

আমরা আশা করতে চাই, বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ভারতের সাথে প্রস্তাবিত কোটা চুক্তি দ্রুত সম্পাদন করে বাজারে নিত্য খাদ্যপণ্যের সরবরাহ নিশ্চিত করার যথাযথ উদ্যোগ নেবে। অতিকথনের চেয়ে ফলাফল দেখতে চাই। বিদায়ী বাণিজ্যমন্ত্রীর কথায় জেনেছি, যথাযথ প্রস্তুতি ছাড়াই আমরা ভারতের সাথে বৈঠক করেছি। আমরা এটাও জেনেছি, প্রস্তাবিত চুক্তি নিয়ে অগ্রগতি থেমে আছে। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি রোধ করতে হলে তৎপরতা জোরদার করতে হবে। প্রয়োজনটা আমাদের।

উম্মাহ২৪ডটকম: এসএ

উম্মাহ পড়তে ক্লিক করুন-
https://www.ummah24.com

দেশি-বিদেশি খবরসহ ইসলামী ভাবধারার গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে ‘উম্মাহ’র ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।