Home শীর্ষ সংবাদ নাবিকের সাক্ষাৎকার: ছিনতাই থেকে মুক্তি, যা ঘটেছিল এমভি আবদুল্লাহয়

নাবিকের সাক্ষাৎকার: ছিনতাই থেকে মুক্তি, যা ঘটেছিল এমভি আবদুল্লাহয়

এমভি আবদুল্লাহ জাহাজের চিফ অফিসার মো. আতিক উল্লাহ খান। ছবি: আতিক উল্লাহ খান/ফেসবুক

সামচ্ছুদ্দিন ইলিয়াস: সোমালি জলদস্যুরা ১৪ এপ্রিল ছিনতাইকৃত জাহাজ এমভি আবদুল্লাহ ও এর ২৩ নাবিককে মুক্তি দেয়। ৩৩ দিন বন্দিদশায় থাকার পর অবশেষে জাহাজটি বাংলাদেশের পথে যাত্রা শুরু করেছে।

দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড-এর চট্টগ্রাম ব্যুরো প্রধান শামসুদ্দিন ইলিয়াস ১৬ এপ্রিল জাহাজের চিফ অফিসার মো. আতিক উল্লাহ খানের সঙ্গে কথা বলেন। সাক্ষাৎকারে জলদস্যুদের আক্রমণের দিন কী ঘটেছিল এবং তারপরের দুঃস্বপ্নের অকপট বর্ণনা দিয়েছেন এ নাবিক।

‘খুব দ্রুত ঘটেছে’

আমরা সবাই সোমালি জলদস্যুদের কথা শুনেছি। আমরা তাদের সম্পর্কে জানতাম। কিন্তু, সত্যি কথা বলতে কী, কখনও ভাবিনি যে আমরা এ ধরনের জলদস্যুতার শিকার হব। আমরা উচ্চ-ঝুঁকিপূর্ণ অঞ্চল থেকে দূরের রুট দিয়ে যাচ্ছিলাম। তাই মানসিকভাবে আমরা মোটেও প্রস্তুত ছিলাম না।

আমাদের জন্য রমজানের দ্বিতীয় দিন ছিল এটা। সকাল ৮টার দিকে ডিউটি শেষ করে একটু বিশ্রাম নিতে কেবিনে গিয়েছি। হঠাৎ অ্যালার্মের শব্দে জেগে উঠি। রুম থেকে দ্রুত বেরোলাম। কিছুক্ষণের মধ্যেই জলদস্যুরা জাহাজে উঠে পড়ে। সবকিছু এত দ্রুত ঘটেছিল, আমরা কোনো প্রস্তুতি নেওয়ার সময় পাইনি।

সবাই ভয় পেয়ে গেলাম। জলদস্যুরা জাহাজে হুড়োহুড়ি করে উঠে পড়লে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। আমরা জানতাম, সোমালি জলদস্যুরা কিছু বিশেষ কিছু পরিস্থিতি বাদে সাধারণত নাবিকদের ক্ষতি করে না। শুরুতে আমরা সবাই চিন্তায় ছিলাম কীভাবে পরিস্থিতি সামাল দেওয়া যায়। আমরা জলদস্যুদের গুলি চালানো ও নাবিকদের মারধরের ঘটনা শুনেছি। তাই অনেক চাপের মধ্যে ছিলাম।

‘পরিবারকে না জানানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছিল বেশিরভাগ’

জলদস্যুরা ওঠার পর আমরা ব্রিজের দিকে ছুটে যাই [যে কক্ষ বা প্ল্যাটফর্ম থেকে জাহাজ পরিচালনা করা যায়]। সেখানেই আমরা ১২ জন সশস্ত্র জলদস্যুকে দেখি। এরাই ছিল মূল ছিনতাইকারী। পরে পর্যায়ক্রমে আরও অনেক জলদস্যু জাহাজে ওঠে। ছিনতাইয়ের দিন মোট ৬৫ জন জলদস্যু ছিল।

তাদের কেউ ইংরেজি বলতে পারত না। তারা নিজেদের ভাষায় চিৎকার করছিল। আমাদের ভয় দেখানোর জন্য কয়েকটি ফাঁকা গুলি ছোড়ে, কিন্তু তারা কাউকে মারধর করেনি। আমাদের জিম্মি করার পর আমরা পরিস্থিতির সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে শুরু করি।

পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগের বিষয়ে আমরা দ্বিধাবিভক্ত ছিলাম; উদ্বিগ্ন ছিলাম যে তারা এ চাপ সহ্য করতে পারবে না। আমি প্রথমদিকে পরিবারকে একটি বার্তা পাঠিয়েছিলাম এটা লিখে যে, জাহাজের ওয়াইফাই সংযোগ বিকল হয়ে যাওয়ায় আমি দুই থেকে তিন মাস তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারব না।

মুক্তিপণ দেওয়ার পর সোমালি জলদস্যুদের জিম্মিদশা থেকে ছাড়া পায় বাংলাদেশি পতাকাবাহী জাহাজ এমভি আবদুল্লাহ ও এর ২৩ নাবিক। ছবি: ইউন্যাভফর আটালান্টা

আমি খবর পাঠাই যাতে তারা চিন্তা না করে। বেশিরভাগই পরিবারকে না জানানোর সিদ্ধান্ত নিই। তাই সবাই ওয়াইফাই নষ্ট হয়ে যাওয়ার কথা বলি মেসেজে। জলদস্যুরা শীঘ্রই আমাদের ব্রিজে জড়ো করে আমাদের মোবাইল ফোন দিয়ে দিতে বলে। সে সময় আমরা ভেবেছিলাম, পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করার এবং ছিনতাই সম্পর্কে তাদের জানানোর শেষ সুযোগটি আমরা হারিয়ে ফেলেছি।

আরও পড়তে পারেন-

তবে কিছু নাবিক তাদের ফোন লুকিয়ে রেখেছিলেন। ওগুলোর মাধ্যমেই আমরা পরে আমাদের পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করি।

‘বন্দুক তাক করেছিল, আমাদের শুয়ে পড়তে বলেছিল’

জলদস্যুরা আমাদের সবাইকে ব্রিজে অবস্থান করতে বাধ্য করেছিল। ২৩ জন লোক; খুব গাদাগাদি হয়ে গিয়েছিল। আমরা ২৩ জন এবং ১২ জলদস্যু সবাই ব্রিজের একমাত্র ওয়াশরুম ব্যবহার করতাম। সেটা আমাদের জন্য অত্যন্ত অস্বাস্থ্যকর এবং একটি কঠিন পরিস্থিতি ছিল। তাদের ভাঙাভাঙা ইংরেজি বুঝতে খুবই কষ্ট হতো। কিন্তু তারা আমাদের জাহাজ চালানোর নির্দেশ দিচ্ছিল।

ছিনতাইয়ের ১২ ঘণ্টার মাথায় ইউরোপীয় ইউনিয়নের নৌবাহিনীর একটি যুদ্ধজাহাজ এবং একটি বিমান আমাদের জাহাজের কাছাকাছি এলে পরিস্থিতি বিপজ্জনক মোড় নেয়। জলদস্যুরা আমাদের দিকে বন্দুক তাক করে শুয়ে পড়ার নির্দেশ দেয়। পুরোটা সময় আমাদের এক ইঞ্চিও নড়তে দেওয়া হয়নি। এমনকি শৌচাগার ব্যবহারও প্রশ্নের বাইরে ছিল।

ইইউ নৌবাহিনী জলদস্যুদের আত্মসমর্পণ করতে বলে, না হলে আক্রমণ করার হুমকি দিয়েছিল। কিন্তু জলদস্যুরা রাজি হয়নি।

‘সবচেয়ে ভয়ংকর অচলাবস্থা’

পরিস্থিতি একটি অচলাবস্থায় পরিণত হয়। এটি আমাদের জন্য সবচেয়ে ভয়ংকর মুহূর্ত ছিল। অভিযান চালানো হলে ইইউ নৌবাহিনী এবং জলদস্যুদের ক্রসফায়ারে পড়ার ভয় ছিল।

এক পর্যায়ে জলদস্যুরা আত্মসমর্পণ না করলে গুলি চালানোর হুঁশিয়ারি দিয়ে ইইউ নৌবাহিনী কাউন্টডাউন শুরু করে। কাউন্টডাউন শেষে তারা ফাঁকা গুলি ছুড়েছিল। এতে জলদস্যুদের উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ে। কিন্তু তারা আমাদের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে থাকে। জলদস্যুরা ক্যাপ্টেনকে ভিএইচএফের (রেডিও) মাধ্যমে ইইউ নৌবাহিনীর সঙ্গে কথা বলতে বাধ্য করে এবং নৌবাহিনীকে ঘটনাস্থল ছেড়ে যেতে বলে। ইইউ নৌবাহিনীর জাহাজ না গেলে তারা আমাদের মেরে ফেলবে বলেও হুমকি দেয়।

পরিস্থিতি আমাদের মানসিকভাবে ভেঙে দিয়েছিল। আমরা ততক্ষণেও ছিনতাইয়ের বিষয়টি আমাদের পরিবারকেও জানাতে পারিনি। প্রায় আধাঘণ্টা পর নীরব হয়ে যায় ইইউ নৌবাহিনী। কিন্তু যুদ্ধজাহাজটি আমাদের জাহাজের পাশাপাশি চলতে থাকে।

‘আমাদের আশ্বস্ত করা হয়েছিল, সারা বাংলাদেশ আমাদের পাশে আছে’

ইইউ জাহাজ আমাদের অনুসরণ করার সময় জলদস্যুরা আমাদের কঠোর নজরদারিতে রাখে। আমরা সারারাত ঘুমাতে পারিনি। আমরা সবাই নামাজ পড়তে থাকলাম। এদিকে আমাদের একজনের কাছে বাড়তি মোবাইল ফোন ছিল। কিছু ওষুধ আনার অনুমতি নিয়ে আমরা নিচে গেলাম। ইন্টারনেট চেক করে তিনি দেখতে পান, আমাদের পরিবারসহ সারা বাংলাদেশ আমাদের জাহাজ ছিনতাইয়ের কথা জানতে পেরেছে। সাংবাদিক ও সরকারি সংস্থা আমাদের পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে যোগাযোগ করছিল। পুরো বাংলাদেশ আমাদের পরিবারগুলোর পাশে দাঁড়িয়েছে জেনে আমরা কিছুটা আশ্বস্ত হলাম।

প্রথম তিন-চার দিন আমরা প্রচণ্ড চাপে ছিলাম। একটি ছোট ঘরে ২৩ জন লোক। কেবল সেহরির সময় আমাদের সিঁড়ি দিয়ে নামতে দেওয়া হতো। যাদের কাছে বাড়তি গোপন মোবাইল ফোন ছিল, তারা তাদের পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারত। আমরা সবাই আমাদের পরিবারের সঙ্গে এক বা দুই মিনিট কথা বলার সুযোগ পেয়েছি।

‘বন্দুকের মধ্যে থাকতে অভ্যস্ত হয়ে গেছিলাম’

চার-পাঁচ দিনের মধ্যে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে শুরু করে। ততদিনে আমরা বন্দুকের মধ্যে ওই ঠাসা ব্রিজে থাকতে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছি।

শুরু থেকেই আমরা একটি বিষয়ে আশ্বস্ত ছিলাম যে, আমাদের কোম্পানির এ ধরনের পরিস্থিতির মুখোমুখি হওয়ার অভিজ্ঞতা রয়েছে। কোম্পানির একটি জাহাজ [এমভি জাহান মনি] ২০১০ সালে ছিনতাই করা হয়েছিল এবং তারা তিন মাসের মধ্যে এটিকে ছাড়িয়ে আনতে সক্ষম হয়।

আমরা মানসিকভাবে প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম যে, অন্তত দুই থেকে তিন মাস আমাদের জিম্মি থাকতে হবে। আমরা পানি-খাবারের মতো প্রয়োজনীয় সব রসদ দিয়ে পরিস্থিতি মোকাবিলার প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। আমাদের এক মাসের জন্য পর্যাপ্ত খাবার এবং জল ছিল। জাহাজে লোকের সংখ্যা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে আমাদের প্রথম থেকেই খাবার ও পানির রেশনিং শুরু করতে হয়েছিল। আমরা জলদস্যুদের সঙ্গে পরামর্শ করে সীমিত জল ও খাবারদাবারের ব্যবস্থাপনার জন্য রেশনিং ব্যবস্থা চালু করি।

আমরা সাধারণত জাহাজে রেশনিং অবলম্বন করি। তবে সেটা দুই থেকে তিন দিন; সর্বোচ্চ এক সপ্তাহ। কিন্তু এতদিন ধরে রেশনিং করার অভিজ্ঞতা আমাদের ছিল না। সাধারণত আমরা জাহাজে আমাদের দৈনন্দিন রুটিন কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকি। কাজ করি, বিশ্রাম নিই এবং আমাদের পরিবারের সঙ্গে কথা বলি; এগুলোই আমাদের প্রতিদিনের রুটিন। যখন জাহাজ হাইজ্যাক করা হয় এবং আমরা জিম্মি হই, তখন আমাদের একমাত্র কাজ ছিল ব্রিজে বসে থাকা। আমাদের আর কিছুই করার ছিল না।

আমাদের নিয়মিত কাজের রুটিন ভেঙে গেল। পরিবারের সঙ্গে কথা বলতে না পেরে সময় কাটছিল না। এক-একটা দিনকে সপ্তাহের মতো লাগত। ভালো করে ঘুমাতে পারতাম না। আমরা মানসিকভাবে খুব ভেঙে পড়েছিলাম। এটি একটা অনিশ্চিত পরিস্থিতি ছিল। আমরা নিশ্চিত ছিলাম না যে, আমাদের কতদিন ধরে এর মধ্য দিয়ে যেতে হবে।

‘ভালো আচরণের বিনিময়ে ভালো আচরণ’

প্রথম থেকেই আমরা জলদস্যুদের সঙ্গে ভাল আচরণ এবং সহযোগিতা করছিলাম। আমরা যদি অভদ্র আচরণ করি, তারাও তা-ই করবে। এক সপ্তাহ পর আমাদের ভালো আচরণের ফল পেলাম। তারা দিনের বেলায় নামাজ, ইফতার এবং অন্যান্য কাজের জন্য আমাদের সিঁড়ি দিয়ে নামতে দিতে শুরু করে। রাতে আমরা ব্রিজে ফিরতাম। এবার একটু নিশ্চিন্ত বোধ করা গেল। পালাক্রমে আমাদের পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ শুরু করলাম। মানসিকভাবে কিছুটা ভালো বোধ হচ্ছিল।

এদিকে জলদস্যুরা আমাদের অবাধে চলাফেরা করতে এবং দিনের বেলা কেবিনে যাওয়ার অনুমতি দেয়। সে সময় কোনো আলোচনার কথা আমরা জানতাম না। গণমাধ্যম ও আমাদের পরিবারের সদস্যদের কাছ থেকে আমরা জানতে পেরেছি, ঈদের আগেই আলোচনা শেষ হতে পারে। কিছুটা খুশি হয়ে উঠেছিলাম। কিন্তু ঈদের আগে যখন তা শেষ হলো না, তখন আমরা হতাশ হয়ে পড়ি। ভেবেছিলাম ব্যাপারটা নিছক গুজব ছিল।

‘জিম্মিদশায় ঈদ উদযাপন’

জলদস্যুরা জানতো ঈদ মুসলমানদের সবচেয়ে বড় উৎসব। আমরা রোজা রাখতাম, নিয়মিত নামাজ পড়তাম; তারা আমাদের সংস্কৃতি সম্পর্কে জানত বলে মনে হয়। ঈদের দিন এলে তারা আমাদের ঈদের জামাতে নামাজ পড়তে, এমনকি উদযাপনও করতে দেয়। তাদের অনুমতি নিয়ে আমরা একটি গ্রুপ ছবি তুলি, যা গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়।

কিন্তু সেই মুহূর্তটি ছিল স্বল্পস্থায়ী। তারা ছবিটি নিয়ে নাখোশ হয়েছিল। এরপর তারা আমাদের চাপ দিতে শুরু করে।

ঈদের একদিন পর জাহাজের পরিবেশ পালটে যেতে থাকে। আমরা তাদের গতিবিধিতে পরিবর্তন লক্ষ্য করি। তারা বাড়ি ফিরে যাওয়ার খুশিতে ছিল বলে মনে হচ্ছিল। আমরা আশা করছিলাম, ভালো কিছু ঘটতে যাচ্ছে। তারা আমাদের ছবি ও ভিডিও তুলে নেয়, যা একটি ভালো লক্ষণ ছিল। পরদিন তারা আমাদের লাইনে দাঁড় করিয়ে একটি ভিডিও করে। ততক্ষণে আমরা বুঝতে পেরেছিলাম যে, আমাদের কোম্পানির সঙ্গে হয়তো আলোচনা শেষ হয়েছে।

১৩ এপ্রিল বাংলাদেশ সময় সকাল সাড়ে ১১টায় একটি বিমান এসে আমাদের জাহাজের ওপর চক্কর দিতে শুরু করে। জলদস্যুরা আমাদেরকে লাইনে দাঁড়াতে বলে। তাদের দোভাষী চিৎকার করে বলে, ‘হাত নাড়ো’। আমরা হাত নাড়লাম। প্লেনটি সমুদ্রপৃষ্ঠের কাছাকাছি নেমে আসে। এরপর আমরা প্লেন থেকে জলে কোনোকিছু পড়ার তিনটি শব্দ পরপর শুনতে পাই। সেদিন রোদ খুব কড়া ছিল। কী হচ্ছিল তা ভালো মতো দেখতে পাইনি। তারপর জলদস্যুদল উল্লাস শুরু করে।

শেষ দুই-তিনদিন আমরা খুব বিধিনিষেধের মধ্যে ছিলাম। আমরা আলোচনার বিষয়ে কিছুই জানতাম না কারণ এটি অত্যন্ত গোপনীয়তার সঙ্গে করা হয়েছিল। যখন আমরা জানতে পারি যে জলদস্যুরা জাহাজ ছেড়ে যাবে, আমরা এতই স্বস্তি পেয়েছিলাম ও উত্তেজিত ছিলাম যে ঘুমাতে পারিনি। যদিও তারা দিনের বেলা জাহাজ ছেড়ে যাবে বলে ধারণা করা হয়েছিল, শেষে ১৪ এপ্রিল রাত সাড়ে ১২টার দিকে জলদস্যুরা জাহাজ ত্যাগ করে।

সে সময় আমাদের মধ্যে স্বাধীনতার এক অন্যরকম অনুভূতি হচ্ছিল, যা ভাষায় বর্ণনা করা যায় না। আমরা খুব খুশি ছিলাম। একটা বোঝা আমাদের বুক থেকে নেমে গেল। ক্লান্তি এবং মানসিক অবসাদ পেছনে ফেলে আমাদের স্বাভাবিক জীবনে পুনরায় ফিরতে শুরু করলাম।

গত এক মাস আমরা প্রচণ্ড অশান্তির মধ্য দিয়ে গেছি, পুরো ঘটনাটি প্রায় একটা দীর্ঘায়িত দুঃস্বপ্নের মতো ছিল। এমনকি পরে যখন আমরা জেগে উঠতাম, আমাদের মনে হতো আমরা তখনও বন্দি অবস্থায় আছি। জলদস্যুরা আছে কিনা তা দেখতে আমরা বারবার ব্রিজের দিকে যেতাম। একমাস ধরাবাঁধা নিয়মের মধ্যে থাকায় আমরা তখনও জাহাজের চারপাশে স্বচ্ছন্দে চলাফেরা করতে ভয় পাচ্ছিলাম। এ দুঃস্বপ্ন আমাদের কতদিন তাড়া করবে সেটা বুঝতে পারছিলাম না।

এখন মুক্তি পাওয়ার পর আমরা আমাদের নিত্যদিনের কাজে মনোনিবেশের চেষ্টা করছি। জলদস্যুরা জাহাজের ভেতর সব উলটপালট করে রেখে গেছে। আমরা এখন সব আবর্জনা পরিষ্কার করছি, সবকিছু পুনর্বিন্যাস করছি। আশা করছি দু–তিনদিনের মধ্যে আমরা স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারব। আমরা প্রচণ্ড মানসিক ট্রমার মধ্যে ছিলাম। কিন্তু এখন একটা স্বস্তির অনুভূতি হচ্ছে। আমরা এখন পরিবার এবং আত্মীয়দের সঙ্গে কথা বলতে পারছি। পুরো ঘটনায় তারাও ট্রমায় ভুগছেন।

আমরা সর্বশক্তিমানের কাছে কৃতজ্ঞ। এত দ্রুত মুক্তি পাব তা আমরা কল্পনাও করতে পারিনি। আমাদের কোম্পানি এসআর শিপিং এবং যারা আলোচনা প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত ছিল, বলা বাহুল্য, আমাদের দ্রুততম মুক্তি নিশ্চিত করার জন্য তারা প্রচুর চেষ্টা করেছে। আমরা কর্তৃপক্ষকে ধন্যবাদ জানাতে চাই। ছিনতাই হওয়া জাহাজ সোমালি জলদস্যুদের কবল থেকে মাত্র এক মাসের মধ্যে মুক্ত করার ঘটনা সচরাচর ঘটে না।

ছিনতাইকৃত জাহাজ এমভি রুয়েনের ঘটনায় জাহাজ মালিকেরা ভরসা হারিয়ে তা পরিত্যাগ করে। অভিযানের মাধ্যমে জাহাজটি উদ্ধার করা হলে এটি ক্ষতিগ্রস্ত পাওয়া যায়। কিন্তু আমাদের জাহাজ অক্ষত রয়েছে, যেমনটা আমরা আছি। আমরা আমাদের দেশের মানুষের কাছেও কৃতজ্ঞ যারা আমাদের জন্য প্রার্থনা করেছেন এবং এ কঠিন সময়ে আমাদের পরিবারের পাশে দাঁড়িয়েছেন।

এছাড়াও আমাদের দেশের সমস্ত গণমাধ্যম আমাদের জিম্মিদশার বিষয়ে অত্যন্ত সোচ্চার ছিল এবং প্রতিনিয়ত খবর প্রকাশ করছিল, সেটাও প্রশংসনীয়। আমরা আমাদের সকল সাংবাদিকদের তাদের প্রচেষ্টার জন্য ধন্যবাদ জানাই। এছাড়াও আমরা আমাদের সরকারি সংস্থাসমূহ, নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়, ডিজি শিপিং এবং পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে আমাদের পাশে দাঁড়ানোর জন্য, আমাদের কোম্পানির সঙ্গে যোগাযোগ করার জন্য এবং আমাদের নিরাপদে প্রত্যাবর্তন নিশ্চিত করার জন্য ধন্যবাদ জানাতে চাই।

এমভি আবদুল্লাহ এখন সংযুক্ত আরব আমিরাতের দিকে যাচ্ছে। ২২ এপ্রিল জাহাজটি আল হামরিয়া পৌঁছাবে বলে আশা করা হচ্ছে।

সূত্র- টিবিএস।

উম্মাহ২৪ডটকম: এমএ

উম্মাহ পড়তে ক্লিক করুন-
https://www.ummah24.com

দেশি-বিদেশি খবরসহ ইসলামী ভাবধারার গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে ‘উম্মাহ’র ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।