Home ওপিনিয়ন সর্বগ্রাসী অবক্ষয় ও অনৈতিক পৈশাচিকতার লাগাম টেনে ধরার মূল দায়িত্ব সরকারের

সর্বগ্রাসী অবক্ষয় ও অনৈতিক পৈশাচিকতার লাগাম টেনে ধরার মূল দায়িত্ব সরকারের

।। জামালউদ্দিন বারী ।।

নির্বাচনের ঝড়ো বিতর্ক পেরিয়ে নতুন বছরের প্রথম সপ্তাহে দেশে নতুন সরকারের নতুন মন্ত্রিসভা শপথ গ্রহণ করল। অধিকাংশ রাজনৈতিক দলের বর্জন এবং অধিকাংশ আসনে বিনাভোটে সদস্য নির্বাচিত হওয়ায় দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে গঠিত সরকার ও সংসদ পুরো ৫ বছর ধরেই বিতর্ক ও আলোচনার বিষয় ছিল। সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা থাকায় এমন নির্বাচন করতে হয়েছিল, রাজনৈতিক সমঝোতার মধ্য দিয়ে একটি মধ্যবর্তি নির্বাচনের কথাও বলা হয়েছিল। কিন্তু গত ৫ বছরেও সরকারের পক্ষ থেকে কোন রাজনৈতিক সংলাপ-সমঝোতার উদ্যোগ নেয়া হয়নি। উপরন্তু বিরোধীদের সংলাপের আহবান বরাবরই প্রত্যাখ্যাত হয়েছে।

একটি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের জন্য জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের দাবী দাওয়া নিয়ে সংলাপের আহবান সাড়া দিয়ে গণভবনে অনুষ্ঠিত সংলাপ শেষ পর্যন্ত সৌজন্যমূলক আনুষ্ঠানিকতা হিসেবেই গণ্য হয়েছে। সেখানে ঐক্যফ্রন্টের কোন দাবীই মানা হয়নি। এমনকি প্রধানমন্ত্রীর মৌখিক প্রতিশ্রুতিরও বাস্তবায়ন দেখা যায়নি। নির্বাচনের তফশিল ঘোষণা থেকে ভোটের দিন পর্যন্ত বিরোধিদলের সর্বাধিক সংখ্যক নেতা-কর্মী হামলা-মামলা ও গ্রেফতারের শিকার হয়েছে। প্রবীণ হেভিওয়েট নেতা থেকে শুরু করে গ্রামের ওয়ার্ড পর্যায়ের নেতা-কর্মীরাও পুলিশ ও দলীয় ক্যাডারদের আগ্রাসী ভ‚মিকা থেকে রেহাই পায়নি।

নির্বাচনের পর বেশ কিছু রোম হর্ষক ঘটনা পুরো জাতির বিবেককে নাড়িয়ে দিয়েছে। ধানের শীষে ভোট দেয়ার অপরাধে নোয়াখালীর সুবর্ণচরে চার সন্তানের জননীকে স্বামী-সন্তানদের সম্মুখে নরপশুএকদল ধর্ষনের ঘটনা, অথবা রাজশাহীর কলমা গ্রামের ভোটকেন্দ্রে ধানের শীষে ভোট বেশী পড়ায় পুরো গ্রামের সব মানুষকে শাস্তির আওতায় আনার পদ্ধতি হিসেবে গ্রামটিকে একটি বিচ্ছিন্ন জনপদে পরিণত করা, গ্রামের যোগাযোগ ব্যবস্থা, সেচব্যবস্থা, ডিসের লাইনসহ জীবনযাত্রার জন্য প্রয়োজনীয় প্রায় সবকিছু রুদ্ধ করে দেয়ার মত ঘটনা ঘটেছে। ব্যক্তিগত ও সামষ্টিক পর্যায়ের এই দু’টি ঘটনা সারা বাংলাদেশের সাম্প্রতিক চালচিত্রের কোন বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। সামাজিক-রাজনৈতিক কারণে মাত্রাভেদে দেশের সর্বত্র এমন ঘটনা ঘটে চলেছে।

আমাদের সমাজ, রাষ্ট্র ও রাজনৈতিক ব্যবস্থার মধ্যে সর্বগ্রাসী অবক্ষয় ও অনৈতিক পৈশাচিকতার বিস্তার যে ক্রমে অপ্রতিরোধ্য হয়ে পড়ছে। এ থেকে উত্তরণের পথ পন্থা খুঁজে বের করার মূল দায়-দায়িত্ব সরকার ও রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর হলেও সমাজের কোনো সচেতন ও দায়িত্ববান মানুষই এ দায় এড়াতে পারেন না। দুর্নীতি ও সামাজিক-রাজনৈতিক অবক্ষয় মাত্রাহীন বিস্তৃতি লাভের পেছনে গত এক দশকের সামাজিক-রাজনৈতিক বাস্তবতা কতটা প্রভাবক হিসেবে কাজ করেছে তা নিয়ে ব্যাপক বিতর্কের অবকাশ রয়েছে। সে বিতর্কে গিয়ে এই নিবন্ধের কলেবর বৃদ্ধি না করাই শ্রেয় বলে মনে করি। তবে একাদশ জাতীয় নির্বাচনের মধ্য দিয়ে গঠিত নতুন সরকার দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াইকে অন্যতম অগ্রাধিকার বিষয় হিসেবে তাদের নির্বাচনী ইশতেহারে উল্লেখ করেছিল।

নির্বাচনে অভাবনীয় জয়ের পর দলের হেভিওয়েট অনেক নেতাকে মন্ত্রীসভার বাইরে রেখে যে চমক দেখানো হয়েছে তা’তে বিপুল সংখ্যক মানুষের মধ্যে নির্বাচন সম্পর্কে মিশ্র প্রতিক্রিয়া সত্ত্বেও টানা তৃতীয় মেয়াদের আওয়ামী লীগ সরকার ভালো কিছু করার ইচ্ছা রাখে এমন খানিকটা প্রত্যাশা জনমনে জাগতেই হবে।

তৃতীয় বিশ্বের মুক্তবাজার অর্থনীতির বেশীরভাগ দেশে সরকারের অবকাঠামো উন্নয়ন ও অর্থনৈতিক দুর্নীতি হাত ধরাধরি করে চলে। কিন্তু দুর্নীতির মাত্রাগত দিক থেকে বাংলাদেশ নানাভাবে ব্যতিক্রমী উদাহরণ সৃষ্টি করেছে। উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণের পর তা বাস্তবায়ণের সময়কালে প্রাক্কলিত বাজেটের আকার দু’তিন গুণ বেড়ে যাওয়া এবং রাস্তা ও সেতুর মত প্রকল্পে বিশ্বের মধ্যে সর্বোচ্চ বাজেট বরাদ্দ করেও সর্বনিম্ন মানের অবকাঠামো নির্মাণ করা আমাদের বিশেষত্ব হয়ে দাঁড়িয়েছে। ধনীর আরো ধনী হওয়ার বিশ্ব র‌্যাংকিংয়ে বাংলাদেশ গত বছর প্রথম স্থান অধিকার করেছে। দেশে বৈদেশিক বিনিয়োগ বা আভ্যন্তরীণ কর্মসংস্থানের ক্ষেত্র না বাড়লেও, নানা পরিসংখ্যানে জানা যায়, গত এক দশকে দেশ থেকে টাকা পাচারের পরিমান ৬ লক্ষ কোটি টাকার বেশী।

সরকারের এক শ্রেণীর মন্ত্রী-এমপি থেকে শুরু করে সরকারী কর্মকর্তাদের দেশে বিদেশে শত শত কোটি টাকার সম্পদের যে ফিরিস্তি দেখা যায় তার পেছনে রয়েছে জনগণের সম্পদের তছরুপ ও লুণ্ঠন। নতুন সরকার দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াই করতে চাইলে এবং সেই লড়াইয়ে জিততে চাইলে প্রথমেই এমপি-মন্ত্রীদের সম্পদ ও কর্মকান্ডের স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে হবে।

অনেকের মনে থাকার কথা, নবম জাতীয় সংসদে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভের পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার দলের মন্ত্রী-এমপিদের সম্পদের তথ্য জমা দেয়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন। সে নির্দেশ আদৌ বাস্তবায়িত হয়েছে বলে আমাদের জানা নেই। দেশের উন্নয়ন এবং অর্থনৈতিক দুর্নীতিতে গত ১০ বছরের ইতিহাসের সাক্ষি আমরাই। কিভাবে হাজার হাজার কোটি টাকা লুণ্ঠন করে দেশের ব্যাংকিং সেক্টরকে প্রায় দেউলিয়া করে ফেলা হয়েছে। কিভাবে শেয়ারবাজার থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা তুলে নিয়ে লাখ লাখ ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীকে পথে বসিয়ে দেয়া হয়েছে। কীভাবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ফরেন এক্সচেঞ্জ কোড হ্যাক করে শত শত মিলিয়ন ডলার চুরি করা হয়েছে।

এসব প্রশ্ন নিয়ে যে ধুম্রজাল সৃষ্টি হয়েছিল তা অপসারণ করে স্বচ্ছতার আলোয় আনা সরকারের দুর্নীতি বিরোধী লড়াইয়ের জন্য অনেক বড় চ্যালেঞ্জ। এই চ্যালেঞ্জে সফল হলে নির্বাচনী জালিয়াতির অভিযোগ সত্ত্বেও এই সরকারের জনগনের আস্থা অর্জন করতে পারবে। তবে সেই সম্ভাবনা খুবই ক্ষীন বলেই ধরে নেয়া যায়। সে ক্ষেত্রে প্রথমেই সরকারী দলের যে সব সাবেক মন্ত্রী-এমপি, আমলা ও ডাকসাইটে নেতার বড় বড় দুর্নীতির অভিযোগ আছে প্রথমে তাদেরকেই কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে হবে। তার আগে অবশ্যই বিচার বিভাগ, দুর্নীতি দমন বিভাগের সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলোর স্বাধীনতা, আইনগত সক্ষমতা ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর রাজনীতি নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করার কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে।

এমপিদের উদ্দেশ্যে দেয়া প্রথম বক্তব্যে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, ক্ষমতাকে সম্পদ অর্জনের হাতিয়ার বানাবেন না। মন্ত্রীসভা থেকে পুরনো অধিকাংশ সদস্যকে বাদ দিয়ে তিনি তাঁর নতুন চিন্তার বহি:প্রকাশ ঘটিয়েছেন। বাকিটা স্পষ্ট হতে খুব বেশীদিন হয়তো লাগবে না।

অবকাঠামো উন্নয়ন ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হাত ধরেই রাষ্ট্র উন্নততর স্তরে পর্দাপণ করতে পারে। তবে জনগনের কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রত্যাশা হচ্ছে, নিজেদের জান-মালের নিরাপত্তা, ভোটের অধিকার নিশ্চিত করার মধ্য দিয়ে রাষ্ট্র পরিচালনায় নিজের অংশিদারিত্বের অধিকার রক্ষা করা এবং সরকারের সমালোচনাসহ সংবিধান স্বীকৃত রাজনৈতিক অধিকারগুলো রক্ষায় সরকার এবং বিচার বিভাগসহ সব সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানের নিরপেক্ষ সক্রিয় ভ‚মিকা। অর্থাৎ মৌলিক মানবাধিকার ও গণতান্ত্রিক পরিবেশ ও সুশাসন নিশ্চিত করতে হলে সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলোর কার্যকারিতা নিশ্চিত করার কোনো বিকল্প নেই।

বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার দুর্বলতা, সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলোর অনিরপেক্ষতা, দুর্নীতি এবং সামাজিক-রাজনৈতিক অবক্ষয়ের চলমান দৃশ্যপট গত এক দশকেই সৃষ্টি হয়নি। এর পেছনে সুদীর্ঘ রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক ধারাবাহিক ঐতিহাসিক ঘটনা প্রবাহের সম্পর্ক আছে। ঔপনিবেশিক আমলে ক্ষমতা টিকিয়ে রাখার পুলিশ আইন, হীন উদ্দেশ্যে শিক্ষানীতি ও শিক্ষাব্যবস্থার পরিবর্তনের ধারাবাহিক পরিনতি ভোগ করছি আমরা। যেখানে শিক্ষকরা প্রশ্নপত্র ফাঁস করছেন, অভিভাবকরা টাকা দিয়ে ফাঁস হওয়া প্রশ্নপত্র কিনে পাবলিক পরীক্ষায় সন্তানের ভাল ফলাফল নিশ্চিত করতে সচেষ্ট থাকেন। সেখানে কোনো আইনের দ্বারা নীতি-নৈতিকতা ও সামাজিক-রাজনৈতিক অবক্ষয় রোধ করা সম্ভব নয়। রাষ্ট্র নাগরিকদের জন্য বিনামূল্যে মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিত করবে।

আমাদের সংবিধানের এমন অঙ্গিকার করা হলেও, স্বাধীনতাত্তোর বাংলাদেশে প্রাথমিক থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত শিক্ষাব্যবস্থার সব স্তরেই শিক্ষাবাণিজ্য অনেকটা প্রাতিষ্ঠানিক ভিত্তি লাভ করেছে। শিক্ষার বাণিজ্যিকিকরণের হাত ধরেই এসেছে দুর্নীতি, বৈষম্য, মানহীনতা ও অনৈতিকতার চর্চা। প্রশ্নফাঁস, সার্টিফিকেট বাণিজ্য, নিয়োগ বাণিজ্য, কোচিং বাণিজ্য, ভর্তি বাণিজ্য, শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক পক্ষপাত, মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক স্তরের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ম্যানেজিং কমিটি নির্বাচনে সামাজিক অংশগ্রহণমূলক ব্যবস্থার বদলে ক্ষমতাসীনদের একচেটিয়া মনোপলি দুর্নীতি ও শিক্ষার মানহীনতার জন্য বহুলাংশে দায়ী। আমরা যদি টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যে কাজ করতে চাই, তাহলে প্রথমেই সব সেক্টরে দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স দেখাতে হবে। এ ক্ষেত্রে শিক্ষাব্যবস্থার গলদ, দুর্নীতি, বৈষম্য ও মানহীনতাই হবে সর্বাধিক অগ্রাধিকারপ্রাপ্য সেক্টর।

সমাজে ও রাজনীতিতে ক্ষমতাবান ও দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের মধ্যে যদি সুশিক্ষা ও নৈতিক মূল্যবোধ না থাকে তাহলে সংবিধান বা আইনের ধারা দিয়ে সমাজ পরিবর্তন সম্ভব নয়। যে জনগণ ভোট দিয়ে তাদের প্রতিনিধি নির্বাচন করবেন, যে সংসদ সদস্যরা আইন প্রণয়ন ও সংবিধান সংশোধন করবেন, যে মন্ত্রী-আমলারা জনগনের সম্পদকে জনগণের সেবায় কাজে লাগাবেন, যে বিচারকরা ন্যায় বিচার ও নিরপেক্ষতার শপথ গ্রহণ করেন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর যে সদস্যরা সাংবিধানিক অধিকার ও আইনের যথাযথ প্রয়োগ নিশ্চিত করবেন তাদের অবশ্যই সুশিক্ষিত ও উন্নত নৈতিক গুনাবলী সম্পন্ন হতে হবে। অতএব রাষ্ট, রাজনীতি ও সমাজব্যবস্থার ইতিবাচক পরিববর্তনের শুরুটা হতে হবে শিক্ষাব্যবস্থা থেকেই।

সুশাসন, সামাজিক-রাজনৈতিক ন্যায়বিচার, বৈষম্যহীনতা ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ সভ্যতা ও জাতীয় সংস্কৃতির মান নির্ধারক বিষয়। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় আরো অনেক কিছুর সাথে অংশগ্রহণমূলক রাজনীতি, নির্বাচনী সংস্কৃতি, নির্বাচনের মান ও বিশ্বাসযোগ্যতার উপর এই মূল্যবোধ ও সংস্কৃতির বিকাশ অনেকাংশে নির্ভরশীল। জনগণের আস্থা ও অংশগ্রহণ বাদ দিয়ে শুধুমাত্র দলীয় লোকজন ও রাষ্ট্রযন্ত্র ব্যবহার করে এর পরিবর্তন সম্ভব নয়। একাদশ জাতীয় নির্বাচনের পর এ চ্যালেঞ্জ আরো কঠিন হয়ে পড়েছে। অনেক ভাল নির্বাচনের মধ্য দিয়ে ক্ষমতায় গিয়েও রাষ্ট্র পরিচালনায় ব্যর্থ ও দুর্নীতিগ্রস্ত হয়ে পড়ার অনেক উদাহরণ বিশ্বে অনেক আছে।

আবার অগণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় ক্ষমতা দখল করেও নানা ইতিবাচক পদক্ষেপের মাধ্যমে জনগণের আস্থা অর্জনের পাশাপাশি জনমনে স্থায়ী আসন প্রতিষ্ঠা করার উদাহরণও কম নেই। সে সব বিবরণে না গিয়ে বলতে চাই, টানা তৃতীয় মেয়াদে ক্ষমতাগ্রহণের পর সরকারের দুর্নীতি বিরোধী প্রতিশ্রতি বাস্তবায়নের প্রাথমিক নীতি হোক, জননিরাপত্তা, আইনের শাসন এবং শিক্ষাব্যবস্থাকে গলদ ও দুর্নীতিমুক্ত করার কার্যকর উদ্যোগ। আমাদের সামাজিক-রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলা, অবক্ষয়, যুবসমাজের মাদকাসক্তি, অপরাধপ্রবণতা, সন্ত্রাস-হানাহানি, নারীর শ্লীলতাহানী ইত্যাদি সবকিছুর উৎসমূলে রয়েছে শিক্ষাব্যবস্থার গলদ।

আমরা যখন বিশ্বে উন্নয়নের রোল মডেল হওয়ার দাবী করছি তখন অত্যন্ত দু:খের সাথে লক্ষ্য করছি, এক সময়ের প্রাচ্যের অক্সফোর্ড নামে খ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আন্তর্জাতিক র‌্যাংকিংয়ে প্রথম হাজারের মধ্যেও স্থান পায় না। সম্প্রতি প্রকাশিত একটি আন্তর্জাতিক র‌্যাংকিংয়ে বিশ্বের আড়াই হাজার বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ১৫৬২তম, বুয়েট ১৮১০তম, জাহাঙ্গির নগর বিশ্ববিদ্যালয় ২১২০তম এবং বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ২২৩৩তম র‌্যাংক লাভ করে। দেশে সরকারী বেসরকারী অন্তত দেড় শতাধিক বিশ্ববিদ্যালয় থাকলেও চারটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ছাড়া আর কোন প্রতিষ্ঠান স্থান পায়নি।

অন্যদিকে স্পেনভিত্তিক ওবোমেট্টিক্স-এর প্রায় ২৮ হাজার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মধ্যে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় ও ঐতিহ্যবাহী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থান ৫০৬৩তম। অবশ্য এ তালিকায় বাংলাদেশের সরকারী বেসরকারী আরো অন্তত ২৫টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অবস্থান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপরে। ইউনিভার্সিটি র‌্যাংকিং অন অ্যাকাডেমিক পারফর্মেন্স(ইউর‌্যাপ) এর জরিপে বিশ্বের আড়াই হাজার বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে ১০৮টি এ++ ক্যাটাগরির, ১৫০টির অধিক এ+ ক্যাটাগরির, এ ক্যাটাগরির বিশ্ববিদ্যালয় ২৫০টির বেশী, ৫০০শতাধিক বিশ্ববিদ্যালয় বি++ ক্যটাগরি এবং বি+ কটাগরির ৫০০শতাধিক। বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে মাত্র ৪টি পঞ্চম বা বি ক্যাটাররি বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে স্থান লাভ করেছে।

বিশ্বের অষ্টম বৃহত্তম জনসংখ্যার দেশ বাংলাদেশের কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান যখন বিশ্বের প্রথম দেড় হাজার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের তালিকায় স্থান পায় না,এ বাস্তবতা সামনে রেখে বাংলাদেশ কি করে বিশ্বের রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে তার কাঙ্খিত লক্ষ্যে পৌঁছবে? আজকের বাংলাদেশে যে সামাজিক-রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলা, অবক্ষয় ও অনিশ্চয়তা গ্রাস করেছে তার মূলে রয়েছে শিক্ষার প্রতিটি স্তরে দুর্নীতি-বিশৃঙ্খলা, দলবাজি ও রাজনৈতিক ক্ষমতার অপচর্চা।

সব বিতর্ক ও অভিযোগ পেছনে ফেলে একাদশ জাতীয় নির্বাচনের মধ্য দিয়ে গঠিত মন্ত্রীসভা তার পথচলা শুরু করেছে। পুৃরনো, অভিজ্ঞ ও বিতর্কিতদের বাদ দিয়ে একদল নতুন মুখ নিয়ে গঠিত মন্ত্রীসভায় শিক্ষামন্ত্রী হিসেবে সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডা. দিপু মনিকে শিক্ষা মন্ত্রনালয়ের মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। এ কথা অস্বীকার করা যাবে না যে, সাবেক শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ শিক্ষা ব্যবস্থার উন্নয়নে ও সমস্যা নিরসনে গত ১০ বছর নিরলস পরিশ্রম করে গেছেন। গত দুই বারের মন্ত্রী সভায় তিনি রাজনৈতিক বাগাড়ম্বর এড়িয়ে সারাদেশের শিক্ষাঙ্গণ ও শিক্ষা বিভাগের কল্যাণে নিবেদিত ছিলেন। তবে পুরো ১০ বছর ধরেই শিক্ষা বিভাগের নানা অনিয়ম, দুর্নীতি, পাবলিক পরীক্ষায় প্রশ্নপত্র ফাঁসের মত অনেক ঘটনায় বিতর্ক তার পিছু ছাড়েনি। শিক্ষা বিভাগের দুর্নীতিগ্রস্ত আমলাতন্ত্রের কাছে কখনো কখনো তাঁকে বড় অসহায় বলে মনে হয়েছে। বাহ্যিকভাবে নুরুল ইসলাম নাহিদ সততা ও একাগ্রতার সাথে কাজ করে শিক্ষা বিভাগের সংকট ও সমস্যা-জঞ্জাল দূর করতে পারেননি। সদিচ্ছা থাকলেও একজন মন্ত্রীর পক্ষে মন্ত্রনালয়ের সব সমস্যা ও সংকট দূর করা সম্ভব নয়। শিক্ষা মন্ত্রনালয়ের ক্ষেত্রে এটা আরো বহুলাংশে সত্য।

পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে আন্তর্জাতিক আদালতে মিয়ানমার ও ভারতের সাথে সমুদ্রসীমা বিরোধের মত গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা নিরসনে বিশেষ ভ‚মিকা পালনকারী ডা. দিপু মনি শিক্ষামন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ নি:সন্দেহে অনেক বেশী জটিল ও চ্যালেঞ্জিং। বিদেশে শিক্ষালাভ এবং পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে বিশ্বের বহু দেশ ভ্রমণের অভিজ্ঞতা শিক্ষা বিভাগে নতুন যুগোপযোগী চিন্তার প্রতিফলন ঘটাতে পারে। অবশ্য শিক্ষাজগতের স্টেকহোল্ডারদের মধ্যে দেশের ওলামা-মাশায়েক, খানাকাহ্ দরবার, কওমী, আলীয়া, ইসলামী শিক্ষাসংশ্লিষ্ট বহু বিষয় বিশেষত বাংলাদেশ জমিয়াতুল মোদার্রেছীন এবং আল-হাইয়াতুল উলিয়া সামলাতে কিংবা অবাধ যাতায়াত, যোগাযোগ, সংলাপ, অংশগ্রহণ সবকিছুতে তার মহিলা হওয়াটা একটু অসুবিধার কারনও ঘটবে। যা বাংলাদেশের বাস্তবতায় যথেষ্ট বিবেচনাযোগ্য।

শিক্ষা ক্ষেত্রে দেশের মানুষ আর কোন এক্সপেরিমেন্ট দেখতে চায় না। আমাদের ইতিহাস-ঐতিহ্যের ধারাক্রম, সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের সামাজিক ও ধর্মীয় মূল্যবোধ এবং সাংবিধানিকভাবে সংরক্ষিত বৈষম্যহীন, মানসম্মত শিক্ষার বাস্তবায়নে এবার একটি কার্যকর, সাহসী পদক্ষেপ প্রয়োজন। সারাদেশে হাজার হাজার বেসরকারী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান শুধুমাত্র রাজনৈতিক কারণে দুর্নীতিগ্রস্ত হয়ে অচলাবস্থার শিকার হয়ে পড়েছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে সরকারদলীয় নেতাকর্মীদের নিয়োগ বাণিজ্য, ভর্তি বাণিজ্যসহ নানাবিধ ম্যানিপুলেশন থেকে মুক্ত করার উদ্যোগ নিতে না পারলে তা কখনোই শিক্ষার কাঙ্খিত পরিবেশ ও ফলাফল নিশ্চিত করবে না।

সামাজিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে ধর্ম-বর্ণ, রাজনৈতিক মতাদর্শ নির্বিশেষে সমাজের প্রতিনিধিত্বশীল ও শিক্ষানুরাগী মানুষের অংশগ্রহণ অবারিত না হলে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে স্বচ্ছ, জবাবদিহিমূলক ও সুষ্ঠু পরিবেশ নিশ্চিত করা সম্ভব নয়। নতুন শিক্ষানীতি অনুসারে প্রাথমিক শিক্ষা অষ্টম শ্রেনী পর্যন্ত বাধ্যতামূলক হলেও ৫ম শ্রেনীর শিশুদের উপর বাধ্যতামূলকভাবে প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষার মত পাবলিক পরীক্ষা চাপিয়ে শিক্ষার প্রাথমিক স্তরকে দুর্নীতিগ্রস্ত ও শিক্ষা বাণিজ্য বিস্তৃত করা হয়েছে। দেশের শিক্ষাবিদ ও নাগরিক সমাজের মধ্য থেকে পঞ্চম শ্রেনীতে পাবলিক পরীক্ষা বাদ দেয়ার জোরালো দাবী আছে। নতুন শিক্ষামন্ত্রীকে এ বিষয়ে যথাশীঘ্র একটি সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে হবে। অন্যদিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের সরকারী বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে উচ্চশিক্ষা ও গবেষণার কাঙ্খিত মান নিশ্চিত করার উদ্যোগ নিতে হবে।

bari_zamal@yahoo.com