।। মাওলানা মুনির আহমদ ।।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ধ্বংসস্তুপের মধ্যে মানবতার রক্ষার উদ্দেশ্যে জাতিসংঘের জন্ম হয়েছিল। লক্ষ্য ছিল যুদ্ধ থামানো, ন্যায় প্রতিষ্ঠা করা এবং আন্তর্জাতিক স্তরে শান্তি রক্ষা করা। কিন্তু আজকের বাস্তবতায় আমরা দেখতে পাচ্ছি, বিশ্বমঞ্চে জাতিসংঘ কেবল শক্তিধর দেশগুলোর পুতুল হয়ে দাঁড়িয়েছে- এক নীরব দর্শক, যে বিবৃতি দেয়, প্রস্তাব দেয়, কিন্তু মানবতার পক্ষে কোনো কার্যকর পদক্ষেপ বাস্তবায়ন করতে পারে না। গাজার রক্তাক্ত ট্র্যাজেডি, ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ, ইয়েমেন ও সুদানের গৃহযুদ্ধ- সবখানেই জাতিসংঘের নিষ্ক্রিয়তা স্পষ্ট।
জাতিসংঘের অক্ষমতার মূল কারণ হলো, নিরাপত্তা পরিষদের ভেটো ক্ষমতা। মাত্র পাঁচটি স্থায়ী সদস্য-যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, রাশিয়া ও চীন; ভেটো ক্ষমতা দিয়ে বিশ্বে ন্যায় ও শান্তি প্রতিষ্ঠার উদ্যোগকে অচল করে রেখেছে। যখনই কোনো বৃহৎ শক্তি বা তার মিত্রের বিরুদ্ধে মানবিক পদক্ষেপ প্রয়োজন, ভেটো ব্যবস্থার জালে গোটা সংস্থা জিম্মি হয়ে যায়। গাজার উদাহরণ সবচেয়ে মর্মান্তিক। ইসরায়েলি বর্বরতার শিকার হাজার হাজার নারী ও শিশু জাতিসংঘের অক্ষমতার শিকার হয়েছে। এটি আমাদের সামনে এক ভয়ানক বাস্তবতা তুলে ধরেছে- যেখানে শক্তিশালী রাষ্ট্রের স্বার্থ মানুষের জীবনকে ছাপিয়ে গেছে।
জাতিসংঘের ব্যর্থতার পাশাপাশি বিশ্বের শান্তি ও ন্যায়ের পথে আরও বড় বাধা হলো, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আগ্রাসী নীতি ও দ্বিমুখী কূটনীতি। আন্তর্জাতিকভাবে মানবাধিকার রক্ষক হিসেবে পরিচিত হলেও বাস্তবে যুক্তরাষ্ট্র তার স্বার্থের জন্য যুদ্ধকে উসকে দেয়। ইরাক, আফগানিস্তান, লিবিয়া ও সিরিয়ায় যে বিপর্যয় সৃষ্টি হয়েছে, তার প্রমাণ ইতিহাসের কাছে অমোঘ। ফিলিস্তিনে ইসরায়েলের বর্বরতা বন্ধ করার পরিবর্তে যুক্তরাষ্ট্রের নীরবতা এবং পক্ষপাত জাতিসংঘকেও কার্যহীন করে দিয়েছে। শক্তির ভারসাম্য ও স্বার্থের রাজনীতি মানবতার নৈতিকতাকে হরণ করেছে।
আরও পড়তে পারেন-
- আদর্শ সমাজ বিনির্মাণে ইসলামের ভূমিকা
- সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি যেন হুমকির মুখে না পড়ে
- সমৃদ্ধ জাতি নির্মাণে দরকার বুদ্ধিবৃত্তিক জাগরণ ও আলেমদের এগিয়ে আসা
- সালাম-কালামের আদব-কায়দা
- বিবি খাদিজা (রাযি.): ইসলাম ধর্মের ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ নারী
আরব বিশ্বের উদাসীনতা মুসলিম উম্মাহর জন্য আরও বড় বিপদ বয়ে আনছে। গাজায় নিরপরাধ ফিলিস্তিনি নারী, শিশু ও পুরুষ প্রাণ হারাচ্ছে, অথচ আরব নেতারা শুধু বিবৃতিতেই সীমাবদ্ধ আছে। তারা একদিকে ফিলিস্তিনের স্বাধীনতার পক্ষে কথা বলেন, অন্যদিকে ইসরায়েলের সঙ্গে কূটনৈতিক ও বাণিজ্যিক সম্পর্ক জোরদার করেন। এই দ্বিচারিতা কেবল ইসরায়েলকেই শক্তিশালী করছে না, পুরো মুসলিম উম্মাহর ঐক্যকে দুর্বল করছে। এ উদাসীনতা ও ভণ্ডামি ফিলিস্তিনিদের ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত করছে।
সমাধানের পথ আছে, তবে তা আন্তরিকতা ও সাহসের ওপর নির্ভর করে। প্রথমত, জাতিসংঘকে কার্যকর, নিরপেক্ষ এবং মানবতার পক্ষে শক্তিশালী সংস্থায় রূপান্তর করতে হবে। ভেটো ক্ষমতা সীমিত করে যুদ্ধবিরোধী ও মানবাধিকার প্রস্তাবগুলোর বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে হবে। দ্বিতীয়ত, আরব রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে ঐক্য তৈরি করতে হবে। কেবল কূটনৈতিক বিবৃতি নয়, বাস্তব পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে- ইসরায়েলের ওপর অর্থনৈতিক চাপ সৃষ্টি, কূটনৈতিক সম্পর্ক পর্যালোচনা এবং আন্তর্জাতিক আদালতে মামলা দায়ের প্রমুখ উদ্যোগ থাকতে পারে। তৃতীয়ত, আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম ও নাগরিক সমাজকে সক্রিয় ভূমিকা নিতে হবে। বিশ্বজনমত গঠন করে যুদ্ধবিরোধী চাপ সৃষ্টি করা জরুরি।
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো, ফিলিস্তিনিদের এবং সর্বোপরি আরববিশ্বসহ বিশ্ব মুসলিম উম্মাহর অভ্যন্তরীণ ঐক্য। কারণ, বিভক্ত কণ্ঠস্বর শক্তি অর্জন করতে পারে না। একক নেতৃত্ব এবং সুসংহত নীতি ছাড়া ন্যায্য অধিকারের দাবি আন্তর্জাতিক মঞ্চে কার্যকর হবে না।
জাতিসংঘের নীরবতা, আমেরিকার আগ্রাসন এবং আরব বিশ্বের উদাসীনতা মানবতার চরম সংকটের প্রতীক। মুসলিম উম্মাহর ঐক্যহীনতা এবং আন্তর্জাতিক সমাজের অদক্ষতা মিলে আজ আমরা এক ভয়াবহ বাস্তবতার মুখোমুখি। ইতিহাসের বিচার কঠিন হবে এবং আল্লাহর আদালতে জালেম শাসকদেরকে অবশ্যই জবাবদিহি হতে হবে।
সুতরাং এখন সময় এসেছে- জাতিসংঘকে পুনর্গঠন করতে, মুসলিম উম্মাহকে ঐক্যবদ্ধ করতে এবং বিশ্বের মানবিক শক্তিকে একত্রিত করে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় সক্রিয়ভাবে ভূমিকা রাখতে যার যার জায়গা থেকে সোচ্চার আওয়াজ তোলার। নইলে নৈতিকতা, মানবিকতা ও ইতিহাসের দায় থেকে কেউ রক্ষা পাবে না।
উম্মাহ২৪ডটকম: এমএ