Home ওপিনিয়ন চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত: বাংলার মুসলমানদের ভূমি হারানোর বেদনাদায়ক ইতিহাস

চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত: বাংলার মুসলমানদের ভূমি হারানোর বেদনাদায়ক ইতিহাস

।। ইফতিখার আহমদ ।।

ভূমিকা: ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের প্রাথমিক পর্যায়ে, বিশেষ করে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রবর্তনের পর, বাংলার ভূমি ব্যবস্থাপনায় এক আমূল পরিবর্তন আসে। এই পরিবর্তন শুধু অর্থনৈতিক নয়, বরং সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কাঠামোতেও গভীর প্রভাব ফেলে। মুঘল আমল থেকে প্রচলিত লাখেরাজ বা নিষ্কর ভূমি প্রথা বিলোপের ফলে সমাজের একটি বিশেষ অংশ, বিশেষ করে মুসলমান সম্প্রদায়, ব্যাপক ক্ষতির শিকার হয়। এই লেখায় আমরা সেই ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট এবং তার সুদূরপ্রসারী প্রভাব নিয়ে আলোচনা করব।

মুঘল আমলে লাখেরাজ প্রথা: মুঘল শাসনের একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য ছিল লাখেরাজ ভূমি, যা ছিল মূলত কর বা খাজনা মওকুফকৃত জমি। এই ভূমি বিভিন্ন কারণে অনুগ্রহপ্রাপ্ত ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের অনুকূলে দান করা হতো। ধর্মীয় স্থাপনা, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, তীর্থস্থান ও মন্দিরের মতো জনহিতকর কাজের রক্ষণাবেক্ষণের জন্য এ ধরনের নিষ্কর ভূমি অনুদান দেওয়া হতো। এটি ছিল রাষ্ট্রের একটি দীর্ঘকালীন ঐতিহ্য, যা মুঘল আমলে সর্বোচ্চ গুরুত্ব পায়। ১৭৭৬ সালের আমিনি কমিশন অনুযায়ী, সাম্রাজ্যের মোট রাজস্ব ভূমির একটি বড় অংশই ছিল এই লাখেরাজদারদের অধীনে। সরকারি নথিপত্রে এই জমিকে ‘বাজে জমি’ বলা হতো, কারণ এখান থেকে সরকার কোনো রাজস্ব পেত না।

ব্রিটিশ আমলে লাখেরাজ বাজেয়াপ্তকরণ: ব্রিটিশ শাসনের মূল লক্ষ্য ছিল ভূমি থেকে সর্বোচ্চ রাজস্ব আদায় করা। এই লক্ষ্য লাখেরাজ প্রথার সঙ্গে সাংঘর্ষিক ছিল। ১৭৯৩ সালের ১৯ ও ৩৭ নং রেগুলেশনের মাধ্যমে সকল লাখেরাজদারকে তাদের সনদ যাচাই ও নিবন্ধনের জন্য কালেক্টরের অফিসে জমা দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়। ১৮২২ সালে অবৈধভাবে হস্তান্তরিত সকল জমি জরিপ করে তা বাজেয়াপ্ত করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। এই পদক্ষেপের ফলে অসংখ্য লাখেরাজ সনদ বাতিল হয়।

মুসলমানদের ওপর প্রভাব: লাখেরাজদারদের মধ্যে মুসলমানরাই ছিলেন সংখ্যাগরিষ্ঠ, এবং তারাই এই বাজেয়াপ্তকরণের ফলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হন। ব্রিটিশ সিভিলিয়ান উইলিয়াম হান্টার তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ ‘দি ইন্ডিয়ান মুসলমানস’-এ এই পরিস্থিতির বিস্তারিত বর্ণনা দিয়েছেন। তিনি লেখেন, “এর ফলে শত শত মুসলমান পরিবার ধ্বংস হয়ে গেল এবং তাদের শিক্ষাব্যবস্থা, যা এতদিন লাখেরাজ ওয়াকফের জমির ওপর নির্ভরশীল ছিল, মারাত্মক আঘাত পেল। মুসলমান আলিম-সমাজ প্রায় আঠারো বছরের হয়রানির পর একেবারে ধ্বংস হয়ে গেল।”

হান্টার আরও বলেন, “ভারতীয় মুসলমানরা হচ্ছে এদেশে ব্রিটিশ শক্তির বিরুদ্ধে চিরন্তন বিপদ।” তিনি মনে করতেন, ব্রিটিশ প্রবর্তিত পরিবর্তনগুলোকে মুসলমানরা তাদের প্রতি অবিচার হিসেবে দেখছিল, যেখানে হিন্দুরা তা আনন্দের সঙ্গে মেনে নিচ্ছিল। হান্টারের মতে, এই অবনতি ব্রিটিশদের “রাজনৈতিক অজ্ঞতা ও অবহেলার বিষময় ফল।”

আরও পড়তে পারেন-

চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত এবং হিন্দু জমিদারদের উত্থান: লর্ড কর্নওয়ালিশ ১৭৯৩ সালে ‘চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত’ চালু করেন। এই ব্যবস্থার অধীনে লাখেরাজ জমিগুলো বাজেয়াপ্ত করে তা ব্রিটিশ অনুগত হিন্দু বাবুদের হাতে তুলে দেওয়া হয়। এর ফলে সমাজে একটি নতুন জমিদার শ্রেণির উত্থান ঘটে। তৎকালীন ভারত সরকারেরই একজন সদস্য চার্লস মেটকাফ ১৮২০ সালে এই নীতির তীব্র সমালোচনা করে বলেন, “এ নীতি হচ্ছে অন্যায় অবিচারের চূড়ান্ত; কোনো দেশেই এরকম নীতির নজির নেই যেখানে সমস্ত জমিজমা যাদের প্রাপ্য তাদেরকে না দিয়ে অন্য এক গোষ্ঠীর হাতে তুলে দেওয়া হলো।”

সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কাঠামোর ওপর আঘাত: লাখেরাজ সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা ছিল বাংলার শত শত বছরের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কাঠামোর ওপর একটি বড় আঘাত। মুঘল আমলের ঐতিহ্য অনুযায়ী, লাখেরাজ জমিগুলো সাধারণত আলিম-উলামা, পীর-দরবেশ এবং অন্যান্য জ্ঞানীগুণী ব্যক্তিদের দেওয়া হতো, যা শিক্ষা ও সংস্কৃতির প্রসারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখত। এই জমি বাজেয়াপ্ত হওয়ার ফলে মুসলমান সমাজের সামাজিক ও অর্থনৈতিক মেরুদণ্ড ভেঙে যায়, এবং তারা শিক্ষা ও অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে পড়ে।

চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত এবং লাখেরাজ সম্পত্তি বাজেয়াপ্তকরণের ফলে সৃষ্ট বৈষম্য ব্রিটিশ ভারতের রাজনীতি ও সমাজে গভীর প্রভাব ফেলে। এটি কেবল একটি অর্থনৈতিক পদক্ষেপ ছিল না, বরং একটি দীর্ঘস্থায়ী সামাজিক পরিবর্তনের সূচনা করেছিল, যার ফলস্বরূপ মুসলমান সমাজের পিছিয়ে পড়া এবং হিন্দু জমিদার শ্রেণির উত্থান ঘটে। এই ঐতিহাসিক ঘটনাটি আজও আমাদের ভূমি ব্যবস্থাপনা ও সামাজিক ইতিহাসের এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় হিসেবে বিবেচিত হয়।

এক ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট এবং বর্তমানের করণীয়

সম্প্রতি ধর্ম বিষয়ক উপদেষ্টা ড. মাওলানা আ ফ ম খালিদ হোসেনের দেবোত্তর সম্পত্তি উদ্ধারের উদ্যোগ প্রশংসনীয়। কারণ, যেকোনও সম্প্রদায়ের বেহাত হওয়া সম্পত্তি পুনরুদ্ধার করা অবশ্যই সরকারের দায়িত্ব। তবে, এই প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমান সমাজের মধ্যে একটি তীব্র নেতিবাচক প্রতিক্রিয়ার জন্ম হয়েছে। কারণ, ঐতিহ্যগতভাবে এবং ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের সময় সম্পত্তি হারানোর ক্ষেত্রে মুসলমানরাই সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল, বিশেষত চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের কারণে লাখেরাজ সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত হওয়ায়।

যেখানে হিন্দুদের দেবোত্তর সম্পত্তি উদ্ধারের ব্যাপারে উপদেষ্টা মহোদয়কে অত্যন্ত উৎসাহী মনে হচ্ছে, সেখানে ঐতিহাসিকভাবে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত মুসলমানদের লাখেরাজ সম্পত্তি উদ্ধারের বিষয়ে তাঁর নীরবতা সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম জনগোষ্ঠীর মধ্যে ভুল বার্তা দিচ্ছে। এতে এমন ধারণা তৈরি হতে পারে যে, বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানরা হিন্দুদের সম্পত্তি জবরদখল করে আছে, যা ঐতিহাসিক সত্যের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ নয়।

অতএব, এই পরিস্থিতিতে মাননীয় উপদেষ্টা মহোদয়ের কাছে আমাদের প্রত্যাশা, তিনি যেন কেবল একটি নির্দিষ্ট সম্প্রদায়ের নয়, বরং ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট বিবেচনা করে মুসলমানদের লাখেরাজ সম্পত্তি উদ্ধারের বিষয়েও সমানভাবে মনোযোগী হন। যদি তিনি পারেন, তবে মুসলমানদের লাখেরাজ সম্পত্তি উদ্ধার করে তাদের দীর্ঘদিনের ক্ষতির কিছুটা হলেও প্রতিকার করতে পারেন। এটি কেবল একটি নির্দিষ্ট সম্প্রদায়ের প্রতি সুবিচার নয়, বরং বাংলাদেশের সকল নাগরিকের জন্য ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হবে।

উম্মাহ২৪ডটকম: এমএ

উম্মাহ পড়তে ক্লিক করুন-
https://www.ummah24.com

দেশি-বিদেশি খবরসহ ইসলামী ভাবধারার গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে ‘উম্মাহ’র ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।