Home ধর্মতত্ত্ব ও দর্শন তাবলীগ জামাআতকে ফিতনা মুক্ত রাখা ওলামায়ে কেরামের কর্তব্য

তাবলীগ জামাআতকে ফিতনা মুক্ত রাখা ওলামায়ে কেরামের কর্তব্য

অলংকরণ- উম্মাহ গ্রাফিক্স।

।। আল্লামা মুফতি খলীল আহমদ কাসেমী ।।

পবিত্র কুরআনে মহান আল্লাহ ইরশাদ করেন, “ইন্নামা ইয়াখসাল্লাহা মিন ঈবাদিহীল উলামা”। অর্থাৎ- নিশ্চয়ই বান্দাদের মধ্যে আলেমগণই আল্লাহ তাআলাকে বেশি ভয় করে। অপরদিকে হাদিসে রাসূলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন, “আল-উলামাউ ওয়ারাসাতুল আম্বিয়া”। অর্থাৎ- ওলামায়ে কেরাম হলেন আম্বিয়াগণের উত্তরসূরী।

এই উত্তরাধীকারের দায়িত্বের মধ্যে তিনটি বিষয় পড়ে- প্রথমতঃ তাফাক্কু ফিদ-দ্বীন তথা দ্বীনের সঠিক জ্ঞান আয়ত্ত করা। দ্বীনের সঠিক জ্ঞান না থাকলে হক-বাতিলের পার্থক্য করা যাবে না, সুন্নাত বিদআতের পার্থক্য করা যাবে না, দ্বীন ও গায়রে দ্বীনের পার্থক্য করা যাবে না। এ জন্য, সঠিক উপায়ে নবীর প্রতিনিধিত্ব করার জন্য দ্বীনি জ্ঞান আয়ত্ত করা ওলামায়ে কেরামের জন্য অপরিহার্য বিষয়। এই দ্বীনি জ্ঞানার্জনে যদি ঘাটতি থাকে, তাহলে দ্বীনের মধ্যে নানা সমস্যা তৈরি হবে। পৃথিবীতে গোমরাহী এসেছে দুই কারণে। যথা-

প্রথম হলো- যাহালাত বা মূর্খতা। আর অন্যটি হলো খাহেশাত বা প্রবৃত্তি দ্বারা পরিচালিত হওয়া। দাওয়াত ও তাবলীগের ময়দানে বর্তমানে যে সংকটের কথা সবচেয়ে বেশি আলোচিত হচ্ছে, এই সমস্যার মূল কারণ জানতে হবে। এই সমস্যার কারণ আমি যে হাদিসটি শুরুতে উল্লেখ করেছি, সেই হাদিসে বর্ণিত ‘তাফাক্কু ফিদ-দ্বীন’-এর ঘাটতির কারণে।

দ্বিতীয় হলো- তাহাফফুজে দ্বীন বা দ্বীনের হেফাজত করা। দ্বীনের উপর যখন কোন আঘাত আসে, সেটা ইসলাম, গায়রে ইসলাম বা নাস্তিকতা ও বে-দ্বীন; যে নামেই আসুক, সেটাকে প্রতিহত করা ওলামায়ে কেরামের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। যারা বলে থাকেন, হুজুরগণ কেন দাওয়াত ও তাবলীগে নাক গলাবেন, তারা জানেন না যে, দ্বীনের হেফাযতের জন্য, দ্বীন সংরক্ষণের জন্য সর্বোচ্চ কুরবানীর মাধ্যমে চেষ্টা-সাধনা করা ওলামায়ে কেরামের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে।

আকাবেরে আসলাফে উম্মত দ্বীনের হেফাজত করতে গিয়ে কত জুলুম নির্যাতনের মুখে পড়েছেন, ফাঁসির কাষ্ঠে ঝুলেছেন, জেল খেঠেছেন, বেত্রাঘাত হজম করেছেন এবং আরো নানা অবর্ণনীয় জুলুম-নির্যাতনের মুখোমুখি হয়েছেন, বলে শেষ করা যাবে না। দ্বীনের হেফাজতের জন্য তাঁরা অনেক বড় পর্যায়ের কুরবানী দিয়েছেন। তবুও তারা দ্বীন রক্ষার মিশন থেকে পিছপা হননি কখনো। সুতরাং দ্বীনের উপর যে কোন আঘাত আসলে, সেটা প্রতিহতের জন্য উদ্যোগ গ্রহণ করা নবীর ওয়ারিশ হিসেবে উলামায়ে কেরামের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। বর্তমানে দাওয়াত ও তাবলীগের মধ্যে যেই সঙ্কটের সৃষ্টি হয়েছে, তা দূর করার জন্য উদ্যোগ গ্রহণ করা এবং যারা দ্বীনি বিষয়ে নানা বিভ্রান্তিতে আছেন, তাদেরকে সঠিক পথে নিয়ে আসার উদ্যোগ নেওয়া ওলামায়ে কেরামের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। এই দায়িত্ব পালন না করলে ওলামায়ে কেরামকে জবাবদেহি হতে হবে আল্লাহর কাছে।

আমি আলোচনা দীর্ঘ করবো না। দাওয়াত ও তাবলীগে বর্তমানে যে সমস্যা চলছে, সে সম্পর্কে সকলেই ওয়াকিফহাল। এই সমস্যা অনেকের কারণে নয়। এই সমস্যার গোড়ায় রয়েছেন মাত্র এক ব্যক্তি। এক ব্যক্তির কারণেই দাওয়াত ও তাবলীগের এই বিশাল ময়দানে আজ সঙ্কট দেখা দিয়েছে। এই এক ব্যক্তিটি হলেন মাওলানা সাদ সাহেব। মাওলানা সাদ সাহেব কী সমস্যা করছেন? তিনি সমস্যা করছেন, হযরত মাওলনা ইলিয়াস (রহ.), হযরত মাওলানা ইউসুফ (রহ.) এবং হযরত মাওলানা এনামুল হক (রহ.)এর সময় থেকে তাবলীগ জামাত হকের যে উসূল ও ভিত্তির উপরে চলে আসছিল, সেটা থেকে সরিয়ে নিয়ে আসতে চাচ্ছেন তিনি।

দ্বিতীয়তঃ মাওলানা সা’দ সাহেব কুরআন সুন্নাহর পরিপন্থি আকিদা বিশ্বাস, কুরআন-সুন্নাহর মনগড়া ব্যাখ্যা ও তাফসীর তাবলীগে চালু করতে চেষ্টা করছেন। এক কথায় মাওলানা সা’দ সাহেব তাবলীগ জামাআতকে গোমরাহীর রাস্তায় নিয়ে যেতে কাজ শুরু করেছেন। তাছাড়া তিনি যুগ যুগ ধরে চলে আসা তাবলীগ জামাআতের শূরা কমিটি এবং গঠনতান্ত্রিক যে নিয়ম-নীতি আছে, সেটাও তিনি মানতে রাজি নন। এমন বিতর্কিত এক ব্যক্তি এই বিশাল দাওয়াত ও তাবলীগ জামাআতের আলমি মুরুব্বী বা কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের পদ গায়ের জোরে দখল করে আছেন। এই এক ব্যক্তির কারণে আজ সারা বিশ্বের তাবলীগী এন্তেজামে ব্যবস্থাপনায় অশান্তি তৈরি হয়েছে। মাওলানা সা’দ সাহেবের সকল অনৈতিক মতবাদ ও অনিয়মের সংশোধনের জন্য এ পর্যন্ত মুরুব্বীগণ সকল পন্থা ও প্রচেষ্টা চালিয়ে এসেছেন। কিন্তু তিনি নিজেকে সংশোধন করেননি। এমনকি, দারুল উলূম দেওবন্দ থেকে ফাতওয়া দেওয়ার পর তিনি সেই ফাতওয়াও মানতে রাজি হননি।

এখন আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশ, যেটা বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম মুসলিম রাষ্ট্র। এই দেশের শতকরা ৯২ জন মানুষ মুসলমান। বিশ্বের মধ্যে দাওয়াত ও তাবলীগের মেহনতের সবচেয়ে বড় মার্কাজ হলো এখন বাংলাদেশে।

কাজেই বাংলাদেশের জমিন যদি সা’দ সাহেবের গোমরাহীতে আক্রান্ত হয়, তাহলে বাংলাদেশের জনগণের ঈমান-আকীদা হেফাজত করাও মুশকিল হয়ে যাবে। হাদিস মতে জনগণের ঈমান-আকীদার উপর মাওলানা সা’দ সাহেবের কারণে যেই হুমকি তৈরি হয়েছে, সেটা থেকে জনগণকে হেফাজত করা ওলামায়ে কেরামের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। এই দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে ওলামায়ে কেরাম সিদ্ধান্ত দিয়েছেন যে, সা’দ সাহেব নিজেও গোমরাহীর মধ্যে আছেন এবং দাওয়াত ও তাবলীগের নেতৃত্বের পদ অবৈধভাবে দখল করে তার গোমরাহী মতবাদ এই বিশাল জামাতের মধ্যেও চালু করতে চাচ্ছেন। যেহেতু তাকে কোনোভাবেই সৎপথে ফিরিয়ে আনা যাচ্ছে না, সুতরাং বাংলাদেশের সাধারণ মুসলমানদেরকে ফিতনা ও গোমরাহী থেকে বাঁচানোর জন্য এই লোককে কোনভাবেই বাংলাদেশে আসতে দেওয়া যাবে না। এই লোকের বিভ্রান্ত অনুসারীদেরকে কখনোই তাবলীগ জামাতের পক্ষরূপে বিবেচনা করা যাবে না। মাওলানা সাদকে বাংলাদেশে আসতে হলে আগে তাকে দারুল উলূম দেওবন্দের ফাতাওয়া মেনে নিয়ে সেই মতে চলার প্রকাশ্য ঘোষণা দিতে হবে এবং ভারতের নেজামুদ্দীনে আগে যে সকল মুরুব্বী ছিলেন, তাদের সাথে সাদ সাহেবকে নিয়ে যে সঙ্কটের সৃষ্টি হয়েছে, সেটার পূর্ণ সমাধান বা সমঝোতা হতে হবে।

আরও পড়তে পারেন-

সা’দ সাহেবের সৃষ্ট এতাতি ফিতনা থেকে অবশ্যই কাকরাইলকে মুক্ত রাখতে হবে। শবগুজারির ইজতিমা হোক, তিন দিনের বা পাঁচ দিনের ইজতিমা হোক, এদেরকে কোথাও স্থান দেওয়া যাবে না। বাংলাদেশে মুষ্টিমেয় যারা সাদ সাহেবের পক্ষাবলম্বন করেছেন, তারাও গোমরাহ। সা’দ সাহেব যেমন ফেতনা ছড়াচ্ছেন, তেমনি বাংলাদেশের মুষ্টিমেয় তার সমর্থকরাও এই দেশে গোমরাহ ছড়াতে চাচ্ছেন। এদেরকে কোনভাবেই প্রশ্রয় দেওয়া যাবে না। শুধু সাদ সাহেবের বাংলাদেশে আগমন বন্ধ করাই যথেষ্ট নয়, বরং তার দেশীয় মুষ্টিমেয় সমর্থকদেরকেও তাবলীগ জামাআত থেকে উচ্ছেদ করার বিষয়ে আমাদেরকে কঠোর সিদ্ধান্ত নিতে হবে। সা’দ সাহেবের অনুসারী কেবল তাবলীগ জামাতেই বিশৃঙ্খলা ও আদর্শহীনতা ছড়ানোর ষড়যন্ত্র করেই ক্ষ্যান্ত হচ্ছেন না, বরং তারা আজ খুনাখুনি থেকে শুরু করে নানান ফিতনায় জড়িয়ে দেশের শান্তি-শৃঙ্খলা ও নিরাপত্তার জন্যও মারাত্মক হুমকি তৈরি করে চলেছে। তাদের এসব অপতৎপরতা ও বেআইনী কর্মকাণ্ড রোধে রাষ্ট্রকেও পদক্ষেপ নিতে হবে।

দেশের সার্বিক শান্তি-শৃঙ্খলার স্বার্থে তাবলীগের সাথী ভাই ও যিম্মাদারগণসহ উলামায়ে কেরাম এ পর্যন্ত কঠোর ধৈর্যধারণ করে আসছে। কিন্তু তারা এখন নানাবিদ সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডসহ নিষ্ঠুর খুনাখুনিতেও জড়িয়ে পড়েছে। একই সাথে তারা সংশোধিত না হয়ে গোমরাহী ছড়ানোও অব্যাহত রেখেছে। এমনকি, সাদ সাহেব ও তার সমর্থকরা দারুল উলূম দেওবন্দের ফাতাওয়া না মেনে বরং দারুল উলূম দেওবন্দ ও ওলামায়ে কেরামকে কটাক্ষ করে নানা ধরনের বিভ্রান্তি ছড়ানোর চেষ্টা করে যাচ্ছেন। কাজেই তাদের বিষয়ে আর চুপ থাকার বা মেনে নেওয়ার কোনই সুযোগ নেই।

আমাদেরকে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে হবে যে, তাবলীগ জামাআত যুগ যুগ ধরে আকাবীরদের দেখানো যেই নিয়মে পরিচালিত হয়ে আসছে, সেই নিয়ম বহাল রাখার বিষয়ে কোন ছাড় দেওয়া যাবে না। বাংলাদেশের ওলামায়ে কেরাম যদি এই ফিতনাবাজদেরকে উৎখাতে সফল না হন, তাহলে বাংলাদেশের সাধারণ মুসলমানদেরকে এরা গোমরাহ করে ছাড়বে। পরম করুণাময় আল্লাহ আমাদেরকে তাঁর মর্জি মতো হকের উপর চলার তাওফীক দান করুন। আমীন।

হযরত মাওলানা আরশাদ মাদানী (হাফি.) ২০১৭ সালে এই মাওলানা সা’দ সম্পর্কে পরিষ্কার বলেছেন, “ইয়ে আদমী জাহেল হায়”, অর্থাৎ- এই লোক মুর্খ। হযরত আরেকটা কথা বলেছেন যে, বাংলাদেশে আসার আগে তিনি নেজামুদ্দীন গিয়েছিলেন। পৌনে এক ঘণ্টা আলোচনা করেছেন সা’দ সাহেবের সাথে। এই আলোচনার শেষ পর্যায়ে হযরত আরশাদ মাদানী সাহেব সা’দ সাহেবকে শুধু একটা প্রশ্ন করে জবাব চাইলেন যে, আপনার উস্তাদ মাওলানা ইবরাহীম সাহেব, মাওলানা ইয়াকুব সাহেব কেন আপনাকে পরিত্যাগ করেছেন? মাওলানা ইবরাহীম ও মাওলানা ইয়াকুব সাহেব আপনার উস্তাদ, আপনার বাবার উস্তাদ। এই বুযুর্গ আলেমগণ কেন নিজামুদ্দীন ছেড়ে চলে গেলেন জবাব দিন? কিন্তু মাওলানা সা’দ এই প্রশ্নের কোন উত্তর দিতে পারেননি। এ সময় সা’দ সাহেবের শ্বশুর মাওলানা সালমান সাহেবও সেখানে বসা ছিলেন। তিনি বললেন, এই প্রশ্ন বাস্তবিকই। এই প্রশ্নের সন্তোষজনক কোন জবাব নেই।

তাহলে প্রমাণিত হলো, এই লোক পথভ্রষ্ট। তার পথভ্রষ্টতায় বাংলাদেশের কয়েকজনও আক্রান্ত হয়ে এটাকে বাংলাদেশে ছড়িয়ে দিতে চাচ্ছেন। সুতরাং এই বিষয়ে আলেম সমাজের নমনীয় হওয়ার বা ছাড় দেওয়ার কোনই সুযোগ নেই।

এ পর্যায়ে বলতে চাই, আমাদের চূড়ান্ত দাবি দু’টিই। এক. নিজেকে সংশোধন করে হকের উপর ফিরে আসার বিষয়ে বিশ্বাসযোগ্য প্রমাণ ছাড়া মাওলানা সাদকে বাংলাদেশে কোনভাবেই ঢুকতে দেওয়া যাবে না। টংগির বিশ্ব ইজতিমা ময়দানকে এই ভ্রান্তমতাদর্শীদেরকে ব্যবহার করতে দেওয়া যাবে না। দুই. কাকরাইল মার্কাজ থেকেও পথভ্রষ্ট মাওলানা সাদের অনুসারী যে কয়জন আছেন, তাদেরকে স্থায়ীভাবে উচ্ছেদ করতে হবে। কাকরাইল মসজিদ থেকে তাবলীগ জামাতের কার্যক্রম একমাত্র উলামায়ে কেরামের নেতৃত্বাধীন তাবলীগ জামাআতের শূরায়ে নেজামের আওতায় পরিচালিত হবে। বিভ্রান্ত মাওলানা সাদের এতাতি ফিতনা থেকে তাবলীগের বৃহত্তম জামাতকে গোমরাহী থেকে রক্ষা করতে হলে এর উপর সকলকে অটল, অবিচল ও দৃঢ় থাকতে হবে।

আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে সকলকে সহীহ বুঝ দান করুন এবং সকলপ্রকার গোমরাহী ও পথভ্রষ্টতা থেকে হেফাজত করুন। আমীন।

– মুফতি খলীল আহমদ কাসেমী; মহাপরিচালক- আল জামিয়াতুল আহলিয়া দারুল উলূম মুঈনুল ইসলাম হাটহাজারী, চট্টগ্রাম।

অনুলিখনে- মাওলানা মুনির আহমদ
নির্বাহী সম্পাদক- মাসিক মুঈনুল ইসলাম, হাটহাজারী, চট্টগ্রাম।

উম্মাহ২৪ডটকম: এমএ

উম্মাহ পড়তে ক্লিক করুন-
https://www.ummah24.com

দেশি-বিদেশি খবরসহ ইসলামী ভাবধারার গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে ‘উম্মাহ’র ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।