Home মহিলাঙ্গন আধুনিকতার ঘূর্ণিপাকে সন্তানের আদর্শ লালন-পালন: চ্যালেঞ্জ ও দায়বদ্ধতা

আধুনিকতার ঘূর্ণিপাকে সন্তানের আদর্শ লালন-পালন: চ্যালেঞ্জ ও দায়বদ্ধতা

সন্তান আল্লাহর পক্ষ থেকে এক মহান আমানত এবং কঠিন পরীক্ষা। প্রযুক্তির অবাধ স্রোত আর ধর্মবিমুখ পরিবেশের ঘূর্ণিপাকে এই আমানত রক্ষা করা আজ সময়ের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। কীভাবে এই কঠিন দায়িত্ব পালন করবেন? পথ ও পাথেয় নিয়ে একটি দিকনির্দেশনামূলক লেখা; যা প্রতিটি অভিভাবকের চোখ খুলে দেবে, ইনশাআল্লাহ।

- এআই দিয়ে তৈরি।

।। ডা. তানজিনা রহমান ।।

আল্লাহ রাব্বুল আলামীন মানবজাতিকে সৃষ্টির সেরা হিসেবে দুনিয়াতে প্রেরণ করেছেন এবং প্রত্যেকের উপর কিছু দায়িত্ব অর্পণ করেছেন। তন্মধ্যে অন্যতম শ্রেষ্ঠ আমানত হলো সন্তান। রাসূলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেছেন- كُلُّكُمْ رَاعٍ وَكُلُّكُمْ مَسْؤولٌ عَنْ رَعِيَّتِهِ অর্থ- “তোমাদের প্রত্যেকেই একজন দায়িত্বশীল (অভিভাবক) এবং প্রত্যেককেই অধীনদের (দায়িত্ব) সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হবে।” (সহীহ বুখারী, হাদিস- ৭১৩৮; সহীহ মুসলিম, হাদিস- ১৮২৯)।

এই হাদিসের আলোকে, সন্তান প্রতিপালন নিছক একটি জৈবিক প্রক্রিয়া নয়, বরং এটি এক মহান ইবাদত ও কঠিন দায়বদ্ধতা। বর্তমান জাহিলিয়াতের যুগে, বিশেষত প্রযুক্তির সর্বগ্রাসী বিস্তারকালে এই দায়িত্ব পালন করা এক কঠিন থেকে কঠিনতর পরীক্ষায় পরিণত হয়েছে।

সম্প্রতি এক বোনের সাথে আলাপের প্রসঙ্গক্রমে জানতে পারলাম, তার মামার পরিবারে (যা তার শ্বশুরবাড়িও) কোনো মেয়েকে স্কুলে পাঠানো হয় না। আমি এর কারণ জানতে চাইলে তিনি বললেন, তারা সন্তানকে ‘দুনিয়া চিনতে দিতে চান না’। তাদের পড়াশোনার মাধ্যম হিসেবে তারা অনলাইনকেই বেছে নিয়েছেন।

বিষয়টি আমাকে গভীরভাবে ভাবিয়ে তুললো। যে সন্তানের হাতে গোটা দুনিয়া তথা ইন্টারনেট তুলে দেওয়া হলো, তাকে দুনিয়া চিনতে না দেওয়ার এই ধারণাটি কতটা আত্মঘাতী! নেট দুনিয়ার অনিয়ন্ত্রিত ও কলুষিত জগৎ আর স্কুলের নিয়ন্ত্রিত পরিবেশের মধ্যে কোনটি সন্তানের জন্য তুলনামূলক অধিকতর কল্যাণকর, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। আমার এই ভাবনার প্রত্যুত্তরে তিনি একটি ঘটনা শেয়ার করলেন।

একদিন তার সেই পরিবারের এক শিশু মোবাইলে কিছু একটা দেখছিল। তিনি কক্ষে প্রবেশ করতেই শিশুটি দ্রুত স্ক্রিন থেকে বিষয়টি সরিয়ে ফেলার চেষ্টা করলো, যা তার দৃষ্টি এড়ায়নি। বিষয়টি শিশুর বাবা-মাকে জানানোর মতো পরিস্থিতি ছিল না বলে তিনি জানাননি।

এই ছোট্ট ঘটনাই কিন্তু বিশাল এক বাস্তবতার দিকে ইঙ্গিত করে। সন্তানের সামান্য একটি সোয়াইপ বা স্ক্রিন পরিবর্তনের চেষ্টার মধ্যেই লুকিয়ে থাকে অনেক কিছু। এই সংকেতটি বুঝার জন্য সন্তানের প্রতি সার্বক্ষণিক সজাগ দৃষ্টি রাখা আবশ্যক। আর এই মনোযোগ সবদিকে সমানভাবে ধরে রাখা অত্যন্ত কঠিন, ক্ষেত্রবিশেষে প্রায় অসম্ভব একটি কাজ।

একজন মা রান্নাবান্না, সামাজিকতা, সাজ-সজ্জা কিংবা ঘুরে বেড়ানোতে ব্যস্ত থাকুন, অথবা কর্মজীবী হয়ে আট ঘণ্টা অফিস কিংবা বাইরের দাওয়াতী কাজে নিজেকে নিয়োজিত রাখুন- উভয় ক্ষেত্রেই সন্তানের প্রতিটি মুহূর্তের খবর রাখা দুঃসাধ্য।

অনেকে হয়তো এর সাথে দ্বিমত পোষণ করে নিজের সফলতার দাবি করবেন, কিন্তু তা হবে একপ্রকার কুতর্ক। কারণ, যারা শতভাগ পেরেছেন বলে দাবি করেন, বাস্তবে সূক্ষ্মভাবে দেখলে তাদের ব্যর্থতার দিকগুলোও উন্মোচিত হয়।

সুতরাং, ‘সন্তানকে স্কুলে পাঠালাম না, আর আমার সব দায়িত্ব শেষ’- এই ভেবে কোনো মা যদি রান্নাঘরে ব্যস্ত থাকেন আর মনে করেন, ‘আমার বাচ্চা তো খুবই সরল, সে কিচ্ছু বুঝে না, কোনো দিকে তাকায় না’, তবে নিঃসন্দেহে তিনি বোকার স্বর্গে বাস করছেন। এই যুগে এই ধরনের আত্মপ্রবঞ্চনা সন্তানের ভবিষ্যৎ ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে যায়।

অন্যদিকে, যে মা সন্তানকে বিদ্যালয় বা স্কুল-কলেজে পাঠিয়ে নিজে অফিস বা দাওয়াতী কাজে বেরিয়ে যান, সন্তান কার সাথে মিশছে, মোবাইলে কী দেখছে, স্বামী কী খাচ্ছে- এসবের কোনো খবর রাখেন না এবং ঘরের ব্যবস্থাপনা গৃহপরিচারিকার উপর নির্ভরশীল করে রাখেন, তিনিও এক ভ্রান্তির গভীর খাদে বসবাস করছেন।

সন্তান লালন-পালন সহজ কোনো কাজ নয়। অবহেলায় ফেলে রাখলে কেবল তার হাত-পাই বড় হয়, তার ভেতরের মানুষটি বিকশিত হয় না। তার উপর, বর্তমান সেক্যুলার বা ধর্মনিরপেক্ষ পরিবেশে ঈমান ও ইসলামী আদর্শের উপর সন্তান গড়ে তোলা আরও কঠিন এক পরীক্ষা। আল্লাহ তাআলা পবিত্র কুরআনে ইরশাদ করেছেন- يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا قُوا أَنفُسَكُمْ وَأَهْلِيكُمْ نَارًا وَقُودُهَا النَّاسُ وَالْحِجَارَةُ অর্থ- “হে মুমিনগণ, তোমরা নিজেদেরকে এবং তোমাদের পরিবার-পরিজনকে সেই আগুন থেকে রক্ষা কর, যার ইন্ধন হবে মানুষ ও পাথর”। (সূরা আত-তাহরীম, আয়াত- ৬)।

এই আয়াত আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় যে, সন্তানের তরবিয়ত বা অনুশীলন কত বড় দায়িত্ব। জীবনের প্রথম ছয় মাস শিশুকে শুধু মায়ের দুধ পান করানো, এরপর ধীরে ধীরে অন্য খাবারে অভ্যস্ত করা, শৈশব থেকেই পারিপার্শ্বিক জগৎ সম্পর্কে ইসলামের আলোকে ধারণা দেওয়া, প্রচলিত সংস্কৃতির সাথে আমাদের আকিদা-বিশ্বাসের সংঘাতগুলো সুস্পষ্টভাবে বুঝিয়ে দেওয়া, স্কুলের অর্জিত জ্ঞানকে বাস্তব জীবনে কীভাবে প্রয়োগ করতে হয় তা শেখানো- এই সবগুলোই তরবিয়তের গুরুত্বপূর্ণ অংশ।

বয়ঃসন্ধিকালে পৌঁছানো সন্তানের প্রতি নজরদারির পদ্ধতি আরও ভিন্ন ও সংবেদনশীল। তাকে পর্যবেক্ষণে রাখতে হবে। কিন্তু তার মনে যেন এমন ধারণা না জন্মায় যে, তাকে সন্দেহ করা হচ্ছে। এই পর্যবেক্ষণ যে তাকে শয়তানের ওয়াসওয়াসা ও ফিতনার পরিবেশ থেকে হেফাজতের জন্য, তা বুঝাতে শত শত ব্যাখ্যা প্রস্তুত রাখতে হয়। বিভিন্ন বিষয় ঘুরিয়ে-পেঁচিয়ে, ভালোবাসা দিয়ে বুঝাতে হয়। কোনো কিছু ব্যাখ্যা করতে না পারলে, কেন পারছেন না, সেটাও তাকে বুঝিয়ে বলার মতো ধৈর্য ও প্রজ্ঞা অর্জন করতে হয়।

আরও পড়তে পারেন-

এই কাজগুলো মোটেও সহজ নয়। বছরের পর বছর ধরে অবিরাম ব্যাখ্যা দিতে দিতে জীবনের সব রং যেন ফ্যাকাশে হয়ে যায়! মাঝে মাঝে মনে হয়, মস্তিষ্কের স্নায়ুগুলো বুঝি নারকেলের ছোবড়া হয়ে গেছে! এতকিছুর পরেও দেখা যায়, কোথাও না কোথাও ভুল বা অপূর্ণতা রয়েই গেছে। আল্লাহ তাআলা মায়ের এই কষ্টকে মূল্যায়ন করেছেন। তিনি বলেন- حَمَلَتْهُ أُمُّهُ وَهْنًا عَلَىٰ وَهْنٍ অর্থ- “তার মা তাকে কষ্টের পর কষ্ট করে গর্ভে ধারণ করেছে।” (সূরা লুকমান, আয়াত- ১৪)।

সন্তানকে তাওহীদ, হালাল-হারাম, ভালো-মন্দ এবং শিরক-বিদআতের সুস্পষ্ট পরিচয় দিয়ে দুনিয়াবী জ্ঞানের সাথে সমন্বয় করে চলার শিক্ষা দেওয়া পিতা-মাতার মৌলিক দায়িত্ব। এই দায়িত্ব কোনো শিক্ষক বা গৃহপরিচারিকার নয়। হাজার হাজার টাকা খরচ করেও শিক্ষকের কাছ থেকে সেই আদর্শিক শিক্ষা পাওয়া যায় না, যা একজন সচেতন ও যোগ্য মা তার সন্তানকে দিতে পারেন। এর জন্য পিতা-মাতারও যথেষ্ট জ্ঞান, ধৈর্য এবং হিকমতের প্রয়োজন।

মা যদি পেশাজীবী হন বা কোনো দাওয়াতি কাজেও যুক্ত থাকেন, তাকে মনে রাখতে হবে যে, সন্তানের তরবিয়তের প্রয়োজনে কখনো সেই কাজের গতি কমাতে হতে পারে, এমনকি সাময়িকভাবে থামিয়ে দেওয়ার মানসিকতাও রাখতে হবে। এটিই হলো দায়িত্বশীলতা। ক্যারিয়ার গোছানো আর দায়িত্ব পালন এক জিনিস নয়।

মায়েদের বিশেষভাবে বলছি, সন্তান লালন-পালনের যে আমানত আপনাদের দেওয়া হয়েছে, সে সম্পর্কে আপনারা জিজ্ঞাসিত হবেন। আপনার শিক্ষক বা গৃহপরিচারিকা তাদের নিজ নিজ সন্তানের ব্যাপারে জিজ্ঞাসিত হবে, আপনার সন্তানের ব্যাপারে নয়। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন- ثُمَّ لَتُسْأَلُنَّ يَوْمَئِذٍ عَنِ النَّعِيمِ অর্থ- “অতঃপর অবশ্যই সেদিন তোমরা নেয়ামত সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবে।” (সূরা আত-তাকাসুর, আয়াত- ৮)।

সন্তান আমাদের জন্য শ্রেষ্ঠ নিয়ামত এবং এই নিয়ামতের সদ্ব্যবহার সম্পর্কে আমাদের জবাবদিহি করতে হবে।

সন্তানের মেসেঞ্জার, হোয়াটসঅ্যাপসহ সামাজিক মাধ্যমে তার বিচরণের সমস্ত ক্ষেত্রে মায়ের প্রবেশাধিকার থাকা অত্যন্ত জরুরি। সন্তানের সাথে যদি মায়ের সম্পর্ক গভীর ও বন্ধুত্বপূর্ণ হয়, তবে এতে সন্তানের আপত্তি থাকে না। তবে মায়ের নিজের আদর্শিক অবস্থান যদি ঠিক না থাকে এবং তিনি নিজেই যদি বিপথগামী হন, তবে এই পরামর্শে কোনো ফায়দা হবে না। এখানে ‘বাচ্চা’ বলতে আমি ঊনিশ-কুড়ি বছর পর্যন্ত টিনএজ ছেলেমেয়েদের বুঝাচ্ছি।

প্রথমে নিজের আখিরাতকে গোছাতে হবে, নিজের ঘরে দ্বীন কায়েম করতে হবে, এরপর যথেষ্ট সময় থাকলে পাঁচ কিলোমিটার দূরের বাড়িতে দ্বীন কায়েমের ফিকির করা উচিত।

চৌদ্দ-পনেরো বছরের সন্তানকে সকালে ঘাড়ে ধরে কুরআন তিলাওয়াত করালেন বা মাদরাসায় পাঠিয়ে দিলেন, আর এরপর সে সারাদিন কানে হেডফোন লাগিয়ে গান শুনলো, ইউটিউবে অশ্লীল ভিডিও দেখলো অথবা ঘরে বসেই বিপরীত লিঙ্গের বন্ধুদের সাথে মেসেঞ্জারে চ্যাটিংয়ে মগ্ন থাকলো- এর অর্থ হলো, আপনার ঘরে দ্বীন কায়েম হয়নি! আপনাকে আবার গোড়া থেকে শুরু করতে হবে।

মানুষকে ধার্মিকতা প্রদর্শনের জন্য আল্লাহ তাআলা আমাদের কাউকে দুনিয়াতে পাঠাননি। অনেকের কাছে অপ্রিয় মনে হলেও এটাই তিতা সত্য যে, বর্তমান সময়ে ধার্মিকতার প্রদর্শনী বা ‘রিয়া’-এর আড়ালে প্রকৃত আল্লাহভীতি বা ‘তাকওয়া’ চাপা পড়ে গেছে। আমরা অনেকেই জেনে বা না জেনে সেই প্রদর্শনীকেই নিজের জীবনে টেনে আনছি এবং তাকে জোর করে তাকওয়া বলে প্রমাণ করতে চাইছি। খুব সহজেই রাতারাতি ‘সো-কল্ড’ দ্বীনদার বনে যাওয়ার এই প্রবণতা আমাদের ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। এই দায়ভার আমাদের নিজেদের কাঁধেই বর্তায়।

আল্লাহ তাআলা আমাদের সবাইকে সন্তানের এই মহান আমানত যথাযথভাবে আদায় করার তাওফীক দান করুন। আমীন।

লেখক: কনসালটেন্ট, সনোলজিস্ট।

উম্মাহ২৪ডটকম: এমএ

উম্মাহ পড়তে ক্লিক করুন-
https://www.ummah24.com

দেশি-বিদেশি খবরসহ ইসলামী ভাবধারার গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে ‘উম্মাহ’র ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।