Home প্রবন্ধ-নিবন্ধ বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কে সমতা ও মর্যাদার প্রশ্নে ছাড় নয়

বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কে সমতা ও মর্যাদার প্রশ্নে ছাড় নয়

।। সৈয়দ জহির উদ্দিন ।।

বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে সাম্প্রতিক গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ক্ষমতাচ্যুতি এবং তার ভারতে আশ্রয়গ্রহণকে এ দেশের জনগণ কেবল একটি রাজনৈতিক পালাবদল নয়, বরং ভারতের দীর্ঘদিনের প্রভাব-প্রতিষ্ঠা নীতির পরাজয় হিসেবেই দেখছে। কিন্তু ভারত সরকার এ বাস্তবতা সহজে মেনে নিতে পারছে না—এটি অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকে ভারতের পররাষ্ট্র ও সীমান্ত নীতিতে প্রকাশ্যভাবে পরিলক্ষিত হচ্ছে।

ভারতীয় কর্তৃপক্ষ একদিকে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি শীতল ও শত্রুভাবাপন্ন অবস্থান গ্রহণ করছে; অন্যদিকে সীমান্তে হত্যাকাণ্ড বৃদ্ধি, পণ্য পরিবহনে অনির্ধারিত প্রতিবন্ধকতা তৈরি এবং ভারতীয় নাগরিকদের বাংলাদেশে জোরপূর্বক পুশ-ইন করার মতো স্পষ্ট উসকানিমূলক পদক্ষেপ নিচ্ছে। এ অবস্থায় দিল্লির আশ্রয়ে থাকা শেখ হাসিনার পক্ষ থেকে দেওয়া বিভাজনমূলক বক্তব্যকে ভারত সরকার প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে প্রশ্রয় দিয়ে চলেছে, যা পারস্পরিক সম্পর্কে আরও অবিশ্বাস ও উত্তেজনা সৃষ্টি করছে। অন্তর্বর্তী সরকার বারবার ভারতকে এই বিষয়ে সংযত আচরণে উদ্বুদ্ধ করার আহ্বান জানালেও তা উপেক্ষিত থেকেছে।

তবে গত ২৬ জুন ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র জয়সোয়ালের এক বক্তব্য নতুন করে আলোচনার সূত্রপাত করেছে। তিনি বলেন, “সহায়ক পরিবেশে” ভারত বাংলাদেশের সঙ্গে সব বিষয়ে আলোচনা করতে প্রস্তুত। এটি একদিকে ইতিবাচক ইঙ্গিত, অন্যদিকে এর পেছনে ভারতের কূটনৈতিক কৌশল—বিশেষ করে পানি সম্পদ ভাগাভাগি নিয়ে ভবিষ্যৎ আলোচনার উদ্দেশ্য নিহিত রয়েছে বলে অনেকে মনে করছেন। বিশেষজ্ঞদের মতে, ১৯৯৬ সালের গঙ্গা পানিবণ্টন চুক্তির মেয়াদ ২০২৬ সালে শেষ হতে চলেছে। ভারত ইতিমধ্যেই পশ্চিমবঙ্গের সেচ, বিদ্যুৎ ও বন্দর রক্ষণাবেক্ষণের বাড়তি চাহিদা পূরণে নতুন কাঠামোর চুক্তি চায়, যার আওতায় আরও ৩০–৩৫ হাজার কিউসেক পানি দাবি করা হচ্ছে।

অতীত অভিজ্ঞতা বলে, ভারতের ‘সুসম্পর্ক’ শব্দচয়ন প্রায়শই নিজস্ব স্বার্থসিদ্ধির পূর্বাভাস হিসেবে দেখা দেয়। গঙ্গা চুক্তির বাস্তবায়নে ভারত বরাবরই ন্যায্যতা বজায় রাখেনি। বাংলাদেশ বিকল্প গঙ্গা ব্যারেজ নির্মাণে উদ্যোগী হলেও ভারতের চাপের কারণে তা বাস্তবায়িত হয়নি। তিস্তা চুক্তি বহু প্রতিশ্রুতির পরও আজও আলোর মুখ দেখেনি। উল্টো ফেনী নদী থেকে ভারতকে পানি উত্তোলনের অনুমতি দিয়ে বাংলাদেশ একতরফাভাবে উদারতা দেখালেও, তার পাল্টা প্রতিদান কখনো মেলেনি। নদীগুলোর নাব্য হারানো, উত্তরাঞ্চলে মরুকরণ, সীমান্তে নির্বিচারে হত্যাকাণ্ড এবং অনুপ্রবেশের মাধ্যমে পুশইন—এসবই ভারতের বৈরি মনোভাবের বহিঃপ্রকাশ।

আরও পড়তে পারেন-

তবে এ অবস্থায় বাংলাদেশের অবস্থান স্পষ্ট ও অনড়। বাংলাদেশ চায়—ভারতের সঙ্গে একটি সম্মাননির্ভর, সমমর্যাদার সম্পর্ক। প্রতিবেশী রাষ্ট্র হিসেবে ভারতের উচিত হবে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বকে পূর্ণাঙ্গ শ্রদ্ধা করা। যে আচরণ ইউরোপের দেশগুলোর মধ্যে স্বাভাবিক—যেখানে সীমান্ত ভাগাভাগি করেও পারস্পরিক সম্মান, আইন ও সমতার ভিত্তিতে দীর্ঘমেয়াদি সম্পর্ক টিকে থাকে—ভারতের কাছ থেকেও তেমন আচরণই প্রত্যাশিত।

ভারতের কাছে একটি ভুল ধারণা প্রতিষ্ঠিত হয়ে থাকতে পারে যে, অতীতে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ সরকারের একতরফাভাবে ভারতের স্বার্থ পূরণ সম্ভব হয়েছে, ভবিষ্যতেও তাই হবে। কিন্তু এই ধারণা বিভ্রান্তিকর ও বিপজ্জনক। অন্তর্বর্তী সরকার বা ভবিষ্যতের কোনো নির্বাচিত সরকারই ভারতের চাপের কাছে আত্মসমর্পণ করবে না। বরং অতীতের গোপন চুক্তি ও একচেটিয়া সুবিধাভোগের প্রশ্নগুলো এখন জনপরিসরে উত্থাপিত হচ্ছে, এবং এসব চুক্তির স্বচ্ছতা নিশ্চিত করার দাবি দিনদিন জোরালো হচ্ছে।

পরিশেষে, প্রত্যেক রাষ্ট্রেরই সম্মান ও মর্যাদার একটি অনড় ভিত্তি থাকে। ভারত যদি সত্যিই বাংলাদেশের সঙ্গে টেকসই, শান্তিপূর্ণ ও সমানাধিকারের সম্পর্ক গড়তে চায়, তবে তাকে ‘আইন মানি, তবে তালগাছটা আমার’—এই প্রবণতা পরিহার করতে হবে। বাস্তব সম্মান, আন্তরিকতা ও ন্যায়ভিত্তিক পারস্পরিকতা ছাড়া দীর্ঘমেয়াদে কোনো সুসম্পর্ক গড়ে ওঠে না। বাংলাদেশ চায় বন্ধুত্ব, আধিপত্য নয়—শ্রদ্ধাপূর্ণ সহাবস্থান, প্রভুত্বমূলক সম্পর্ক নয়।

লেখক: ব্যবস্থাপনা পরিচালক- আল-বাশার ইন্টারন্যাশনাল, নয়া পল্টন, ঢাকা।

উম্মাহ২৪ডটকম: এমএ

উম্মাহ পড়তে ক্লিক করুন-
https://www.ummah24.com

দেশি-বিদেশি খবরসহ ইসলামী ভাবধারার গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে ‘উম্মাহ’র ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।