মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ও রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ছয় বছরের মধ্যে প্রথমবারের মতো দেখা করতে যাচ্ছেন। আজ শুক্রবার তাদের বহুল প্রতীক্ষিত বৈঠকের আগে যুক্তরাষ্ট্রের আলাস্কা অঙ্গরাজ্যে সমবেত হচ্ছেন দুই দেশের কর্মকর্তারা। এবারের বৈঠকে ট্রাম্পের লক্ষ্য ইউক্রেন যুদ্ধের অবসান ঘটিয়ে নিজের গুরুত্বপূর্ণ নির্বাচনি প্রতিশ্রুতি পূরণ করা।
নিজেকে ‘বৈশ্বিক শান্তিদূত’ হিসেবে তুলে ধরা ট্রাম্প আশা করছেন, পুতিনের সাথে তার ব্যক্তিগত সম্পর্ককে কাজে লাগিয়ে যুদ্ধবিরতির ক্ষেত্রে এমন এক অগ্রগতি আনতে পারবেন, যেখানে অন্যরা ব্যর্থ হয়েছেন। তবে বৈঠক ‘সফল না হওয়ার সুযোগ ২৫ শতাংশ’ বলে বৃহস্পতিবারই তিনি ধারণা দিয়েছেন।
এই আলোচনায় ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কিকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। তিনি সতর্ক করেছেন, তার অনুপস্থিতিতে গৃহীত যেকোনো সমাধান অর্থহীন হবে।
আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের উপস্থিতি ছাড়া শীর্ষ পর্যায়ের এই বৈঠক নিয়ে আলাস্কার অ্যাঙ্কোরেজ শহরে খুব একটা চঞ্চলতা দেখা যাচ্ছে না। বরং সাংবাদিকরা সেখানে অন্য রাজ্য থেকে ছুটি কাটাতে আসা পর্যটকদের সাথে আলাপ জমানোর চেষ্টা করছেন।
শুক্রবারের বৈঠকটি একটি মার্কিন সামরিক ঘাঁটির কাছের এক ভেন্যুতে অনুষ্ঠিত হবে। নিরাপত্তা আর সময় স্বল্পতার বিবেচনায় এই সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। বৈঠকটি কয়েক ঘণ্টার বেশি স্থায়ী হওয়ার কথা নয়।
যুদ্ধবিরতি অথবা নতুন নিষেধাজ্ঞা– যেকোনো একটি বেছে নেয়ার জন্য রাশিয়াকে দেয়া যুক্তরাষ্ট্রের সময়সীমা বেঁধে দেয়ার ঠিক এক সপ্তাহ পর এই শীর্ষ সম্মেলনটি অনুষ্ঠিত হচ্ছে।
২০২২ সালে ইউক্রেনে রাশিয়ার পূর্ণমাত্রার আগ্রাসন শুরুর পর থেকে মস্কো ও কিয়েভ রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে লিপ্ত। এমন অবস্থায় সময়সীমার আগে চুক্তি হওয়া প্রায় অসম্ভব ছিল।
রাশিয়ার সাথে ব্যবসা করা দেশগুলোর ওপর নিষেধাজ্ঞার হুমকিতে ট্রাম্প অটল থাকবেন কি-না, তা নিয়ে সংশয় ছিল। এমন নিষেধাজ্ঞা চীনের সাথে ভয়াবহ বাণিজ্যযুদ্ধ ডেকে আনতে পারত। তবে ট্রাম্প জানিয়েছেন, রুশ তেল কেনার কারণে চলতি মাসের শেষ দিকে আবারো ভারতের ওপর শুল্ক আরোপ করবেন তিনি।
গত সপ্তাহে ট্রাম্প-পুতিন বৈঠকের ঘোষণা কার্যত নিষেধাজ্ঞার সময়সীমা স্থগিত করেছে এবং পরবর্তী পদক্ষেপ ভেবে দেখার জন্য দুই পক্ষই বাড়তি সময় পেয়েছে। এই বৈঠক নিয়ে সপ্তাহজুড়েই মার্কিন দৃষ্টিভঙ্গি নানা মাত্রায় ওঠানামা করেছে- কখনো আশাবাদী, কখনো সতর্ক, আবার কখনো কঠোর ভঙ্গিতে।
সবচেয়ে কঠোর অবস্থানে গিয়ে ট্রাম্প হুঁশিয়ারি দিয়েছেন, রাশিয়া যদি যুদ্ধ শেষ করতে রাজি না হন, তবে ‘অনেক গুরুতর পরিণতির’ মুখোমুখি হবে। জেলেনস্কিসহ বুধবার ইউরোপীয় নেতাদের সাথে ভার্চুয়াল আলাপের পর ট্রাম্পের অবস্থান আরো কঠোর মনে হয়েছে।
অন্যদিকে, ট্রাম্প যখন রাশিয়া ও ইউক্রেনের মধ্যে ‘অঞ্চল বিনিময়ের’ কথা তোলেন এবং হোয়াইট হাউস ইঙ্গিত দেয় যে প্রেসিডেন্ট বৈঠকটিকে কথা ‘শোনার অনুশীলন’ হিসেবে দেখবেন, তখন কিয়েভের দিক থেকে উদ্বেগ দেখা দেয়।
এদিকে রাশিয়া প্রায় পুরোটা সময় নীরব থেকেছে। স্থবির যুদ্ধরেখা, অঞ্চল বিনিময় বা মস্কো-ওয়াশিংটনের মধ্যে খনিজসম্পদ সংক্রান্ত সম্ভাব্য চুক্তি নিয়ে কোনো জল্পনা-কল্পনায় জড়ায়নি দেশটি। এই নীরবতার ধারাবাহিকতা আছে। সপ্তাহজুড়ে ক্রেমলিন কর্মকর্তাদের কথায় কেবল পুতিনের আপসহীন অবস্থানের বিষয়টিই উঠে এসছে।
তারা স্পষ্ট করে বলেছে, যুদ্ধের অবসান তখনই ঘটবে যখন রাশিয়া দোনেৎস্ক ও লুহানস্ক, যা দনবাস অঞ্চলের অংশ, এবং খেরসন ও জাপোরিঝঝিয়া অঞ্চলের পূর্ণ সার্বভৌমত্ব অর্জন করবে। একইসাথে কিয়েভকে অসামরিকীকরণ করার ও পশ্চিমা সামরিক জোট ন্যাটোতে যোগ না দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিতে হবে।
তবে ট্রাম্প বিশ্বাস করেন, পুতিনের সাথে তার যে সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে উঠেছে তা হয়তো এই সংঘাতের অবসান টানতে এবং তার বৈশ্বিক শান্তিদূতের ভাবমূর্তি জোরদার করতে সহায়তা করতে পারে।
আরও পড়তে পারেন-
- আদর্শ সমাজ বিনির্মাণে ইসলামের ভূমিকা
- সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি যেন হুমকির মুখে না পড়ে
- সমৃদ্ধ জাতি নির্মাণে দরকার বুদ্ধিবৃত্তিক জাগরণ ও আলেমদের এগিয়ে আসা
- সালাম-কালামের আদব-কায়দা
- বিবি খাদিজা (রাযি.): ইসলাম ধর্মের ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ নারী
মার্কিন প্রেসিডেন্ট হিসেবে দ্বিতীয় মেয়াদে ফিরে আসার পর থেকে বৈশ্বিক অঙ্গনে ট্রাম্প কী অর্জন করেছেন সেটিই এখন মূল প্রশ্ন হয়ে উঠেছে। দেশে তার একটি সমর্থকগোষ্ঠী রয়েছে যারা তাকে দ্রুত যুদ্ধ শেষ করা এবং ব্যয়বহুল বিদেশী সংঘাত থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে সরিয়ে আনার প্রতিশ্রুতির কারণে সমর্থন করেছে।
তার শীর্ষ কর্মকর্তারা পুতিনের সাথে সরাসরি বৈঠকের অপরিহার্যতার বিষয়ে জোর দিয়েছেন, আর ট্রাম্প নিজেও তার ব্যবসায়ীসুলভ প্রবৃত্তি নিয়ে বলেছেন, ‘প্রথম দুই মিনিটেই আমি ঠিক বুঝে যাব, চুক্তি হবে কি হবে না।’
দুই পক্ষের মাঝে আটকা পড়ে এবং শুক্রবারের আলোচনায় বাইরে থেকে ইউরোপ এখন এক অস্বস্তিকর অবস্থায় আছে। বুধবার ট্রাম্পের সাথে শেষ মুহূর্তের ফোনালাপে ইউরোপীয় নেতারা আংশিক আশাবাদী হয়েছেন যে আলাস্কায় গিয়ে মার্কিন প্রেসিডেন্ট তাদের পক্ষে লড়বেন।
ইউক্রেনের মতো তারাও কয়েক মাসের অস্থির সময় কাটিয়েছে। এর মধ্যে ছিল হোয়াইট হাউসে জেলেনস্কির সাথে ট্রাম্পের স্মরণীয় বিবাদের পর সাময়িকভাবে কিয়েভের জন্য সামরিক সহায়তা স্থগিতের ঘটনাও। ট্রাম্পের এমন আচরণ পূর্বসূরি জো বাইডেনের অবস্থানের থেকে পুরোপুরি আলাদা ছিল।
শুক্রবারের আগে ইউক্রেনকেও সরিয়ে রাখা হয়েছে। ইউক্রেনের প্রেসিডেন্টের প্রতিবাদ সত্ত্বেও কিয়েভকে অন্তর্ভুক্ত না করে ট্রাম্প ও পুতিনের করা যেকোনো চুক্তি সফল না হওয়ার সম্ভাবনা থাকায় সপ্তাহ গড়ানোর সাথে সাথেই স্পষ্ট হয়ে উঠছে যে মার্কিন-রুশ বৈঠক কেবল দ্বিপক্ষীয়ই থাকবে।
ট্রাম্পকে পাশে রাখার জন্য জেলেনস্কি সতর্ক অবস্থান নিলেও রাশিয়া ও ইউক্রেনের মধ্যে ‘কিছু ভূমি বিনিময়’ প্রসঙ্গ সামনে এলে প্রতিক্রিয়া জানাতে বাধ্য হন তিনি। ‘আমরা দনবাস থেকে সরে আসব না। আমরা তা করতে পারি না,’ সম্ভাব্য আঞ্চলিক ছাড় দেয়ার গুঞ্জন চূড়ান্তে পৌঁছালে মঙ্গলবার কিছুটা বিরক্ত সুরেই এ কথা বলেন ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট।
এই অঞ্চল ছেড়ে দিলে ইউক্রেনের মাটিতে সংঘাতের পথ আরো সুগম হবে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘সবাই প্রথম অংশটা ভুলে যায়, আমাদের ভূখণ্ড অবৈধভাবে দখল করা হয়েছে। রাশিয়ার জন্য দনবাস ভবিষ্যতের নতুন হামলার সোপান।’
সূত্র : বিবিসি
উম্মাহ২৪ডটকম: এমএ