জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশের প্রার্থীদের নিয়ে ‘জমিয়ত প্রার্থীদের নির্বাচনী ভাবনা’ ধারাবাহিক প্রতিবেদনের আজকের আয়োজনে থাকছেন কিশোরগঞ্জ-১ আসনের খেজুরগাছ প্রতীকের প্রার্থী মাওলানা মুহাম্মদুল্লাহ জামী।
কিশোরগঞ্জ-১ দেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ আসন। মোট ৫,১৩,৯৭৯ জন ভোটারের এ আসনটি রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে বিশেষ আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু। শিক্ষা, কৃষিনির্ভর অর্থনীতি এবং সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যে সমৃদ্ধ এ জনপদে রাজনৈতিক সমীকরণে স্থানীয় জনআকাঙ্ক্ষা বড় ভূমিকা রাখে।
মাওলানা মুহাম্মদুল্লাহ জামী একজন সুপরিচিত আলেম, শিক্ষক ও খতিব। তাঁর জন্ম ১৯৭১ সালে কিশোরগঞ্জ সদর উপজেলার পূর্বতারাপাশা গ্রামে। পিতা মরহুম মাওলানা আব্দুর রহমান জামী (রহ.) এবং মাতা অনুফা আক্তারের স্নেহ ও দ্বীনি পরিবেশে বেড়ে ওঠেন তিনি। কিশোরগঞ্জের ঐতিহ্যবাহী আল জামিয়াতুল ইমদাদিয়া থেকে দাওরায়ে হাদিস সম্পন্ন করেন। দীর্ঘ ৩০ বছরের শিক্ষকতা, খতিব ও ধর্মীয় আলোচনার অভিজ্ঞতায় তিনি মানুষের সঙ্গে নিবিড় সম্পর্ক গড়ে তুলেছেন।
রাজনীতিতে আসার মূল প্রেরণা ছিল, জালিম ও অসৎ নেতৃত্ব থেকে মজলুম মানুষকে হেফাজত করা এবং ন্যায়ভিত্তিক ইসলামী রাজনীতি প্রতিষ্ঠা করা। ন্যায়, ইনসাফ ও ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়ার কারণে প্রায় তিনমাস তিনি জালিমের কারাগারেও বন্দি ছিলেন। জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশের বিভিন্ন স্তরে দায়িত্ব পালন শেষে বর্তমানে তিনি কেন্দ্রীয় জমিয়তের যুগ্ম মহাসচিব ও কিশোরগঞ্জ জেলা জমিয়তের সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।
আসন্ন নির্বাচন নিয়ে মাওলানা মুহাম্মদুল্লাহ জামীর ভাবনা কী? তারই উত্তর খুঁজেছেন উম্মাহ’র নিজস্ব প্রতিনিধি, মুহাম্মদ নূর হোসাইন।
উম্মাহ: কিশোরগঞ্জ-১ থেকে আপনার জয়লাভের সম্ভাবনা আপনি কীভাবে মূল্যায়ন করেন?
মাওলানা মুহাম্মদুল্লাহ জামী: নির্বাচিত হওয়ার ব্যাপারে আমি আশাবাদী। কারণ, এ আসনটি ওলামা-বন্ধব। এই জনপদের মানুষ আলেম-ওলামাদেরকে ভোট দিয়ে অভ্যস্ত। এ আসন থেকে পূর্বে নির্বাচিত হয়েছেন মরহুম মাওলানা আতহার আলী (রহ.), মাওলানা আতাউর রহমান খান (রহ.)। এছাড়াও এখানে রয়েছে আমাদের পূর্বসূরী বহু আলেম-ওলামার অক্লান্ত মেহনত, যেমন— মাওলানা আহমদ আলী খান (রহ.), মাওলানা আমিনুল হক মাহমুদী (রহ.), মাওলানা আব্দুল হালিম হোসাইনী (রহ.), মাওলানা আজহার আলী আনোয়ার (রহ.), মাওলানা আবুল খায়ের মোহাম্মদ নুরুল্লাহ (রহ.), মাওলানা আব্দুর রহমান জামী (রহ.) প্রমুখ।
উম্মাহ: ইসলামী রাজনীতিকে জনপ্রিয় করতে কী ধরনের কার্যক্রম চালাচ্ছেন?
মাওলানা মুহাম্মদুল্লাহ জামী: আমি দাওয়াত, তালিম, তাসাউফ, সিয়াসতসহ প্রায় সব ধরনের কল্যাণমূলক কাজে সক্রিয়ভাবে নিয়োজিত আছি এবং অন্যদেরও এসব জনকল্যাণমূলক কাজে অংশগ্রহণে উৎসাহিত করি। রাজনীতির ময়দানে ৩০ বছরের অভিজ্ঞতার ফলে সমাজের সব শ্রেণি-পেশার মানুষের সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত সম্পর্ক রয়েছে। ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে স্পষ্ট অবস্থান নেওয়ার কারণে বিগত জালিম সরকারের কারাগারে আমাকে তিন মাস বন্দি থাকতে হয়েছে, যার ফলে সাধারণ মানুষের মনে আমার প্রতি এক ধরনের সহানুভূতি জন্মেছে। দেশ, জাতি ও উম্মাহর কল্যাণে ধৈর্য ও সহনশীলতার সঙ্গে এ ময়দানে অবতীর্ণ হয়েছি বলেই আমি মহান আল্লাহ তাআলার সাহায্য আমার সঙ্গে থাকবে এ ব্যাপারে আমি আশাবাদী। তাছাড়া আমি সাধ্য অনুযায়ী গণসংযোগ করে যাচ্ছি। ইনসাফ ভিত্তিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার আওয়াজ দিচ্ছি এবং বৈষম্যহীন বাংলাদেশ নির্মাণের স্বপ্ন দেখছি এবং দেখাচ্ছি।
উম্মাহ: আপনার দল বা দলীয় প্রতীকের আদর্শিক অবস্থান সম্পর্কে সাধারণ জনগণকে জানাতে কী কার্যক্রম হাতে নিচ্ছেন?
মাওলানা মুহাম্মদুল্লাহ জামী: আমি যে সংগঠন থেকে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে চাই, তার নাম “জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশ”।
জমিয়তের একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলো— এটি কোনো একক ব্যক্তি বা পরিবারের নিয়ন্ত্রণাধীন নয়। হকপন্থী আলেম-ওলামার সিংহভাগই জমিয়তের রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত। ১৯৪৭, ১৯৭১, ২০২৪ সহ ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক সিদ্ধান্তগুলোতে জমিয়ত কখনো ভুল পথে হাঁটেনি। আমি জনগণকে জমিয়তের গৌরবময় ও স্বর্ণোজ্জ্বল ইতিহাস শোনাচ্ছি এবং এর সুযোগ্য নেতৃত্ব সম্পর্কে সচেতন করছি, যাতে মানুষ জমিয়তের রাজনীতির প্রতি আকৃষ্ট হয়। জমিয়তের স্লোগান- “জমিয়তের দাওয়াত, জমিয়তের পয়গাম, আল্লাহর জমিনে আল্লাহর নেজাম”-এর মধ্যেই সংগঠনের আদর্শিক অবস্থান স্পষ্টভাবে ফুটে উঠেছে। জমিয়ত আল্লাহর নেজাম প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে দুনিয়া ও আখেরাতের কল্যাণ কামনা করে। তাই ব্যাপক দাওয়াতি কার্যক্রমের মাধ্যমে আমরা জনগণের কাছে আমাদের আদর্শ তুলে ধরছি।
উম্মাহ: আপনি নির্বাচিত হলে সাধারণ মানুষের কোন সমস্যাগুলোকে অগ্রাধিকার দেবেন?
মাওলানা মুহাম্মদুল্লাহ জামী: আইন-শৃঙ্খলার উন্নয়ন, যাতে প্রত্যেক মানুষ নিজেকে নিরাপদ মনে করতে পারে। কর্মক্ষেত্রে, বাড়ি আসা-যাওয়ায়, এবং রাতে ঘুমানোর সময়ও যেন নিরাপত্তা অনুভূত হয়। সরকারি সেবাসমূহ জনগণের জন্য সহজলভ্য করা হবে, যাতে মানুষ বিনা দুর্ভোগে, বিনা কষ্টে, সহজে এসব সেবা গ্রহণ করতে পারে। অপরিকল্পিত অবকাঠামো নির্মাণের কারণে যানজট, জলাবদ্ধতা ও ময়লা আটকে থাকার মতো নানা সমস্যা দেখা দিচ্ছে। চলাচলের দুর্ভোগ যেন কিশোরগঞ্জবাসীর ভাগ্যের লিখন হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমি নির্বাচিত হলে কিশোরগঞ্জের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত নরসুন্দা নদী খনন, উন্নত ড্রেনেজ ব্যবস্থা নিশ্চিতকরণ, এবং প্রয়োজনীয় রাস্তাঘাট নির্মাণের মাধ্যমে জলাবদ্ধতা, যানজট ও ময়লা জমে থাকার সমস্যার স্থায়ী সমাধান করব, ইনশাআল্লাহ।
আমার এলাকার মানুষ শিক্ষা সচেতন। তবে যেসব স্থানে এখনও শিক্ষার প্রতি অনাগ্রহ ও অসচেতনতা রয়েছে, সেসব এলাকায় মানুষকে শিক্ষার প্রতি উৎসাহিত করব। দ্বীনি ও নৈতিক শিক্ষার মাধ্যমে প্রকৃত নাগরিক এবং খাঁটি মানুষ তৈরির চেষ্টা করব। বিদ্যমান শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অবকাঠামো উন্নয়নের পাশাপাশি নতুন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে আপ্রাণ পরিশ্রম করে যাব। কেননা, প্রকৃত শিক্ষা ছাড়া আদর্শ নাগরিক এবং দেশ গঠনের যোগ্য কারিগর তৈরি করা সম্ভব নয়।
আরও পড়তে পারেন-
- আদর্শ সমাজ বিনির্মাণে ইসলামের ভূমিকা
- সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি যেন হুমকির মুখে না পড়ে
- সমৃদ্ধ জাতি নির্মাণে দরকার বুদ্ধিবৃত্তিক জাগরণ ও আলেমদের এগিয়ে আসা
- সালাম-কালামের আদব-কায়দা
- বিবি খাদিজা (রাযি.): ইসলাম ধর্মের ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ নারী
সামাজিক সুবিচার প্রতিষ্ঠার জন্য গ্রাম ও মহল্লায় দ্বীনদার, সৎ, নিষ্ঠাবান এবং দেশপ্রেমিক নেতৃবৃন্দের মাধ্যমে সালিশ বোর্ড গঠন করব, যাতে অধিকাংশ সমস্যা স্থানীয়ভাবেই সমাধান হয়ে যায়। সমাজ ও দেশে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় আমরা সম্মিলিত প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখব। বিদ্যুৎ, পানি ও গ্যাস মানুষের মৌলিক চাহিদার মধ্যে অন্যতম। এগুলো ছাড়া জীবনযাত্রা প্রায় অচল। নির্বাচিত হলে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ, পানি ও গ্যাসের ব্যবস্থা করব, ইনশাআল্লাহ।
উম্মাহ: তরুণ, নারী ও সংখ্যালঘুর নিরাপত্তা ও কর্মক্ষেত্রে অংশগ্রহণ বিষয়ে কী উদ্যোগ নিতে চান?
মাওলানা মুহাম্মদুল্লাহ জামী: হোসেনপুর এলাকায় ব্রহ্মপুত্র ও নরসুন্দা নদীর সংযোগস্থলে একটি রাবার ড্যাম নির্মাণ করে নরসুন্দাকে স্রোতস্বিনী করব। এর মাধ্যমে হোসেনপুর থেকে নীলগঞ্জ পর্যন্ত নদীর দুই তীরে কল-কারখানা স্থাপন করা হবে। দেশি-বিদেশি উদ্যোক্তাদের আমার এলাকায় বিনিয়োগে উৎসাহিত করব এবং বিনিয়োগের জন্য নিরাপদ পরিবেশ তৈরি করব। উদ্যোক্তা উন্নয়ন, কারিগরি ও প্রযুক্তিগত প্রশিক্ষণের মাধ্যমে তরুণদের জন্য ব্যাপক কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করব, ইনশাআল্লাহ।
নিরাপত্তা আমার অগ্রাধিকার পরিকল্পনার অন্যতম অংশ। বিশেষ করে নারীরা নিরাপত্তার সর্বাধিক হকদার, তাদের নিরাপত্তায় সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া হবে। আমি মনে করি, নারীদের জন্য আলাদা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও পৃথক কর্মসংস্থানের সুযোগ অত্যন্ত জরুরি, যা তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিতের জন্যও গুরুত্বপূর্ণ।
ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা ও অধিকার রক্ষায় আমি সুন্নাহর অনুসরণ করব। কারণ, ইতিহাসে একমাত্র হযরত মুহাম্মদ (সা.)-ই ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘুদের পূর্ণ নিরাপত্তা এবং অধিকার প্রদান করেছিলেন। ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে তিনি সম্প্রীতির সমাজ ও শান্তির পরিবেশ গড়ে তুলেছিলেন। আমি তাঁর আদর্শ অনুসরণ করে সবার জন্য নিরাপদ, শান্তিপূর্ণ ও সম্প্রীতিময় সমাজ গঠন করব, ইনশাআল্লাহ।
উম্মাহ: আসন্ন নির্বাচনকে আপনি কীভাবে দেখছেন—সহযোগিতাপূর্ণ না প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ? এবং আপনার আসনে অন্যান্য প্রার্থীদের প্রতি আপনার দৃষ্টিভঙ্গি কী?
মাওলানা মুহাম্মদুল্লাহ জামী: আগামী নির্বাচন অত্যন্ত প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ হবে। কিশোরগঞ্জ একটি শান্তিপ্রিয় এলাকা এবং এখানকার নেতৃত্বও শান্তিপ্রিয়। আমি আশা করি, প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ নির্বাচন হলেও আমরা একে অপরের শত্রু হব না। জনগণের ভোটে যে নির্বাচিত হবেন, আমরা তাঁর নেতৃত্বে কিশোরগঞ্জে কাজ করে যাবো, ইনশাআল্লাহ।
উম্মাহ: আগামীর বাংলাদেশ কেমন দেখতে চান? আপনার স্বপ্নের বাংলাদেশ কেমন হবে?
মাওলানা মুহাম্মদুল্লাহ জামী: আমি এমন একটি বাংলাদেশ চাই, যে বাংলাদেশ আল্লাহ তাআলার বিধান দ্বারা পরিচালিত হবে। যে বাংলাদেশে মূর্খতা, দারিদ্রতা, নিরাপত্তাহীনতা থাকবে না। আমি এমন একটি বাংলাদেশ চাই, যেখানে হিংসা-বিদ্বেষ, মারামারি, কাটাকাটি থাকবেনা। আমি এমন একটি বাংলাদেশ চাই যেখানে থাকবে ন্যায় পরায়ণতা, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ও পারস্পরিক শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা।
উম্মাহ২৪ডটকম: এমএ