Home প্রবন্ধ-নিবন্ধ মালয়েশিয়ায় একজন আলেম যেভাবে প্রাদেশিক প্রধানমন্ত্রী ও শিক্ষকের ভূমিকায়

মালয়েশিয়ায় একজন আলেম যেভাবে প্রাদেশিক প্রধানমন্ত্রী ও শিক্ষকের ভূমিকায়

তক গুরু নিক আব্দুল আযীয বিন নিক মাত।

।। মুকিম আহমাদ ।।

তক গুরু নিক আব্দুল আযীয বিন নিক মাত । ভক্ত ও শিষ্যদের কাছে তিনি এই নামেই পরিচিত । ১৯৩১ সালে কেলান্তানের সম্ভ্রান্ত উলামা পরিবারে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতাও একজন স্বনামধন্য আলেম ও মাদ্রাসা-শিক্ষক ছিলেন । গুরু ‍নিক মাত বিন রাজা আব্দুল্লাহ তাঁর পিতার নাম । মায়ের কোল আর বাবার হাতেই তাঁর শিক্ষা শুরু ,পরবর্তীতে কেলান্তান ও তেরেঙ্গানুর বিভিন্ন তাহফীজে তাঁর প্রাথমিক শিক্ষালাভ করেন ।

উচ্চতর ডিগ্রী অর্জনের জন্য নিক আবদুল আযীয় ভারতের দারুল উলূম দেওবন্দ গমন করেন এবং দাওরাতুল হাদীস সমাপ্ত করেন । পাশাপাশি সেই সময়ে তিনি শাইখুল ইসলাম হোসাইন আহমাদ মাদানী রহ.-এর সান্নিধ্য লাভে ধন্য হন, তাঁর রাজনৈতিক দীক্ষা গ্রহণ করেন এবং তাঁর থেকে খেলাফত লাভ করেছেন বলেও কোনো কোনো তথ্যে পাওয়া যায়। সুদীর্ঘ পাঁচ বছর (১৯৫৩-১৯৫৭) দেওবন্দে অধ্যয়ন শেষে এক বছর (১৯৫৭-১৯৫৮) পাকিস্তানে তাফসীর নিয়ে অধ্যয়ন করেন।  তারপর ফিরে আসেন স্বদেশে ।অতঃপর মিসরের আল আযহার বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আরবী ভাষায় স্নাতক ও ইসলামী আইন বিষয়ে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন ।

এই দীর্ঘ প্রবাস-শিক্ষা জীবনে তিনি পৃথিবীর নানা প্রান্তের ইসলামী নেতৃত্বের সাথে পরিচিত হন । আরব-ইসরাইলের যুদ্ধ খুব কাছ থেকে দেখেন ও নিরীক্ষণ করার সুযোগ লাভ করেন । ফলে বৈশ্বিক রাজনীতি সম্পর্কে অভিজ্ঞতা লাভ করেন।

দেশে ফেরার পর তিনি ১৯৬২ সালে তাঁর মামার ওয়াকফ করা জমিতে দারুল উলূম দেওবন্দের দীক্ষা বুকে নিয়ে প্রতিষ্ঠা করেন মাধ্যমিক পর্যায়ের মাদ্রাসা “দারুল উলূম “ পুলাও মেলাকা । পরবর্তীতে বিভিন্ন মাদরাসায় দরস প্রদান করেন । প্রাদেশিক প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পরও তিনি দরস-প্রদান অব্যাহত রাখেন । আমৃত্যু তিনি তাদরীসের সাথে যুক্ত ছিলেন । প্রাদেশিক প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর তাঁকে প্রশ্ন করা হয়েছিল, আপনার কাছে কোনটা প্রিয়- মন্ত্রীত্ব না শিক্ষকতা ? তিনি জবাব দিয়েছিলেন শিক্ষকতা ।

রাজনীতিতে তাঁর অভ্যুদয়: মালয়েশিয়ার তৎকালীন একমাত্র ইসলামী রাজনৈতিক দল পাস পার্টি তখন ইসলামী দল হয়ে ওঠার লড়াইয়ে ক্লান্ত । ঠিক তখনই ইসলামী রাজনীতিতে অভিষেক ঘটে মাওলানা নিক আব্দুল আযীযের । হোসাইন আহমাদ মাদানী রহঃ -এর শিষ্য । তিনি প্রথমেই নেতৃত্বের বড় পর্যায়ে মানসিক পরিবর্তন নিয়ে আসেন । কাঠামোগত ইসলামী ভাবধারার বিস্তার ঘটান । একটি ইসলামী দলের পট পরিবর্তনের সাথে সাথে পোশাক ও চালচলনেও চলে আসে পরিবর্তন । দলটির নেতৃস্হানীয় ব্যক্তিবর্গের মাথায় সাদা টুপি আর গায়ে জুব্বা । মফস্বল এলাকাগুলোর সাধারণ মুসলমানদের মাঝে তৈরি হয় আলাদা আবেদন । গোটা রাষ্ট্রে ছড়িয়ে পড়ে পরিবর্তনের প্রভাব । যেখানে একটিমাত্র সংসদীয় আসন জেতার কথাও ছিল না দলটির, সেখানে একটি প্রদেশ শাসনের সৌভাগ্য অর্জন করে ১৯৯০ সালে কেলান্তানে ।

ভোটের রাজনীতিতে পাস আবির্ভূত হয় এক নতুন শক্তি নিয়ে । চিন্তা ও চেতনায় মৌলিকত্ব নিয়ে । মাওলানা নিক আব্দুল আযীয় বিন নিক মাত কেলান্তান প্রদেশের প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন । দেওবন্দিয়্যাত তার ব্যক্তি জীবনে ভীষণ প্রভাবক হয়। তাই প্রদেশ শাসনে তিনি প্রাণান্তকর চেষ্টা করেছেন পরিপূর্ণ সুন্নতের অনুশাসন মেনে চলতে এবং প্রতিষ্ঠা করতে ।

প্রাদেশিক প্রধানমন্ত্রী বা মন্ত্রী বেসার নির্বাচিত হওয়ার পর সর্বপ্রথম তিনি তাঁর জন্য রাষ্ট্রীয় বরাদ্দের প্রাসাদ প্রত্যাখ্যান করে  বেছে নেন তাঁর পুরনো কাঠের বাড়ি। বিলাসবহুল গাড়ি ফিরিয়ে দিয়ে নিজের কেনা পুরনো সাধারণ মডেলের গাড়িটিই ব্যবহার করেন । প্রাদেশিক কাজের ফাঁকে ফাঁকে বিভিন্ন মাদরাসায় তিনি তাঁর দরস প্রদানে চলে যেতেন । বৃহস্পতিবার ও শুক্রবারে তাঁর মসজিদে দীর্ঘদিনের নিয়ম মাফিক বিভিন্ন বিষয়ে বয়ান করতেন । শনিবার দিনটি ছিল শুধুই সাধারণ গ্রামবাসীদের জন্য । কোনো লৌকিকতা ছাড়াই সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত সাধারণ মানুষের সমস্যার কথা শুনতেন এবং কোন দীর্ঘ প্রক্রিয়া ছাড়াই সমাধানের নির্দেশ দিতেন ।

তিনি এতটাই সাদাসিধে জীবন-যাপন করতেন যে পকেটে টাকা রাখার জন্য দামী ওয়ালেটের পরিবর্তে সাদা খাম ব্যবহার করতেন । একবার কোন এক সমাবেশে পকেটে টাকা রাখতে গেলে উপস্হিত পাস পার্টির নেতাদের গোচরীভূত হয় যে , একজন প্রদেশিক মন্ত্রী বেসার এলোমেলোভাবে কাগুজে খামের ভিতর টাকা-পয়সা রাখেন তখন উপস্হিত পার্টির নেতারা জোর করে তাকে পার্টির লোগো সম্বলিত ওয়ালেট দেন ।

ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে তক গুরু আব্দুল আযীয ছিলেন সবার ভালবাসার ভরসাস্হল । একজন খ্রিস্টান হেডমাস্টার একটি দৈনিকে তাঁকে স্মরণ করে লেখেন “ আমাদের চার্চের ডোমটি কোনো এক ঝড়ে ক্ষতিগ্রস্হ হয় , তক গুরু আব্দুল আযীযের অফিসও ছিল আমাদের চার্চের অপরদিকে । তিনি পরদিন অফিসে এসে দেখতে পেলেন চার্চের গম্বুজটি নেই । তিনি আমাকে কল দিয়ে জানতে চাইলেন আপনাদের চার্চের গম্বুজটি নেই কেন ? কেও কি সরিয়ে দিয়েছে ? আমি জানালাম ঝড়ে ক্ষতিগ্রস্হ হয়েছে ।

সাথে সাথে তিনি মেরামতের জন্য চেক দিতে চাইলেন এবং জানালেন আমার কাছে অমুসলিমদের জন্য আলাদা ফান্ড আছে ।” এভাবেই তিনি দীর্ঘ তে্ইশ বছর লাগাতার একটি প্রদেশ শাসন করেন । তিনি তাঁর উত্তম আচরণে জনমানুষের মনে স্হায়ী বসত গড়ে তুলেছেন । তাঁর সাদাসিধে চলাফেরা আর ন্যায়শাসনে মুগ্ধ হয়ে একটি ইসলামী দলের বিধর্মী প্রজাদের জন্য আলাদা যুব সংঘ তৈরি হয় । পাস পার্টি অনন্য দৃষ্টান্ত স্হাপন করে মাওলানা আব্দুল আযীযের নির্দেশে । ইসলামের সার্বজনীনতা পুনঃপ্রতিষ্ঠা করে যান নিক আব্দূল আযীয রহ. ।

তাঁর বিদায়বেলা: এই মহান মানুষটি ক্ষমতার প্রতি নির্মোহ ছিলেন । জনগণের কল্যাণকামী ছিলেন । তিনি প্রধানমন্ত্রী হতে অনাগ্রহী ছিলেন । বলেছিলেন, আমাকে আপনারা বড়জোর স্পিকার বানাতে পারেন । কিন্তু পার্টির পীড়াপীড়িতেই তাকে মন্ত্রী বেসারের দায়িত্ব নিতে হয় । শেষ বয়সে তিনি দূরারোগ্য ক্যান্সারে আক্রান্ত হন , ফলে ২০১৩ সালে ক্ষমতা হস্তান্তর করেন । ২০১৫ সালের ১৫ই ফেব্রুয়ারীতে তিনি মৃত্যুবরণ করেন ।

পাস পার্টির রাজনৈতিক উত্থানে এবং আদর্শিক ধারার ইতিবাচক পরিবর্তনের মূল নেপথ্য নায়ক ছিলেন মাওলানা নিক আব্দুল আযয়ি বিন নিক মাত । তাঁর নেতৃত্বে সুদীর্ঘ ২৩ বছরের শাসন পাস পার্টিকে ভোট ও ক্ষমতার লড়াইয় আরও বেশি দৃঢ় ও সুসংহত করেছিল।

লেখক: মুকিম আহমাদ, মালয়েশিয়া থেকে।