।। মাওলানা মুনির আহমদ ।।
স্বাধীনতা শুধু একটি রাজনৈতিক অর্জন নয়; এটি একটি জাতির আত্মপরিচয়ের ভিত্তি, আত্মত্যাগের ফল এবং সম্মিলিত বিশ্বাসের বাস্তবায়ন। বাংলাদেশের ইতিহাসে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ ছিল এক অনন্য সংগ্রাম- স্বাধিকারের আকাক্সক্ষা থেকে সশস্ত্র প্রতিরোধ পর্যন্ত এক আত্মমর্যাদাশীল জাতিগঠনের গৌরবময় যাত্রা। কিন্তু আজ, স্বাধীনতার ৫৪ বছর পর আমাদের প্রশ্ন করতে হয়- এই স্বাধীনতার উপর কি সত্যিই আমাদের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছি?
ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের সময়কার বিভাজন, দমন-পীড়ন ও কৌশলী আইন প্রয়োগের মতোই স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশেও আমরা নানা দিক থেকে আধিপত্যবাদী শক্তির প্রচ্ছন্ন প্রভাব দেখেছি। বিশেষত ভারতীয় হেজিমনির নেপথ্য ভূমিকা, স্বাধীনতা-উত্তর লুটপাট ও নিরাপত্তা হস্তক্ষেপ এবং রাজনৈতিক মদদদানের মাধ্যমে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিকে প্রভাবিত করার প্রবণতা এখনো শেষ হয়নি। এই বহুমাত্রিক হস্তক্ষেপের কারণে গণতন্ত্র, মানবাধিকার এবং জাতীয় স্বার্থ বারবার সংকটের মুখে পড়েছে।
এই প্রেক্ষাপটে সাম্প্রতিক ছাত্র-জনতার আত্মত্যাগ ও গণজাগরণকে ‘দ্বিতীয় স্বাধীনতা’-র একটি সম্ভাব্য রূপ হিসেবে দেখা যেতে পারে। তারা কেবল একটি দলের বিরুদ্ধে নয়, বরং একটি বিদেশি-সমর্থিত শোষণমূলক রাজনৈতিক ব্যবস্থার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছে। প্রশ্ন জাগে- যে স্বপ্নে লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে দেশ স্বাধীন হয়েছিল, তা কি আজও পূরণ হয়েছে? নাকি সেই স্বাধীনতা বারবার অভ্যন্তরীণ দুর্নীতি ও বাহ্যিক আধিপত্যের বাণিজ্যিক পণ্যে পরিণত হয়েছে?
স্বাধীনতা যেন কোনো নির্দিষ্ট দলের মালিকানায় রূপ না নেয়, এটাই ছিল একাত্তরের মূল প্রেরণা। কিন্তু রাজনৈতিক ইতিহাসের পুনঃলিখন এবং স্বাধীনতার পক্ষ-বিপক্ষ ন্যারেটিভের মাধ্যমে একটি দল যখন বারবার নিজেকে জাতির একমাত্র অভিভাবক হিসেবে দাবি করে, তা স্বাধীনতার মূল চেতনার পরিপন্থী। যখন দেশের জনগণ পুনরায় গণতন্ত্র, ন্যায়বিচার ও আত্মনিয়ন্ত্রণের আকাক্সক্ষায় রক্ত দেয়, তখন তা স্বাধীনতার ধারাবাহিকতায় এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করে।
আরও পড়তে পারেন-
- আদর্শ সমাজ বিনির্মাণে ইসলামের ভূমিকা
- সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি যেন হুমকির মুখে না পড়ে
- সমৃদ্ধ জাতি নির্মাণে দরকার বুদ্ধিবৃত্তিক জাগরণ ও আলেমদের এগিয়ে আসা
- সালাম-কালামের আদব-কায়দা
- বিবি খাদিজা (রাযি.): ইসলাম ধর্মের ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ নারী
আজকের প্রেক্ষাপটে আমাদের করণীয় হলো- স্বাধীনতার অতীত ও বর্তমান উভয় দিকের নিরপেক্ষ মূল্যায়ন। ঐতিহাসিক সত্যকে বিকৃত না করে, বরং তথ্যভিত্তিক গবেষণার মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতা-উত্তর রাজনীতির প্রকৃত রূপ জনগণের সামনে তুলে ধরা সময়ের দাবি। একাত্তরের বিজয় যেমন সম্মিলিত সংগ্রামের ফল ছিল, তেমনি আজকের গণজাগরণও নিরপেক্ষ মূল্যায়নের দাবি রাখে।
আমরা বিশ্বাস করি, কোনো জাতির রাজনৈতিক স্বাধীনতা তখনই পূর্ণতা পায়, যখন তা নৈতিক আত্মশক্তিতে বলিয়ান হয়। এই আত্মশক্তির মূল ভিত্তি হলো ঈমান, ইনসাফ এবং সত্য ও ন্যায়ের প্রতি অবিচল প্রতিশ্রুতি। ভারতীয় আধিপত্য বা কোনো বিদেশি গোয়েন্দা গোষ্ঠীর ছায়ায় যারা দেশ শাসন করতে চায়, তাদের প্রত্যাখ্যান করা প্রতিটি মুসলমানের অন্যতম দায়িত্ব।
যখন বাংলাদেশে ‘দ্বিতীয় স্বাধীনতা’র দাবি উচ্চারিত হচ্ছে, তখন আমাদের দায়িত্ব ইতিহাসের পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণ করা, মিথ্যাকে সত্যরূপে প্রচারের অপচেষ্টা প্রতিহত করা এবং পরবর্তী প্রজন্মকে মুক্তচিন্তা, আত্মত্যাগ ও সত্যনিষ্ঠায় লালন করা। আল্লাহর ওপর ভরসা রেখে, অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে, স্বজাতির মর্যাদা রক্ষায় প্রতিটি নাগরিককে ন্যায়-নীতি, সুবিচার, ইনসাফ ও ন্যায্য অধিকারের পক্ষে সচেতন ও সোচ্চার হতে হবে।
আমরা যেন এই জাতির স্বাধীনতা আর কখনো কারো কাছে বিকিয়ে না দেই, কেউ যেন আমাদের উপর অনধিকার ছড়ি না ঘুরাতে পারে- জুলাই বিপ্লবের পর এই হোক আমাদের সম্মিলিত অঙ্গীকার।
উম্মাহ২৪ডটকম: এমএ