Home লাইফ স্টাইল আল্লামা নূর হোসাইন কাসেমী (হাফি.)এর মাহে রমযান যেভাবে কাটে!

আল্লামা নূর হোসাইন কাসেমী (হাফি.)এর মাহে রমযান যেভাবে কাটে!

।। মাওলানা গোলাম মাওলা ।।

রাজধানীর অন্যতম বিখ্যাত দ্বীনি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান জামিয়া মাদানিয়া বারিধারার প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক ও শায়খুল হাদীস আকাবের ও আসলাফের জীবন্ত প্রতিচ্ছবি আল্লামা নূর হোসাইন কাসেমী (হাফি.) শায়েখ জাকারিয়্যা (রাহ.)এর জানেশীন মুফতি মাহমুদ হাসান গাঙ্গুহী ( রাহ.)এর অন্যতম খলীফা।

অন্যান্য বছরের মতো এবারও আল্লামা কাসেমী (হাফি.) পুরো রমজান মাস জামিয়ার জামে মসজিদে ইতিকাফে কাটাচ্ছেন। জাতীয় কোনো বিশেষ সংকট কিংবা বিশেষ প্রয়োজনে মসজিদ থেকে রমযানের প্রথম ২০ দিনের মধ্যে ক্ষণিকের জন্য বের হলেও দ্রুত মসজিদে ফিরে আসেন। রমজানে সাধারণত সাক্ষাত প্রদান করেন না এবং কারো কথাও বলেন না। জমিয়তের কোন প্রোগ্রামেও শরীক হন না। চলতি রমযানের প্রথম ২০ দিনে মাত্র দুই বার বাইর হয়েছিলেন। একবার ভারতের ডাবিলে হযরত ইবরাহীম আফ্রিকী হযরতের সাথে ৩ দিন ইতিকাফে শরীক হতে। সেখান থেকে ফিরে আবার মসজিদে প্রবেশ করেন। অন্য কোথাও যাননি। দ্বিতীয়বার বারিধারা মাদ্রাসায় ছাত্র জমিয়তের ইফতার মাহফিলে উস্তাদগণের পীড়াপীড়িতে মাত্র ১০ মিনিটের জন্য মসজিদের বাইরে এসেছিলেন। এছাড়া চলতি রমযানে তিনি আর মসজিদ থেকে বের হননি।

জামিয়া মাদানিয়া বারিধারার মসজিদ ইতিকাফকারীদের পদভারে মুখরিত। আল্লামা কাসেমী (হাফি.) পুরো রমযান ইতিকাফে থাকার ফলে আলেম উলামার সমাগম বেশী থাকে। সাধারণ লোক থাকে কম। বিভিন্ন মাদ্রাসার মুহাদ্দিস, মুহতামিম,শায়খুল হাদীস, মুদাররিস, সদ্য ফারেগ তরুণ আলেমগণ সব চেয়ে বেশী ভীড় জমান।

রমযানের শুরু থেকে মসজিদে তারাবীহ এর নামাজের জন্য দুই জন অবিজ্ঞ হাফেজ নিযুক্ত আছেন। যারা খুবই ধীরে ধীরে তারতিলের সাথে অত্যন্ত সুমধুর আওয়াজে ক্বিরাত তিলাওয়াতের মাধ্যমে তারাবীহ আদায় করেন।
প্রায় দুই-আড়াই ঘন্টা লেগে যায় এই তারাবীতে। নামাজের পর সুরা ইয়াসিনের আমল, দরুদ, সালাত ও সালাম পাঠের আমল।

বার্ধেক্যজনিত অসুস্থতার কারণে একেবারে দুর্বল। লাঞ্চের সমস্যার কারণে প্রচন্ড কাশি। আবার টাইফয়েড জণিত কারণে পায়েও তাঁর বড় সমস্যা। ঠিকমত দাঁড়াতে পারেন না। তবুও কখনও বসে তারাবীহ আদায় করেন না এই দুর্বল বৃদ্ধ মানুষটি। অন্যান্য নামায তো বসে পড়ার প্রশ্নই আসে না তাঁর জন্য। তিনি ইবাদত করার সময় কখনো নিজের শারীরিক দুর্বলতা দেখান না। এই পরিণত বয়সেও যেন হযরতের ইবাদতে মনোসংযোগ সবল যুবককেও হার মানাবে।

এরপর কিছু সময় বিশ্রাম নেওয়ার পর আবার শুরু হয় গভীর রাত পর্যন্ত কোরআন তেলাওয়াত। এরপর অল্প কিছু সময় বিশ্রাম নিয়ে তাহাজ্জুদ এর নামাজ শুরু করেন। তাহাজ্জুদ নামাজে লম্বা ক্বেরাত, লম্বা রুকু ও সেজদা করেন। কখনো কখনো পা দুটি ফুলে যায়। আর তখনই খুশীতে আত্মহারা হয়ে পড়েন। কারণ, আজ আরেকটি সুন্নাত আদায় হয়েছে; এটা বলে।

তাহাজ্জুদ শেষ করে সাহরী করেন যৎসামান্য আহার করে। শুধু সুন্নাত পালনের জন্যই সাহরীতে শরীক হন। সাহরী শেষ করে ফজরের নামাজের সময় হলে, জামাতে নামাজ আদায় করে কিছু সময় বিশ্রাম করেন। এরপর ওঠ ইশরাক আদায় করে বিশ্রাম করেন।

সকাল ৯ টা পর্যন্ত ঘুমান। মুলত: এই অল্প সময়টুকুই তিনি বিশ্রাম নেন। আর বাকী অন্য সময় দিন-রাত ইবাদতে মশগুল থাকেন। সকালে ঘুম থেকে মসজিদে অন্যান্য ইতিকাফকারীদের নিয়ে তালীম শুরু হয়। বিভিন্ন কিতাবাদি তালীম করা হয়। একজন পড়েন, আর বাকী সাথীরা শুনেন। মাঝে মাঝে শায়েখ নিজে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করেন জরুরত মতো।

এক দেড় ঘন্টা তালীমের পর কোরআন তেলাওয়াতে মশগুল হয়ে পড়েন সকলে। যোহর পর্যন্ত কুরআনুল কারীমের তেলাওয়াত হয়। অনেকে বিভিন্ন কিতাবাদী মুতাআলা করেন।

বাদ যোহর জিকিরের আমল শুরু করেন। সম্মিলিত ভাবে বসে নিজ নিজ আসনে জিকির করেন তবে সমস্বরে নয়। জিকির শেষ করে আবার তিলাওয়াত শুরু হয়। আসর পর্যন্ত চলে তিলাওয়াত। আসরের পর আবার তালিমের মজলিস। বয়ান শেষ হলে আবার তিলাওয়াতে, ব্যক্তিগত আমল ও দোয়ায় মশগুল হয়ে যান সকলে ইফতার পর্যন্ত।

ইফতারের সময় অনেকে লম্বা দুআ করেন। দুআয় অনেক পরিবর্তন হয়ে যায় মজলিসের আবহ। সকলে সৃষ্টিকর্তার কাছে ফরিয়াদ জানান গুনাহ মাফের এবং অন্যান্য হাজতের।

মাগরীবের পরে আওয়াবীনের আমল। সেখানেও ইতিকাফের সাথীরা দুই তিন জন করে জামাতবদ্ধ হয়ে আওয়াবীনে কুরআন তিলাওয়াত শুনেন। আওয়াবীন শেষ হলে তারাবীর জন্য সবাই তৈরী হন।

হযরত রমজানের প্রতিটি মুহূর্তকে, প্রতিটি দিনকে এভাবে গনীমত মনে করে ক্বদর করেন। যেন কোন কারণে অযথা সময় নষ্ট না হয় বা দুনিয়াবী কোন শোগল না আসে, সে ব্যাপারে অত্যন্ত সতর্ক থাকেন। শায়েখ জাকারিয়্যা (রাহ.) এবং মুফতি মাহমুদ হাসান গঙ্গুহী (রাহ.)এর মজলিসের স্মৃতিচারণ করে নিজেকে আকাবির ও আসলাফের রঙে রাঙাতে চেষ্টায় কোন কসুর করেন না শায়খ। হযরতের প্রতিটি কদম যেন সুন্নাত মোতাবেক হয়, সে বিষয়ে তিনি অত্যন্ত সজাগ ও সতর্ক থাকেন। রমজানে জমিয়ত ও মাদ্রাসার কোন কাজে অতীব জরুরী ছাড়া কোন কথা বলেন না। মাদ্রাসার জিম্মাদারগণই দৈনন্দিন সকল কাজ সমাধা করেন।

পরম করুণাময়ের দরবারে ফরিয়াদ, তিনি যেন আমাদের শায়েখকে সুস্থতাদান করেন এবং দীর্ঘ হায়াত দান করে আমাদের আমলের রাহবার এবং আমাদের মাথার উপর ছায়া করে রাখেন। আমীন।।

লেখক: ফারেগে দারুল উলূম দেওবন্দ, নির্বাহীপরিষদ সদস্য- জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদে, সাবেক সাধারণ সম্পাদক- যুব জমিয়ত বাংলাদেশ এবং স্বত্বাধিকারী- কওমী টুপি ঘর।

দারিদ্র্যবিমোচনে ইসলামের যাকাত ব্যবস্থার অবদান যথেষ্ট এবং অতুলনীয়