Home সম্পাদকীয় দিনে-দুপুরে প্রকাশ্যে কুপিয়ে হত্যা: এমন নৃশংসতার শেষ কোথায়?

দিনে-দুপুরে প্রকাশ্যে কুপিয়ে হত্যা: এমন নৃশংসতার শেষ কোথায়?

দেশের দক্ষিণাঞ্চলের বরগুনা শহরে কতিপয় সন্ত্রাসী এক যুবককে প্রকাশ্য জনসম্মুখে রামদা দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করার বিভৎস দৃশ্যের ভিডিওটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়ে সারাদেশে অন্যতম আলোচ্য বিষয়ে পরিণত হয়েছে।

মাত্র ক’দিন আগে ভারতে হিন্দুত্ববাদী সন্ত্রাসী গোষ্ঠির হাতে মুসলমান যুবক নির্যাতিত হয়ে নিহত হওয়ার ঘটনা ভারতজুড়ে এখনো রজনৈতিক উত্তাপ ছড়াচ্ছে। দু’টি ঘটনার প্রেক্ষাপট ভিন্ন। বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িক কারণে এমন নৃশংস ঘটনার কোনো নজির নেই বললেই চলে।

ভাইরাল হওয়া ভিডিওতে দেখা যায়, বরগুনা শহরের রাস্তায় কতিপয় যুবক ধারাল অস্ত্র দিয়ে এক যুবককে এলোপাতাড়ি কোপাচ্ছে। দায়ের কোপে রক্তাক্ত যুবকটির সদ্য বিবাহিত স্ত্রী স্বামীকে বাঁচাতে প্রাণপণ চেষ্টা, বাঁধা ও আর্তনাদ করছে। আক্রমনের শিকার ছেলেটিও বাঁচার জন্য আকুল আকুতি জানালেও শেষ রক্ষা হয়নি। চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে রিফাত শরিফ নামের সেই যুবককে রাস্তায় ফেলে দুর্বৃত্তরা চলে যাওয়ার পর স্থানীয়রা প্রথমে বরগুনা জেনারেল হাসপাতালে, অতঃপর বরিশাল মেডিকেল কলেজে নিয়ে যাওয়া হলে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে তার মৃত্যু হয়।

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভিডিওটি ভাইরাল হওয়ার পর বেশ কয়েকটি টিভি চ্যানেলে তা প্রচারিত হয়। গতকাল দেশের প্রায় সব গণমাধ্যমেই এ নিয়ে সচিত্র সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। তবে সাম্প্রতিক সময়ে এটি কোনো নতুন বা বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। দেশের বিভিন্ন স্থানে প্রায় প্রতিদিনই এমন সব নৃশংস ঘটনার খবর পাওয়া যাচ্ছে।

নিহত রিফাত শরিফের সাথে আয়েশা সিদ্দিকা মিন্নির বিয়ে হয়েছিল কয়েকমাস আগে। মিন্নির কথিত প্রেমিক নয়নের নেতৃত্বে চারপাঁচজন যুবক তাকে রাস্তায় নির্মমভাবে হত্যা করে। ঘটনার পর প্রকাশিত আরেকটি ভিডিওতে মিন্নি তার স্বামীকে হত্যার প্রেক্ষাপট বর্ণনা করে বলেন, বিয়ের পর থেকেই নয়ন প্রায়শঃ তাকে রাস্তায় উত্ত্যক্ত করতো, হুমকি দিতো। এ কারণেই স্বামী রিফাত তাকে কলেজ থেকে নিতে এসেছিল।

গত এক সপ্তাহে এ ধরনের বেশ কয়েকটি নির্মম হত্যাকান্ডের খবর গণমাধ্যমে উঠে এসেছে। শুধুমাত্র গতকাল প্রকাশিত খবরে দেখা যায়, রাজধানীর পার্শ্ববর্তী রূপগঞ্জের কায়েতপাড়া ইউনিয়ন পরিষদের মহিলা সদস্য বিউটি আক্তারকে সন্ত্রাসীরা কুপিয়ে হত্যা করেছে। এর আগে তার স্বামীকেও হত্যা করেছে সন্ত্রাসীরা। নরসিংদীতে এক তরুণীর গায়ে কেরোসিন ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেয়ার পর ১৩ দিন ঢাকা মেডিকেল কলেজেন বার্ন ইউনিটে চিকিৎসাধীন থাকার পর কলেজ ছাত্রী ফুলন বর্মনের মৃত্যু হয়েছে।

কিশোরগঞ্জের হোসেনপুরে চুরির অভিযোগে এক যুবককে হাত-পা, চোখ বেঁধে রাতভর নির্যাতনের ঘটনা এবং রাজশাহীতে ছাত্রলীগের এক নেতাকে দুর্বৃত্তরা ছুরি মেরে হত্যা করেছে। একদিনের পত্রিকা থেকে এমন আরো বেশ কয়েকটা ঘটনা উদ্ধৃত করা যাবে। একটি চরম অস্বাভাবিক সমাজবাস্তবতা, নির্মমতা ও অবক্ষয়ের শিকার আমাদের সমাজ। অবক্ষয়, অপরাধপ্রবণতা এবং নৃশংস সন্ত্রাস আমাদের সমাজব্যবস্থাকে চরম নিরাপত্তাহীন করে তুললেও এহেন বাস্তবতা থেকে সমাজকে রক্ষা করার কোনো সামাজিক-রাজনৈতিক উদ্যোগ নেই।

চলমান সামাজিক অবক্ষয়, সন্ত্রাস এবং একের পর এক নির্মম হত্যাকান্ডের ঘটনার পেছনে কাজ করছে রাজনৈতিক অসহিষ্ণুতা, গণতান্ত্রিক রাজনীতির অনুপস্থিতি এবং বিচারহীনতার সংস্কৃতি। ২০১২ সালে বিরোধী জোটের অবরোধের সময় রাজধানীর বাহাদুর শাহ পার্কের বাইরে জগন্নাথ কলেজের ছাত্রলীগকর্মীদের হাতে প্রকাশ্য দিবালোকে বিশ্বজিৎ দাস নামের এক যুবককে বিরোধীদলের কর্মী সন্দেহে চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করা হয়।

গণমাধ্যমে প্রকাশিত ছবিতে ও ভিডিওতে দেখা গেছে, বিশ্বজিৎকে কোপানোর সময় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা অদূরে দাঁড়িয়ে নিরব দর্শকের ভূমিকা পালন করছিল। কেউ তাঁকে বাঁচাতে এগিয়ে আসেনি। এরপর অনুরূপ ঘটনা আরো বহু ঘটেছে। গত ৭ বছরে অবস্থার আরো অবনতি ঘটেছে। নির্মম ঘটনার ছবি ও ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছেড়ে ভাইরাল করার মাধ্যমে এক ধরনের প্রতিবাদী জনমত গঠিত হলেও আর্ত ও আক্রান্ত অসহায় মানুষকে রক্ষায় তেমন কোনো প্রতিরোধ গড়ে উঠতে দেখা যায় না।

বরগুনায় সন্ত্রাসীদের হাতে নিহত রিফাতের স্ত্রী আক্ষেপ করে বলছেন, রাস্তার পাশে অনেক লোক থাকলেও কেউ তার স্বামীকে বাঁচাতে এগিয়ে আসেনি। রাস্তার পাশে জড়ো হয়ে নিরব দর্শকের ভ‚মিকা পালনকারীরা এ ধরনের ঘটনায় ন্যূনতম প্রতিবাদ বা প্রতিরোধ গড়ে তুললে এ ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি হতো না।

প্রায় প্রতিটি ঘটনায় মামলা হলেও দোষীদের গ্রেফতার ও বিচার প্রক্রিয়াকে এগিয়ে নিতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ব্যর্থতার কারণে দেশে এক প্রকার বিচারহীনতার সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে। বেশিরভাগ ঘটনায় ছাত্রলীগ বা সরকারিদলের স্থানীয় নেতাকর্মীদের সম্পৃক্ততা থেকে এসব ঘটনায় দেশের রাজনৈতিক বাস্তবতার দায় আঁচ করা যায়। নারায়ণগঞ্জের সাতখুন মামলায় প্রভাবশালী মহলের ছত্রছায়া প্রাপ্ত আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরাও বিচারের আওতায় এসেছে। এটি নিঃসন্দেহে আশাব্যঞ্জক দিক।

তবে বিচার দীর্ঘায়িত হলে ন্যয়বিচার থেকে বঞ্চিত হওয়ার আশঙ্কা রয়ে যায়। এর ফলে অপরাধীরা আরো বেপরোয়া হয়ে উঠে। গুম-খুন, প্রকাশ্য কুপিয়ে হত্যার মত ঘটনার দ্রুত বিচার নিশ্চিত করার পাশাপাশি এ ধরনের সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে সামাজিক প্রতিরোধ গড়ে তোলার কোনো বিকল্প নেই।

সাগর-রুনির পরিবার, বিশ্বজিতের পরিবার, খাদিজা, মিতু ও নুসরাতের পরিবার দ্রুত ন্যায়বিচার পেলে, হত্যাকারীদের দ্রুত দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হলে সাম্প্রতিক সময়ের বিউটি, ফুলন বমর্ণ বা রিফাত শরিফ হয়তো এমন পৈশাচিক হত্যাকান্ডের শিকার হতো না।

২০৪১ সাল নাগাদ সারা বিশ্বের মানুষকে আমরা ঋণ দেব: সংসদে অর্থমন্ত্রী