Home ইসলাম মনোমুগ্ধকর আচরণে রাসূলুল্লাহ (সা.)এর সুন্নাত

মনোমুগ্ধকর আচরণে রাসূলুল্লাহ (সা.)এর সুন্নাত

।। আলহাজ্ব সৈয়দ জহির উদ্দীন ।।

মানুষের আরবী হচ্ছে, ইনসান। ইনসান-এর উৎপত্তি ‘নিসইয়ান’ শব্দ থেকে। নিসইয়ান মানে ভুলে যাওয়া, ভুল করা। সুতরাং প্রত্যেক মানুষেরই কম বেশী ভুল-ত্রুটি থাকে। প্রকাশ্যে না হলেও গোপনে আছে। অন্যরা না জানলেও নিজে জানে। কিন্তু রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ছিলেন এমন ভুল-ত্রুটি থেকে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র ও পাক-পবিত্র। তাঁর জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত পুরো জীবনের মধ্যে কোন ত্রুটি কেউ বের করতে পারেনি। আল্লাহ তায়ালাই তাঁর চরিত্রের সার্টিফিকেট দিচ্ছেন, “নিশ্চয়ই আপনি মহান চরিত্রের অধিকারী।” (সূরা- ৬৮, আয়াত- ৪)।

উল্লেখ্য, সৎ (খুলুক্বে হাসান) বা মহৎ (খুলুক্বে কারীম)এর উপরের স্তর হল মহান চরিত্র (খুলুক্বে আযীম)। এমন চরিত্রের অধিকারী বলেই একমাত্র তিনি তাঁর উম্মতকে বলতে পেরেছিলেন, “তোমরা আমার পক্ষ থেকে একটি কথা হলেও মানুষের কাছে পৌঁছে দিও”। মা আয়েশা (রাযি.) বলেন, “রাসূল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের চরিত্র হল কুরআনের চরিত্র”। কুরআনে যেমন কোন ভুল নেই, নবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মধ্যেও কোন ভুল-ত্রুটি নেই। তাঁকেই করা হয়েছে আমাদের আদর্শ। (সূরা- ৩৩, আয়াত- ২১)।

শিশুকাল থেকে নিয়ে বৃদ্ধ বয়স পর্যন্ত সমস্ত স্তর ও ক্ষেত্রে তিনি আমাদের জন্য আদর্শ চরিত্র রেখে গেছেন। রাখাল থেকে রাষ্ট্রপতি; সৈনিক বা সেনাপতি, চিকিৎসায় বা বিজ্ঞানে, শিক্ষকতায় অথবা নেতৃত্বে, পরিবারে বা সমাজের সকল স্তর, পদ ও বিভাগে তাঁরই রেখে যাওয়া চরিত্র আমাদের জন্য আদর্শ।

অত্যন্ত দুঃখের বিষয় যে, আজ আমাদের মধ্যে প্রিয়নবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যগুলো অনুপস্থিত। শিশুকাল থেকেই তিনি যে সততা, সত্যবাদীতা, বিশ্বস্ততা, ওয়াদাপূরণ, পরোপকারীতা ও দয়া-দরদের গুণে গুণান্বিত ছিলেন, আমরা বুড়ো হয়েও তা অর্জন করতে পারিনা। পরহেযগার হিসাবে পরিচিত ব্যক্তিদের মুখ দিয়েও ফাহেশা মিথ্যা ও চোগলী-গীবত সম্বলিত কথা বের হতে লজ্জা করে না। অথচ আমাদের নবীজি জীবনে কৌতুক করেও একটি মিথ্যা কথা বলেন নি। শত্রুরও চুগলী-গীবত করেন নি। এমনকি তিনি মিথ্যা বানোয়াট গল্প বলতেও নিষেধ করেছেন। (আবু দাঊদ)

উল্লিখিত গুণ ও আমানতদারীর কারণেই তো মক্কার মুশরিকরা তাঁকে আল-আমীন বলে ডাকত। মক্কাবাসীরা যখন তাঁকে হত্যা করার জন্য ঘিরে রেখেছিল, তখনও রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদের আমানত রক্ষা করার চেষ্টা ত্যাগ করেননি। তিনগুণের চেয়েও বেশী সংখ্যক শত্রুর মোকাবিলা করছেন এমন যুদ্ধেও তিনি সেই সাহাবীদ্বয়কে ওয়াদা ভঙ্গ করতে দেননি, যারা শত্রুর হাতে ধৃত হয়ে মুসলিম পক্ষে যুদ্ধ না করার ওয়াদা করেছিলেন। কাফিরদের সাথে অনেক সময় চুক্তি করেছেন, কিন্তু কখনো তিনি তা লংঘন করেননি। যুদ্ধের জন্য নানা কৌশল অবলম্বন করলেও প্রতারণার আশ্রয় নেননি। জীবনে কোন যুদ্ধে পরাজিত হননি বলে বীরত্বের অহংকার করেননি। তিনটি কাজ থেকে তিনি নিজকে সদাসর্বদা বিরত রাখতেন- (১) লোক দেখানো কর্মকান্ড (২) অহংকার করা এবং (৩) অনর্থক কাজ।

রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কখনো শত্রুর কাছ থেকে কোন প্রতিশোধ গ্রহণ করননি। প্রাণের শত্রুকেও তিনি ক্ষমা করেছেন। তাদের প্রতি দয়া ও সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন। কোন শত্রু বা ভৃত্যের সাথেও তিনি কঠোর ব্যবহার করেননি। বরং কথা, কাজ ও ব্যবহারে তিনি এত ভদ্র, নম্র ও বিনয়ী ছিলেন যে, শত্রুরাও তাতে বিমোহিত হয়ে ইসলামের ছায়াতলে আশ্রয় নিত। ইরশাদ হচ্ছে- “আল্লাহর রহমত যে, আপনি তাদের প্রতি কোমল স্বভাবের হয়েছেন। পক্ষান্তরে আপনি যদি রূঢ় স্বভাবের হতেন, তবে তারা আপনার কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যেত”। (সূরা ইমরান, আয়াত- ১৫)।

অত্যন্ত দুঃখের বিষয়, আমাদের সমাজে রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের এই সুন্নাতটির বড় অভাব। আমরা তাঁর মত সুন্দর ভাষা, দরদী মন ও বিনয় রক্ষা করে মানুষের সাথে কথা বলতে ও কাজ করতে পারি না। এমনকি শরীয়তের কোন মাসআলার সমাধান দিতেও অনেকে সদিচ্ছা প্রকাশ করেন না। অথচ রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মদীনার যে কোন গলিতে উট-ঘোড়া থেকে নেমে মাটিতে বসে কোন গোলামের মনের কথা শুনতেও দ্বিধাবোধ করতেন না। কিন্তু এই সমাজে যিনি যত বড় জ্ঞানী তিনি যেন সাধারণ মানুষ থেকে তত দূরে। রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তো সাথীদের সঙ্গে মাটি কেটেও ধূলি-ধূসর হয়ে ছিলেন। তাদের সাথে হাসি কৌতুকও করেছেন। তিনি বলেছেন, বাস্তব কৌতুকে দোষ নেই।

সুতরাং আমাদের অবস্থার পরিবর্তন হওয়া দরকার। যারা আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অনুসারী তথা দ্বীনদার মুত্তাকী হতে চান অথবা ইসলামের খেদমত করার প্রয়াস পান, তাদের জন্য একান্ত কর্তব্য হল উল্লিখিত বৈশষ্ট্য সমূহকে আঁকড়ে ধরা। মানুষের সাথে ভদ্র ও নম্র ব্যবহার করতে হবে। সত্য ও সুন্দর ভাষায় কথা বলতে হবে। এর ফলে মানুষের আমল সংশোধন ও গোনাহ মাফ হয়। (সূরা- ৩৩, আয়াত- ৭১)।

মূসা ও হারুন (আ.)কে ফিরআউনের কাছে পাঠানোর সময় তার সাথে নম্রভাবে কথা বলতে আল্লাহ তায়ালাই নির্দেশ দিয়েছেন (সূরা- ২০, আয়াত- ৪৪)।

হাদীসে সুন্দর কথা ও উত্তম ব্যবহারের জন্য রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অনেক উপদেশ দিয়েছেন। যেমন রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, জাহান্নামের আগুন থেকে বাঁচতে চেষ্টা কর, খেজুরের একটা টুকরো দিয়ে হলেও। তাও না পারলে অন্তত একটি উত্তম কথা বল। (বুখারী ও মুসলিম)।

এই পুরো বিষয়ের প্রতি আমাদের কিশোর ও যুব-তরুণদের বিশেষভাবে উৎসাহিত করতে হবে। কারণ, এই বয়সই রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের এসব গুরুত্বপূর্ণ গুণসমূহের অভ্যাস গড়ে তোলার প্রকৃত সময়। আজ তারাই হোক আমাদের অগ্রপথিক।

লেখক: প্রকাশক, উম্মাহ ২৪ডটকম এবং ব্যবস্থাপনা পরিচালক, আল বাশার ইন্টারন্যাশনাল, ঢাকা।

আরও পড়ুন- ‘হজ্বের তাৎপর্য ও শিক্ষা’