Home লাইফ স্টাইল সম্মান নিবেন সম্মান!

সম্মান নিবেন সম্মান!

|| নোমান মাহফুজ||

শিরোনাম দেখে অনেকেই আশ্চর্যান্বিত হতে পারেন, তবে বাস্তব! অদূর ভবিষ্যতে এমন হবে যে, মানুষজন বলে ফিরবে- সম্মান নিবেন, সম্মান! কেউ শুনবে না কথা। সবাই যার যার মতো করে চলতে থাকবে। কি সম্মান আর কি অসম্মান, তা বুঝতেই চাইবে না। আর এটা ক্বেয়ামতের অন্যতম এক আলামতও বটে!

এখনকার সময় পরিবার থেকে শুরু করে রাষ্ট্রিয় পর্যায়ে সম্মানের বালাই উঠে যাচ্ছে। যার ভুরি ভুরি প্রমাণ আমার প্রতিনিয়ত দেখেই যাচ্ছি। পিতা ছেলে, পিতা মেয়ে, মা ছেলে, মা মেয়ে, ভাই ভাই, ভাই বোন, স্বামী স্ত্রী, চাচা ভাতিজা, যুবক মুরব্বী, নেতা কর্মী, ছাত্র শিক্ষক, মেম্বার চেয়ারম্যান, মাতব্বর চেীকিদার ইত্যাদি সম্পর্কে এখন পরস্পরে অধিকাংশ সময় দেখা যায় শ্রদ্ধা সম্মানহীনতার তেলেসমাতি।

অথচ আজ থেকে প্রায় ১০/১৫ বছর পূর্বে মানুষে মানুষে যে শ্রদ্ধা সম্মানবোধ ছিলো তা এখন আর নেই। আগেকার দিনে আমরা যখন ছোট ছিলাম বড় কাউকে দেখলেই সালাম দিতাম, বড়রা একসাথে কোথাও বসলে চুপিসারে চলে যেতাম, তাদের সামনে বসতে ভয় কাজ করতো, আর এখনকার সময়ের ছেলেরা সালাম তো দুরে থাক, বড়দের সামনে তাদের চলাফেরা আর কথাবার্তা বলার ধরণ দেখলেই অকপটেই বুঝা যায় যে আমাদের এ সমাজ থেকে ধীরে ধীরে নৈতিকতা উঠে যাচ্ছে।

আর এ জন্য বর্তমান সময়ের ছেলেদেরকে শুধু দোষারুপ করা ঠিক হবে না, কারণ নৈতিকতা উঠে যাওয়ার পিছনে বড়দেরও চরম গাফিলতি রয়েছে। তাদের অনেককেও দেখেছি ছোট বড় ভেদ করে চলাফেরা বা কথাবার্তা বলেন না। যা নিতান্তই দুঃখজনক বটে! ছোটদের সামনে যাচ্ছে তাই চলন বলনে ব্যস্থ থাকেন। তাহলে কি শিখবে আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম।

অ’র গুণ নেই, ব’র গুণ আছে/শিঙা নেই, ডুগডুগি আছে। যার ব্যাখ্যা- অন্তরের গুণ নেই, বাইরে রঙের বাহার ও বাগাড়ম্বরের জোর বেশি।লেটোরে বলো না লেটো/উল্টো ধরবে চুলের মুঠো। যার ব্যাখ্যা- যার মান-সম্মানের বালাই নেই, তাকে অপমানসূচক কোনো কথা বললে নিজেই অপমানিত হতে হবে।

আমরা বেড়ে উঠার সময় দেখেছি অসৎ পথে উপার্জনকারীকে ঘৃণা করা হত, সামাজিক মর্যাদা ছিল না। আজ সে বালাই নেই। বিত্তের উৎস খুঁজে না কেউ। ধরেই নেয়া হয় বিত্তবানরা হবে সমাজপতি, দণ্ডমুণ্ডের কর্তা। সভার প্রথম চেয়ার দুর্বৃত্তের জন্য বরাদ্দ। অপরাধী অর্থের বিনিময়ে কিনে সম্মান, আমরা জয়ধ্বনি করি, তার দুর্নীতিকে উৎসাহিত করি।

আমরা জানি যে, মাছের পচন শুরু হয়, মাথা থেকে। আর রাষ্ট্রের পচন শুরু হয়, শিক্ষা ব্যবস্থা থেকে এবং শিক্ষা ব্যবস্থার পচন শুরু হয়, শিক্ষক থেকে। আমাদের দেশে এমন এক অপসংস্কৃতির সৃষ্টি হয়েছে যেখানে নৈতিকতা বলতে কিছু নেই। সমাজ, সংসার এবং দেশের সকল জায়গায় বিবেকের আজ বড়ই অভাব।

আল্লাহ তায়ালা আমাদেরকে সৃষ্টি করেছেন পৃথিবীর সেরা জীব হিসাবে। কিন্তু আমরা পৃথিবীর সেরা জীব হয়ে নিকৃষ্টতম কাজগুলা করতে দ্বিধাবোধ করি না। আসলে পৃথিবীর লোকজন আজ বড়ই স্বার্থপর হয়ে গেছে। নিজেকে ছাড়া কেউ কাউকে ভাবতে চায় না।

মানবিক গুণাবলির মধ্যে মানুষকে সম্মান প্রদর্শন করা একটি অন্যতম গুণ। সমাজে নিয়মশৃঙ্খলা, প্রেম-প্রীতি ও শ্রদ্ধা-সম্মানের এ মহৎ গুণের উসিলায় শান্তি নেমে আসে সমাজে। ইসলামে তাই অন্যের প্রতি সম্মান প্রদর্শনের ওপর গুরুত্বারোপ করা হয়েছে।

সৎ স্বভাব ও সৎ আচরণের মাধ্যমে আমরা এ গুণটি জীবনের প্রতিটি কর্মক্ষেত্রে ফুটিয়ে তুলতে পারি। পরিবারের সদস্য হিসেবে আদব রক্ষা করা যেমন সবার উচিত, তেমনি মর্যাদা-সম্মান প্রদর্শন করাও সবার কর্তব্য। মানুষের উত্তম স্বভাব ও শিষ্টাচার পার্থিব এবং পারলৌকিক জীবনে উপকারে আসে, পারস্পরিক সম্পর্ক ও শিষ্টতা নির্ভর করে মর্যাদা-সম্মান প্রদর্শনের ওপর।

পরিবারের ছোট-বড় সবাইকে নিয়ে আমরা বসবাস করি। পরস্পরের প্রতি সৌহার্দ্যবোধ ও মমতার বাঁধনে সংসার হয় সুখের। তাই সমাজ ও সংসারের আদব রক্ষার জন্য আমাদের সবার বয়োজ্যেষ্ঠদের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করা একান্ত কর্তব্য। আমাদের নবী করিম (সা.) বলেছেন, যারা বড়দের শ্রদ্ধা করে না এবং ছোটদের স্নেহ করে না, তারা আমার উম্মত নন।

তিনি আরও বলেছেন, যে যুবক কোনো বৃদ্ধের প্রতি তার বার্ধক্যের কারণে সম্মান প্রদর্শন করে, আল্লাহ তায়ালা সেই যুবকের শেষ বয়সে তার জন্য সম্মানকারী ব্যক্তি পয়দা করে দেবেন। সম্মানবোধের এ মহান বাণী আমরা মনে রেখে বলতে পারি, প্রত্যেক ব্যক্তির পদমর্যাদা অনুযায়ী মর্যাদা দেয়া, বয়োবৃদ্ধকে পিতার মতো সম্মান দেখানো এবং ছোটদের পুত্রের মতো স্নেহ করা মানবিক মূল্যবোধের পরিচয় বহন করে।

এ সম্পর্কে রাসূল (সা.) আরও বলেছেন, ‘তিনটি বিষয় দিয়ে মানুষের পারস্পরিক সম্পর্ক উন্নত ও মজবুত হয়। তাহল কারও সঙ্গে সাক্ষাৎ হলেই সালাম দেবে। মজলিসে এলে বসার স্থান দেবে এবং তিনি যে নামে সম্বোধন করলে খুশি হন, সেই নামে সম্বোধন করবে। বয়োজ্যেষ্ঠদের সম্মান প্রদর্শনের পাশাপাশি চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য ফুটিয়ে তোলার জন্য সবার সঙ্গে বিনম্র ব্যবহার ও সদালাপি হতে হবে।

নবী করিম (সা.) এই রকম আচরণকারীর জন্য দোযখ থেকে নাজাত পাওয়ার এবং আল্লাহর বন্ধুত্ব লাভের সুসংবাদ দিয়েছেন। একবার এক সম্মানিত ব্যক্তি তার কাছে এলে তিনি নিজে চাদর বিছিয়ে দিয়ে বলেছেন, ‘তোমাদের কাছে যে কোনো সম্প্রদায়ের লোক এলে তাকে সম্মান করো। সম্মান করা ঈমানের জন্য অত্যাবশ্যক।’

সত্যিকারভাবে মানুষের মর্যাদা নির্ভর করে সম্মান প্রদর্শনের ওপর। সুন্দর চেহারা উত্তম পরিচ্ছদ পরিধানকারী অধিক মর্যাদা দেয়া বা সমাদর করা এ বিধান ইসলামের কোথাও নেই। হজরত নবী করিম (সা.) বিদায় হজের খুতবায় বলেছেন, যে কোনো আরববাসী কোনো অনারব বা আজমি লোকের তুলনায় এতটুকুই শ্রেষ্ঠ নয়। কৃষ্ণকায় ব্যক্তি, শ্বেতকায় ব্যক্তি কৃষ্ণকার অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ নয়।

মানবিক মূল্যবোধের কারণে আমাদের সবাইকে সম্মান প্রদর্শন করতে হবে। আমরা ব্যক্তি, সামাজিক এবং রাষ্ট্রীয় জীবনের প্রতিটি কাজকর্ম জাতি, ধর্ম, নির্বিশেষে সবার মধ্যে পারস্পরিক সম্মান প্রদর্শন করে একে অপরের প্রতি শ্রদ্ধা, মর্যাদা ও সম্মান বোধের দৃষ্টান্ত স্থাপন করে যেন এক পরিপূর্ণ ভালোবাসার বেহেশতি জগৎ গড়ে তুলতে পারি। আল্লাহ আমাদের তৌফিক দিন।রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, “তুমি কারোর কোনো ধরনের ক্ষতি করো না। তেমনিভাবে তোমরা পরস্পর একে অপরের ক্ষতি করার প্রতিযোগিতা করো না।’’ (ইবন মাযাহ : ২৩৬৯, ২৩৭০)।

আবু সিরমাহ রাদিআল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, “যে ব্যক্তি অন্যের ক্ষতি করতে চায়, আল্লাহ তায়ালা তার ক্ষতি করেন। তেমনিভাবে যে ব্যক্তি অন্যের উপর কঠিন হয় আল্লাহ তায়ালাও তার উপর কঠিন হন।’’ (ইবন মাযাহ : ২৩৭১)।

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, “তোমরা অবশ্যই ধারণা থেকে বেঁচে থাক। কেননা ধারণা সবচেয়ে বড় মিথ্যা কথা। কারো দোষ খুঁজে বেড়িও না, গোয়েন্দাগিরিতে লিপ্ত হয়ো না এবং (বেচা-কেনায়) একে অপরেরকে ধোঁকা দিয়ো না। পরস্পরে হিংসা করো না, একে অন্যের প্রতি বিদ্বেষ ভাব রেখো না, একজন থেকে আর একজন বিচ্ছিন্ন হয়ে যেও না। বরং সবাই এক আল্লাহর বান্দা হয়ে ভাই ভাই হয়ে যাও।’’ (বুখারী, হা/৬০৬৬)।

সম্মান তাদের প্রাপ্য, যারা কখনো সত্যকে পরিত্যাগ করে না, এমনকি যখন পরিস্থিতি অন্ধকারচ্ছন্ন এবং বেদনাদায়ক..! পবিত্র কোরানে ইরশাদ হচ্ছে, হে মুমিনগণ! কোনো পুরুষ যেন অপর পুরুষকে উপহাস না করে। কারণ যাকে উপহাস করা হয়, সে উপহাসকারী অপেক্ষা উত্তম হতে পারে। তেমনিভাবে কোনো নারীও যেন অপর নারীকে উপহাস না করে। কারণ, সে উপহাসকারী অপেক্ষা উত্তম হতে পারে। তোমরা একে অপরের প্রতি দোষারোপ কর না। একে অপরকে মন্দ নামে ডেক না। কারণ, ইমানের পর মন্দ নাম অতি মন্দ।

যারা তওবা না করে তারাই জালিম। অহেতুক প্রকাশ্যে-অপ্রকাশ্যে মানুষকে খাটো করি, যা আদৌ উচিত নয়। ইসলামে এসব কাজ সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। সমালোচনার ঝড় তুলে তীব্র বাক্যালাপে প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করাকে নিষেধ করেছে ইসলাম। ব্যক্তি, সামাজিক, রাজনৈতিক ও আন্তর্জাতিক জীবনে মানুষের প্রতিপক্ষ থাকতেই পারে। চলতেই পারে পারস্পরিক বিরোধ। তাই বলে একে অন্যকে এমন ভাষায় বা এমন বাক্যবাণে জর্জরিত করা যাবে না, যা দ্বারা তার মানহানি ঘটে।

এমন বক্তব্য দেয়া যাবে না, যার কারণে জনসমক্ষে বেইজ্জতি হতে হয়। হাদিসে এসেছে, যে ব্যক্তি দুনিয়াতে অন্য ভাইয়ের দোষ গোপন করবে, মানুষের কাছে প্রকাশ করবে না, আল্লাহ তায়ালাও তার সব দোষত্রুটি কিয়ামতের দিন প্রকাশ করবেন না। নবিজি (সা.) বলেছেন, যে ছোটদের স্নেহ করে না, বড়কে শ্রদ্ধা করে না, সে আমার উম্মতের অন্তর্ভুক্ত নয়।

আল্লাহ আমাদের সবাইকে ইসলামে দিক-নিদের্শনা মেনে আদর্শ জীবন প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে মানুষকে সম্মান করার তাওফিক দান করুন। আমিন।

লেখক: সাধারণ সম্পাদক, গোলাপগঞ্জ সাংবাদিক কল্যাণ সমিতি, সিলেট। মোবাইল- ০১৭৮৯-২২৫৪৪৬