Home শিক্ষা ও সাহিত্য ছাত্রদের প্রতি হযরত মুফতী মাহমূদ গাঙ্গুহী (রাহ.)এর ১২টি মূল্যবান উপদেশ

ছাত্রদের প্রতি হযরত মুফতী মাহমূদ গাঙ্গুহী (রাহ.)এর ১২টি মূল্যবান উপদেশ

।। আল্লামা হাফেজ নাজমুল হাসান কাসেমী ।।

আমার সম্মানিত প্রাণপ্রিয় ভাইয়েরা! আপনারা জনেন যে, দুনিয়ার সামান্য সামান্য জিনিসও শরীয়ত এবং আদবের অনুসরণ ব্যতীত অর্জন হয় না। তাহলে ভাবার বিষয় যে, ইলমের মত উচ্চমর্যাদা সম্পন্ন একটি সম্পদ (যা আল্লাহ্ তায়ালার গুণাবলীর একটি এবং আল্লাহর নূর) ইহা শরীয়তের পাবন্দী ও আদবের অনুসরণ ছাড়া কীভাবে অর্জন হবে? নিঃসন্দেহে এর জন্যও কিছু আদব রয়েছে। আর আমাদের আকাবিরগণ তো ইলম হাসিলের জন্য অনেক বড় বড় চেষ্টা মেহনত করেছেন।

আমাদের ধারণা এবং কল্পনার বাহিরে কষ্ট সহ্য করেছেন। তাদের উপর অগণিত শর্ত এবং আদব প্রবর্তীত ছিল। কিন্তু এখন আমরাতো দুর্বল হয়ে গিয়েছি। আমাদের দুর্বলতা এবং অলসতা ব্যাপক থেকে ব্যাপকতর হচ্ছে। এই জন্য হযরত (রাহ.) ছাত্রদের সহজের জন্য শুধুমাত্র ১২টি শর্ত এবং আদব সংকলন করেছেন এবং এর নাম দিয়েছেন “هدايات إثنا عشريه برائے طلبه”। করুণাময় ও দয়ালূ আল্লাহ্ তায়ালার কাছে অতি প্রত্যাশা যে, এই সমস্ত আদবের অনুসরণ আমাদের সকলকে ইলমে নাফে’ ও এর বরকত অর্জনে সাহায্য করবে।

হযরত মুফতী মাহমূদ গাঙ্গুহী (রাহ.)এর ১২টি মূল্যবান উপদেশ

১) সঠিক নিয়্যাত: নিয়্যাত ঠিক করা অর্থাৎ দ্বীনের প্রজ্ঞা এবং হালাল হারামকে চিনতে ও নির্ণয় করার জ্ঞান অর্জন করা। যেন এর উপর আমল করে আত্মশুদ্ধি এবং আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জিত হয় এবং আমৃত্যু এর উপর দৃঢ় থাকা।

২) সংযমশীলতা এবং খোদাভীতি: অর্থাৎ সংযমশীলতার সাথে জ্ঞান অর্জন করা। তা’লীমুল মুতাআল্লীমে একটি হাদীস বর্ণনা করা হয়েছে, যে খোদাভীতির সাথে ইলম অর্জন করবে না আল্লাহ তায়ালা তাকে তিনটি শাস্তির যে কোন একটি দিবেন। ক) যুবক অবস্থায় মৃত্যুবরণ করবে। খ) আল্লাহ তায়ালা তাকে কোন রাজার গোলামিতে লাগিয়ে দিবেন। গ) তার বসবাসের জন্য এমন স্থান নির্দিষ্ট করবেন যেখানে তার ইলম থেকে উপকৃত হওয়ার কোন লোক থাকবে না।

৩) আল্লাহর হুকুম-আহকাম অনুযায়ী আমল: অর্থাৎ- ফরয, ওয়াজিব সমূহের পাবন্দী। সুন্নাত ও আদবের শেষ স্তর পর্যন্ত অনুসরণ এবং সিলেবাসভুক্ত বিষয়গুলোর উপর গুরুত্বারোপ করা।

৪) ইলমের জন্য প্রতিবন্ধক বিষয়গুলোকে পরিহার করা: ইলমের প্রতিবন্ধক মোটামুটি এই কয়টি- ক) ছোট-বড় সর্বপ্রকারের গুনাহ্ থেকে বেঁচে থাকা। বিশেষভাবে চোখ, লজ্জাস্থান এবং যবানের গুনাহ্ অর্থাৎ কু-দৃষ্টি, খারাপ কথা ও অবৈধ চাহিদা থেকে বেঁচে থাকা। বিশেষভাবে সুন্দর চেহারার অধিকারী শ্মশ্রুবিহীন বালকের প্রতি বদনযর করা অত্যন্ত ক্ষতিকর। (জাতির কর্ণধার হযরত মাওলানা আব্দুল্লাহ কাপুদরুয়ী (দা.বা.) শুনলেন যে, মাওলানা মাসীহুল্লাহ (রাহ.)এর খলীফা হাজী মোহাম্মদ ফারুক সাহেব (রাহ.) একবার বললেন, হযরত মাওলানা মাসীহুল্লাহ খাঁ সাহেব বলতেন যে, মৌলবী সাহেব! বাচ্চাদের থেকে বেঁচে থাকো। খ) গাঢ় সম্পর্ক অর্থাৎ বেশি বন্ধুত্ব। গ) বিয়ে। আমাদের হযরত ফকীহুল উম্মত (রাহ.)এর প্রসিদ্ধ বর্ণনা-

لِكُلِّ شيئٍ افَةٌ، ولِلعِلمِ آفاةٌ، أولها التزوج (مكتوبات فقيه الامت)

“প্রত্যেক বিষয়ের জন্য একটি প্রতিবন্ধক থাকে, আর ইলমের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধক থাকে অনেক। এর মাঝে সর্বপ্রথমটি হল বিবাহ।” এই জন্য আকাবিররা ছাত্রদের ছাত্র যামানায় বিবাহ থেকে বিরত থাকার নির্দেশ দিয়েছেন। ঘ) অসৎ সঙ্গ: এমন ছাত্রদের সাথে উঠা-বসা করা, যে ইলম অর্জনে মেহনত করার পরিবর্তে বেপরোয়াভাবে চলা-ফেরা করে। ঙ) ভুল এবং খারাপ পরিবেশ। চ) হারাম এবং সন্দেহযুক্ত খাবার গ্রহণ। ছ) অনর্থক এবং অপ্রয়োজনীয় কাজে শামীল হওয়া। আমাদের এই সমস্ত অনর্থক বিষয় থেকে নিজেদের সম্পূর্ণ হিফাজত করা জরুরী।

৫) পড়া-শোনায় কঠোর পরিশ্রমের প্রতি মনোযোগ দেয়া: কেউ কেউ বলেন- العلم لا يعطيك بعضه حتى تعطيك كلك “নিজেকে সম্পূর্ণ ইলমের জন্য বিলিয়ে দেয়া ব্যতীত ইলম তার সামান্য অংশও তোমাকে দিবে না।”

৬) উস্তাদের সাথে আত্মিক সম্পর্ক গড়ে তোলা: এর দুটি আলামত রয়েছে- ক) পরিপূর্ণ আদব এবং সম্মান করা: কিছু কিছু ছাত্ররা উস্তাদের সামনে এবং পিছনেও খুব ‘জ্বী হুজুর’ ‘জ্বী হুজুর’ করে। ভালো ভালো কথা বলে। জুতা সোজা করে দেয়। কিন্তু উস্তাদের নিকট থেকে সামান্য একটু দূরে সরা মাত্রই হাত ঝেড়ে ফেলে দেয়। এরা খুব বেশি বিপদজনক। খ) অন্তরে উস্তাদের খিদমতের প্রকৃত আশা লালন। কিন্তু কখনো খিদমতের সুযোগ হয়নি। আদবের উদ্দেশ্য হল উস্তাদের অধিকারের প্রতি লক্ষ্য রাখা। এবং খিদমতের উদ্দেশ্যে উস্তাদকে শান্তি দেয়া, তৃপ্তি দান করা।

৭) ইলমের উপকরণগুলোর পরিপূর্ণ সম্মান: অর্থাৎ কিতাব, টেবিল, ক্লাসরুম, কাগজ, কলম, সহপাঠী, মাদরাসার সাথে সম্পর্কিত সকল বিষয়ের সম্মান, এমনকি খানা পাকানেওয়ালা বাবুর্চী, সাফ-সুতরার জন্য নির্দিষ্ট কর্মচারী এমনকি মাদরাসার দারওয়ানের সম্মানও ইলম অর্জনের জন্য সাহায্যকারী হয়। স্বরণ রাখো! ইলম অর্জনের উপায় সমূহের মাঝে আসল বিষয় হল সম্মান। ইলম এবং তার সাথে সম্পর্কিত সকল বিষয়ের সম্মান করবে। তাহলে ইলম অর্জন হবে। এর মাঝে উন্নতি রয়েছে। ইমাম আবু হানীফা (রাহ.) ইরশাদ করেন-

(لِكُلِّ شيئٍ افَةٌ، ولِلعِلمِ آفاةٌ، أولها التزوج (مكتوبات فقيه الامت قسط

“যার ইলম অর্জন হয়েছে, সম্মান করার কারণেই যেন তা অর্জন হয়েছে। আর যে এই রাস্তা থেকে ঝরে পড়েছে, সে যেন সম্মান না করার কারণেই ঝরে পড়েছে”।

৮) মাদরাসার নিয়ম-শৃঙ্খলার পাবন্দী: বিশেষভাবে সময়ের হিফাজতের ব্যাপারে প্রসিদ্ধ রয়েছে। الوقت اثمن من الذهاب “সময় স্বর্ণের চেয়ে বেশি দামী” একবার অতিক্রান্ত হলে আর ফিরে আসে না। খাজা মাহ্যুব কী সুন্দর করে বলেছেন-

هو رهى هے عمر مثل  برف كم  – چپکے چپکے رفته رفته دم بدم

জীবনটা ফুরিয়ে যাচ্ছে ধীরে ধীরে বরফ যেমন যায় কমে / চুপে চুপে আস্তে আস্তে মোর প্রতিটি দমে দমে।

৯) আকার-আকৃতি বিশূদ্ধকরণ: অর্থাৎ উলামায়ে কেরামের এবং সৎ লোকদের অনুসরণ বিশেষ করে নিজের আকাবিরদের মত পোষাক পরিধান করবে। দাড়ি সুন্নাত অনুযায়ী রাখবে। মাসে কিংবা দেড় মাসে একবার মাথা কামাবে। ছাত্রদের মাথার চুল সুন্নাত অনুযায়ী রাখা চাই। এতটুকু মনে রেখো যে, চুলের হিফাজত এবং এর রক্ষণা-বেক্ষণ করা এতো সহজ নয়। অনেক কঠিন এবং সময়ের প্রয়োজন। এই জন্য ছাত্রদের জন্য হলক্বের সুন্নাতের উপর আমল করাই উত্তম। যেন আকাবিরদের সুন্নাতকে বেশি করে আঁকড়ে ধরা যায়।

১০) ফলদায়ক ইলম অর্জনের জন্য দোয়ার প্রয়োজন: কুরআনের কারীমে স্বয়ং নবী কারীম (সা.)কেই অধিক ইলম অর্জনের জন্য দোয়া করতে বলা হয়েছে- وَقُلْ رَّبِّ زِدْنِىْ عِلْمًا। তাই রাসূল (সা.) কখনো এই আদেশের উপর আমল করতে গিয়ে এই দোয়া করেছেন- اللهم إنى اسألك علما نافعا “হে আল্লাহ! আমাকে উপকারী ইলম দান করুন।” এবং কখনো এই দোয়া করতেন- اللّهم إنى أعوذبك من علم لا ينفع “হে আল্লাহ! আমি অনুপকারী জ্ঞান থেকে আপনার নিকট পানাহ্ চাই। এর থেকে আমাদের হিফাজত করুন।

১১) কিতাবের লেখকদের জন্য ঈসালে সওয়াবের প্রতি গুরুত্ব: যে কোন বই শুরু করলে বা শেষ করলে সে কিতাবের লেখকের জন্য কুরআন পড়ে তাসবিহাত ও যিকির-আযকার ইত্যাদি আমল করে সাওয়াব পাঠাবে; যেন তার রূহানী বরকত অর্জন হয়। এবং তার অন্তর আমাদের দিকে মনোযোগী হয়। তবে শর্ত হল, লেখক খাঁটি ঈমানদ্বার হতে হবে।

১২) উলামা-মাশায়েখদের সাথে রূহানী সম্পর্ক সৃষ্টি করা: কেননা এটা ব্যতীত ইলম অর্জন এবং আমল করার স্বাদ পাওয়া মুশকিল। কথিত আছে, আগের আকাবিরগণ ছাত্রদের বাইয়াত করতেন না। যেন তার পূর্ণ সময় পড়া-লেখায় ব্যয় হয়। ঐসমস্ত বুযুর্গানে দ্বীন ছাত্রদের ওযীফা আদায় করাকে ইলমের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধক মনে করতেন।

শাইখুল ইসলাম হুসাইন আহ্মদ মাদানী (রাহ.) সারাজীবন এই কঠিন নিয়মের উপরই আমল করেছেন। কোন ছাত্রকেই ফারেগ হওয়ার পূর্বে বাইয়াত করতেন না। কিন্তু এখনকার ছাত্ররা যেহেতু নানা রকম ব্যস্ততায় নিজেদের মূল্যবান সময় নষ্ট করে থাকে, তখন পরবর্তী আকাবিররা পদ্ধতি পরিবর্তন করে দিলেন। আমাদের হযরত বলেন, ছাত্ররা কোন কামেল শায়খের হাতে যেন বাইয়াত হয়ে যায়। এবং তার হিদায়াত অনুযায়ী নিজের জীবন পরিচালনা করে। যেন নিজের মূল্যবান সময়কে এদিক-সেদিকের অনর্থক কাজে ব্যয় না করে ওযীফা আদায়ে ব্যয় করে।

তাহলে অন্তরের মাঝে ইলমী একাগ্রতা এবং আল্লাহ্ ও আল্লাহর রাসূলের মোহাব্বতের প্রেরণা সৃষ্টি হবে। যদি কোন কারণ বশতঃ কামেল শায়খের সাথে সম্পর্ক না  হয় তাহলে আকাবিরগণের জীবনী এবং তাদের লিখিত কিতাবাদী মুতাআলা করবে। ইন্শাআল্লাহ্! আখেরাতের চিন্তা এবং আত্মশূদ্ধির প্রেরণা অন্তরে সৃষ্টি হবে। এবং আশা করা যায় যে ঈমান-আমল নিরাপদ থাকবে। নবুয়াতের সত্যিকারের যোগ্য ওয়ারিশ হওয়ার সৌভাগ্যে ধন্য হতে পারবে। আল্লাহ্ তায়ালা সকলকে আমল করার তাওফীক্ব দান করুন। আমিন।

সতর্কবাণী: সর্বশেষ একটি গুরুত্বপূর্ণ আরজ এই যে, ছাত্ররা অবসর সময়ে আকাবিরদের কিতাবাদী মনোযোগ সহকারে মুতালা করবে। কেননা আকাবিরদের কিতাবগুলো তাদের সোহবতের স্থলাভিষিক্ত হয়ে থাকে। আশা করি যে, এই হিদায়াতগুলোর উপর আমল করার পরিপূর্ণ চেষ্টা করবে। আল্লাহ্ তায়ালা আমাদের সকলকে আমল করার তৌফিক দান করুন। আমিন।