Home ধর্মতত্ত্ব ও দর্শন হিংসা এক কঠিন আত্মব্যাধি, হিংসা মনের শান্তি বিনষ্ট করে দেয়

হিংসা এক কঠিন আত্মব্যাধি, হিংসা মনের শান্তি বিনষ্ট করে দেয়

।। মুফতি আহমদ মফিজ ।।

 হে আদম সন্তান! তুমি তোমার মুসলিম ভাইয়ের সঙ্গে কেন হিংসা করছ? তুমি যার সঙ্গে হিংসা করছ, তার প্রতি আল্লাহ তায়ালা যেসব নিয়ামত দান করেছেন, তা যদি তার প্রতি আল্লাহ তায়ালার অনুগ্রহ হয়ে থাকে তাহলে তুমি এমন ব্যক্তির সঙ্গে হিংসা করছ, যাকে আল্লাহ তায়ালা ধনসম্পদ, ইজ্জত-সম্মান, প্রভাব-প্রতিপত্তি দিতে চাচ্ছেন।

হিংসা এক কঠিন আত্মব্যাধি। যে ব্যক্তি এ ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে পড়ে, তার ইহজীবনের সুখ-শান্তি, পরকালের মুক্তির প্রত্যাশা সবই নিষ্ফল হয়ে যায়। মানুষের প্রতিটি পাপের শাস্তি প্রদানের জন্য আল্লাহ তায়ালা একটি সময় নির্দিষ্ট করে রেখেছেন, যে সময় পাপী  তার কৃত পাপের শাস্তি ভোগ করবে। কিন্তু হিংসা এমনই এক পাপ, যে পাপের শাস্তি হিংসুক তাৎক্ষণিকভাবে ভোগ করতে থাকে। কেননা হিংসুক যাদের সঙ্গে হিংসা করে, যখন দেখে তার প্রত্যাশা অনুযায়ী তাদের ক্ষতি হয় না তখন সে এ ব্যাপারে রাত-দিন মর্মজ্বালা ভোগ করতে থাকে। হিংসার আগুনে জ্বলেপুড়ে মরতে থাকে। এ হচ্ছে হিংসুকের দুনিয়াবি শাস্তি। আর তার পরকালীন শাস্তি যে কত কঠিন হবে, কত ভয়াবহ হবে, তা বলারই অপেক্ষা রাখে না। 

হিংসা-বিদ্বেষ দ্বারা হিংসুকের হৃদয়ে এমন অগ্নি প্রজ্বলিত হয়, যা হিংসুকের জীবনের সব নেক আমল জ্বালিয়ে ভস্মীভূত করে দেয়। এ সম্পর্কে রাসুল (সা.) ইরশাদ করেন, আগুন যেমন কষ্টকে জ্বালিয়ে ভস্মীভূত করে দেয়, তেমনি হিংসাও মানুষের নেক আমল জ্বালিয়ে ভস্মীভূত করে দেয়। (আবু দাউদ : ৪৯০৫)। 

রাসুল (সা.) হিংসাকে আগুনের সঙ্গে তুলনা করেছেন। এর তাৎপর্য হচ্ছে, আগুন প্রজ্বলিত হলে যেমন তা সব কিছু জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে নিশ্চিহ্ন করে দেয়, তেমন হিংসাও মানুষের সব নেক আমল জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে নিশ্চিহ্ন করে দেয়। আগুনের লেলিহান শিখা জ্বালানোর মতো কিছু না পেলে যেমন নিজেই নিজেকে দগ্ধ করে এক সময় নিভে যায়, তেমনি হিংসুকও কারও ক্ষতি করতে না পারলে নিজেই নিজের হিংসার আগুনে জ্বলে দগ্ধ হয়ে এক সময় মনের অশান্তিতে মৃত্যু বরণ করে।

অনুরূপভাবে হিংসা হচ্ছে এক ব্যাধি যা পূর্ববর্তী জাতি থেকে এ জাতির মধ্যে সংক্রমিত হয়েছে। এ সম্পর্কে হজরত জুবায়ের ইবনে আওয়াম (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) এরশাদ করেন, ‘তোমাদের পূর্ববর্তীদের মধ্যে যে ব্যাধি সংক্রমিত হয়েছে, তা হচ্ছে হিংসা-বিদ্বেষ, যা মু-নকারী। আমি এ কথা বলি না যে, মাথা মু-ন করে বরং তা দ্বীন-ধর্ম মু-ন করে দেয়। ওই সত্তার কসম যার হাতে আমি মুহাম্মদের জান, তোমরা ততক্ষণ পর্যন্ত জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে না যতক্ষণ না তোমরা মোমিন হও! আর তোমরা ততক্ষণ পর্যন্ত মোমিন হতে পারবে না যতক্ষণ না তোমরা পরস্পরকে ভালোবাস। আমি কি তোমাদের ওই বিষয় সম্পর্কে অবগত করব না? যা তোমাদের পরস্পরের মাঝে ভালোবাসা সৃষ্টি করবে, তা হচ্ছে তোমাদের পরস্পরের মাঝে সালামের প্রসার ঘটানো।’ (মুসনাদে আহমদ : ১৪৩০)।

হিংসার তাৎপর্য বর্ণনা করে হাসান বসরি (রহ.) বলেন, হে আদম সন্তান! তুমি তোমার মুসলিম ভাইয়ের সঙ্গে কেন হিংসা করছ? তুমি যার সঙ্গে হিংসা করছ, তার প্রতি আল্লাহ তায়ালা যেসব নেয়ামত দান করেছেন, তা যদি তার প্রতি আল্লাহ তায়ালার অনুগ্রহ হয়ে থাকে তাহলে তুমি এমন ব্যক্তির সঙ্গে হিংসা করছ, যাকে আল্লাহ তায়ালা ধন-সম্পদ, ইজ্জত-সম্মান, প্রভাব-পতিপত্তি দিতে চাচ্ছেন। আর আল্লাহ তায়ালা যদি কাউকে ধনসম্পদ প্রভাব-প্রতিপত্তি দিতে চান তাহলে তুমি তাতে বাধা দেয়ার কে? আর তুমি যার সঙ্গে হিংসা করছ তাকে আল্লাহ তায়ালা যে ধনসম্পদ, পদমর্যাদা দান করছেন, তা যদি তার প্রতি আল্লাহ তায়ালার অনুগ্রহ না হয়ে থাকে বরং তার প্রতি তা আল্লাহ তায়ালার অভিসম্পাত হয়ে থাকে, তাহলে তুমি জাহান্নামে যাওয়ার ব্যাপারে ওই ব্যক্তির সঙ্গে কেন হিংসা করছ!

হিংসা দুই ধরনের। ১. প্রকৃত হিংসা, কারও নেয়ামত চলে যাওয়ার কামনা করা। এটা সর্বসম্মতিক্রমে হারাম। ২. রূপক হিংসা অর্থাৎ কারও প্রতি কোনো নিয়ামত দেখে এ কামনা করা যে, তাকে আল্লাহ তায়ালা যে নিয়ামত দিয়েছেন, তার নেয়ামত ঠিক থাকুক; কিন্তু আমাকেও আল্লাহ তায়ালা সে নেয়ামত দান করুক। এটা যদি দুনিয়াবি বস্তুর ক্ষেত্রে হয় তাহলে বৈধ। আর যদি আল্লাহ তায়ালার আনুগত্যের ক্ষেত্রে হয় তাহলে মুসতাহাব বা উত্তম। 

সর্বপ্রথম ইবলিস শয়তান হিংসার সূচনা করেছে। আল্লাহ তায়ালা যখন আদম (আ.) কে সৃষ্টি করে তার খেলাফত তথা প্রতিনিধিত্বের মর্যদায় ভূষিত করেন, তখন ইবলিস শয়তান এ মর্যাদার অধিকারী হতে পারেনি বলে বনি আদমের সঙ্গে হিংসা করতে শুরু করে। তাই আল্লাহ তায়ালা যখন আদম (আ.) কে সেজদা করার নির্দেশ দেন তখন সে আদম (আ.) এর প্রতি আক্রোশে ফেটে পড়ে এবং আল্লাহ তায়ালার নির্দেশ অমান্য করে আদম (আ.) কে সেজদা করা থেকে বিরত থাকে। অতঃপর আল্লাহ তায়ালা তাকে লাঞ্ছিত, অপদস্থ করে জান্নাত থেকে বের করে দেন। তাই শয়তান আজ পর্যন্ত বনি আদমের অন্তরে হিংসা-বিদ্বেষের বিষবাষ্প ছড়ানোর সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।