।। মাওলানা সাকিব আমজাদ জমিরী ।।
কথিত ঈদে মিলাদুন্নবী কি সত্যিই ইসলামের অংশ? এই প্রশ্নটি নিয়ে মুসলিম সমাজে বহু বিতর্ক বিদ্যমান। প্রচলিত জশনে জুলুস ও মিলাদুন্নবীর আয়োজনকে যারা শরীয়তের অংশ মনে করেন, তাদের প্রতি সম্মান রেখেও এই প্রশ্নটি করা জরুরি যে, এমন উদযাপনের ভিত্তি কি কোরআন, হাদিস, ইজমা নাকি কিয়াস?
হযরত রাসূলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেছেন, “যে আমাদের এই দ্বীনের মাঝে এমন কোনো বিষয় উদ্ভাবন করবে, যা এর মধ্যে নেই; তা প্রত্যাখ্যাত।” (সহীহ মুসলিম – ১৭১৮)।
এই হাদিসের ব্যাখ্যায় আলেমরা বলেন, কোনো আমল বা বিষয় শরিয়তের অন্তর্ভুক্ত হতে হলে তা অবশ্যই কোরআন, হাদিস, ইজমা অথবা কিয়াসের মাধ্যমে প্রমাণিত হতে হবে। অন্যথায়, তা বাতিল বা প্রত্যাখ্যাত বলে গণ্য হবে।
আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, ইসলামের প্রথম তিন স্বর্ণযুগ—সাহাবি, তাবেঈ এবং তাবে-তাবেঈদের যুগে কোনো আমল প্রচলিত ছিল কি না। এই তিন যুগের কোনো এক যুগে যদি কোনো আমল প্রমাণিত না হয়, তবে তা পরবর্তীকালে উত্তম বা সাওয়াবের কাজ হিসেবে গণ্য হতে পারে না।
কিন্তু প্রচলিত কথিত মিলাদুন্নবীর আয়োজন কি সাহাবী, তাবেঈ বা তাবে-তাবেঈদের যুগে প্রচলিত ছিল? ইতিহাসের পাতা থেকে জানা যায়, খোলাফায়ে রাশেদার ৩০ বছরে, এমনকি ১১০ হিজরি পর্যন্ত সাহাবিদের যুগেও মিলাদ মাহফিলের কোনো অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি। ১৭০ হিজরি পর্যন্ত তাবেঈদের যুগেও এর কোনো প্রমাণ নেই, এমনকি ২২০ হিজরি পর্যন্ত তাবে-তাবেঈদের যুগেও এর প্রচলন দেখা যায় না।
আরও পড়তে পারেন-
- আদর্শ সমাজ বিনির্মাণে ইসলামের ভূমিকা
- সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি যেন হুমকির মুখে না পড়ে
- সমৃদ্ধ জাতি নির্মাণে দরকার বুদ্ধিবৃত্তিক জাগরণ ও আলেমদের এগিয়ে আসা
- সালাম-কালামের আদব-কায়দা
- বিবি খাদিজা (রাযি.): ইসলাম ধর্মের ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ নারী
যদি সাহাবিদের নবীপ্রেমের কথা বলি, তবে তা ছিল নজিরবিহীন। তারা রসুল (সা.)-এর জন্য নিজেদের জীবন, সম্পদ, এমনকি পরিবারকেও উৎসর্গ করতে প্রস্তুত ছিলেন। রাসূলুল্লাহ (সা.)কে ভালোবাসা ও সম্মান প্রদর্শনের জন্য এর চেয়ে বড় কোনো উদাহরণ হতে পারে না। অথচ এমন গভীর ভালোবাসা থাকা সত্ত্বেও তারা মিলাদুন্নবীর মতো কোনো অনুষ্ঠানের আয়োজন করেননি।
চার মাজহাবের ইমামগণ এবং সিহাহ সিত্তার ইমামগণের জীবনীতেও মিলাদের কোনো উল্লেখ পাওয়া যায় না। এমনকি মুসলিম বিশ্বের অন্যতম সম্মানিত পীর শায়খ আবদুল কাদের জিলানি (রহ.) (মৃত্যু: ৫৬১ হি.) এবং খাজা মুঈনুদ্দিন চিশতি আজমিরি (রহ.) (মৃত্যু: ৬৩২ হি.)-এর মতো যুগবরণ্য সুফি সাধকরাও মিলাদ মাহফিলের প্রচলন করেননি। তাদের মাধ্যমে যে নবীপ্রেমের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপিত হয়েছিল, তা ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা আছে।
তাহলে যে কাজ সাহাবি, তাবেঈ এবং তাবে-তাবেঈদের যুগে সাওয়াবের কাজ হিসেবে গণ্য হয়নি, তা আজ কীভাবে অসীম বরকতের কাজ হতে পারে? এই মৌলিক প্রশ্নটি নিয়ে গভীরভাবে চিন্তা করলে এটি পরিষ্কার হয়ে যায় যে, প্রচলিত এসব আচার-অনুষ্ঠান কি সত্যিই সুন্নাত ও নবীপ্রেমের কাজ, নাকি বিদআত এবং রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর অসন্তুষ্টির কারণ?
যদি কেউ কোরআন, হাদিস বা ইসলামের প্রথম তিন স্বর্ণযুগের কোনো নির্ভরযোগ্য সূত্র থেকে এই মিলাদের প্রচলন প্রমাণ করতে পারেন, তবে আমরাও তাদের সঙ্গে একমত হতে বাধ্য হব। কিন্তু কিয়ামত পর্যন্ত এমন কোনো প্রমাণ কারো পক্ষে পেশ করা সম্ভব হবে না।
তাই, আমাদের উচিত ইসলামকে তার মৌলিক রূপে অনুসরণ করা এবং এমন কোনো আমল থেকে বিরত থাকা, যার ভিত্তি কোরআন ও হাদিসে নেই।
লেখক: শিক্ষক, আল জামিয়াতুল আহলিয়া দারুল উলুম মুঈনুল ইসলাম, হাটহাজারী
উম্মাহ২৪ডটকম:আইএএ