Home ধর্মতত্ত্ব ও দর্শন আল্লাহর সিফাত: আসমান থেকে জমিন পর্যন্ত: জুমার বয়ান

আল্লাহর সিফাত: আসমান থেকে জমিন পর্যন্ত: জুমার বয়ান

[রাজধানীর অন্যতম বিখ্যাত দ্বীনি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান উত্তরা জামেয়াতুন নূর আল-কাসেমিয়ার প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক ও উত্তরা ১২নং সেক্টর বায়তুন নূর জামে মসজিদের খতীব, নমুনায়ে কাসেমী আল্লামা হাফেজ নাজমুল হাসান কাসেমী শুক্রবার (৮ আগস্ট) জুমায় মুসল্লীদের উদ্দেশ্যে ‘আল্লাহর সিফাত: আসমান থেকে জমিন পর্যন্ত’ শীর্ষক যে গুরুত্বপূর্ণ বয়ান করেছেন, বিষয়বস্তুর গুরুত্ব বিবেচনা করে বয়ানের অনুলিপি উম্মাহ পাঠক সমীপে উপস্থাপন করা হল -সম্পাদক]

আল্লাহর হামদ ও সালাত দিয়ে শুরু করছি।

মুহতারাম হাজিরীন! এই মহাবিশ্বের স্রষ্টা, পালনকর্তা ও একচ্ছত্র অধিপতি আল্লাহ তাআলার অগণিত গুণাবলি রয়েছে। পবিত্র কোরআন ও হাদিসে বর্ণিত এই গুণাবলিকে সাধারণত তিন ভাগে ভাগ করা যায়। এই গুণাবলি নিয়ে গভীর চিন্তাভাবনা করলে আমরা কেবল আল্লাহকে চিনতে পারি না, বরং নিজেদের জীবনকেও সঠিক পথে পরিচালিত করার দিকনির্দেশনা পাই।

আল্লাহর সিফাত: তিন প্রকার

১. ইতিবাচক গুণাবলি (সিফাতে ইসবাতী): এই গুণগুলো কেবল আল্লাহর জন্য নির্দিষ্ট। কোনো মানুষ বা সৃষ্টির পক্ষে এগুলো অর্জন করা সম্ভব নয়। যেমন—

  • খালিকুল কুল্লি শাই (সবকিছুর স্রষ্টা): আল্লাহ তাআলা কোরআনে বলেন, “আল্লাহই সবকিছুর স্রষ্টা।” (সূরা আল-আন’আম, আয়াত: ১০২)। সৃষ্টি করা কেবল আল্লাহর একক ক্ষমতা। মানুষের পক্ষে কোনো কিছুকে অস্তিত্বে আনা সম্ভব নয়।
  • রাব্বুল আলামিন (বিশ্বজগতের প্রতিপালক): সূরা ফাতিহায় আল্লাহ নিজের পরিচয় দিয়েছেন, “সমস্ত প্রশংসা জগতসমূহের প্রতিপালক আল্লাহর।” (সূরা আল-ফাতিহা, আয়াত: ১)। প্রতিপালক বা রব হওয়া আল্লাহর এক অনন্য সিফাত, যা অন্য কেউ দাবি করলে শিরক হবে।

২. নেতিবাচক গুণাবলি (সিফাতে সালবী): এই গুণগুলো এমন, যা আল্লাহর ক্ষেত্রে অনুপস্থিত থাকাই তাঁর পূর্ণতা ও শ্রেষ্ঠত্বের পরিচায়ক। যেমন—

  • ঘুম ও তন্দ্রাহীনতা: আল্লাহ তাআলা কোরআনে বলেন, “তাঁকে তন্দ্রা বা ঘুম স্পর্শ করতে পারে না।” (সূরা আল-বাকারা, আয়াত: ২৫৫)। ঘুম বা তন্দ্রা মানুষের জৈবিক চাহিদা, যা আলস্য বা দুর্বলতার লক্ষণ। এর থেকে মুক্ত থাকা আল্লাহর পূর্ণ সত্তার নিদর্শন। অথচ মানবজীবনে সুস্থ থাকার জন্য ঘুম অপরিহার্য।
  • অংশীদারহীনতা: আল্লাহ বলেন, “তাঁর কোনো অংশীদার নেই।” (সূরা আল-আন’আম, আয়াত: ১৬৩)। এই মহাবিশ্বের পরিচালনায় তাঁর কোনো সহযোগী বা অংশীদারের প্রয়োজন নেই। এই গুণটিও আল্লাহর একচ্ছত্র ক্ষমতা ও পূর্ণতার প্রমাণ।

৩. অর্জিতব্য গুণাবলি (সিফাতে কাসবী): এটি এমন কিছু গুণ, যা মানুষ চেষ্টা করলে নিজের মধ্যে ধারণ করতে পারে। এই গুণাবলি আল্লাহর সত্তাগত হলেও এর কিছু কিছু বৈশিষ্ট্য মানুষের জীবনে অনুশীলন করা সম্ভব। এর মাধ্যমে বান্দা আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করতে পারে। যেমন—

  • সত্যবাদিতা (আস-সিদক): আল্লাহ তাআলা কোরআনে বলেন, “আর আল্লাহর চেয়ে অধিক সত্যবাদী আর কে আছে?” (সূরা আন-নিসা, আয়াত: ৮৭)। সত্যবাদিতা আল্লাহর একটি গুণ। এই গুণটি মানুষও অর্জন করতে পারে। নবুয়ত লাভের পূর্বে আমাদের প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) তাঁর সত্যবাদিতা ও সততার জন্য ‘আল-আমীন’ উপাধি লাভ করেছিলেন। এই গুণের মাধ্যমে একজন মানুষ সমাজে মর্যাদা ও বিশ্বাস অর্জন করতে পারে।
  • দয়া ও করুণা (আর-রহমান, আর-রাহীম): সূরা ফাতিহায় আল্লাহকে ‘আর-রহমান, আর-রাহীম’ বলা হয়েছে। এর অর্থ হলো আল্লাহ পরম দয়ালু ও অতি দয়ালু। এই দুটি শব্দের মাধ্যমে আল্লাহ দুনিয়া ও আখেরাতে তাঁর ব্যাপক ও সীমাহীন দয়ার প্রকাশ ঘটিয়েছেন। আল্লাহর এই অসীম দয়া ও ভালোবাসার সর্বনিম্ন পরিমাণও আমাদের কল্পনার বাইরে। সহিহ মুসলিমের একটি হাদিসে রাসূল (সা.) বলেছেন, জান্নাতে একজন সর্বনিম্ন মর্যাদার ব্যক্তিকে এমন বিশাল স্থান দেওয়া হবে, যা দুনিয়ার দশগুণ। এই হাদিস থেকে আমরা আল্লাহর অসীম দয়া ও দানের সর্বনিম্ন পরিমাণ সম্পর্কে ধারণা পাই।
  • ন্যায়পরায়ণতা (আল-আদল): আল্লাহ তাআলা নিজে ন্যায়বিচারক। তিনি কোরআনে মুমিনদেরও ন্যায়পরায়ণ হওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। ব্যক্তিগত, পারিবারিক ও সামাজিক জীবনে ন্যায় ও ইনসাফ প্রতিষ্ঠা করা এই গুণেরই প্রতিফলন।
  • ক্ষমাশীলতা (আল-গাফুর): আল্লাহ যেমন ক্ষমাশীল, তেমনি মুমিনদের উচিত অন্যের ভুল-ত্রুটিকে ক্ষমা করে দেওয়া। রাসুল (সা.) বলেন, “তোমরা দয়া করো, তাহলে তোমাদের প্রতি দয়া করা হবে; তোমরা ক্ষমা করো, তাহলে তোমাদের প্রতি ক্ষমা করা হবে।” (মুসনাদে আহমাদ)।

স্রষ্টার গুণ ও সৃষ্টির প্রতি আমাদের কর্তব্য

প্রিয় উপস্থিতি! আল্লাহর এই গুণাবলি আমাদের কেবল আধ্যাত্মিকভাবেই পূর্ণতা দেয় না, বরং আমাদের সামাজিক ও পরিবেশগত দায়িত্ব সম্পর্কেও সচেতন করে তোলে। আল্লাহ তাআলা তাঁর অপার দয়ায় পৃথিবীকে আমাদের বসবাসের উপযোগী করে সৃষ্টি করেছেন। তিনি আমাদের জন্য প্রকৃতিতে বাতাস, পানি, মাটি—সবকিছুর সুষম ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। কিন্তু দুঃখজনকভাবে, আমরা আমাদের কর্মকাণ্ডের মাধ্যমেই এই সুন্দর পৃথিবীকে বাস-অযোগ্য করে তুলছি।

আরও পড়তে পারেন-

ইসলামে পরিচ্ছন্নতা ও পরিবেশ সুরক্ষার গুরুত্ব অপরিসীম। রাসুল (সা.) বলেন, “পরিচ্ছন্নতা ঈমানের অর্ধেক।” এই শিক্ষা শুধু ব্যক্তিগত পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, বরং আমাদের চারপাশের পরিবেশকে দূষণমুক্ত রাখার দায়িত্বও এর অন্তর্ভুক্ত।

পরিবেশ সুরক্ষায় ইসলামের নির্দেশনা

  • গাছ লাগানো: রাসুল (সা.) গাছ লাগানোর গুরুত্ব সম্পর্কে বলেন, “যদি কোনো মুসলিম গাছ লাগায় বা ফসল ফলায় এবং তা থেকে কোনো মানুষ, পশুপাখি খায়, তবে সেটি তার জন্য সদকা হিসেবে গণ্য হবে।” (সহিহ বুখারি)। এর মাধ্যমে আমরা বুঝতে পারি, পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করা এবং সবুজায়ন বাড়ানো কতটা সওয়াবের কাজ।
  • অপচয় রোধ: আল্লাহ তাআলা কোরআনে অপচয়কারীদের পছন্দ করেন না বলে উল্লেখ করেছেন, “এবং তোমরা অপচয় করো না। নিশ্চয় তিনি অপচয়কারীদের পছন্দ করেন না।” (সূরা আল-আন’আম, আয়াত: ১৪১)। পানি, বিদ্যুৎ বা যেকোনো প্রাকৃতিক সম্পদের অপচয় রোধ করা পরিবেশ সুরক্ষার একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক।
  • প্লাস্টিক ও বর্জ্য ব্যবস্থাপনা: একসময়কার খরস্রোতা বুড়িগঙ্গা নদী এখন মরা খালে পরিণত হয়েছে, যার তলদেশে জমা হয়েছে প্রায় ১০ ফুট প্লাস্টিক ও পলিথিন। একটি প্লাস্টিক পচতে প্রায় ৫ হাজার বছর সময় লাগে। এই দীর্ঘ সময় ধরে তা পরিবেশ দূষণ করে। আমরা প্রায়শই আমাদের ব্যবহৃত প্লাস্টিক ও পলিথিন যত্রতত্র ফেলে দিই। আমরা কি কখনো ভেবে দেখেছি, এর দায় আমাদেরও? জাতি হিসেবে আমরা কি এর জন্য দায়ী নই?

আমাদের করণীয় ও উপসংহার

মুহতারাম হাজিরীন! আল্লাহর গুণাবলি থেকে আমরা শিক্ষা নিতে পারি যে, তিনি যেমন দুনিয়ার সকল সৃষ্টির প্রতি দয়ালু, তেমনি আমাদেরও উচিত সৃষ্টির প্রতি সদয় হওয়া। পরিবেশের সুরক্ষাও এর অন্তর্ভুক্ত। এই দায়িত্ব কেবল ব্যক্তিগত নয়, বরং একটি সামাজিক আন্দোলন হিসেবে গড়ে তোলা প্রয়োজন। মসজিদের ইমাম, মাদ্রাসার শিক্ষক এবং আলেম-ওলামাদের মাধ্যমে এই বার্তা সমাজের সকল স্তরে পৌঁছে দিতে হবে।

পলিথিন ও প্লাস্টিকের ব্যবহার সীমিত করে আমরা পাটের ব্যাগ বা অন্যান্য পরিবেশবান্ধব পণ্যের ব্যবহার শুরু করতে পারি। আমাদের মহান সৃষ্টিকর্তা যেভাবে আমাদের প্রতি দয়াশীল, আমরাও যেন তাঁর সৃষ্টির প্রতি, অর্থাৎ এই সুন্দর পৃথিবীর প্রতি দায়িত্বশীল হই। আসুন, আমরা নিজেরা সচেতন হই এবং অন্যকে সচেতন করি। পলিথিন ও প্লাস্টিকমুক্ত এক নির্মল পরিবেশ পরবর্তী প্রজন্মের জন্য রেখে যাওয়ার অঙ্গীকার করি। আল্লাহ আমাদের তাওফিক দান করুন। আমিন।

উম্মাহ২৪ডটকম: এমএ

উম্মাহ পড়তে ক্লিক করুন-
https://www.ummah24.com

দেশি-বিদেশি খবরসহ ইসলামী ভাবধারার গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে ‘উম্মাহ’র ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।