Home ধর্মতত্ত্ব ও দর্শন বিবর্তনের ভ্রান্ত দর্শন এবং প্রাসঙ্গিক পর্যালোচনা (২)

বিবর্তনের ভ্রান্ত দর্শন এবং প্রাসঙ্গিক পর্যালোচনা (২)

।। আল্লামা উবায়দুল্লাহ ফারুক ।।

[পূর্ব প্রকাশিতের পর]

মানুষের সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ :

সৃষ্টি জগতের মধ্যমণি মানুষ। পৃথিবী এক প্যান্ডেল স্বরূপ যা সাজানো হয়েছে মানুষের সমাবেশের জন্য, আর এই সমাবেশের বক্তাগণ হলেন আম্বিয়া আলাইহিমুস সালাম। আল্লাহ তাআলা আদম সৃষ্টির পূর্বেই ঘোষণা দিয়েছেন- إني جاعل في الأرض خليفه আমি পৃথিবীতে আমার প্রতিনিধি পাঠাবো। অতঃপর আল্লাহ তাআলা আদমকে সৃষ্টি করেন এবং ফেরেশতাদের বলেন আদমকে সম্মান প্রদর্শন করতে। আদমকে পৃথিবীতে পাঠানোর প্রাক্কালে জরুরী হেদায়েত দেন। কুরআন মাজীদে বিভিন্ন স্থানে তার আলোচনা আসছে-

وَ اِذْ قُلْنَا لِلْمَلٰٓىِٕكَةِ اسْجُدُوْا لِاٰدَمَ فَسَجَدُوْۤا اِلَّاۤ اِبْلِیْسَ١ؕ اَبٰی وَ اسْتَكْبَرَ١٘ۗ وَ كَانَ مِنَ الْكٰفِرِیْنَ

অর্থাৎ- এবং যখন আমি হযরত আদম (আঃ)-কে সেজদা করার জন্য ফেরেশতাগণকে নির্দেশ দিলাম, তখনই ইবলীস ব্যতীত সবাই সিজদা করলো। সে (নির্দেশ) পালন করতে অস্বীকার করল এবং অহংকার প্রদর্শন করল। ফলে সে কাফেরদের অন্তর্ভূক্ত হয়ে গেল। (সূরা বাক্বারাহ- ৩৪)।

পরবর্তীতে যত মানুষ দুনিয়াতে এসেছে সব আদমের সন্তানাদী। সৃষ্টিগতভাবেই এরা মানুষ-আদমের বংশদর। এমন নয় যে, বন জঙ্গল ও মাঠে ময়দানে কালের পরিবর্তনে এমনিতেই এরা মানুষে পরিণত হয়ে গেছে। কুরআন মাজীদে আদম থেকে মানুষের উৎপত্তির বিষয়টি পরিষ্কার বলা হয়েছে-

يۤاَیُّهَا النَّاسُ اتَّقُوْا رَبَّكُمُ الَّذِیْ خَلَقَكُمْ مِّنْ نَّفْسٍ وَّاحِدَةٍ وَّ خَلَقَ مِنْهَا زَوْجَهَا وَ بَثَّ مِنْهُمَا رِجَالًا كَثِیْرًا وَّ نِسَآءً١ۚ وَ اتَّقُوا اللّٰهَ الَّذِیْ تَسَآءَلُوْنَ بِهٖ وَ الْاَرْحَامَ١ؕ اِنَّ اللّٰهَ كَانَ عَلَیْكُمْ رَقِیْبًا.

১. হে মানব সমাজ! তোমরা তোমাদের পালনকর্তাকে ভয় কর, যিনি তোমাদেরকে এক ব্যক্তি থেকে সৃষ্টি করেছেন এবং যিনি তার থেকে তার সঙ্গীনীকে সৃষ্টি করেছেন; আর বিস্তার করেছেন তাদের দু’জন থেকে অগণিত পুরুষ ও নারী। আর আল্লাহকে ভয় কর, যাঁর নামে তোমরা একে অপরের নিকট যা”ঞ্ঝা করে থাক এবং আত্মীয় জ্ঞাতিদের ব্যাপারে সতর্কতা অবলম্বন কর। নিশ্চয় আল্লাহ তোমাদের ব্যাপারে সচেতন রয়েছেন। (সূরা নিসা-১)।

خَلَقَكُمْ مِّنْ نَّفْسٍ وَّاحِدَةٍ ثُمَّ جَعَلَ مِنْهَا زَوْجَهَا وَ اَنْزَلَ لَكُمْ مِّنَ الْاَنْعَامِ ثَمٰنِیَةَ اَزْوَاجٍ١ؕ یَخْلُقُكُمْ فِیْ بُطُوْنِ اُمَّهٰتِكُمْ خَلْقًا مِّنْۢ بَعْدِ خَلْقٍ فِیْ ظُلُمٰتٍ ثَلٰثٍ١ؕ ذٰلِكُمُ اللّٰهُ رَبُّكُمْ لَهُ الْمُلْكُ١ؕ لَاۤ اِلٰهَ اِلَّا هُوَ١ۚ فَاَنّٰی تُصْرَفُوْنَ

৬. তিনি সৃষ্টি করেছেন তোমাদেরকে একই ব্যক্তি থেকে। অতঃপর তা থেকে তার যুগল সৃষ্টি করেছেন এবং তিনি তোমাদের জন্যে আট প্রকার চতুষ্পদ জন্তু অবতীর্ণ করেছেন। তিনি তোমাদেরকে সৃষ্টি করেছেন তোমাদের মাতৃগর্ভে পর্যায়ক্রমে একের পর এক ত্রিবিধ অন্ধকারে। তিনি আল্লাহ তোমাদের পালনকর্তা, সাম্রাজ্য তাঁরই। তিনি ব্যতীত কোন উপাস্য নেই। অতএব, তোমরা কোথায় বিভ্রান্ত হচ্ছ? (সূরা যামার- ৪)।

মানুষের সৃষ্টি তথ্য এটাই যে, প্রথমত হযরত আদমকে জান্নাতে তৈরি করা হয়। আদম-হাওয়া দীর্ঘকাল সেখানেই ছিলেন। পরে তাদেরকে দুনিয়াতে পাঠানো হয়। পৃথিবীর সকল মুসলমান, খ্রিস্টান ও ইহুদী এই দর্শনের বিশ্বাস করে। এটাই বাস্তব, এটাই প্রমাণিত।

নাস্তিক বৈজ্ঞানিকদের দর্শণ

এই তথ্যের বিপরীতে বিজ্ঞানী অ্যারিস্টটল, ল্যামার্ক, ডারউইন, এম্পেডোক্লিস, ডেমোক্রিটাস, বুফন, ডেভ্রিস, আগস্টাইজম্যান সহ বিবর্তনবাদী বৈজ্ঞানীকদের মতে পৃথিবী ও পৃথিবীতে যা কিছু বিদ্যমান তার কোনো সৃষ্টিকর্তা নেই। তারা বলেন, “সূর্য ভেঙ্গে এক টুকরো ছিটকে পড়ে পৃথিবীর আকার ধারণ করে। পৃথিবীর পানি থেকে বিভিন্ন কীট তৈরী হয়, এসব কীট হাজার হাজার বছরের বিবর্তনে বিভিন্ন জীব জন্তুর আকার ধারণ করে। এগুলো এমনিতেই হচ্ছে, এটাই প্রকৃতির স্বভাব। তার জন্য কোনো সৃষ্টিকর্তার প্রয়োজন নেই।”

এই অযৌক্তিক ও কাল্পনিক মতবাদের উপর কিছু পর্যালোচনা করতে চাই:

আমরা দেখি, পৃথিবীতে কোনো ঘটনা যেমন, খুন, চুরি, এক্সিডেন্ট প্রভৃতি ঘটলে পুলিশ বা গোয়েন্দারা আসামী নির্ণয় করার জন্য প্রথমত কতগুলো সম্ভাব্য দিক ঠিক করে। যেমন, এই কারণে অমুক এই কাজ করতে পারে, ওই কারণে তমুক এই কাজ করতে পারে। এসব দিকগুলোকে ‘ধারণা’ বলা হয়। পুলিশ এসব ধারণার পর্যালোচনা করে এবং প্রমাণ খোঁজার অভিযান চালায়। অতঃপর অকাট্য দলিল প্রমাণ সংগ্রহের পর আসামি সাব্যস্ত করে। কখনো কোনো অনুমান ও ধারণার উপর বিচার ফায়সালা হয় না।

বৈজ্ঞানীকদের মন্তব্য যে মিথ্যা তার প্রমাণাদি

১. বিজ্ঞানীরা এক জীব থেকে অন্য জীবে রূপান্তরিত হওয়ার আজ পর্যন্ত কোনো প্রমাণ দিতে পারেননি। তারা যত প্রমাণ পেশ করেছেন কোনটা মিথ্যা, কোনটা ধারণা। একটাকেও দলিল বা প্রমাণ বলা যায় না।

২. এখন পর্যন্ত পৃথিবীতে কোনো মাকড়শা, ব্যাঙ, চড়ুইপাখি, তেলাপোকা, প্রভৃতি ছোট ছোট জীব অন্য কোন পশুতে রূপান্তরিত হয়েছে তার কোনো প্রমাণ নেই। পৃথিবীতে কোনো মোরগ হাঁস হয়েছে, কোনো হরিণ ঘোড়া হয়েছে, কোন ঘোড়া জিরাফ হয়েছে, কোন বিড়াল বাঘ হয়েছে, কোন ব্যাঙ বানর হয়েছে, কোন গাধা ঘোড়া হয়েছে, কোনো খরগোশ শুকর হয়েছে, কোনো বানর হনুমান হয়েছে, কোনো ছাগল ভেড়া হয়েছে, কোনো ভেড়া ছাগল হয়েছে, কোনো বানর মানুষ হয়েছে, তার কোনো প্রত্যক্ষদর্শী কিংবা তার কোনো দৃষ্টান্ত কোথাও পাওয়া যায়নি।

৩. কোনো অঙ্গ ব্যবহার না করলে বিলুপ্ত হয়ে যায় আবার কোনো অঙ্গ ব্যবহার বেশি হলে তার আকার বড় হয়ে যায়, তারও কোনো দৃষ্টান্ত নেই।

৪. মোরগ বা কোনো পাখি পানিতে বেশি সাঁতার কাটায় তার হাঁসের মত পা হয়ে গেছে এবং ঠোটও বদলে গেছে, এটা একটা মিথ্যা কথা; তার কোনো বাস্তবতা নেই। যদি তাই হয়, তাহলে এখন তা হচ্ছে না কেন?

৫. ঘোড়া গাছের পাতা খাওয়ার জন্য মাথা উঠিয়ে বারংবার চেষ্টা করার কারণে জিরাফ হয়ে গেছে এটাও মিথ্যা কথা। তার কোনো নজীর নেই। যদি তাই হতো তাহলে এখন তা কেন হচ্ছে না?

৬. বানর লেজ ব্যবহার না করায় লেজ পড়ে গেছে এবং শহরে বাস করতে করতে মানুষের আকার ধারণ করেছে, এটা পাগলের প্রলাপ। বর্তমানে কত বানর বছরকে বছর মানুষের সাথে বসবাস করছে একটারও লেজ পড়েনি এবং কোনটা মানুষও হয়নি।

৭. প্রকৃতির স্বভাব যদি জীবের বিবর্তন হতো, আর বিজ্ঞানীদের মতে মন্থরগতিতে কয়েক হাজার বছরে যদি বিবর্তন হয় তাহলে প্রত্যেক প্রাণীর সব সময়ই পূর্বেকার পরিবর্তনের পর হাজার বছর যাচ্ছে, তাতে কোনো পরিবর্তন হচ্ছে না কেন?

৮. বানর যখন মানুষ হয়ে গেল তাহলে বানর থাকল কেন? ঘোড়া যখন জিরাফ হলো ঘোড়া থাকল কেন?

৯. জীবের বিবর্তন যদি প্রকৃতির স্বভাব হয়, তাহলে বানর থেকে মানুষ, কিন্তু মানুষ থেকে কী হয়েছে? এবং ঘোড়া থেকে জিরাফ, কিন্তু জিরাফ থেকে কী হয়েছে?

১০. বানর থেকে মানুষ, মোরগ থেকে হাঁস ও ঘোড়া থেকে জিরাফ পরিবর্তনে যদি হাজার হাজার বছর লাগে তবে পানি থেকে হাঁস, পানি থেকে জিরাফ এবং পানি থেকে মানুষের বিবর্তনে কত লক্ষ বছর লাগবে?

১১. কোটি কোটি নিদর্শন আমাদের সামনেÑ দুই-চার মাস থেকে দু’বছর কালের সীমিত সময়ে পানি (বীর্য) থেকে মানুষ, হাতি, ঘোড়া, গাঁধা, মহিষ, গরু, ছাগল, বাঘ, সিংহ, ভাল্লুক, বানর ইত্যাদি তৈরী হচ্ছে। প্রকৃতি এই সল্প সময়ে এত কঠিন বিবর্তন ঘটাতে পারলো অথচ বিজ্ঞানীদের মতে এক পশু থেকে অন্য পশুতে রূপান্তিরিত হতে হাজার হাজার বছর লাগে- এ মন্তব্য অবাস্তব তো বটেই, কল্পনাতীতও।

১২. ডিম থেকে পাখি, মাছ, সাপ, কুমির, কচ্ছপ ইত্যাদির বিবর্তন ১৫-২০ দিনে হচ্ছে, অথচ এক জাত থেকে অন্য জাতের বিবর্তনে বিজ্ঞানীদের মতে হাজার হাজার বছর লাগে। যদি বিজ্ঞানীদের কথা সত্য হতো তাহলে ডিম থেকে পাখিতে রূপান্তরিত হতে হাজার হাজার বছর লাগার কথা। কারণ এক জাত থেকে অন্য জাতে রূপান্তরিত হওয়ার বিবর্তন থেকে ডিম পাখিতে রূপান্তরিত হওয়া অনেক বেশি কঠিন।

১৩. এক জীবের কোনো অঙ্গ অন্য জীবের অঙ্গের সাথে মিল থাকার অর্থ কি এই যে, একটা অন্যটা থেকে রূপান্তরিত হয়েছে? তাহলে আব্দুর রাহমানের শরীরের সাথে আব্দুল্লাহর হাজার মিল পাওয়ার কারণে আব্দুর রাহমানকে আব্দুল্লাহর ছেলে বলা সত্য হবে?

১৪. বিজ্ঞানীর কাছে বিবর্তনের প্রমাণাদীর উদাহরণ হলো, রিক্সার চাকা মন্থরগতিতে ট্রাকের চাকায় রূপান্তরিত হয়েছে, তার প্রমাণ হলো রিং টিউব ও টায়ারে দুইটার মধ্যে অনেক মিল রয়েছে- এ ধরণের হাস্যকর প্রমাণ ছাড়া তাদের কাছে কিছুই নেই।

১৫. বিবর্তন যদি স্বভাবগত ব্যাপার হতো তাহলে নর অথবা নারী একটা হতো, দুটো কেন?

১৬. প্রকৃতির স্বভাব যখন বিবর্তন তাহলে সর্বদা বিবর্তনের মাধ্যমেই জীব-জন্তুর আবির্ভাব ঘটত, এ কী বিবর্তন যে, একবার-ই ঘটলো তারপর থেকে নর ও নারীর সংমিশ্রনের ধারাবাহিকতায় সর্ব জাতের প্রজন্ম চলমান।

১৭. বিবর্তন চলমান প্রক্রিয়া কিন্তু বিজ্ঞানীদের এ কী কেরেশমা যে, মানব জাতীর অস্তিত্বের পূর্বের যে যুগের  অবস্থা শিক্ষিত-অশিক্ষিত কেউই জানেনা, সে সময় সারা বিশ্বের বিবর্তন হয়ে গেল, কিন্তু যে যুগ থেকে ইতিহাস রচিত হলো, ওই সময় থেকে আর কোনো বিবর্তন নেই! কোন সুস্থ মস্তিষ্কের মানুষ এসব ফালতু কথা মেনে নিতে পারে?

১৮. সৃষ্টিকর্তা ছাড়া বিবর্তনের কারণে যদি মানুষ অস্তিত্ব লাভ করে, তবে তার জৈবিক চাহিদাও বিবর্তনের কারণে হয়েছে। এখন মানুষ যদি তার জৈবিক চাহিদা মিটাতে কারো সাথে যৌন আচরণ করে, খুন-চুরি-ডাকাতি ও নেশা গ্রহণ ইত্যাদি আচরণ করে তবে তা অপরাধ হবে কেন? এটাতো স্বভাবগত কাজ, যা বিবর্তনের অনিবার্য ফলাফল।
[চলবে]

লেখক: প্রখ্যাত প্রবীণ আলেমে-দ্বীন, শায়খুল হাদীস- জামিয়া মাদানিয়া বারিধারা-ঢাকা এবং সহসভাপতি- জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশ।

বিবর্তনের ভ্রান্ত দর্শন এবং প্রাসঙ্গিক পর্যালোচনা (১)