Home সাক্ষাৎকার ‘ধর্মীয় ভাবধারায় ভারতের মতো সংকীর্ণতা বাংলাদেশে নেই’

‘ধর্মীয় ভাবধারায় ভারতের মতো সংকীর্ণতা বাংলাদেশে নেই’

ধর্মীয় ভাবধারায় ভারতের মতো সংকীর্ণতা বাংলাদেশে নেই। - অমর্ত্য সেন।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিখ্যাত সাময়িকী দি নিউ ইয়র্কার গত ৬ অক্টোবর ২০১৯ তারিখে নোবেল পুরস্কারে সম্মানিত অধ্যাপক অমর্ত্য সেনের একটি দীর্ঘ সাক্ষাৎকার ছাপে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন আইজ্যাক চোটিনার। তিনি দি নিউ ইয়র্কার ম্যাগাজিনের লেখক।ইংরেজি থেকে অনুবাদ করেছেন আহমেদ জাভেদ।

আইজ্যাক চোটিনার : তাহলে আপনি দেশভাগের আগ থেকেই ভারতে কী ঘটছিল তা লক্ষ্য করছিলেন?

অমর্ত্য সেন : দেশভাগের বেশ আগে থেকেই। আমার স্কুলজীবন কেটেছে ব্রিটিশ-ভারতে।

আইজ্যাক চোটিনার : আপনার সে সময়ের স্মৃতিগুলো আমাদের বলবেন?

অমর্ত্য সেন : ব্রিটিশ শাসন থেকে মুক্তির জন্য মানুষের কথাবার্তা বেশ স্পষ্টই মনে আছে আমার। আমার চাচা ও মামা এবং চাচাতো ও মামাতো ভাইবোনদের কথা বেশ ভালোভাবেই মনে আছে, যারা সে সময় কারাগারে আটক ছিলেন। ব্রিটিশ শাসকরা একে বলত ‘নিবৃত্তিমূলক আটকাবস্থা’। তাদের গ্রেপ্তার করা হয়েছিল তাদের কোনো কৃতকর্মের জন্য নয় বরং এমন আশঙ্কায় যে, তারা ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে সাংঘাতিক কিছু করে ফেলতে পারে। সাম্রাজ্যের কর্তাদের এমন আতঙ্ক থেকেই তাদের জেলে দেওয়া হয়েছিল। যদিও তাদের মারাত্মক কিছু করার প্রমাণ কর্তাদের কাছে ছিল না।

আমার দাদার সঙ্গে কথোপকথনের কথা মনে পড়ে। তিনি বলছেন, ‘তোমার কি মনে হয় ভারতে নিবৃত্তিমূলক আটকাবস্থার কোনোদিন অবসান হবে?’ এবং এর উত্তরে তিনি নিজেই বলছেন, ‘স্বাধীনতার আগ পর্যন্ত হবে না। এর অবসানের জন্যই আমাদের স্বাধীনতা অর্জন করতে হবে।’ দুর্ভাগ্যজনকভাবে আজ আমরা স্বাধীন হয়েছি কিন্তু স্বাধীনতার পর প্রথমে কংগ্রেস স্বল্পমাত্রায় এই নিবৃত্তিমূলক আটকাবস্থার কৌশল প্রয়োগ করে। আর এখন এটি তো বেশ জোরেশোরেই ব্যবহার করা হচ্ছে। একটি আইন আছে, যাকে বলা হয় বেআইনি কর্মকাণ্ড (নিবৃত্তিমূলক) ধারা, যেটি এ বছরই সংশোধন করা হলো। এর ফলে সরকার যে কাউকে কোনো প্রমাণ ছাড়াই সন্ত্রাসী হিসেবে চিহ্নিত ও গ্রেফতার করতে পারবে; এমনকি এতে তার বিচারিক প্রক্রিয়ারও প্রয়োজন পড়বে না। এমন ক্ষমতা দিয়েই আইনটি তৈরি করা হয়েছে। সেই নিবর্তনমূলক আইনটিই আবার ফিরে এলো। স্বাধীন ভারতে এটি আবার ফিরে আসবে, আমি তা কখনই ভাবিনি।

আইজ্যাক চোটিনার : দেশভাগ কিংবা যুদ্ধের কথা মনে আছে?

অমর্ত্য সেন : দেশভাগ ও যুদ্ধের কথা খুব মনে আছে। এবং হিন্দু-মুসলমান সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার কথাও মনে পড়ে। আমি জন্মেছি ঢাকায়। বর্তমানে এটি বাংলাদেশের রাজধানী। যদিও আমি নানাবাড়িতে বড় হয়েছি ও লেখাপড়া করেছি। এখনকার পশ্চিম বাংলার শান্তিনিকেতনে ছিল আমার নানাবড়ি। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শান্তিনিকেতন প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। শান্তিনিকেতন ছিল চিন্তাচেতনায় অগ্রসর একটি বিদ্যাপীঠ। হিন্দু-মুসলমান সহিংসতা বাংলায় হরহামেশা ঘটত না। এমনকি ১৯৩৭ সালের নির্বাচনেও ধর্মনিরপেক্ষ দলগুলোই জয়লাভ করেছে। কিন্তু এরপর ১৯৪০-এর দশকের গোড়াতেই দেশভাগের পক্ষের শক্তিগুলোর প্রভাব বাড়তে থাকে। সম্ভবত ভারতের স্বাধীনতার মাত্র এক বছর আগে ১৯৪৬ সালে মুসলিম লীগ প্রথমবারের মতো নির্বাচনে জয়লাভ করে।

আইজ্যাক চোটিনার : সাতচল্লিশের দেশভাগের সময় আপনার পরিবার কোথায় ছিল?

অমর্ত্য সেন : আমার বাবা ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক। অল্প কিছু মেধাবী শিক্ষকের সঙ্গে তিনিও সেখানে অধ্যাপনা করছিলেন। সম্ভবত ১৯৪৬ সালের দিকে পাঁচ কি ছয়জন শিক্ষক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ত্যাগ করেন। কারণ, এত ঘন ঘন দাঙ্গা বাধছিল যে, ক্লাসই নেওয়া আর সম্ভব হচ্ছিল না। আমার বাবার সঙ্গে ছিলেন বিখ্যাত বিজ্ঞানী সত্যেন্দ্রনাথ বোস। পদার্থবিজ্ঞানী অধ্যাপক সত্যেন বসু সম্পর্কে সবাই জেনে থাকবেন বোস-আইনস্টাইন পরিসংখ্যান তত্ত্বের জন্য। আমার পিতা যিনি রসায়নের অধ্যাপক ছিলেন, তিনিও সেখান থেকে চলে আসলেন এবং দিল্লিতে নতুন কাজ খুঁজতে লাগলেন। পরে তিনি দিল্লিতে ভূমি-উন্নয়ন কমিশনার হিসেবে কাজ করেন। এরপর তিনি পশ্চিমবঙ্গ লোক প্রশাসন কমিশনের সভাপতি হিসেবে কর্মরত ছিলেন।

আইজ্যাক চোটিনার : ভারত ছাড়ার সিদ্ধান্ত নিলেন কখন?

অমর্ত্য সেন: সেভাবে বলতে গেলে আমার কথা আপনার কাছে খানিকটা একঘেয়ে লাগতে পারে। লেখাপড়ার জন্য কেমব্রিজসহ দু-একটি জায়গার প্রতি আমার খুব আগ্রহ ছিল। সে সময়ে অর্থনীতিতে কেমব্রিজের বেশ নামডাক ছিল, বিশেষত ট্রিনিটি কলেজের। আমি সেখানে ভর্তির জন্য আবেদন করি এবং কর্তৃপক্ষ আমার আবেদন গ্রহণ করেনি। পরে কোনো একজন ছাত্র ঝরে পড়লে একটি আসন ফাঁকা হয়। তখন কর্তৃপক্ষ আমাকে ভর্তি হওয়ার জন্য সুযোগ দেয় একদম শেষ মুহূর্তে। এর বহু বছর পর, যখন আমি কেমব্রিজের ট্রিনিটি কলেজের অধ্যক্ষ পদে যোগ দিই, তখন তারা সে ঘটনার কথা স্মরণ করেন। [হাসি] অর্থনীতি ও রাজনীতি বিষয়ে সবসময়ই আমার আগ্রহ কাজ করে। গণিত নিয়েও আমার উৎসাহ রয়েছে। কিন্তু সেসময়ে কেমব্রিজের অর্থনীতিবিদ্যায় ততটা গণিতের ব্যবহার ছিল না। অন্যদিকে, ট্রিনিটি কলেজের গণিতের জন্য সুখ্যাতি ছিল- যেটি শুরু হয়েছিল বিজ্ঞানী নিউটনের মতো বিখ্যাত গণিতজ্ঞের মাধ্যমে।

আইজ্যাক চোটিনার : কখনও কি মনে হয়েছে অন্য বিষয়ে সরে আসার পর গণিত ও বিজ্ঞানের প্রতি আপনার আগ্রহ কাজে এসেছে?

অমর্ত্য সেন : আমার মনে হয় কাজে লেগেছে। কেমব্রিজে তখনকার সময়ের চিন্তার বিশাল দ্বন্দ্বে ট্রিনিটি কলেজ কিছু বিষয়ে শক্ত অবস্থান নিয়েছিল। একপক্ষে ছিল কেমব্রিজ অর্থশাস্ত্র বা পুরোনো অর্থশাস্ত্র ধারা আর অন্যপক্ষে ছিল নতুন অর্থনীতি, যেটিকে তারা নয়াধ্রুপদী অর্থশাস্ত্র বলে অভিহিত করত। আমি ট্রিনিটি কলেজের প্রতি আগ্রহী হয়েছিলাম কেবল এ জন্য নয় যে, সেখানে বিজ্ঞানী নিউটন ও দার্শনিক বেকন ছিলেন; বরং তখনকার সময়ের শীর্ষ মার্কসীয় অর্থশাস্ত্রী মরিস ডব এই ট্রিনিটিতেই পড়াতেন। একটু ভিন্ন ধারার মার্কসীয় চিন্তক আন্তনিও গ্রামসির ঘনিষ্ঠ বন্ধু বিখ্যাত তাত্ত্বিক পিয়েরে স্রাফাও ট্রিনিটির শিক্ষক ছিলেন। বেশ রক্ষণশীল অর্থশাস্ত্রী ডেনিস রবার্টসন ছিলেন সবার জ্যেষ্ঠ। চিন্তার পার্থক্য থাকলেও তারা পরস্পরের সুহৃদ ছিলেন। আমাকে এ বিষয়টিও আকর্ষণ করেছিল।

আইজ্যাক চোটিনার : আপনি তখন কোন রাজনীতিতে বিশ্বাসী ছিলেন?

অমর্ত্য সেন : বামপন্থায় বিশ্বাস করতাম। নিখুঁতভাবে বললে সেটি হবে মধ্যবামপন্থা। সেখানে আমার অবস্থানটি ছিল ‘কারও মতোই নয়’-এর মতো। আমি মার্কসবাদী চিন্ত্মাধারায় প্রভাবিত হয়েছিলাম। কিন্তু কখনও মার্কসবাদী হইনি। কার্ল মার্কসের নির্দিষ্ট কিছু লেখা আমার ভালো লেগেছিল। সেগুলোর মধ্যে তার ১৮৪৪ সালের অর্থনীতি ও দর্শনের খসড়া, জার্মান ভাবাদর্শ এবং ১৮৭৫ সালের গোথা কর্মসূচির সমালোচনা উল্লেখযোগ্য। আর পছন্দের এই তালিকার সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল গরিব মানুষের জন্য সংবেদনশীলতা। এসব দেখে আমার মনে হয়েছিল সাম্যবাদীদের দেওয়ার মতো সত্যি সত্যিই কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় রয়েছে। অন্যদিকে সেখানে রাজনীতি-তত্ত্বের অভাব আমি তীব্রভাবে অনুভব করতাম। মার্কস নিজে রাজনৈতিক সংগঠনের ব্যাপারে বেশি আগ্রহী ছিলেন না। সর্বহারার একনায়কত্বের সমগ্র ধারণাটির আসলে কোনো মানে হয় না। [হাসি]। জন কেনেথ গ্যালব্রেইথের মতে, [গণতন্ত্রে বা যেকোনো ব্যবস্থায়] বিরোধী মত অত্যন্ত প্রয়োজন। যেটিকে তিনি বলেছেন ‘ক্ষমতার ভারসাম্য রক্ষাকারী’। মার্কসবাদীদের ভাবনা জগতে ক্ষমতার ভারসাম্য রক্ষার চিন্তাটি অনুপস্থিত।

কলকাতায় ছাত্র থাকাকালীন- যেখানে আমার ছাত্রজীবনের আরম্ভ হয়- আমার কাছে সবচেয়ে আকর্ষণীয় লাগত অনেকগুলো ছাত্র সংগঠন অস্পৃশ্য, দরিদ্র ও অবহেলিত জনগোষ্ঠীর স্বার্থের পক্ষে কথা বলত। অন্যদিকে, এটি ভেবে আমি খুবই পীড়িত হতাম যে, বিরোধী মতও যে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ- এটি তাদের চিন্তাচেতনায় একদমই ছিল না। গণতন্ত্র- যাকে প্রায়শই বড়লোকের গণতন্ত্র বলে গালমন্দ করা হয়- আমার মতে এর সীমাবদ্ধতা হলো সামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রকৃত সমস্যা তার চোখে ধরা পড়ে না।

সুতরাং আমি বামপন্থি হলেও আশপাশের অনেক কিছু নিয়ে আমি ছিলাম সংশয়ী। আমি নিকোলাই বুখারিনের অনেক লেখা পড়েছি। হঠাৎ বলাবলি শুরু হলো- তিনি নাকি সোভিয়েত ইউনিয়নকে ধ্বংস করার চেষ্টা করছেন এবং তিনি তা স্বীকার করে নিয়েছেন। মার্কিন পর্যটক জন গুন্থার বলেন, তিনি সেখানে গিয়ে দেখেছেন যে, তাকে (বুখারিন) তার ভিন্ন মতের জন্য হেনস্তা করা হয়নি। তখন আমার সহপাঠীরা বলেছিল, ‘এসব কথা বিশ্বাস করলে বিশ্বাসের কোনো মর্যাদাই থাকে না’। [বুখারিন একসময় স্তালিনের খুব ঘনিষ্ঠ সহযোগী ছিলেন। পরে তার বিরুদ্ধে গুপ্তচরবৃত্তি ও বিশ্বাস ভঙ্গের অভিযোগে তাকে নির্যাতন করা হয়। ১৯৩৮ সালে কিছু বলশেভিক বড় নেতার সঙ্গে তারও মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়।] সোভিয়েত কমিউনিস্ট পার্টির ২০তম কংগ্রেসে স্টালিনের সমালোচনা করে ক্রুশ্চেভের বক্তৃতা শুনে আমি কিন্তু একদমই অবাক হইনি।

সুতরাং আমার এ উপলব্ধি হয় যে, আমার কোনো ধরাবাঁধা রাজনৈতিক দলে অন্তর্ভুক্ত হওয়া চলবে না। তখন আমি মার্কসীয় বিশ্নেষণ থেকে পাওয়া চিন্তাগুলো অন্যান্য চিন্তার ঘরানার রাজনৈতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক ধারার সঙ্গে সমন্বয়ের ভিত্তিতে চলার সিদ্ধান্ত নিলাম। আমি অ্যাডাম স্মিথের অর্থনৈতিক ও দার্শনিক লেখা পড়ে দারুণ প্রভাবান্বিত হই। তারপর জন স্টুয়ার্ট মিলের লেখা পড়েও আমার একইরকম ভালো লাগে। আমার নিজের আগ্রহের সঙ্গে এসব অভিজ্ঞতার সমন্বয় করতে হয়েছে। গণিতের পাশাপাশি সংস্কৃতও ছিল আমার প্রিয় বিষয়। আমি ধ্রুপদি সংস্কৃত ও লোকায়ত দর্শন জানতাম। ভারতের বস্তুবাদী দর্শনে লোকায়ত দর্শন একটি উল্লেখযোগ্য ঘরানা। আমার ওপর নানা ধরনের চিন্তাভাবনার প্রভাব পড়েছিল। সুতরাং উত্তরাধিকার সূত্রে আমি যেমন প্রাচীন সংস্কৃত ধারা পেয়েছিলাম। তার সঙ্গে ইউরোপীয় বামধারা বা প্রগতিশীল চিন্তাধারার সংমিশ্রণ আমার মধ্যে বেশ ভালোভাবেই হয়েছিল।

আইজ্যাক চোটিনার : গত ৫ বছরে ভারতে যে পরিবর্তন ঘটেছে তা কি আপনাকে ভারতরাষ্ট্র ও তার সংবিধান সম্পর্কে ভিন্নভাবে ভাবতে বাধ্য করছে? নাকি এটি পরবর্তীকালের উপলব্ধি?

অমর্ত্য সেন : এটি আমার পরবর্তী সময়ের উপলব্ধি। ভারতের সংসদে সংবিধান নিয়ে যত তর্কবিতর্ক হয়েছে সেগুলো সবই খুব সমৃদ্ধ আলোচনা। এবং আমি মনে করি এমনটিই হওয়া উচিত। আমরা জানি, ভারতে হিন্দুত্ববাদী সংকীর্ণ ভাবধারায় বিশ্বাসী দল বিপুল জনসমর্থনের মাধ্যমে ক্ষমতায় এসেছে। আমার প্রশ্ন হলো, সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতার মতাদর্শিক অঙ্গীকার সত্ত্বেও কোনো সংখ্যাগরিষ্ঠ দল দেশ পরিচালনার ক্ষেত্রে নিজেদের বিপরীত মতাদর্শিক স্বার্থ প্রয়োগ করছে কীভাবে? আমি মনে করি, ভারতের সুপ্রিম কোর্ট এ ক্ষেত্রে বিভক্ত ও ভীষণ রকমের মন্থর। যদিও সুপ্রিম কোর্ট অনেক যুগান্তকারী রায় দিয়েছে তা সত্ত্বেও বহুত্ববাদের অভিভাবকত্ব যে শক্ত হাতে তারা করতে পারত তা তারা করেননি।

আজকের ভারতে কট্টর হিন্দুত্ববাদী ভাবধারারই আধিপত্য। সব ঘটনাতেই তারা এর গন্ধ খুঁজে বেড়ান। আজ রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী ও নেতৃত্বে যারা আছেন সকলেই হিন্দু। কিন্তু আপনি যদি মাত্র বারো বছর আগে ২০০৭ সালের সঙ্গে তুলনা করেন তবে দেখবেন রাষ্ট্রপতি ছিলেন মুসলমান, প্রধানমন্ত্রী ছিলেন শিখ এবং ক্ষমতাসীন দলের প্রধান ছিলেন একজন খ্রিষ্টান। সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্য হিন্দু হওয়া সত্ত্বেও তারা তাদের মতামতকে সকলের ওপর চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেনি। তখন এটিই ছিল স্বাভাবিক। আর আজকে এমন অবস্থা সৃষ্টি করা হয়েছে যেখানে একজন মুসলমান গরুর মাংস খাওয়ার জন্য নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন। ভারতে এমন ধারার ঘটনা কদাচিৎ ঘটেছে। আপনি যদি প্রাচীন সংস্কৃত গ্রন্থগুলো দেখেন- উদাহরণস্বরূপ বেদের কথা বলা যায়- সেখানে কিন্তু গরুর মাংস খাওয়া নিষিদ্ধ ছিল না। সুতরাং স্বাধীনতা-উত্তর ভারতে কেবল গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতার অবক্ষয়ই ঘটেনি, এমনকি হিন্দুবাদী ভারতের ইতিহাস-ঐতিহ্য বোধেরও ক্ষয় হয়েছে।

ফলে আমাদের চোখে প্রাচ্য দুনিয়ায় ভারতের গুরুত্বের বিষয়টি উপেক্ষিত হচ্ছে। এদেশে বৌদ্ধবাদী ভাবধারার প্রভাবে খ্রিষ্টীয় প্রথম সহস্রাব্দে আন্তরাজ্য যোগাযোগের গুরুত্বপূর্ণ ভাষা ছিল সংস্কৃত। ভারত প্রায় এক হাজার বছর ধরে ছিল একটি বৌদ্ধদেশ। এটিও তো আমাদের ঐতিহ্যের অংশ। পৃথিবীর সবচেয়ে প্রাচীনতম বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর একটি নালন্দা, যা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল পঞ্চম শতাব্দীতে। এখানে পড়তে কেবল ভারত থেকেই ছাত্রছাত্রীরা আসত না বরং চীন, জাপান, কোরিয়া, ইন্দোনেশিয়া থেকেও শিক্ষার্থীরা আসত। আমরা যখন পূর্ব এশীয় দেশগুলোর সহযোগিতায় সেই নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়কে পুনরায় আরম্ভ করার চেষ্টা করলাম তখন ভারতের হিন্দুত্ববাদী সরকার এটিকে আগের ভাবধারার সঙ্গে মিল রেখে বৌদ্ধধারা বিশ্ববিদ্যালয় হতে দিল না। বরং আস্তে আস্তে এটিকে হিন্দুত্ববাদী প্রতিষ্ঠার আদলে রূপ দেওয়া হলো। আমি নিজেও তো একজন হিন্দু ধর্মাবলম্বী। [হাসি]। আমার তো হিন্দুধর্ম নিয়ে তেমন কোনো আপত্তি থাকার কথা নয়। এক্ষেত্রে আমার ছেলেবেলার একটি ঘটনা বলি। বিখ্যাত প্রকাশনা সংস্থা পেঙ্গুইন আমার ঠাকুরদাকে হিন্দুধর্ম নিয়ে একটি বই লিখতে বলে। তাঁর ইংরেজি ভাষার দখল সীমিত ছিল বলে আমাকেই সে বইটি অনুবাদ ও সম্পাদনার কাজ করতে হয়েছিল। শুনতে অদ্ভুত লাগলেও সেটিই ছিল আমার সম্পাদিত ও অনূদিত প্রথম বই, যেটি ছিল আবার হিন্দুধর্ম সম্পর্কে। ঠাকুরদা সবসময় আমাদের বলতেন, নেহরু আমলের সমস্যা হলো কেবল হিন্দু-মুসলমান সহিষ্ণুতার কথাই বলা হয়। কিন্তু তার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ হলো, হিন্দু-মুসলমান মিলেমিশে একসঙ্গে কাজ করা। এই সম্প্রীতিই বিগত পাঁচশ’ বছর ধরে ভারতের ইতিহাসের অংশ হিসেবে উদ্‌যাপিত হয়ে আসছে।

আইজ্যাক চোটিনার : আমি লক্ষ্য করেছি আপনার লেখায় ব্যক্তি পরিচয়ের বহুমাত্রিকতার কথা গুরুত্বের সঙ্গে ঘুরেফিরে এসেছে।

অমর্ত্য সেন : অবশ্যই। এটি তো একবারে কেন্দ্রীয় বিষয়। এটা নিয়ে চিন্তা করলে দেখা যাবে যে, এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ বিভিন্নভাবে বর্তমান ভারতের তুলনায় বেশি সাফল্য অর্জন করেছে। জন্মের সময় প্রত্যাশিত আয়ুস্কালের (প্রচলিত অর্থে গড় আয়ু) দিক থেকে একসময় বাংলাদেশ ভারতের চেয়ে কম ছিল। আর এখন বাংলাদেশ ভারতের চেয়ে পাঁচ বছর বেশি। আর হিন্দুত্ববাদী ভাবধারায় যে ধরনের সংকীর্ণতা রয়েছে বাংলাদেশের মুসলমানদের মধ্যে সে রকমটি নেই। আমার মনে হয়, ব্যক্তির বহুমাত্রিক পরিচিতির বিষয়টি বাংলাদেশের জন্য অনেক উপকারী হয়েছে। ভারতের অবস্থাও বাংলদেশের মতোই ছিল ততদিন পর্যন্ত, যতদিন না ভারত আত্মপরিচিতির বহুমাত্রিকতার উদ্দেশ্যমূলক (হিন্দুত্ববাদের ফলে) সংকোচনের দিকে চেষ্টা না করেছে। ভারতে এ রকম চেষ্টা আগেও হয়েছে। উনিশ-বিশের দশকে হিন্দুত্ববাদী আন্দোলন বেশ জোরালোই ছিল। মহাত্মা গান্ধীকে হত্যা করে এই ফ্যাসিবাদী হিন্দুত্ববাদী সংগঠন রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের (আরএসএস) এক সদস্য। আজকের বিজেপির মধ্যে সবচেয়ে বেশি আধিপত্য এই আরএসএসের। কিন্তু গান্ধীজিকে হত্যার সময় তারা ক্ষমতায় ছিল না। কিন্তু তা সত্ত্বেও সবসময় আমরা কোনো হুমকি অনুভব করিনি, কারণ সে সময় তারা ছিল একদম প্রান্তিক শক্তি। সে সময়ের সে প্রান্তশক্তিই ক্রমে শক্তি সঞ্চয় করে সর্বশেষ নির্বাচনে বিপুল ভোটে জয়ী হয়েছে। তাদের বিজয়ের আংশিক ভিত্তি ছিল হিন্দুত্ববাদের রাজনৈতিক ফলপ্রসূতা।

সমস্যা হলো, বহু জাতি ও ধর্মভিত্তিক ভারতকে ধারণ করার মতো মোদির দূরদৃষ্টি নেই। তার কারণ, ছোটবেলা থেকেই সে আরএসএস সংগঠনটির সঙ্গে কাজ করেছে। ফলে তার দৃষ্টিভঙ্গি সে আদলেই গড়ে উঠেছে। অন্যদিকে, রাজনৈতিক নেতা হিসেবে সে শক্তিশালী এবং ভীষণ সফল। সুতরাং নির্বাচনে জেতার জন্য মোদি একটি বড় প্রভাবক ছিল। আর নির্বাচনের জন্য তাদের হাতে বিপুল পরিমাণ অর্থও ছিল। আমি বেশ অবাক হয়েছি এটি দেখে যে, অর্থদাতা হিসেবে দু-তিনটি ব্যবসায়িক গোষ্ঠীই কেবল নয়; তারা ব্যবসায়ী সমাজের একটি বড় অংশের সমর্থন পেয়েছে। অন্যান্য দলের তুলনায় নির্বাচনের সময় তারা অনেক বেশি অর্থ ও পৃষ্ঠপোষকতা পেয়েছে। এসব কিছুর ফলে তারা নির্বাচনে জিতল ঠিকই কিন্তু নির্বাচনী ব্যবস্থাটি ছিল ত্রুটিপূর্ণ। মোদির সংখ্যাগরিষ্ঠতা কিন্তু মোট ভোটের চল্লিশ ভাগেরও কম। আমেরিকার নির্বাচনী ব্যবস্থার ইলেক্টরাল পদ্ধতির ত্রুটি নিয়েও আমি লিখেছি।

আইজ্যাক চোটিনার : বেশ। যেখানে ট্রাম্প কিংবা এরদোয়ানের ৫০ ভাগের বেশি ভোট পেতে বেশ বেগ পেতে হয়েছে, সেখানে মোদি তাদের তুলনায় অনেক বেশি জনপ্রিয়। দেশের বিপুলসংখ্যক জনগণ তাকে সমর্থন করছে।

অমর্ত্য সেন : মুশকিল হলো বিপুল জনগোষ্ঠীর সমর্থন আসলে রয়েছে কি-না, সেটিই পরিস্কার নয়। ভারতের জনসংখ্যা একশ’ কোটির বেশি। তার মধ্যে বিশ কোটি মুসলমান। আর দলিত সম্প্রদায় বা যাদের অস্পৃশ্য বলা হয় তাদের সংখ্যাও ২০ কোটি। দশ কোটি হলো ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী, যাদের বলা হয় শিডিউল ট্রাইবস। ভারতে তাদের অবস্থা দলিতদের চেয়েও খারাপ। তা ছাড়া হিন্দু জনগোষ্ঠীর একটি বড় অংশ রয়েছে, যারা মোদিকে সমর্থন করে না। তাদের অনেককে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে এবং অনেককে কারাগারে বন্দি করে রাখা হয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে ভারতের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ মোদিকে সমর্থন করে, এটি বলা কঠিন। এটি এমন একটি পরিস্থিতি, যেখানে বিভিন্ন রকমের বিধিনিষেধের মাধ্যমে এক বিশেষ অবস্থা সৃষ্টি করা হয়েছে। সকল সংবাদপত্র সরকারি বিজ্ঞাপন পায় না। সরকারের বিপক্ষে লিখলে, এমনকি বেসরকারি বিজ্ঞাপনও বেশি পাওয়া যায় না। সরকার সৃষ্ট বিভিন্ন বিধিনিষেধের জালের ভেতর টিভি চ্যানেল কিংবা সংবাদপত্রের স্বাধীনভাবে কাজ করা ভীষণ কঠিন।

জন স্টুয়ার্ট মিলের কাছ থেকে সবচেয়ে বড় যে শিক্ষাটা পাই তা হলো, গণতন্ত্র মানে সরকার পরিচালিত হবে আলাপ-আলোচনার ভিত্তিতে। কিন্তু আপনি যদি আলোচনাকে ভয়ের বিষয় করে তোলেন, তা দিয়ে আর যা-ই হোক, গণতন্ত্র পাওয়া যায় না। ভোট যেভাবেই আপনি গণনা করেন তাতে গণতন্ত্র হয় না। বর্তমানে তাঁর এ কথাটি ভীষণভাবে সত্য। মানুষ এখন কথা বলতেই ভয় পায়। আমি জীবনে কখনও এমনটি দেখিনি। টেলিফোনে আমার সঙ্গে কথা বলার সময় সরকার সম্পর্কে সমালোচনামূলক কিছু চলে আসলে বলে, ‘থাক এ বিষয়ে আমরা সামনাসামনি কথা বলব, কারণ, নিশ্চয়ই আমাদের কথা কেউ আড়ি পেতে শুনছে।’ গণতন্ত্র তো এভাবে চলে না। দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের চাওয়া কী- তা বোঝার পন্থাও এটি নয়।

আইজ্যাক চোটিনার : মোদি কিংবা হিন্দুত্ববাদের রাজনীতির বিরুদ্ধে জনগণের স্বতঃস্ম্ফূর্ত প্রতিরোধ রয়েছে- এ দুটি কথার মধ্যে কোনো টানাপোড়েন রয়েছে?

অমর্ত্য সেন : দুইয়ের বিরুদ্ধেই প্রতিরোধ আরও প্রকাশিত হতো, যদি জনগণের ভেতর ভয় না থাকত।

আইজ্যাক চোটিনার : আমার প্রশ্ন জনগণ যদি ভয় পেয়েই থাকে, তাহলে ভারতের গণতন্ত্র আজ কোথায় এসে দাঁড়িয়েছে। পরিস্থিতি দেখে মনে হচ্ছে যে, আমরা গণতান্ত্রিক দেশ হিসেবে ভারত সম্পর্কে আগে যা ভাবতাম, এখনকার পরিস্থিতিতে ভারত বিষয়ে অন্যভাবে ভাবতে হবে। আপনি কি তা মনে করেন না?

অমর্ত্য সেন : খুব মনে হয়। কিন্তু ভারতীয় গণতন্ত্রের সবটুকু শেষ হয়ে যায়নি। প্রথমত, কিছু সাহসী সংবাদপত্র রয়েছে, যারা সরকারের বিরুদ্ধ খবর ছাপার ঝুঁকি নিতে দ্বিধা করে না। সেরকম দু-একটা টিভি চ্যানেল, রেডিও স্টেশন রয়েছে। সাহসী কিছু জনসভাও হয়। ভারত তো একটি ফেডারাল রাষ্ট্রও। কয়েকটি রাজ্য রয়েছে, যেখানে বিজেপি একমাত্র প্রধান শক্তি নয়।

আইজ্যাক চোটিনার : পশ্চিমবঙ্গের কথা বলছেন?

অমর্ত্য সেন : কেবল পশ্চিমবঙ্গ নয়, তামিলনাড়ূ এবং কেরালাতেও বিজেপির সংখ্যাগরিষ্ঠতা নেই। আরও কয়েকটি রাজ্য রয়েছে, যেখানে বিজেপির একক কর্তৃত্বের বিরুদ্ধে প্রশ্ন আছে। আর আছে সুপ্রিম কোর্ট। সুপ্রিম কোর্টের ওপর আমার গভীর আস্থা রয়েছে। কিন্তু তারা ভীষণ মন্থরগতিতে কাজ করেন। সেখানে কিছু বিচারক রয়েছেন, যারা সরকারের অভিপ্রায়ের প্রতি আনুগত্য দেখাতে বেশি আগ্রহী। সুতরাং গণতন্ত্রের বেশ কিছু উপাদান এখনও অবশিষ্ট রয়েছে। অন্যদিকে, যদি এমন প্রশ্ন করা হয় যে, বিগত দশ, পনের কিংবা বিশ বছরে কি গণতন্ত্রের অবনমন ঘটেছে?

আমার উত্তর হবে হ্যাঁ, ঘটেছে। সত্তরের দশকে আমাদের গণতন্ত্রের জন্য একটি বিরাট হুমকি সৃষ্টি হয়েছিল, যখন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী জরুরিীঅবস্থা জারি করলেন। কিন্তু তিনি সাধারণ নির্বাচন দিয়েছিলেন। তখন ভেবেছিলাম বিরোধী দলগুলো ভয়ভীতি ও বাধাবিপত্তির মুখে পড়তে পারে। কিন্তু সেরকম কিছু ঘটেনি আর তিনি নির্বাচনে হেরেছিলেন এবং তিনি সেই ফল মেনে নিয়েছিলেন। তাই আমার মনে হয় প্রতিরোধের অনেক উপাদান রয়েছে, যেগুলোকে আমরা আরও শক্তিশালী করতে পারি। সমাজে কিছু মানুষ আছে যাদের নকশালপন্থি বলা হয়। কিন্তু সরকার তাদের মাওবাদী, চরমপন্থি বলে মনে করে। এসব লোকদের তাদের কর্মকাণ্ডের জন্য অভিযুক্ত করে জেলে দেওয়া হয়েছে। সুতরাং ভারতের রাজনৈতিক চিত্রটি মিশ্র। কিন্তু আমরা গণতন্ত্রের যে জ্বল জ্বলে চিত্রটি সহজেই পেতে পারতাম, সেটি এখন অংশত অতীত।

আইজ্যাক চোটিনার : নির্বাচনের পর আপনি একটি লেখায় লিখেছিলেন, “অনেকে হয়তো বলতে পারেন, বিজেপির বিজয় আসলে কংগ্রেসের বিরুদ্ধে ‘মতাদর্শিক বিজয়’। কিন্তু হিন্দু জাতীয়তাবাদী দর্শনের কোনো সুনির্দিষ্ট বিজয় হয়নি। গান্ধী, নেহেরু ও রবীন্দ্রনাথ মানুষের অন্তর্ভুক্তিমূলক ঐক্যের কথা বলতেন, তার কোনো উল্লেখযোগ্য ক্ষয় হয় নাই।” এ মন্তব্যের একটু ব্যাখ্যা করবেন? এখনও কি আপনি এ রকমটাই মনে করেন?

অমর্ত্য সেন : আমি এখনও সেটিই মনে করি। কাশ্মীর বা এ ধরনের কোনো নির্দিষ্ট কারণে মানুষকে ক্ষেপানো খুবই সহজ। ভারতের সংবিধান অনুযায়ী কাশ্মীর যে বিশেষ অধিকার ভোগ করছিল, সেটি অব্যাহত না থাকার কোনো কারণই নেই। কিন্তু এর বিরুদ্ধে জনসমর্থন বাড়ানো সহজ। নির্বাচনে সেটিই করা হয়েছে। ব্রিটেনের নির্বাচনে মার্গারেট থেচার নির্বাচনে হেরে যাচ্ছিলেন তখনই তিনি (১৯৮২ সালে) আর্জেন্টিনার বিরুদ্ধে ফকল্যান্ড যুদ্ধ আরম্ভ করেন। তখন থেচারের পক্ষে যা করা হয়েছে নির্বাচনে জেতার জন্য- ভারতেও নির্বাচনে মোদির সমর্থন বাড়াতে কাশ্মীর ইস্যুকে একইভাবে ব্যবহার করা হয়েছে, আপনার হয়তো মনে আছে।

আইজ্যাক চোটিনার : সে বছরই আমার জন্ম, ফলে আমার সেটা মনে নেই। তবে ‘ফকল্যান্ড ফ্যাক্টর’ বিষয়টি আমি জানি।

অমর্ত্য সেন : ফকল্যান্ড যুদ্ধ ব্রিটিশদের জাতীয়তাবাদীতে পরিণত করেছিল। যদিও এটি বেশি দিন স্থায়ী হয়নি, তবুও সেটি মার্গারেট থেচারকে নির্বাচনে বিপুল বিজয়ের জন্য যথেষ্ট ছিল। এ বছরের গোড়ার দিকে অনুষ্ঠিত নির্বাচনের দিকে যদি তাকান, দেখবেন যে সেখানে প্রবল প্রচার চালানো হয়েছে, একটি অংশে ভয়ভীতি ছড়ানো হয়েছিল, আর অন্য একটি অংশে ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে যুদ্ধের উত্তেজনা নির্বাচনী খেলায় ক্রিড়ানক হিসেবে কাজ করেছে। ভারত সরকার দাবি করেছিল যে, পাকিস্তান ভারতীয় সেনাবহিনীর নিরাপত্তাদানকারী জাহাজের ওপর হমলা করেছে। যুদ্ধের চেয়েও বেশি খারাপ হলো যুদ্ধ নিয়ে উন্মাদনা। তেমন একটা সময়েই হিন্দুত্ববাদ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল। কিন্তু নির্বাচনের ফল দেখে বোঝা গেল, হিন্দুত্ববাদ আসলে ততটা জনপ্রিয় হয়নি। ভারতের গ্রামাঞ্চলে যখনই সংখ্যালঘুদের নিশ্চিহ্ন করার পাঁয়তারা চলছিল, তখন দেখা গেল বাস্তবে সেটি বাস্তবায়ন করার খুব বেশি লোক খুঁজে পাওয়া গেল না। এর অর্থ হলো সংখ্যালঘুদের প্রতি এক ধরনের সহিষুষ্ণতা রয়েছে। আনন্দের কথা হলো এই ঐতিহ্য প্রবলভাবে আজ পর্যন্ত টিকে আছে।

আইজ্যাক চোটিনার : ভারত এমন একজনকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নির্বাচিত করল, যিনি সংখ্যালঘুদের ওপর ব্যাপক জাতিগত সহিংসতায় নেতৃত্ব দিয়েছেন।

অমর্ত্য সেন : আপনি ঠিকই বলেছেন। ২০০২ সালে গুজরাট হত্যাকাণ্ডে মোদি ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহের বিরুদ্ধের মামলাটি তারা আদালতকে দিয়ে খারিজ করাতে পেরেছে- এটি নিঃসন্দেহে মোদির বড় সাফল্য। তাই ভারতের আনেক মানুষ এ ঘটনা বিশ্বাস করে না। [২০০২ সালে মোদি গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার অল্পদিন পরই মুসলিমবিরোধী দাঙ্গায় এক হাজারের বেশি মানুষকে হত্যা করা হয়। সেই দাঙ্গা রোধে ব্যর্থ হওয়া ও দাঙ্গায় ইন্ধন জোগানোর অভিযোগে মোদির বিরুদ্ধে মামলা হলে যুক্তরাষ্ট্রে তার প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা জারি করে।]

আপনি যদি বলতে চান যে, ভারতে হিন্দুত্ববাদের বিজয় হয়েছে- আমার মনে হয়, তাহলে তো প্রত্যেক মানুষের সত্য জানার সুযোগ অনেক বেড়ে যাওয়ার কথা। তাহলে তো সামাজিক যুক্তিতর্ক, সংবাদপত্র ও টেলিভিশনের স্বাধীনতা বেড়ে যাওয়ার কথা। মত প্রকাশের জন্য কারোরই জেলে যাওয়ার ভয় থাকত না। তাই আমি মনে করি না যে হিন্দুত্ববাদের জয় হয়েছে। যদি গণমাধ্যমের ওপর ভয়ভীতি, সেন্সরশিপ, বিজ্ঞাপন নিয়ন্ত্রণের জুলুম না থাকত এবং মোদি নির্বাচনে জিততেন, তাহলে আমি বলতে পারতাম হিন্দুত্ববাদের বিজয় হয়েছে।

আইজ্যাক চোটিনার : আমার মনে হয় আরএসএস ভারতকে মতাদর্শিকভাবে বদলে দেওয়ার আকাঙ্ক্ষা দীর্ঘদিন ধরে পোষণ করে আসছে।

অমর্ত্য সেন : আপনি ঠিকই বলেছেন। তারা এমন একটা দৃষ্টিভঙ্গি সৃষ্টি করতে পেরেছে, যা বেশ কার্যকর :’ভারত দীর্ঘ সময় মুসলমান দখলদারদের অধীনে ছিল, এখন সময় আমাদের, তাদের চিরতরে ধ্বংস করতে হবে। যেহেতু দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ হিন্দু, তাই এরই প্রতিফলন ঘটাতে হবে সবকিছুতে।’ এই দৃষ্টিভঙ্গি হিন্দু ইতিহাসকে উপেক্ষা করে। হিন্দু ইতিহাসে বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যে যথেষ্ট সহিষুষ্ণতা ছিল। বেশ কিছুদিন আগে আমি একটি বই লিখেছিলাম, যার শিরোনাম ‘তর্কপ্রিয় ভারতীয়’। সেখানে আমি দেখিয়েছি যে, কত ব্যাপক পরিসরের তর্কবিতর্ক ভারতীয় সমাজে ছিল। আরএসএস একটি মতাদর্শ তৈরি করে নিয়েছে, তারা সেটার প্রচার করছে এবং এটি ভীষণ কার্যকর হয়ে উঠেছে।

এটি খুবই দুঃখজনক। একই সঙ্গে আমি মনে করি, এই দুঃখের বিষয়টা বেশি বড় করে দেখানো ভুল হবে; কারণ, পরিস্থিতি এখনও আমাদের নিয়ন্ত্রণের মধ্যেই রয়েছে। আমি যখন ঔপনিবেশিক ভারতে বেড়ে উঠছিলাম, তখন মাহাত্মা গান্ধীর মতো ভারতীয়র তুলনায় ব্রিটিশরা দৌর্দণ্ড প্রতাপশালী ছিল। কিন্তু তা সত্ত্বেও সে লড়াইয়ে ভারতীয়দের বিজয় সম্ভব হয়েছে।

আইজ্যাক চোটিনার : গত মাসে কাশ্মীর পরিস্থিতির অনেকখানি অবনতি ঘটেছে। কিন্তু কাশ্মীর এমন একটি ভূখণ্ড, যেখানকার পরিস্থিতি দেশভাগের সময় থেকেই নাজুক ছিল, বিশেষ করে বিগত ৩০ বছর ধরে এমন অবস্থা বিরাজ করছে। আপনার কি মনে হয় গত কয়েক দশক ধরে ভারতের উদারপন্থি নাগরিক সমাজ ও বুদ্ধিজীবীদের কাশ্মীর বিষয়ে চিন্তা-ভাবনা ও কথাবার্তায় ব্যর্থতা রয়েছে?

অমর্ত্য সেন : খুব মনে হয়। নিশ্চিতভাবেই এই ব্যর্থতা সমগ্র গল্পের একটি অংশ। কাশ্মীরকে যতটা না ভারতের অংশ মনে হতো তার চেয়ে বেশি ভারতশাসিত একটি অঞ্চল মনে হতো। সাংবিধানিকভাবে স্বীকার করে নিলেও ভারত প্রায়ই কাশ্মীরের বিচ্ছিন্নতাবাদীদের ওপর কঠোর দমন-পীড়ন চালিয়েছে, যা পাকিস্তানপন্থিদের চেয়েও অনেক বেশি মাত্রার। অনেক ক্ষেত্রেই দেখা গেছে যে, পাকিস্তানপন্থিদের চেয়ে ভারত বিচ্ছিন্নতাবাদীদের বেশি ক্ষতি করেছে। কারণ, আক্রান্ত হলে পাকিস্তানপন্থিরা পাকিস্তান নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরে পালিয়ে বাঁচতে পারে। কিন্তু এ অংশের বিচ্ছিন্নতাবাদীদের যাওয়ার তো জায়গা নেই। ফলে তাদের নিশ্চিহ্ন করা সহজ। এসবের ফলে কাশ্মীরের স্বাধীনতাকামী আন্দোলন ভারতবিরোধী আন্দোলনের চেয়ে বেশি মাত্রায় পাকিস্তানপন্থি হয়ে উঠেছে। এ বিষয়ে ভারতের আগের সরকারগুলোও একই রাজনৈতিক ভুল করেছে। আপনি ঠিকই বলেছেন যে, ভারতের সংখ্যাগরিষ্ঠ নাগরিক সমাজ, এমনকি ধর্মনিরপেক্ষ বুদ্ধিজীবীদের বেশিরভাগ কাশ্মীর ইস্যুতে নিশ্চুপ থেকেছেন বলে আজ এ গল্পের সৃষ্টি হয়েছে। আমি মনে করি এই ভুলটি অনেক আগেই শোধরানো উচিত ছিল।

আইজ্যাক চোটিনার : কাশ্মীর পরিস্থিতির জন্য আপনি নিজে আরও বেশি কী করতেন?

অমর্ত্য সেন : সম্ভব হলে আরও বেশি কিছু করতাম আমি। মানুষ তো নানা কজে ব্যস্ত থাকে। তা ছাড়া কাশ্মীর পরিস্থিতি বোঝা বেশ কঠিন। কারণ, তারা একটি বিচ্ছিন্ন জনগোষ্ঠী। আর লোকে বলাবলি করে যে, এ বিচ্ছিন্নতা দূর করতে কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে। এটি আসলে ভুল চিন্তা। আমিও মনে করি, কাশ্মীর নিয়ে আমার আরও বেশি লেখা উচিত ছিল। নিজেকে যদি প্রশ্ন করি কেন লিখিনি কাশ্মীর প্রসঙ্গে? এর উত্তর হলো দুর্ভিক্ষ, দারিদ্র্য, লিঙ্গ সমতার দাবি, সক্ষমতার পন্থা, সামাজিক চয়ন, লোকনীতি ইত্যাদি নিয়ে আমার মাথা পরিপূর্ণ ছিল। সুতরাং আপনার প্রশ্নের উত্তর হবে একই সঙ্গে হ্যাঁ এবং না।

আইজ্যাক চোটিনার : দ্য গেটস ফাউন্ডেশন ঘোষণা দিয়েছে তারা মোদিকে পুরস্কার দিতে যাচ্ছে। মোদিকে আন্তর্জাতিক পরিসরে এখনও একজন রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে দেখা হচ্ছে বলে কি আপনি বিস্মিত?

অমর্ত্য সেন : আমার মনে হয় বিশ্বের মানুষ সাফল্য পছন্দ করে আর বিল ও মেলিন্ডা গেটসও এর থেকে ব্যতিক্রম নন। মোদি দৌর্দণ্ড ক্ষমতাধর বলে তার অবস্থানকে একরকমের সাফল্য হিসেবে দেখা হচ্ছে। অকপটেই স্বীকার করছি যে, মোদিকে গেটস ফাউন্ডেশন থেকে পুরস্কার দেওয়ার ঘোষণায় বেশ বিস্মিত ও আহত হয়েছি।

আইজ্যাক চোটিনার : দুর্ভিক্ষ নিয়ে আপনি অনেক লিখেছেন। দুর্ভিক্ষ প্রতিরোধে গণতন্ত্রের গুরুত্ব, জবাবদিহিতা ইত্যাদি বিষয়ে লিখেছেন। আপনি যখন দেখছেন, গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার ভেতর প্রতিষ্ঠানগুলো দুর্বল হচ্ছে কিংবা সাড়া কম দিচ্ছে, এমনকি দেশের শাসনব্যবস্থা অগণতান্ত্রিক শক্তির দখলে চলে যাচ্ছে, তখন কি দুর্ভিক্ষ ও অন্যান্য বিষয় নিয়ে আপনার কাজগুলো সম্পর্কে অন্যভাবে ভাবতে উদ্বুদ্ধ করে?

অমর্ত্য সেন : না। আমি এখনও মনে করি দুর্ভিক্ষ হয় গণতন্ত্রের অভাবে। কিন্তু খালি চোখে দেখা যায় না এমন কতগুলো প্রকট কদর্য ব্যাপার প্রতিরোধে গণতন্ত্র সাফল্য পায়নি। সেগুলো হলো- নিত্যদিনের অপুষ্টি, নারীর প্রতি বৈষম্য ইত্যাদি। এসব সমাধানের লক্ষ্যে অবশ্য গণতন্ত্রকে কাজে লাগানো যেতে পারে কিন্তু সেটি নির্ভর করে রাজনৈতিক দলের সদিচ্ছার ওপর। গণতন্ত্র কোনো সমস্যার স্বয়ংক্রিয় সমাধান দিতে পারে না। গণতন্ত্র ম্যালেরিয়া সারানোর কুইনাইন নয়। গণতন্ত্র সক্ষমতার পন্থা সৃষ্টির জন্য সহায়ক। সক্ষমতা অর্জনের পরিবেশ থাকলে দুর্ভিক্ষ মোকাবিলা খুব সহজ হয়। এ কারণেই ভারতে ব্রিটিশ উপনিবেশের শেষ দিকে দুর্ভিক্ষ দেখা দিলে সেটি দূর হতে তেমন সময় লাগেনি, যখন সংবাদপত্রের স্বাধীনতা ব্যাপকভাবে বাড়ল এবং বহু দলের অংশগ্রহণে নির্বাচন হলো। দুর্ভিক্ষের কদর্য ব্যাপার নিয়ে রাজনীতি করা খুবই সহজ কাজ। কিন্তু ধারাবাহিক অপুষ্টি, পুরুষের তুলনায় নারীর নিত্যদিনের বঞ্চনা, শিশুদের স্কুল শিক্ষার গুণগত মানের অবনমন- এগুলো নিয়ে রাজনীতি করা অত সোজা নয়। আমি জানি না আমি গণতন্ত্র শব্দটি বেশি ব্যবহার করছি কি-না। তবে এটি সত্য যে, কোনো কোনো সমস্যা সমাধানে গণতন্ত্র বেশ কার্যকর। অন্য সমস্যাগুলোর সমাধান অবশ্য আরেকটু কঠিন।

আইজ্যাক চোটিনার : আমি যেমনটা আপনাকে দেখেছি, সাধারণভাবে আপনি একজন আশাবাদী মানুষ। বর্তমান বৈশ্বিক পরিস্থিতি নিয়ে আপনাকে যতটা হতাশ দেখব ভেবেছিলাম, আপনাকে অতটা হতাশ লাগছে না।

অমর্ত্য সেন : আমি নিজেকে আশাবাদী বলব না। তবে মানুষ আমাকে যতটা নিরাশ বলে ভাবে, আমি তার চেয়ে কম নিরাশ। [হাসি]

আইজ্যাক চোটিনার : আপনার কেন মনে হয় মানুষ আপনাকে নিরাশ প্রকৃতির ভাবে? আর আপনি কেন নিজেকে কম নিরাশ বলে ভাবেন?

অমর্ত্য সেন : নিজেকে কম নিরাশ বলে ভাবার কারণ হলো শৈশবে আমাকে এমন সব ঘটনার অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়ে যেতে হয়েছিল, যেগুলো বেশ খারাপই বলতে হবে। আমি বেড়ে ওঠার সময় আমার সব মামা-কাকাদের নিবৃত্তিমূলক কারাবন্দি করা হয়েছিল। তারা কখন মুক্তি পাবেন আমরা তা জানতাম না। কারাগার থেকে ছাড়া পাওয়ার কোনো আশাই ছিল না। বাংলায় দুর্ভিক্ষ যা মন্বন্তর যখন ঘটে তখন আমার বয়স যখন মাত্র নয় বছর। ত্রিশ লাখ মানুষ মারা যায় সেই মন্বন্তরে। আমি হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গা সচক্ষে দেখেছি। সেসময় আমার দেখা নৃশংস একটি ঘটনার কথা বলি। আমরা যে পাড়ায় থাকতাম সেটি প্রধানত হিন্দুঅধ্যুষিত এলাকা।

একজন মুসলমান দিনমজুর আমাদের পাড়ায় ঢুকে পড়ায় এক হিন্দু মাস্তান তার পেটে ছুরি মেরেছিল। রক্তাক্ত অবস্থায় সে আমাদের বাগানে ঢুকেছিল, আমি তখন বাগানে খেলছিলাম। সে সাহায্য চাইছিল ও পানি খেতে চাচ্ছিল। ঘটনার আকস্মিকতায় আমি চিৎকার করে বাবাকে ডাকছিলাম। বাবা দৌড়ে তার জন্য পানি নিয়ে এলেন। সে আমার কোলে মাথা রেখে বাগানে শুয়ে ছিল। বাবা তাকে হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছিলেন, কিন্ত দুর্ভাগ্যজনকভাবে হাসপাতালে লোকটা মারা যায়। লোকটা কিছু কথা এলোমেলোভাবে বলছিল, যা আমি তখন বুঝিনি, পরে বাবা সে কথাগুলো গুছিয়ে বলেছিলেন, যে লোকটার স্ত্রী তাকে কোনো হিন্দু এলাকায় কাজে যেতে মানা করেছিল। প্রত্যুত্তরে লোকটা বলেছিল, ছেলেমেয়েগুলো কিছু খেতে পায়নি তার জন্য রোজগারে যেতে হবে, সেটি যে এলাকাতেই হোক না কেন।

আমি এমন নৃশংস ঘটনা জীবনে কখনও দেখিনি। আমার দশ কি এগারো বছর বয়সে একজন মানুষকে রক্তে ভেসে যেতে দেখেছি। মৃত্যুর আগে লোকটা বাবাকে মাস্তানদের সম্পর্কে যে বর্ণনা দিয়েছিল, সেটি বাবা পুলিশকে জানিয়েছিলেন। কিন্তু দুঃখের বিষয় সেখানকার পুলিশ এ ব্যাপারে কিছুই করেনি। আমি এমন নিষ্ঠুর হতাশাজনক অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে গেছি আবার ভারতের স্বাধীনতারও প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা আমার হয়েছে।

সুতরাং আমি অনেক বড় সমস্যা দেখেছি আবার সেগুলোর সমাধানও দেখেছি। এ কথার মানে এই নয় যে, আমি সব সময় আশাবাদে উদ্দীপ্ত। কোনো কিছু নিয়ে আমি অতিমাত্রায় আশাবাদী নই। এটির অর্থ আবার এই নয় যে, নিরাশ হওয়ার যথেষ্ট কারণ না থাকলেও নিরাশই হতে হবে।

আইজ্যাক চোটিনার : জ্ঞানের এমন কোনো বিষয় কিংবা ক্ষেত্র কি রয়েছে, যেখানে আপনি আরও কাজ করতে চেয়েছিলেন?

অমর্ত্য সেন : কিছু দার্শনিক সমস্যা রয়েছে, যেখানে আমি কাজ করতে চাই। ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও পেরে উঠিনি। আমাকে নানা কাজে এত ব্যস্ত থাকতে হয়েছে যে জ্ঞানতত্ত্বে ফেরা সম্ভব হয়ে ওঠেনি। সুতরাং এখানটায় আমার আরও কাজের ইচ্ছা আছে।

আইজ্যাক চোটিনার : সেটি কি এজন্য যে কাজটি নিজে থেকেই গুরুত্ববহন করে নাকি এটি আপনার পছন্দের কাজ?

অমর্ত্য সেন : দুটোই। কিন্তু আমি রাজনীতি থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিতে পারি না। বিশেষ করে ভারতের চলমান রাজনীতি থেকে। আমি একজন গর্বিত ভারতীয়। কিন্তু আমি কেবলমাত্র গর্বিত ভারতীয়ই নই। [হাসি]। একই সঙ্গে আমি একজন গর্বিত এশীয় এবং একজন গর্বিত মানুষ। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রতিষ্ঠিত প্রগতিশীল বিদ্যালয়ে আমি পড়েছি। এটির সুবিধা ছিল মাত্র আট-নয় বছর বয়সেও একটি সুনির্দিষ্ট বিষয় নিয়ে পড়াশোনা করা যায়। সে সুযোগে আমি প্রচুর ইতিহাস পড়েছি।

আইজ্যাক চোটিনার : আপনার সম্পর্কে একবার কোথাও পড়েছিলাম যে আপনি নিজেকে ‘অনমনীয় ধর্মনিরপেক্ষতাবাদী’ বলে মনে করেন। আপনি কি এখনও সেরকমই আছেন?

অমর্ত্য সেন :ঠিক তাই। এটি কোনো সমস্যা নয়। ধর্মনিরপেক্ষতা নিয়ে কথা বলা দরকার নয়।

আইজ্যাক চোটিনার : কেন নয়?

অমর্ত্য সেন : কারণ, জন্মসূত্রে আপনার পরিচয় কোনো ব্যাপারই নয়। এর সমাধান গণতন্ত্রের ভেতরেই রয়েছে। কিন্তু গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া প্রায়ই ব্যর্থ হয় বলে এসব খুচরা ব্যাপার মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে কখনও কখনও। সে জন্যই ব্যক্তি পরিচয়ের বহুমাত্রিকতা সম্প্রীতির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

আইজ্যাক চোটিনার : আপনার সন্তানরা কি আপনার বই পড়ে?

অমর্ত্য সেন : খুব বেশি নয়। [হাসি]। আমার সন্তানদের মধ্যে একজন সাংবাদিক। অন্যজন শিশুতোষ বই লেখে। আরেকজন সংগীতজ্ঞ। একজন একটি ম্যাগাজিনের সম্পাদক। আমি কখনোই ওদের ভালো ফলের জন্য তাগাদা দেইনি। বরং চেয়েছি তারা যা করতে আনন্দ পায় তাই করুক। তারা অসাধারণ কিছু অর্জনের জন্য কীভাবে নিজেকে প্রস্তুত করবে- এমন কোনো পূর্বানুমান বা দিকনির্দেশনা আমার কাছ থেকে পায়নি। আমি বেশ অবাক হয়েছি এটা দেখে যে, একজন অভিনেত্রীকে কারাগারে পর্যন্ত যেতে হয়েছে এজন্য যে, তিনি তার সন্তানকে নির্দিষ্ট গন্তব্যের দিকে যেতে জোর করছিলেন…

আইজ্যাক চোটিনার : ওহ! আপনি অভিনেত্রী ফেলিসিটি হফম্যানের কথা বলছেন?

অমর্ত্য সেন : তিনি যা করেছেন সেটি আমার কাছে বাড়াবাড়িই মনে হয়েছে। আপনি ভাবতে পারেন আপনার সন্তানের একটি ভালো স্কুলে যাওয়া গুরুত্বপূর্ণ। সেটি আপনার দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ হলেও তার দিক থেকে এমন কিছু নাও হতে পারে। [হাসি]।

আইজ্যাক চোটিনার : আপনি কি এখন গল্প-উপন্যাস পড়ার সময় পান?

অমর্ত্য সেন : গল্প-উপন্যাস পড়ার সময় একদম কমে গেছে। আমার দু-দু’বার ক্যান্সার হলো। প্রথমবার হলো যখন আমার বয়স ১৮। তখন আমার রেডিয়েশন নিতে হয়েছিল। ডাক্তাররা তখন বলেছিলেন, আমার মাত্র ১৫ শতাংশ সম্ভাবনা রয়েছে পাঁচ বছর বাঁচার। সে ঘটনা আজ থেকে ৬৮ বছর আগের কথা। সে তুলনায় আমি এখন দিব্যি বেঁচে আছি, ভালো আছি। দ্বিতীয়বারে হলো প্রস্টেট ক্যান্সার। আমি এখন এর চিকিৎসা নিচ্ছি। এ পর্বেও প্রচুর রেডিয়েশন নিতে হচ্ছে। অবশ্য সর্বশেষ পরীক্ষায় ক্যান্সার পুনরায় ফিরে আসার লক্ষণ পাওয়া যায়নি। চিকিৎসার সময় একটি সমান এক্সেলেটরে আমাকে শুয়ে থাকতে হত। এর ফলে আমি পড়ার অনেক সুযোগ পাই। সে সময়ে আমি প্রচুর উপন্যাস পড়েছি। এখনও আমি ছোটগল্প প্রচুর পড়ি। কিন্তু উপন্যাস পড়তে লম্বা সময়ের দরকার। আমার মনে হয় উপন্যাসের জন্য আমার আরও সময় খরচ করা উচিত। পড়ার জন্য আরও সময় দরকার আমার। মনে হচ্ছে না আমার এ আশা পূর্ণ হবে।

[দৈনিক সমকাল-এর সৌজন্যে]