Home ইসলাম আদর্শ ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় সততা, ওয়াদা ও আমানত রক্ষার গুরুত্ব...

আদর্শ ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় সততা, ওয়াদা ও আমানত রক্ষার গুরুত্ব অপরিসীম

।। আলহাজ্ব সৈয়দ জহির উদ্দীন ।।

বর্তমান সমাজের প্রায় সকল মানুষের চরিত্র থেকে কমবেশী সততা, ওয়াদা, আমানত ইত্যাদি সৎ গুণগুলো দিনদিন হ্রাস পাচ্ছে। একে অন্যের প্রতি মায়া-মমতা, ভালোবাসা লোপ পাচ্ছে। ফলে পরস্পর হিংসা-বিদ্বেষ, দাঙ্গা-হাঙ্গামা, মারামারি, কাটাকাটি অধিক হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। পরিণাম স্বরূপ পার্থিব জীবনের অমঙ্গল ও অশান্তির সাথে সাথে পরকালীন চিরস্থায়ী জীবনের ধ্বংস অনিবার্য হয়ে পড়ছে। এজন্য কুরআন এবং হাদীসে অনেক নির্দেশাবলী রয়েছে। প্রচুর ভয়ভীতি প্রদর্শনের কথা উল্লেখ রয়েছে। যাতে করে সকল লোকই এসব গুণাগুণ অর্জন করতঃ ইহ ও পরকালীন জীবনের কল্যাণ সাধন করে নিতে পারে।

(১) সততাঃ

সততার বিপরীত হচ্ছে মিথ্যা। সততা এমন একটি মহৎগুণ যদ্বারা মানুষ সুউচ্চ মর্যাদার পরম শিখরে সমাসীন হতে পারে। পক্ষান্তরে মিথ্যার প্রশ্রয় নিলে দুনিয়া ও আখেরাত উভয়ের ভয়াবহ পরিণতির শিকার হতে হয়। সততার প্রতি অনুপ্রাণিত করে কুরআনে কারীমে নির্দেশ করা হয়েছে- হে মু’মিনগণ! আল্লাহ্কে ভয় কর এবং সঠিক (সত্য) কথা বল। তিনি তোমাদের আমল আচরণ সংশোধন করবেন। এবং তোমাদের পাপসমহ ক্ষমা করবেন। (সূরা আহযাব- ৭০ আয়াত)।

উল্লিখিত আয়াতে বর্ণিত- “ক্বাওলান ছাদীদান”-এর অর্থ তাফ্সীরবিদগণ লিখেছেন, সত্যকথা, সরল কথা, সঠিক কথা।

ইব্নে কাসীর (রাহ্.) বলেছেন, সবগুলো অর্থই সঠিক। তাফ্সীরে রূহুল বয়ানে বলা হয়েছে, ক্বওলে ছাদীদ এমন কথা, যা সত্য এবং তাতে মিথ্যার নামগন্ধ নেই, সঠিক- যাতে ভুলের কণামাত্র নেই, গাম্ভীর্যপূর্ণ- যাতে রসিকতার লেশমাত্র নেই, কোমল- যা হৃদয় বিদারক নয়।

মিথ্যা সম্পর্কে আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন- যারা আল্লাহর প্রতি মিথ্যা আরোপ করে, ক্বিয়ামতের দিন আপনি তাদের মুখ কালো দেখবেন। (সূরা যুমার- ৬০ আয়াত)।

অন্য আয়াতে ইরশাদ হয়েছে- মিথ্যা কেবল তারা রচনা করে, যারা আল্লাহর নিদর্শনে বিশ্বাস করেনা। (সূরা নাহল- ১০৫ আয়াত)।

বুখারী ও মুসলিম শরীফে বর্ণিত নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন- তোমাদের জন্য সততা গ্রহণ করা একান্ত আবশ্যকীয়। কেননা, সততা নেক কাজের প্রতি অনুপ্রাণিত করে। আর নেক কাজ বেহেশ্তের দিকে পথ প্রদর্শন করে। যে ব্যক্তি সর্বদা সত্য বলবে এবং সততার উপর অবিচল থাকবে শেষ পর্যন্ত আল্লাহ ঐ ব্যক্তির নাম (সিদ্দীক) সত্যবাদীদের তালিকায় লিখে নেন। আর তোমরা মিথ্যা থেকে বেঁচে থাক। কেননা, মিথ্যা পাপকর্মের দিকে নিয়ে যায়। আর পাপকর্মই দোযখে পৌঁছিয়ে দেয়। যে বান্দা সারাক্ষণ মিথ্যা বলে এবং মিথ্যার উপর থেকে যাবে আল্লাহ ঐ ব্যক্তির নাম মিথ্যাবাদীর তালিকায় লিখে নেন।

আহমদ ও ইব্নে হাব্বান গ্রন্থে উবাইদা ইব্নে সাবিত (রাযি.) সূত্রে বর্ণনা করা হয়েছে যে, হুযূর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন- (হে আমার উম্মতেরা!) তোমরা ছয়টি বস্তুর যিম্মাদারী নিয়ে নাও, আমি তোমাদের জন্য বেহেশ্তের জামিন হয়ে যাবো। যথাক্রমে- (ক) যখন কোন কিছু বলবে সত্য বলবে, (খ) যা ওয়াদা করবে তা পুরণ করবে, (গ) তোমাদের কাছে কোন কিছু গচ্ছিত রাখা হলে তা সঠিকভাবে আমানত আদায় করবে, (ঘ) তোমাদের লজ্জাস্থানের হিফাযত করবে, (ঙ) দৃষ্টিকে নীচের দিকে আনত রাখবে এবং (চ) তোমাদের হস্তুদ্বয়কে (অনর্থক কাজ থেকে) বিরত রাখবে।

ইমাম মালেক (রাহ্.) একটি মুরসাল রিওয়ায়াত বর্ণনা করেছেন যে, হুযূর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে জানতে চাওয়া হল- মু’মিন কি ভীরু হতে পারে? তিনি উত্তরে বললেন- হ্যাঁ। আবার জানতে চাওয়া হলো- সে কি কৃপণ হতে পারে? তিনি উত্তরে বললেন, হ্যাঁ। আবার জানতে চাওয়া হলো- তাহলে কি মিথ্যুক হতে পারে? প্রত্যুত্তরে বললেন, না।

উল্লেখ্য, উলামায়ে কিরাম ‘সিদক্বুন’ বা সততার বিভিন্ন স্তর বর্ণনা করেছেন। স্তরগুলো হলো যথাক্রমে-

(১) সিদক্বুল্ লিসান বা মৌখিক সততা। প্রত্যেক মু’মিনের জন্য তার জিহ্বার যথার্থ সংরক্ষণ করা কর্তব্য। এই জিহ্বা দ্বারা কখনও মিথ্যা বলা যাবে না। তবে শরীয়ত সম্মত কোন কোন অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে সত্য গোপন করা যেতে পারে। যেমন শিশুদেরকে শাসন করার ক্ষেত্রে, মহিলাদের ব্যাপারে, নিজেকে নির্যাতন থেকে বাঁচানোর লক্ষ্যে। অনুরূপভাবে দুশমনের খপ্পর থেকে মুক্তির লক্ষ্যে।

ইমাম নববী (রাহ্.) ‘রিয়াজুস্ সালিহীন’ গ্রন্থে লিখেন, প্রকৃত পক্ষে মিথ্যা বলা মৌলিকভাবে অবশ্যই হারাম। কিন্তু কোন কোন সময় তা করা জায়েয। তবে লক্ষণীয় যে, যদি কোন মহৎ উদ্দেশ্য মিথ্যা ছাড়া অর্জন সম্ভব হয়, তাহলে মিথ্যার আশ্রয় নেওয়া হারাম। আর যদি নেক ও মহৎ উদ্দেশ্যটি মিথ্যা ব্যতীত অর্জন সম্ভব না হয়, তখন মিথ্যার আশ্রয় গ্রহণ করা জায়েয। এখানে আরও উল্লেখ্য, অর্জনীয় বস্তু মুবাহ হলে মিথ্যা বলা মুবাহ্। আর অর্জনীয় বস্তু (ওয়াজিব) বা একান্ত প্রয়োজনীয় হলে মিথ্যা বলা ওয়াজিব।

(২) দ্বিতীয় স্তর নিয়্যাত ও ইচ্ছার ক্ষেত্রে সততা। এ সততা প্রতিষ্ঠিত হয় ইখলাস বা নিষ্ঠার ভিত্তিতে। এতে করে নিজের চলাফেরা, আচার-আচরণ সব কিছুই আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য হয়।

(৩) তৃতীয় স্তর সততার জন্য বদ্ধপরিকর হওয়া। অর্থাৎ সততার জন্য পরিপূর্ণভাবে পাকাপোক্ত হওয়া, যাতে কোন দুর্বলতা ও সন্দেহ বাকী না থাকে।

(৪) চতুর্থ স্তর আমলের ক্ষেত্রে সততা। অর্থাৎ মানুষ প্রকাশ্য আমল করবে। আর প্রকাশ্য আমল প্রমাণ করবে বাতিনী আমল সঠিক হওয়ার উপর। মোদ্দাকথা, মানুষের জাহিরী এবং বাতিনী উভয় ক্ষেত্রে সততা প্রকাশ পাবে।

(২) ওয়াদা বা অঙ্গীকারঃ

সৃষ্টির সূচনালগ্নে আল্লাহ তায়ালা বান্দার কাছ থেকে যে সব অঙ্গীকার নিয়ে ছিলেন তন্মধ্যে সর্বপ্রথম ছিল পালনকর্তা সম্পর্কিত অঙ্গীকার। এটি সৃষ্টির সূচনা কালে সকল আত্মাকে সমবেত করে নেওয়া হয়েছিল। বলা হয়েছিল ‘আলাস্তু বিরাব্বিকুম’ অর্থাৎ আমি কি তোমাদের পালনকর্তা নই? উত্তরে সবাই সমস্বরে বলেছিল ‘বালা’ অর্থাৎ হ্যাঁ, আপনি অবশ্যই আমাদের পালনকর্তা।

এমনিভাবে ইসলামের যাবতীয় বিধিবিধানের আনুগত্য, সকল প্রকার অত্যাবশ্যকীয় ইবাদতের যথার্থ প্রতিপালন এবং অবৈধ বিষয়াদি থেকে বিরত থাকার ব্যাপারে আল্লাহর পক্ষ থেকে উপদেশ এবং বান্দার পক্ষ থেকে স্বীকারোক্তি কুরআনে পাকের বিভিন্ন আয়াতে উল্লেখ করা হয়েছে। আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেনঃ এরা এমন লোক, যারা আল্লাহর প্রতিশ্রুতি পূর্ণ করে এবং অঙ্গীকার ভঙ্গ করেনা। (সূরা রা’দ- ২০ আয়াত)।

উল্লিখিত আয়াতে আল্লাহ এবং বান্দার মধ্যে কৃত অঙ্গীকার এবং উম্মত ও পয়গাম্বরের মধ্যে কৃত অঙ্গীকারসহ সকল মানব জাতির একে অপরের সাথে কৃত অঙ্গীকারকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।

অন্যত্র ইরশাদ হয়েছে- মু’মিনদের মধ্যে কতক আল্লাহর সাথে কৃত ওয়াদা পূর্ণ করেছে। (সূরা আহযাব- ২৩ আয়াত)। আমাদের সকলের জেনে রাখা প্রয়োজন যে, ওয়াদা পূর্ণ করা হচ্ছে আল্লাহ তায়ালার গুণাবলীর মধ্যে বিশেষ আরেকটি গুণ। আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেনঃ কেউ যেন এরূপ মনে না করে যে, আল্লাহ তায়ালা রাসূলগণের সাথে যে ওয়াদা করেছেন, তিনি তার খেলাফ করবেন। (সূরা ইবরাহীম- ৪৭ আয়াত)।

অন্যত্র ইরশাদ করেন, তাওরাত, ইঞ্জিল ও কুরআনে তিনি এ সত্য প্রতিশ্রুতিতে অবিচল, আর আল্লাহর চেয়ে প্রতিশ্রুতি রক্ষায় কে অধিক অগ্রগামী? (সূরা তাওবা- ১১১ আয়াত)।

ওয়াদা বা অঙ্গীকার পূর্ণ করা নবীগণের বিশেষ গুণ

কুরআনে কারীমে ইরশাদ হয়েছে- তাকে কি জানানো হয়নি, যা আছে মূসার কিতাবে এবং ইব্রাহীমের কিতাবে, যে তার (ওয়াদা) দায়িত্ব পালন করেছিল। (সূরা হজ্ব- ৩৬, ৩৭ আয়াত)।

হযরত ইব্রাহীম (আ.) আল্লাহর কাছে অঙ্গীকার করেছিলেন যে, তিনি আল্লাহর আনুগত্য করবেন। এবং মানুষের কাছে তাঁর পয়গাম পৌঁছিয়ে দেবেন। তিনি এই অঙ্গীকার সকল দিক দিয়েই পূর্ণ করে দেখিয়েছেন। এতে তাঁকে অনেক অগ্নিপরীক্ষায় অবতীর্ণ হতে হয়েছে।

উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, অঙ্গীকার পালন শব্দটি আসলে ব্যাপক অর্থবোধক। এতে নিজস্ব কর্মকাণ্ডসহ খোদায়ী বিধানাবলীর প্রতিপালন এবং আল্লাহর আনুগত্যও অন্তর্ভুক্ত। এছাড়া রিসালতের কর্তব্য পালনের মাধ্যমে সাধারণ মানুষের সংশোধন এর পর্যায়ভুক্ত। হাদীসে বর্ণিত কর্মকাণ্ডও এগুলোর মধ্যে শামিল। কুরআনে কারীমে আল্লাহর ইরশাদ হচ্ছে- এই কিতাবে ইসমাঈলের কথা বর্ণনা করুন, তিনি প্রতিশ্রুতি পালনে সত্যাশ্রয়ী এবং তিনি ছিলেন রাসূল, নবী। (সূরা মারইয়াম- ৫৪)।

উপরোক্ত আলোচনা দ্বারা প্রমাণিত হলো যে, ওয়াদা পুরণ করা আল্লাহ তায়ালা, সকল পয়গাম্বর ও সৎকর্ম পারায়ণ মণীষীদের বিশেষ গুণ। এবং সম্ভ্রান্ত লোকদের অভ্যাস। আর এর বিপরীত করা পাপাচার ও হীন লোকদের চরিত্র। একটি হাদীসে হুযূর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন- “ওয়াদা এক প্রকার ঋণ।” অর্থাৎ ঋণ পরিশোধ করা যেমন অপরিহার্য, তেমনি ওয়াদা পুরণে যত্নবান হওয়া জরুরী। অন্য এক হাদীসে বলা হয়েছে- মু’মিনের ওয়াদা ওয়াজিব।

ফিক্বাহ্বিদগণ বলেন, ওয়াদা ঋণ হওয়া এবং ওয়াজিব হওয়ার অর্থ- শরীয়ত সম্মত ওযর ব্যতীত ওয়াদা পুরণ না করা গুনাহ্। কিন্তু ওয়াদা এমন ঋণ নয় যে, তজ্জন্য আদালতের শরণাপন্ন হওয়া যায়। কিংবা জবরদস্তি করে আদায় করা যায়। ফিক্বাহ শাস্ত্রবিদগণের পরিভাষায় একে বলা হয় ধর্মতঃ ওয়াজিব, বিচারে ওয়াজিব নয়। বুখারী এবং মুসলিম শরীফে বর্ণিত আছে, হুযূর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন- চারটি অভ্যাস যার মধ্যে পাওয়া যাবে সে একনিষ্ঠ মুনাফিক। যথা- (১) যখন তার কাছে কোন কিছু আমানত স্বরূপ রাখা হয় সে তার খিয়ানত করে। (২) যখন কিছু বলে মিথ্যা বলে। (৩) যখন ওয়াদা করে ধোঁকা দেয় অর্থাৎ ওয়াদা পুরণ করেনা। (৪) যখন ঝগড়া করে গালিগালাজ করে।

(৩) আমানতঃ

কোন মানুষের কাছে কোন কিছু আমানত থাকলে সে আমানত প্রাপককে সঠিকভাবে পৌঁছিয়ে দেবে। আর পৌঁছিয়ে দেওয়া হচ্ছে ঐ ব্যক্তির জন্য কর্তব্য। আমানত আদায়ের জন্য আল্লাহ তায়ালা বারংবার নির্দেশ দিয়েছেন।

কুরআনের ঘোষণা- আল্লাহ তায়ালা তোমাদেরকে নির্দেশ দিচ্ছেন যে, তোমরা আমানতসমূহ তার অধিকারীর নিকট অর্পন করে দাও। (সূরা নিসা- ৫৮ আয়াত)।

অন্যত্র ঘোষিত হয়েছে- এবং যারা আমানত ও অঙ্গীকার সম্পর্কে হুঁশিয়ার থাকে। (সূরা মু’মিনূন- ৮ আয়াত)।

এখানে লক্ষণীয় বিষয়, কুরআনে কারীমে আমানতের বিষয়টিকে ‘আমা-না-ত’ বহুবচনে উল্লেখ করা হয়েছে। এতে ইঙ্গিত প্রদান করা হয়েছে, কারো নিকট অপর কারো বস্তু বা সম্পদ গচ্ছিত রাখাটাই শুধুমাত্র আমানত নয়, যাকে সাধারণতঃ আমানত বলে অভিহিত করা হয়। বরং আমানতের আরো কিছু প্রকার আছে। তাই ‘আমা-না-ত’ বহুবচনে ব্যবহার করা হয়েছে যাতে যাবতীয় প্রকার এর অন্তর্ভুক্ত হয়ে যায়। হুকূকুল্লাহ তথা আল্লাহর হক্ সম্পর্কিত আমানত হোক, কিংবা হুকূকুল ইবাদ তথা বান্দার হক্ সম্পর্কিত হোক।

আল্লাহর হক্ সম্পর্কিত আমানত হচ্ছে- শরীয়ত কর্তৃক সকল ফরয, ওয়াজিব পালন করা এবং যাবতীয় হারাম ও মাকরূহ বিষয়াদি থেকে আত্মরক্ষা করা। বান্দার হক্ সম্পর্কিত আমানতের মধ্যে আর্থিক আমানত সম্পৃক্ত। অর্থাৎ কেউ কারো কাছে টাকা-পয়সা, সম্পদ গচ্ছিত রাখলে তার আমানত আদায়করা পর্যন্ত এর হিফাযত করা তার দায়িত্ব।

এছাড়া কেউ কোন গোপন কথা কারো কাছে বললে তাও তার আমানত। শরীয়ত সম্মত অনুমতি ব্যতীত কারো গোপন তথ্য ফাঁস করা খিয়ানতের মধ্যে শামিল। অধিনস্ত দিনমজুর ও কর্মচারীকে অর্পিত কাজের জন্য পারস্পরিক সমঝোতাক্রমে যে সময় ও কাজ নির্ধারণ করে দেওয়া হয়, তাতে সেই কাজ যথাযথভাবে যথাসময়ে সম্পন্ন করা এবং অন্য কাজ না করা আমানত। কাজ চুরী এবং সময় চুরী মানে বিশ্বাসঘাতকতা।

উপরোক্ত আয়াতদ্বয়ের প্রথম আয়াত দ্বারা প্রতীয়মান হয় যে, রাষ্ট্রীয় পদমর্যাদাসমূহ আল্লাহ তায়ালার আমানত অর্থাৎ যাদের হাতে নিয়োগ-বরখাস্তের অধিকার রয়েছে সে সমস্ত অফিসার ও কর্মকর্তাবৃন্দ হলো সে পদের আমানতদার। কাজেই তাদের পক্ষে কোন পদ এমন কাউকে অর্পন করা জায়েয নয় যে যোগ্য নয়।

একটি হাদীসে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমানত আদায়ের বিশেষ তাকীদ প্রদান করেছেন। হযরত আনাস (রাযি.) বলেন, এমন খুব কম হয়েছে যে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কোন ভাষণ দিয়েছেন অথচ তাতে একথা বলেননি- যার মধ্যে আমানতদারী নেই তার মধ্যে ঈমান নেই। আর যার মধ্যে প্রতিশ্রুতি রক্ষার নিয়মানুবর্তিতা নেই তার ধর্ম নেই। (শুআবুল ঈমান)। অন্য এক হাদীসে মুনাফিকীর লক্ষণ বর্ণনা করতঃ হুযূর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন- যখন তার কাছে কোন আমানত রাখা হয় তখন সে তাতে খিয়ানত করে।

উল্লেখ করা আবশ্যক যে, ‘মিন ওয়াসায়ার রাসূল’ গ্রন্থে আল্লামা ত্বাহা আব্দুল্লাহ উফয়েফী লিখেছেন, মানুষের সব অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ আমান। মুখের আমানত হলো- মুখকে মিথ্যা, পরনিন্দা, গীবত তথা ইসলাম বিরোধী কোন কাজে ব্যবহার না করা। চোখের আমানত হলো- নিষিদ্ধ বস্তুর দিকে দৃষ্টিপাত না করা। কর্ণের আমানত হলো- নাজায়েয, হারাম, শরীয়ত পরিপন্থী কোন কিছু শ্রবণ না করা। অনুরূপভাবে অবশিষ্ট সকল অঙ্গগুলোকেও সংশ্লিষ্ট হারাম কাজে ব্যবহার না করাই আমানত।

তেমনিভাবে মানুষের সঙ্গে আমানত হলো- গচ্ছিত টাকা-পয়সা বা সম্পদ মালিকের হাতে সঠিকভাবে প্রত্যার্পন করা। আমীরের আমানত হলো- অধিনস্তদের উপর ন্যায় বিচার করা। উলামায়ে কিরামের আমানত হলো- সর্বসাধারণকে দ্বীনের আনুগত্যের উপর রাখা এবং সচ্চরিত্রবান করে গড়ে তোলা। তাদেরকে বদ্বীনী তথা আল্লাহর নাফরমানী থেকে ফিরিয়ে রাখা।

সুতরাং সঠিকভাবে আমাদেরকে আমানতের প্রতিও যত্নবান হতে হবে, কখনও খিয়ানত করা যাবে না। কেননা, খিয়ানতকারীদেরকে আল্লাহ ভালোবাসেন না। কুরআনে আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ ফরমান- হে ঈমানদারগণ! খিয়ানত করোনা। আল্লাহর সাথে ও রাসূলের সাথে এবং খিয়ানত করো না নিজেদের পারস্পরিক আনামত জেনেশুনে। (সূরা আনফাল- ২৭ আয়াত)।

অন্যত্র ইরশাদ ফরমান- নিশ্চয়ই আল্লাহ খিয়ানতকারীদেরকে ভালো বাসেন না। (সূরা আনফাল- ৫৮ আয়াত)।

আরও ইরশাদ ফরমান- আল্লাহ পছন্দ করেন না যে বিশ্বাসঘাতক (খিয়ানতকারী) পাপী হয়। (সূরা নিসা- ১০৭ আয়াত)।

সূরা ইউসুফে ইরশাদ ফরমান- আল্লাহ বিশ্বাসঘাতক (খিয়ানতকারী)দের প্রতারণাকে এগুতে দেন না। (সূরা ইউসুফ- ৫২ আয়াত)।

আরেকটি আয়াতে ইরশাদ ফরমান- আল্লাহ তায়ালা কোন বিশ্বাসঘাতক অকৃতজ্ঞকে পছন্দ করেন না। (সূরা হজ্ব- ৩৮ আয়াত)।

উপসংহারঃ

প্রবন্ধের শিরোনামের উপর উপরোক্ত আলোচনা সংক্ষিপ্ত হলেও আশাকরি পাঠক মহল কিছুটা বুঝতে সক্ষম হবেন। তবে বিশেষভাবে বিবেচনার বিষয় হলো, উল্লিখিত আলোচনার সংগে বর্তমান বাস্তবতার মিল কতটুকু রয়েছে? এটা তো সচেতন মহল মাত্র অনুধাবন করতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয়।

আজ একথা অস্বীকার করার কোন উপায় নেই যে, ব্যক্তি পর্যায় থেকে শুরু করে সামাজিক, রাষ্ট্রীয়, আন্তর্জাতিক তথা সার্বিক ক্ষেত্রে সততা, ওয়াদা, আমানতের নির্দেশকে অহরহ লংঘন করা হচ্ছে। বর্তমান পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে, যে যত অধিক হারে মিথ্যা বলতে পারে সে তত বেশী লোক সমাজে সমাদৃত ও সম্মানিত। কিন্তু পরিণামের কথা কখনও চিন্তা করেনা। ওয়াদা পালনের ক্ষেত্রে সবাই অমনোযোগী। ওয়াদা করে আজ একে অন্যকে ধোঁকা দেয়।

রাষ্ট্রপ্রধান, মন্ত্রী-আমলা, রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ জনগণের সঙ্গে ওয়াদা করে প্রতারণা করে থাকেন। এরা সবচেয়ে বেশী ওয়াদা পালনের ক্ষেত্রে দুর্বল ও অনীহ। আজ আমানতের বেলায়ও যথেষ্ট খিয়ানত করা হচ্ছে। কে কত বেশী খিয়ানত করতে পারে সবাই যেন সে প্রতিযোগিতায় মেতে উঠেছে। মন্ত্রী-আমলা, অফিসারবৃন্দ সরকারের দেওয়া আমানতের খিয়ানত অবলীলায় করে যাচ্ছেন। গচ্ছিত সম্পদ আত্মসাৎ করে যাচ্ছেন। স্বয়ং সরকার প্রধানও কখনও কখনও এ অপকর্মে লিপ্ত হয়ে পড়েন।

তাই বর্তমান এই অশান্তিময় অবস্থা থেকে পরিত্রাণ লাভ করতে হলে সততা, ওয়াদা, আমানতের প্রতি আমাদেরকে পূর্ণ মাত্রায় যত্নবান হতে হবে। বিশেষ করে আমাদের দেশের সাধারণ জনগণ থেকে মন্ত্রী-আমলা, সরকার প্রধানসহ সকলকেই কুরআন-হাদীসের নির্দেশ পালন করতঃ এই তিনটি গুণ অর্জন করতে হবে। তাহলেই আমাদের পরকালে মুক্তি এবং দুনিয়াতে শান্তি অনিবার্য। আল্লাহ তায়ালা আমাদের সবাইকে এর উপর আমল করার তাওফীক দান করুন। আমীন।

লেখক: প্রকাশক- উম্মাহ ২৪ ডটকম, সিইও- এম.জেড. ট্রাভেলস এন্ড ট্যুরস এবং ব্যবস্থাপনা পরিচালক- আল-বাশার ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেড, পুরানা পল্টন, ঢাকা।

আরও পড়ুন- ‘বিজ্ঞানের আলোকে রাসূলুল্লাহ (সা.)এর সুন্নাত’