Home বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি পবিত্র কুরআন কী বলে- ‘আসমানের প্রান্তসীমা মানুষ অতিক্রম করতে পারবে?’

পবিত্র কুরআন কী বলে- ‘আসমানের প্রান্তসীমা মানুষ অতিক্রম করতে পারবে?’

।। খন্দকার মুহাম্মদ হাবিবুল্লাহ ।।

সুরা আর রাহমানের ৩৩ নং আয়াতের ব্যাখ্যায় ইদানীং অনেকেই বলছেন যে, এখানে বুঝানো হয়েছে মানুষ যন্ত্র ব্যবহার করে আসমানের প্রান্তসীমা অতিক্রম করতে পারবে এবং মানুষ চাঁদে গিয়ে তা প্রমাণও করেছে। কিন্তু তাদের ব্যাখ্যা মুফাসসিরিনে কেরামের ব্যাখ্যার সাথে মিলে না বলেই আমার মনে হয়েছে। মুফাসসেরিনে কেরাম কী বলেছেন তা আমরা একটু পরেই দেখব। আগে দেখা যাক চাঁদে বা মঙ্গলে যদি মানুষ যায়,সেটাকে আসমানের প্রান্তসীমা অতিক্রম করা বলা যেতে পারে কিনা।

চাঁদে,মঙ্গল গ্রহে বা এ রকম অন্য কোনো গ্রহে মানুষের যাওয়াটাকে আসমানের প্রান্তসীমা অতিক্রম করা বলা যাবে  কিনা তা নির্ভর করছে আসমানের প্রান্তসীমা কোথায় তা জানার উপর। যতক্ষণ আসমানের প্রান্তসীমাটা কোথায় তা নির্ণয় করা না হবে,ততক্ষণ চাঁদে যাওয়া বা তার চেয়েও দূরে যাওয়াটাকে আসমানের প্রান্তসীমা অতিক্রম করা  বলা যাবে না।

 তাহলে আমাদেরকে আগে দেখতে হবে আসমানের প্রান্তসীমাটা কোথায়? তারও আগে জানতে হবে যে, আসমান কী? সেই বিষয়ে একটু পরেই আসছি। আগে আয়াতটি দেখা যাক।  আল্লাহ তা’আলা বলেছেন:

يَا مَعْشَرَ الْجِنِّ وَالْإِنسِ إِنِ اسْتَطَعْتُمْ أَن تَنفُذُوا مِنْ أَقْطَارِ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ فَانفُذُوا ۚ لَا تَنفُذُونَ إِلَّا بِسُلْطَانٍ

 অর্থ: “হে জিন ও মানবকূল, নভোমন্ডল ও ভূমন্ডলের প্রান্তসীমা অতিক্রম করা যদি তোমাদের সাধ্যে কুলায়, তবে অতিক্রম কর। কিন্তু ছাড়পত্র ব্যতীত তোমরা তা অতিক্রম করতে পারবে না”। সুরা আর রাহমান, ৩৩।

 এখানে আসমান ও জমিনের প্রান্তসীমা অতিক্রম করা মানুষের পক্ষে সম্ভব বলে বুঝাতে আল্লাহ তা’লা এই আয়াত নাজিল করেননি। এই আয়াত নাজিল করা হয়েছে এটা বুঝানোর জন্য যে, মানুষ (আল্লাহর বিচার থেকে পালিয়ে বাঁচতে) আসমান জমিনের প্রান্তসীমা অতিক্রম করে পালিয়ে যেতে পারবে না। তবে আল্লাহর আদেশ হলে বা আল্লাহর দেয়া ছাড়পত্র নিয়ে তা পারা যাবে।

 এই যে আল্লাহর দেয়া আদেশ বা অনুমতিপত্র অথবা শক্তি পেলে পারা যাবে বলেছেন,এটাকে আমরা বিশেষ কোনো নবী রাসুলের জন্য বলেই মনে করতে পারি। যেমন রাসুল স. আসমানের প্রান্তসীমা অতিক্রম করেছেন আল্লাহর দেয়া শক্তি এবং অনুমতিক্রমে। তিনি মেরাজে গিয়েছেন আসমানের সীমা অতিক্রম করে। এটা আল্লাহর অনুমতি নিয়ে আল্লাহর ইচ্ছায় হয়েছে। আর ঈসা আ. কেও আল্লাহ আসমানে উঠিয়ে নিয়েছেন।

আসমান কী জিনিস?

আসমান শব্দটি আরবি سماء  সামাউন’থেকে এসেছে। অর্থ –উপরে,জমিনের বিপরীত,উপরের খালি

জায়গা। বাংলায় আকাশ। কোরআনের বিভিন্ন আয়াত থেকে আমরা জানতে পারি যে,আসমানের দুটি অর্থ আছে। একটি অর্থ হচ্ছে আমাদের মাথার উপরের খোলা স্থান। একই অর্থে উপরের সব কিছুকেই আসমান বলা হয়। এই অর্থের পক্ষে দলীল কোরআনের আয়াত-  وَأَنزَلَ مِنَ السَّمَاءِ مَاءً فَأَخْرَجَ بِهِ مِنَ الثَّمَرَاتِ رِزْقًا لَّكُمْ

“আর আকাশ থেকে পানি বর্ষণ করে তোমাদের জন্য ফল-ফসল উৎপাদন করেছেন তোমাদের খাদ্য হিসাবে।” সুরা বাকারা ২২ অন্য আয়াতে  وَأَنزَلْنَا مِنَ السَّمَاءِ مَاءً طَهُورًا

অর্থ: এবং আমি আকাশ থেকে পবিত্রতা অর্জনের জন্যে পানি বর্ষণ করি। সুরা ফুরকারন, ৪৮। অন্য আয়াতে

وَمَا أَنزَلَ اللَّهُ مِنَ السَّمَاءِ مِن مَّاءٍ فَأَحْيَا بِهِ الْأَرْضَ بَعْدَ مَوْتِهَا

অর্থ: আর আল্লাহ তাআলা আকাশ থেকে যে পানি নাযিল করেছেন,তদ্দ্বারা মৃত যমীনকে সজীব করে তুলেছেন। সুরা বাকারা, ১৬৪।

অন্য আয়াতে এসেছে-  َوَهُوَ الَّذِي أَنزَلَ مِنَ السَّمَاءِ مَاءً فَأَخْرَجْنَا بِهِ نَبَاتَ كُلِّ شَيْءٍ

“তিনিই আকাশ থেকে পানি বর্ষণ করেছেন অতঃপর আমি এর দ্বারা সর্বপ্রকার উদ্ভিদ উৎপন্ন করেছি।” সুরা আনআম, ৯৯।

এ রকম আরো অনেক আয়াত আছে যেগুলোতে বলা হয়েছে আল্লাহ তায়ালা আসমান থেকে বৃষ্টি বর্ষণ করেন। আমরা জানি যে, মেঘ থেকে বৃষ্টি হয়। আর মেঘ থাকে আমাদের মাথার কিছুটা উপরের দিকে, খোলা আকাশে। এই খোলা আকাশকে আসমান বলা হয়েছে উক্ত আয়াতগুলোতে।

  আবার কোরআনের অন্য কয়েকটি আয়াত থেকে আসমানের দ্বিতীয় একটি অর্থ বুঝা যায়। সেটা হল আসমান একটি দরজা বিশিষ্ট বস্তু । অনেকটা ছাদের মত। স্তরে স্তরে তা বানানো হয়েছে। যাতে পাহারাদার নিযুক্ত আছে। সেটির অবস্থানও উপরের দিকে। এর পক্ষেও আয়াতে দলিল আছে। সুরা হিজর এর ১৪ ও ১৫ নং আয়াত:

 وَلَوْ فَتَحْنَا عَلَيْهِم بَابًا مِّنَ السَّمَاءِ فَظَلُّوا فِيهِ يَعْرُجُونَ (14) لَقَالُوا إِنَّمَا سُكِّرَتْ أَبْصَارُنَا بَلْ نَحْنُ قَوْمٌ مَّسْحُورُونَ

“যদি আমি ওদের সামনে আকাশের কোন দরজাও খুলে দেই আর তাতে ওরা দিনভর আরোহণ ও করতে থাকে। তবুও ওরা এ কথাই বলবে যে,আমাদের দৃষ্টির বিভ্রাট ঘটানো হয়েছে,না বরং আমরা যাদুগ্রস্থ হয়ে পড়েছি”। অন্য আয়াতে,

إِنَّ الَّذِينَ كَذَّبُوا بِآيَاتِنَا وَاسْتَكْبَرُوا عَنْهَا لَا تُفَتَّحُ لَهُمْ أَبْوَابُ السَّمَاءِ وَلَا يَدْخُلُونَ الْجَنَّةَ حَتَّىٰ يَلِجَ الْجَمَلُ فِي سَمِّ الْخِيَاطِ ۚ وَكَذَٰلِكَ نَجْزِي الْمُجْرِمِينَ

অর্থ: “নিশ্চয়ই যারা আমার আয়াতসমূহকে মিথ্যা বলেছে এবং এগুলো থেকে অহংকার করেছে, তাদের জন্যে আকাশের দ্বার উম্মুক্ত করা হবে না এবং তারা জান্নাতে প্রবেশ করবে না। যে পর্যন্ত না সূচের ছিদ্র দিয়ে উট প্রবেশ করে। আমি এমনিভাবে পাপীদেরকে শাস্তি প্রদান করি”। সুরা আরাফ, ৪০।  আরেকটি আয়াত,

الَّذِي خَلَقَ سَبْعَ سَمَاوَاتٍ طِبَاقًا ۖ

“তিনি সপ্ত আকাশ স্তরে স্তরে সৃষ্টি করেছেন”।সুরা মুলক, আয়াত : ৩। এ আয়াতগুলোতে বুঝা যাচ্ছে, আসমান একটি ছাদের মত বস্তু। যাতে দরজা আছে এবং দরজায় পাহারাদার নিযুক্ত আছে। তাহলে আমরা আসমান শব্দের দুটি অর্থ পেলাম। একটি হচ্ছে খোলা আকাশ। অন্যটি হচ্ছে দরজা বিশিষ্ট আকাশ। যদিও বিজ্ঞানীরা এই দ্বিতীয় অর্থের আসমানটাকে স্বীকার করেন না।

কারণ, তাদের দৃষ্টি সীমায় এখনো সেই আসমান ধরা দেয়নি। বিজ্ঞানীদের মধ্যে অনেকেই আবার কিছু না দেখে বা যন্ত্রপাতির মাধ্যমে হলেও কিছুর অস্তিত্ব বুঝতে না পারলে তা আছে বলে মনে করেন না। তাই তাদের মতে আসমান হচ্ছে খোলা আকাশ। আর দ্বিতীয় অর্থে দরজাবিশিষ্ট আসমান বলতে তাদের কাছে কিছুই নাই। তবে ইদানীং অনেক বিজ্ঞানী বলছেন যে এই মহাবিশ্বে মানুষের দেখা বা জানাশোনা বস্তুর চেয়ে অদেখা বা অজানা বস্তু অনেক অনেক বেশি।

তাহলে দরজা বিশিষ্ট আসমানের অস্তিত্ব নাই তা বলা যাবে না। অনেকের মতে সেই দরজা বিশিষ্ট আসমান আছে মহাবিশ্বের প্রান্তসীমায়,যা মহাবিশ্বকে ঘিরে রেখেছে। এগুলো একটার চেয়ে আরেকটা অনেক অনেক বড়। আর সেই আসমানগুলোর আয়তন এখনো মানুষের কল্পনার চৌহদ্দি থেকে অনেক অনেক দূরে।

মানুষ এই পর্যন্ত যা কিছু নিয়ে গবেষণা করছে তা দরজা বিশিষ্ট আসমানের ভেতরেই। দরজা বিশিষ্ট আসমানের ভেতরের মহাকাশের সীমানা এখনো মানুষ জানতে পারেনি। তাই সেই দরজা বিশিষ্ট আসমানের অস্তিত্ব সম্পর্কেও এখনো মানুষের কোনো ধারণা নাই। বিজ্ঞানীদের মতে দরজা বিশিষ্ট আসমান বলতে কিছু নাই। আবার অনেকে আসমানের প্রথম অর্থ খোলা স্থানকেই শুধু আসমান বলছেন। আর এ-খোলা স্থানকেই বিভিন্ন স্তরে ভাগ করে সাতটি আসমান বলে মনে করছেন। এই অর্থটি অনেক মুফাসসিরিনে কেরামও করেছেন।

তাহলে সুরা আর রাহমানের ৩৩ নং আয়াতে যেই আসমানের কথা বলা হয়েছে সেটা যদি আমরা খোলা আকাশ বলেই মনে করি এবং এর শুরুতেই চাঁদের আগে,আমাদের বাড়ির (পৃথিবী) উঠোনে কয়েকটি সীমা দিয়ে বলি যে এটাই আসমানের সীমানা,তাহলে বলাই যায় যে,চাঁদে গিয়ে মানুষ আসমানের প্রান্তসীমা অতিক্রম করে ফেলেছে। কিন্তু আয়াতে আল্লাহর কথা বলার ধরণ দেখেই বুঝা যাচ্ছে এখানে দ্বিতীয় অর্থে আসমান বুঝানো হয়েছে এবং আল্লাহর অনুমতি ছাড়া কেউ এর প্রান্তসীমা অতিক্রম করতে পারবে না বলে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেয়া হয়েছে।

যেমন ধরা যাক উপরে বর্ণিত সুরা আরাফের ৪০ নং আয়তে যেখানে দরজা বিশিষ্ট আসমানের কথা বলা হয়েছে,সেখানে আরো একটি কথা বলা হয়েছে যে,আল্লাহর আয়াত সমূহকে যারা মিথ্যা বলেছে,তারা জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে না,যে পর্যন্ত না সুচের ছিদ্র দিয়ে উট প্রবেশ করে। এখানে কেউ যদি বিরাট এক সুচ বানিয়ে তার ছিদ্র দিয়ে উট প্রবেশ করিয়ে দেয়,তাহলে বলা যাবে না যে, তারা এবার জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে। এখানে কখনো পারবে না বুঝানো হয়েছে।

ঠিক একইভাবে সুরা আর রহমানের ৩৩ আয়াতেও বুঝানো হয়েছে যে,মানুষ ও জ্বীন কখনো আসমান ও জমিনের প্রান্তসীমা অতিক্রম করতে পারবে না এবং আল্লাহর ধরা থেকেও পালিয়ে বাঁচতে পারবে না। এখন কেউ যদি বাড়ির উঠোনকে (মহাবিশ্বের তুলনায় চাঁদ ও মঙ্গল বাড়ির উঠোনের মত) আসমানের প্রান্তসীমা বানিয়ে,চাঁদে গিয়ে সেটাকে আসমানের প্রান্তসীমা অতিক্রম করেছে বলে দাবি করে,তাহলে ত বড় একটি সুচ বানিয়ে তার ছিদ্র দিয়ে উট প্রবেশ করিয়ে দেয়ার মত হয়ে গেল। তাই সুরা আর রাহমানের ৩৩ নং আয়াতে দরজা বিশিষ্ট আসমানের কথা বলা হয়েছে বলে আমরা ধরে নিতে পারি। যা মানুষ ও জ্বীন কখনো অতিক্রম করতে পারবে না।

অন্য আয়াতে বলা হয়েছে তাদের জন্য আসমানের দরজাও খোলা হবে না এবং তাদেরকে জান্নাতেও প্রবেশ করানো হবে না। এতে বুঝা যাচ্ছে জান্নাত আসমানের উপরেই হবে, (তাফসীরে ক্বুরতুবী)। যেখানে মুমিনদেরকে আসমানের দরজা খুলে প্রবেশ করানো হবে। এ থেকে আরও স্পষ্টভাবেই বুঝা গেল যে প্রথম অর্থে অর্থাৎ খোলা আকাশ অর্থে এই আয়াতে আসমান বুঝানো হয়নি। বরং দরজা ও পাহারাদার বিশিষ্ট আসমানের কথা বুঝানো হয়েছে। যা অতিক্রম করা মানুষ ও জ্বীনের পক্ষে (অনুমতি ছাড়া) সম্ভব নয়।

কিন্তু অন্য একটি আয়াত থেকে বুঝা যাচ্ছে দরজা বিশিষ্ট হলেই আসমানের দ্বিতীয় অর্থ করার কোনো প্রয়োজন নাই। বরং প্রথম অর্থে আসমানের মধ্যেও অর্থাৎ খোলা আকাশেও দরজা থাকতে পারে। আয়াতটি হল

فَفَتَحْنَا أَبْوَابَ السَّمَاءِ بِمَاءٍ مُنْهَمِرٍ

অর্থ: তখন আমি খুলে দিলাম আকাশের দ্বার প্রবল বারিবর্ষণের মাধ্যমে। সুরা কামার, ১১। এখানে দরজা খুলে দিয়ে বৃষ্টি বর্ষণ করার কথা বলা হয়েছে। আমরা জানি মেঘ থেকে বৃষ্টি হয়,আর মেঘ থাকে আমাদের মাথার সামান্য উপরে খোলা আকাশে। তাহলে দরজা বিশিষ্ট হলেই ছাদের মত হতে হবে তা জরুরী নয়। এবার অন্য একটি আয়াতের দিকে নজর দেয়া যাক। এই আয়াত দ্বারা বুঝা যাচ্ছে খোলা স্থানকে আসমান বলা হলেও আসমানের অন্য একটি অর্থ আছে। যা আমি উপরে প্রমাণ করার চেষ্টা করেছি। আয়াতটি হল

أَلَمْ تَرَ أَنَّ اللَّهَ سَخَّرَ لَكُم مَّا فِي الْأَرْضِ وَالْفُلْكَ تَجْرِي فِي الْبَحْرِ بِأَمْرِهِ وَيُمْسِكُ السَّمَاءَ أَن تَقَعَ عَلَى الْأَرْضِ إِلَّا بِإِذْنِهِ ۗ إِنَّ  اللَّهَ بِالنَّاسِ لَرَءُوفٌ رَّحِيمٌ  

অর্থ: তুমি কি দেখ না যে, ভূপৃষ্টে যা আছে এবং সমুদ্রে চলমান নৌকা তৎসমুদয়কে আল্লাহ নিজ আদেশে তোমাদের অধীন করে দিয়েছেন এবং তিনি আকাশ স্থির রাখেন,যাতে তাঁর আদেশ ব্যতীত ভূপৃষ্টে পতিত না হয়। নিশ্চয় আল্লাহ মানুষের প্রতি করুণাশীল, দয়াবান। সুরা হজ্জ ৬৫। এই আয়াতে বলা হয়েছে আসমানকে আল্লাহ এমনভাবে স্থির রাখেন তা যেন জমিনের উপর পতিত না হয়। এ থেকে বুঝা যাচ্ছে যে,যে খোলা স্থান অর্থাৎ মহাশূন্যকে আমরা এতক্ষণ যে আসমান বলে আসছিলাম তাছাড়াও এমন একটি আসমান আছে যা আল্লাহ স্থির না রাখলে জমিনের উপর পড়ে যেত। সেটা অবশ্যই খোলা স্থান বা মহাশূন্য নয়। আর খোলা আকাশকে আসমান ধরে নিলেও সেটাকে মহাশূন্য বলা হয়ে থাকে। সেই মহাশূন্য জমিনের উপর পড়ে যাওয়ার কথা বলা হয়েছে বলে মনে হয় না। শূন্য মানে কিছু নাই। খোলা আকাশ। সেটা এক অর্থে আসমান। আবার জমিনের উপর যেটার পড়ে যাওয়ার আশঙ্কার কথা বলা হয়েছে সেটা নিশ্চয় দ্বিতীয় অর্থের আসমান। আর আসমান জমিনের উপর পড়ে যেত বলে অবশ্যই গ্রহ-নক্ষত্রগুলোকেও বুঝানো হয়নি। কারণ গ্রহ-নক্ষত্রগুলো আসমান নয় বরং তারা আসমানে অবস্থানকারী। যে তারাগুলোকে দিয়ে আল্লাহ আসমানকে সাজিয়েছেন। إِنَّا زَيَّنَّا السَّمَاءَ الدُّنْيَا بِزِينَةٍ الْكَوَاكِبِ অর্থ: নিশ্চয় আমি নিকটবর্তী আকাশকে তারকারাজির দ্বারা সুশোভিত করেছি। সুরা আস সাফফাত, ৬।

আরো একটি আয়াত দেখা যাক-

تَبَارَكَ الَّذِي جَعَلَ فِي السَّمَاءِ بُرُوجاً وَجَعَلَ فِيهَا سِرَاجاً وَقَمَراً مُنِيراً

কল্যাণময় তিনি, যিনি নভোমন্ডলে রাশিচক্র সৃষ্টি করেছেন এবং তাতে রেখেছেন সূর্য ও দীপ্তিময় চন্দ্র। সুরা আল ফুরকান ৬১। অন্য আয়াতে   وَلَقَدْ جَعَلْنَا فِي السَّمَاءِ بُرُوجًا وَزَيَّنَّاهَا لِلنَّاظِرِينَ  অর্থ: নিশ্চয় আমি আকাশে রাশিচক্র সৃষ্টি করেছি এবং তাকে দর্শকদের জন্যে সুশোভিত করে দিয়েছি। সুরা হিজর ১৬।

বুরুজ বলা হয় তারকাগুচ্ছকে। সেটা গ্যালাক্সিও হতে পারে আবার সৌরজগতও হতে পারে। যাইহোক গ্রহ,নক্ষত্র, চাঁদ,সূর্য ইত্যাদি সবই আসমানে অবস্থিত। আবার সেই আসমান খোলা স্থান। তাহলে এখানে আসমান অর্থ খোলা স্থান মনে করতে পারি। আবার যে আসমান পড়ে যাওয়ার আশঙ্কার কথা বলা হয়েছে সেটাকে দ্বিতীয় অর্থে আসমান ধরে নিতে পারি। এবং প্রথম অর্থে আসমানেও দরজা থাকলেও যে আসমানের সীমানা অতিক্রম করা যাবে না বলা হয়েছে সেটা দ্বিতীয় অর্থে আসমান ধরে নিতে পারি।

এখানে বলে রাখা ভাল যে, আসমান সম্পর্কিত আয়াতগুলোকে অনেক মুফাসসেরিনে কেরাম আয়াতে মুতাশাবিহাত آيات متشابهات  বলেছেন। অর্থাৎ এগুলোর মর্মার্থ আমরা বুঝতে না পারলেও এটা বিশ্বাস করি যে আল্লাহ যা বলেছেন সেটাই সত্য,আমরা তার উপর ঈমান এনেছি।  কিন্তু আয়াতে মুতাশাবিহাত বলে আমরা মেনে নিলেও যারা কোরানের আয়াতের উপর আপত্তি তুলতে সচেষ্ট, তারা ত মানবে না।

তারা বলবে যে আল্লাহ বলেছেন,মানুষ কখনো আসমানের প্রান্তসীমা অতিক্রম করতে পারবে না। কিন্তু চাঁদে গিয়ে মানুষ তা করে দেখিয়েছে। তাদের জন্য বলছি যে, সুরা আর রহমানের ৩৩ নং আয়াতের দিকে আবার লক্ষ্য করুন এবং আসমান সম্পর্কিত আয়াতগুলোও লক্ষ্য করুন। বলা হয়েছে মানুষ ও জ্বীন আসমানের ও জমিনের প্রান্তসীমা অতিক্রম করতে পারবে না। এবার আসমান সম্পর্কিত আয়াতগুলোর দিকে আমরা দেখলে এবং মাথার উপরের খোলা আকাশকে আসমান মেনে নিলেও যা বুঝা যাচ্ছ তা হল চাঁদ,সূর্য,গ্রহ-নক্ষত্র ইত্যাদি সব কিছুই আসমানের ভিতরে।

এইসব তারাগুলোতে মানুষ ঘোরাঘুরি করলেও কেও দাবি করতে পারবে না যে,সে আসমানের প্রান্তসীমা অতিক্রম করেছে। যেমন কোনো দেয়াল অতিক্রম করার অর্থ হল দেয়াল টপকিয়ে বা যে কোনোভাবেই হোক তার অপর প্রান্তে চলে যাওয়া। তার ভিতরে থাকাকে অতিক্রম বলা হয় না। বাড়িটা অতিক্রম করার মানে কিন্তু বাড়ির ভিতরে বসে থাকা নয়। তাহলে বুঝাই গেল যে,চাঁদে,মঙ্গলে বা অন্য কোথাও যাওয়া মানে সেটা আসমানের প্রান্তসীমা অতিক্রম করা নয়।

সুরা আর আর রাহমানের ৩৩ নং আয়তাটির ব্যাখ্যায় তাফসিরে তাবারিতে লেখা হয়েছে, إن استطعتم أن تجوزوا أطراف السموات والأرض، فتعجزوا ربكم حتى لا يقدر عليكم؛ فجوزوا ذلك، فإنكم لا تجوزونه إلا بسلطان من ربكم অর্থ: যদি আসমান ও জমিনের সীমানা অতিক্রম করে আল্লাহকে তোমাদের বিচারে অক্ষম করে দিতে পার,তাহলে অতিক্রম করে দেখাও। কিন্তু তোমরা তা পারবে না আল্লাহর অনুমতি ব্যতীত।

মহাকাশ কত বড় তার সামান্য ধারণা নিচে দেয়া হল

এই পর্যন্ত দেখা আসমান বা আকাশের প্রশস্ততা কত বড় মানুষ তা কল্পনাও করতে পারে না। মানুষের কল্পনা শক্তিও হার মানে আকাশের বিশালতার সামনে। আকাশের বিশালতা মাপার জন্য মাইল আর কিলোমিটার যথেষ্ট নয়। আলোর গতির হিসেবে আকাশের দূরত্ব মাপা হয়। আমরা জানি,আলোর গতি প্রতি সেকেন্ডে ১,৮৬,০০০ এক লাখ ছিয়াশি হাজার মাইল বা ৩,০০,০০০ তিন লাখ কিলোমিটার। আমাদের মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সির এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে আলোর গতিতে গেলেও এক লাখ বছর লাগবে। আবার মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সির চেয়ে অনেক অনেক বড় গ্যালাক্সি রয়েছে মহাকাশে। একটা গ্যালাক্সি থেকে আরেকটা গ্যালাক্সির মাঝখানে দূরত্ব হয়ে থাকে প্রায় গ্যালাক্সির আয়তনের চেয়ে অনেক বেশি। এই পর্যন্ত দেখা মহাবিশ্বে কতগুলো গ্যালাক্সি আছে?

ইদানীং বিজ্ঞানীরা বলছেন প্রায় একশত বিলিয়ন গ্যালাক্সি আছে শুধু দৃশ্যমান মহাবিশ্বে। দেখা মহাবিশ্বের আয়তন প্রায় ৯৩ বিলিয়ন আলোকবর্ষ। এটাও শেষ নয়। এর বাইরেও অদেখা জগত রয়েছে। তাও শেষ নয়। প্রতিনিয়ত এই মহাবিশ্ব সম্প্রসারিত হচ্ছে। আল্লাহ বলেন- وَالسَّمَاءَ بَنَيْنَاهَا بِأَيْدٍ وَإِنَّا لَمُوسِعُون  

আর মহাকাশমন্ডল -আমরা তা নির্মাণ করেছি হাতে,আর আমরাই বিশালতার নির্মাতা। সুরা আজ জারিয়াত,৪৭।

وَإِنَّا لَمُوسِعُونَ   এর অর্থ অনেকেই করেছেন ‘আমি সম্প্রসারণকারী।’ এতে বুঝা যাচ্ছে আল্লাহ প্রতি নিয়ত মহাবিশ্বকে সম্প্রসারণ করে চলেছেন। বিজ্ঞানীরাও বলছেন,বিগব্যাঙ এর মাধ্যমে সৃষ্টি হওয়ার পর থেকেই এই মহাবিশ্ব অবিরত সম্প্রসারিত হচ্ছে। এই সম্প্রসারণের গতিও আলোর গতির চেয়ে বেশি।  

আমরা জানি কোনো বস্তুর গতিই আলোর গতির চেয়ে বেশি হতে পারে না। তাহলে মহাবিশ্বের সম্প্রসারণের গতি আলোর গতির চেয়ে বেশি হয় কীভাবে? এই সমস্যার সমাধান আগামী কোনো লেখায় আসবে বলে আশা করছি। আল্লাহ তালা তাওফিক দান করুন।