Home প্রবন্ধ-নিবন্ধ বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতা সংগ্রামে জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশ’র গৌরবময় ভূমিকা

বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতা সংগ্রামে জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশ’র গৌরবময় ভূমিকা

।। মুনির আহমদ ।।

১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ সরাসরি মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার আগে থেকেই জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম সক্রিয় আন্দোলন-সংগ্রামের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতা পক্ষে কাজ করেছে এবং মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় মূলধারার সাথে যুক্ত হয়ে প্রত্যক্ষভাবে রণাঙ্গনেও সক্রিয় ছিল দলটি।

১৯৬৮ সালের ৮ জানুয়ারি পূর্ব পাকিস্তানের ঢাকায় তৎকালীন জমিয়তের সেক্রেটারী জেনারেল মুফতি মাহমুদ রাহ. জামহুরি মজলিস-ই-আমালের প্রধান নেতা ছিলেন; যিনি আইয়ুব খানের শাসনের বিরোধিতা করেছিলেন। ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে মুফতি মাহমুদ রাহ. পশ্চিম পাকিস্তানের ডেরা ইসমাইল খান নির্বাচনী আসনে জুলফিকার আলী ভুট্টোর বিরুদ্ধে বিপুল পরিমাণ ভোট পেয়ে নির্বাচিত হন। ১৯৭০ সালে পাকিস্তানের সাধারণ নির্বাচনের পর ‘জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম অল-পাকিস্তান’-এর সভাপতির দায়িত্বভারও গ্রহণ করেন।

অল-পাকিস্তান জমিয়ত সভাপতি মুফতি মাহমুদ রাহ. ১৯৭১ সালের ১৩ মার্চ এক বক্তব্যে স্পষ্ট ভাষায় ইয়াহিয়া-ভূট্টোর নীতিকে ভুল আখ্যা দিয়ে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি হিসেবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের আহ্বান জানিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, জাতীয় পরিষদে সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের প্রধান হিসেবে শেখ মুজিবকে সরকার গঠনের জন্য আহ্বান জানানো প্রেসিডেন্টের অবশ্যই কর্তব্য। তিনিই পাকিস্তানের প্রথম কোন জাতীয় নেতা- যিনি শেখ মুজিবুর রহমানের আন্দোলনের প্রতি সবাত্মক সমর্থন প্রদান করেছেন। (সূত্র- আশফাক হাশেমী, সাপ্তাহিক কওমী ডাইজেস্ট, মুফতি মাহমুদ রাহ, কায়েদে জমিয়ত -মুফতি মাহমুদ)।

১৯৭১ সালের ১৩ মার্চ অসহযোগ আন্দোলন দমনের জন্য পশ্চিমা শাসকমহল যে আদেশ জারি করেছিল, তার মোকাবিলায় বিরোধী দলীয় নেতা জমিয়ত সভাপতি মুফতি মাহমুদ রাহ. এর সভাপতিত্বে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে অনুষ্ঠিত সভায় সামরিক আইন প্রত্যাহার, ২৫ মার্চের আগেই ক্ষমতা হস্তান্তর এবং সেনাবাহিনীকে ব্যারাকে ফিরিয়ে নেয়ার আহ্বান জানানো হয়। এদিনই পূর্ব পাকিস্তান জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম এর নেতৃত্বে অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের উদ্যোগে শীতলক্ষ্যা নদীতে লক্ষাধিক মানুষ দীর্ঘ নৌ-মিছিল করে স্বাধীনতা আন্দোলনকে এগিয়ে নিতে বিশাল ভূমিকা পালন করে। (সূত্র- দৈনিক আমার দেশ, ৭ মার্চ ২০০৭ইং, মুক্তিযুদ্ধের বয়ানে ইসলাম – পিনাকী ভট্টাচার্য)।

একাত্তরের যুদ্ধের শুরুতেই ২৩ মার্চ পাকিস্তানী শাসকদের রক্তচক্ষুকে উপক্ষা করে পূর্ব পাকিস্তানে এসে শেখ মুজিবুর রহমান-এর সাথে একাধিক বৈঠক করেন অল পাকিস্তান জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের সভাপতি মুফতি মাহমুদ রাহ.। প্রথম বৈঠক বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে অনুষ্ঠিত হয়েছিল। পরে হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে উভয় নেতা আরো বৈঠক করেন। এসব বৈঠকে জমিয়ত সভাপতি মুফতি মাহমুদ পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধিকার আদায়ের দাবীকে জোরালোভাবে সমর্থন করে সাংবাদিক সম্মেলন করেন এবং স্বায়ত্তশাসনের পক্ষে কথা বলেন।

১৯৭১ সালে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান জমিয়তের শীর্ষ নেতা এবং পরবর্তীতে জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশ’র আমৃত্যু সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছিলেন মাওলানা আশরাফ আলী বিশ^নাথী রাহ.। তিনি বলেছেন, “১৯৭১ সালের ১৬ থেকে ২৪ মার্চের মধ্যে ইয়াহইয়া খানের সাথে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দফায় দফায় বৈঠক এবং বিভিন্ন রাজনৈতিক উদ্যোগ ব্যর্থ হলে পশ্চিম পাকিস্তান ফিরে যাওয়ার সময় মুফতি মাহমুদ রাহ. পূর্ব পাকিস্তান জমিয়ত নেতৃবৃন্দকে ৩টি মূল্যবান নির্দেশনা ও মতামত দিয়ে যান। সেখানে আমিও ছিলাম। তিনি পূর্ব পাকিস্তান জমিয়ত নেতৃবৃন্দের উদ্দেশ্যে বলেছিলেন-

(১) পূর্ব পাকিস্তান স্বাধীন রাষ্ট্র হয়ে যাবে। পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকরা এই দেশকে আর ধরে রাখতে পারবে না। আপনারা পূর্ব পাকিস্তানের জমিয়ত নেতা-কর্মী যারা আছেন, তারা এখন থেকেই এই অঞ্চলের স্বাধীনতার পক্ষে প্রত্যক্ষভাবে কাজ শুরু করুন। পাশাপাশি দেশের মানুষকে মুক্তি সংগ্রামে শামিল হতে উৎসাহিত করুন। আমরা যেহেতু পশ্চিম পাকিস্তানে থাকব, আমরা পাকিস্তানের পক্ষে কাজ করব। কিন্তু আপনারা সর্বাত্মকভাবে পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতার পক্ষে কাজ করে যাবেন। এই দেশ স্বাধীন হয়ে যাবে।

(২) আপনারা জামায়াতে ইসলামীর সাথে মিলে কোন কাজ করবেন না। আমরা পশ্চিম পাকিস্তানে জামায়াতের সাথে মিলে কাজ করতে পারব। কারণ, পশ্চিম পাকিস্তানে জামায়াতের তুলনায় জমিয়তের প্রভাব অনেক বেশি। কিন্তু আপনারা জামায়াতের সাথে মিলে কাজ করতে গেলে ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। সুতরাং আপনারা জামায়াত থেকে আলাদা থাকবেন।

(৩) আমি স্পষ্টত: বুঝতে পারছি একই দেশের নাগরিক হিসেবে এটাই আমার শেষ সফর। আগামীতে পূর্ব পাকিস্তানে আসতে হলে ভিসা নিয়েই আসতে হবে। ভিসা ছাড়া আর আসা যাবে না”।

মাসিক মদীনার সম্পাদক জমিয়ত শীর্ষনেতা মাওলানা মুহিউদ্দীন খান এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, আমরা বঙ্গবন্ধুর সাথে বৈঠকের পর মুফতি মাহমুদের সাথে বৈঠক করে সম্ভাব্য যুদ্ধোন্মুখ পরিবেশে পূর্ব পাকিস্তান জমিয়তের ভূমিকা কেমন হবে- এ বিষয়ে জানতে চাইলাম। তিনি তখন জমিয়তের নেতা-কর্মিদেরকে বললেন, “পাকিস্তানী শাসকদের বন্ধু এখন আমেরিকা। আমেরিকা যাদের বন্ধু তারা আমাদের শত্রু। তোমারা পূর্ব পাকিস্তানের অধিকার আদায়ের সংগ্রামের পক্ষে লড়াই করবে। তোমাদেরকে এখানে থাকতে হবে। তোমরা এই অঞ্চলের স্বাধীকারের পক্ষেই কাজ করে যাবে”। (সূত্র- আলেম মুক্তিযোদ্ধার খোঁজে -শাকের হোসাইন শিবলী, মুক্তিযুদ্ধের বয়ানে ইসলাম -পিনাকী ভট্টাচার্য)।

এদেশে জমিয়তে উলামায়ে ইসলামই একমাত্র ইসলামী রাজনৈতিক দল, যে দলটি একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে প্রত্যক্ষভাবে বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করেছে। তাই বাকশালের সময় বঙ্গবন্ধু সব রাজনৈতিক দলকে নিষিদ্ধ করলেও আলেমদের প্রতি শ্রদ্ধা ও মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে কাজ করার ফলে জমিয়তকে নিষিদ্ধ করেননি। (মুক্তিযুদ্ধের বয়ানে ইসলাম -পিনাকী ভট্টাচার্য)।

পশ্চিম পাকিস্তানের তৎকালীন বিরোধী দলীয় নেতা এবং অল পাকিস্তান জমিয়তের সভাপতি মুফতি মাহমুদ রাহ. বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষে নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে পাকিস্তানে ইয়াহিয়া-ভূট্টোর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে ছিলেন। ২৫ মার্চ ঢাকায় গণহত্যার প্রতিবাদে তিনি লাহোরে বাংলাদেশের পক্ষে বিক্ষোভ করেছিলেন। পাকিস্তান পিপলস্ পার্টির নেতা তারেক ওয়াহিদ বাট লিখেছেন, পাকিস্তান জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের সভাপতি মুফতি মাহমুদ সাহেবের বক্তব্য সব সময় বাঙালি মুসলমানদের পক্ষে ছিল। ফলে সে সময় জামায়াতে ইসলামী ও পিপলস পার্টি কর্মীরা মিলে মুফতি মাহমুদের পেশওয়ারস্থ অফিসে আক্রমণ করে। তিনি পাকিস্তানের নাগরিক হয়েও মুক্তিযুদ্ধের অকৃত্রিম এক মহান বন্ধু ছিলেন। (সূত্র- বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ ও উলামায়ে কেরাম -সৈয়দ মবনু)।

সিলেটের জকিগঞ্জ এলাকার মাওলানা আব্দুস সালামের বরাতে করাচির এক আলেমের বক্তব্য আমরা হাতে পেয়েছি। তিনি বলেছেন- “১৯৭১ খ্রিস্টাব্দে আমি করাচির ইউসুফ বান্নুরী মাদ্রাসার ছাত্র ছিলাম। পূর্ব পাকিস্তানে যুদ্ধ শুরু হয়ে গেলে কিছু পাঞ্জাবি ছাত্র আমাদের সাথে উৎপাত শুরু করে দিল। এই সময় একদিন জমিয়ত সভাপতি মুফতি মাহমূদ সাহেব মাদ্রাসায় আসলে আমি তাঁর কাছে ব্যাপারটি উপস্থাপন করলাম। তিনি আমাকে সান্ত¡না দিয়ে বললেন- ‘ডরাও মাত, আল্লাহ হায়’।

মুফতি সাহেবের আগমন সংবাদে আসরের নামাযের পর পর প্রচুর রাজনৈতিক নেতা-কর্মী এবং সাংবাদিক এসে উপস্থিত হলেন মাদ্রাসায়। এই সময় একজন নেতা মুফতি সাহেবকে প্রশ্ন করলেন- ‘হযরত গাদ্দার কো গ্রেফতার কার লে আয়া, লেকিন আভি তাক কাতল্ নেহি কিয়া!’ প্রশ্ন শুনেই মুফতি সাহেব খুব ক্ষুব্ধ হয়ে জিজ্ঞেস করলেন- ‘গাদ্দার কৌন?’ অতঃপর নিজেই বললেন- ‘শেখ মুজিবুর রহমান গাদ্দার নেহি, উয়ে সুন্নী মুসলমান হায়। র্হা সুন্নী মুসলমানকে জান আওর মাল কি হেফাজত র্কা না র্হা সুন্নী মুসলমানকে লিয়ে ওয়াজীব হায়’। পরের দিন এই কথাটা করাচির পত্রিকাসমূহে প্রকাশিত হয়েছিল। (সূত্র- নিউ ওয়াল্ড ওয়ার্ডার ইসলাম আওর ইসলাম, -তারিক ওয়াহিদ বাট)।

বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের পক্ষে সর্বাত্মক সমর্থন, বিবৃতি, বক্তব্য ও মিছিল-সমাবেশ করে ভারতের জমিয়তে উলামায়ে হিন্দও গুরুত্বপূর্ণ সহায়ক ভূমিকা পালন করেছে। পাকিস্তান সরকারের অপপ্রচারে বিশ^বাসী এবং ভারতীয় মুসলমানরা যাতে বিভ্রান্ত না হয়, সে জন্য জমিয়তে উলামায়ে হিন্দের নেতৃবৃন্দ আসাম, পশ্চিমবঙ্গ, দিল্লী, হায়দারাবাদ প্রদেশে বিভিন্ন সভা-সেমিনার, কনভেনশন আয়োজন করে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের পক্ষে জনমত গঠনে ব্যাপক ভূমিকা রাখেন। সীমান্ত অঞ্চলে মাওলানা আসআদ মাদানী রাহ. এর নেতৃত্বে বহু ক্যাম্প স্থাপন করে শরণার্থীদের থাকার ব্যবস্থা করেন।

জমিয়তে উলামায়ে হিন্দ তখন স্পষ্টভাবে ঘোষণা দেয়- “ধর্মের নামে, পবিত্র ইসলামের নামে পাকিস্তান সরকার পূর্ব পাকিস্তানের বুকে যে অমানুষিক নির্যাতন চালাচ্ছে, পবিত্র ইসলাম ধর্মে এরূপ বর্বরতার কোন অবকাশ নেই। এরূপ কল্পনায়ও মহান ইসলামের বুক কেঁপে ওঠে”। (মুক্তিযুদ্ধের বয়ানে ইসলাম -পিনাকী ভট্টাচার্য)।

সারকথা, বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতা সংগ্রামকে সফলতায় নিয়ে যেতে জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশ, জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম পাকিস্তান এবং জমিয়তে উলামায়ে হিন্দ-এর প্রত্যক্ষ সমর্থনই শুধু নয়, বরং যার যার অবস্থান থেকে গৌরবময় ভূমিকাও পালন করেছে।

এমনকি, মহান মুক্তিসংগ্রামের পক্ষে কাজের ক্ষেত্রে কিছুটা শীথিলতার কারণে ১৯৭১ সনের আগস্ট মাসে তৎকালীন সভাপতি পীর মুহসিন উদ্দীন আহমদ দুদু মিয়া রাহ.-কে জমিয়ত সভাপতির পদ থেকে ইস্তফা দিতে হয়। তখন জমিয়তের পৃষ্ঠপোষক মাওলানা আব্দুল করীম শায়খে কৌড়িয়া সভাপতির দায়িত্বভার গ্রহণ করে স্বাধীনতা-সংগ্রামে দলীয় নেতাকর্মীদেরকে ব্যাপকভাবে উজ্জীবিত রাখতে সফল নেতৃত্ব দেন।

জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশ মহান স্বাধীনতার পক্ষে মাঠে-ময়দানে ও রণাঙ্গনে প্রত্যক্ষভাবে দায়িত্ব পালনকারী রাজনৈতিক দল। এই দলের অনেক নেতা প্রত্যক্ষভাবে মুক্তিযুদ্ধে শরীক ছিলেন, আত্মত্যাগ স্বীকার করেছেন। জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশ এই মহান ভূমিকার জন্য গৌরবান্বিতবোধ করে। #