Home ফিকহ ও মাসায়েল ইসলামের আলোকে ‘হিউম্যান মিল্ক ব্যাংক’

ইসলামের আলোকে ‘হিউম্যান মিল্ক ব্যাংক’

।। মাওলানা বাহাউদ্দীন যাকারিয়া ।।

সম্প্রতি ঢাকার একটি হাসপাতালে শিশুদের জন্য Human Milk Bank অর্থাৎ ”মাতৃদুগ্ধ সংগ্রহশালা” খোলা হয়েছে। ব্লাড ব্যাংকের আদলেই হিউম্যান মিল্ক ব্যাংকের যাত্রা শুরু। এ বিষয়টি গণমাধ্যমে প্রকাশিত হওয়ার পর থেকেই ব্যাপক আলোচনা, সমালোচনা শুরু হয়েছে।

বাংলাদেশ হিউম্যান মিল্ক ব্যাংকের সাথে পরিচিত নয়। পশ্চিমাদের দূষিত সমাজে এর প্রচলন রয়েছে বলে জানা যায়। একটি মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশে এর প্রয়োজনীয়তা কতটুকু বা এর নেপথ্যে কোন অসৎ, অশুভ উদ্দেশ্য লুকায়িত কিনা, ইসলামী সভ্যতা-সংস্কৃতি ধ্বংসের সুক্ষ্ম কোন ষড়যন্ত্র কিনা তা চিন্তার বিষয়। তাই হিউম্যান মিল্ক ব্যাংক নিয়ে আলোচনার প্রয়াস পাব এ নিবন্ধে।

জন্মের পর নবজাতকের পক্ষে কোনভাবেই সম্ভব নয় নিজের জীবনকে রক্ষা করার উপকরণ গ্রহণ করা। মায়ের দুধের পরিবর্তে অন্য খাদ্য শিশুর উপযোগী নয়। নবজাতকের স্বাস্থ্য সুরক্ষা এবং পুষ্টি বর্ধনে মায়ের দুধের কোন বিকল্প নেই। সন্তানের খাবারের চাহিদা পুরণার্থে মায়ের স্তনে কুদরতিভাবে দুধ তৈরি হতে থাকে। সন্তান মায়ের স্তন থেকে সেই দুধ পান করে তার খাদ্যের প্রয়োজনীয়তা পূরণ করে।

আল্লাহ তায়ালা মায়ের উপর সন্তানকে দুধ পান করানোর দায়িত্ব অর্পণ করেছেন। মায়ের হৃদয়ে জন্ম নেয়া সন্তানের প্রতি মায়া, মমতা ও ভালোবাসার টানে তিনি নিজ সন্তানকে দুধ পান করিয়ে থাকেন।

নবজাতককে মা ব্যতীত অন্য নারীদেরও দুধ পান করানোর অনুমতি রয়েছে ইসলামে। যে নারী দুধ পান করাবেন তাকে শরীয়তের পরিভাষায় দুধ মা বলা হয়। দুধ মায়ের মর্যাদা আপন মায়ের মতই। দুধ মায়ের স্বামী দুধ পিতা হিসেবে স্বীকৃত। দুধ মায়ের সন্তানেরা দুধ ভাই বোন হিসেবে গণ্য। দুধ মাতা, ভাই, বোনের সাথে পর্দা করতে হয় না। আপন মা, বাবা,ভাই, বোনের সাথে যে সব কাজ হারাম, দুধ মা, বাবা, ভাই, বোনের সাথেও তা হারাম।

পবিত্র কুরআনে আল্লাহ পাক বলছেন, وامهتكم التى ارضعنكم واخواتكم التى من الرضاعة অর্থাৎ তোমাদের জন্য হারাম করা হয়েছে তোমাদের দুগ্ধ মাতা, দুগ্ধ ভগ্নি…। -সূরা নিসা ২৪)
হাদীস শরীফে উল্লেখ হয়েছে يحرم من الرضاعة ما يحرم من النسب অর্থাৎ দুগ্ধ পানের কারণে তাই হারাম, যা রক্তের সম্পর্কের কারণে হারাম। -বুখারী, তিরমিযী, মুসনাদে আহমদ ইবনে হাম্বল।
উক্ত আয়াত ও হাদীস থেকে সুস্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয়- দুগ্ধ মা, বাবা, ভাই, বোনকে বিবাহ করা হারাম। যেহেতু তাদের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার অনুমতি শরীয়তে নেই, তাই তাদের সাথে পর্দা করারও প্রয়োজনীয়তা নেই।

যদি কোন কারণে নবজাতকের মা, বাবা কেউ জীবিত না থাকেন, তাহলে তাকে দুধ পানের ব্যবস্থা করার দায়িত্ব ওয়ারিশদের উপর বর্তায়।

মোটকথা, মা ব্যতীত অন্য নারীর দুধ পানের অনুমতি ইসলামী শরীয়তে দেয়া আছে। তাই আবহমান কাল থেকেই অপর নারীর দুধ পানের প্রচলন সমাজে বিদ্যমান আছে। আমাদের প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকেও হযরত হালিমা রাযি. থেকে দুধ পান করানো হয়েছিল। এ ধারা এখনও অব্যাহত আছে।

ইসলাম নবজাতকের দুধ পানের সময়সীমা নির্ধারণ করে দিয়েছে। পূর্ণ দুই বছর পর্যন্ত দুধ পান করতে পারবে। এর থেকে বেশী সময় দুধ পানের অনুমতি নেই।

হিউম্যান মিল্ক ব্যাংক মানবীয় সহানুভূতির দোহাই দিয়েই প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছে। যে মায়েদের সন্তান জন্মের পর মারা গিয়েছে বা নিজের সন্তানকে খাওয়ানোর পর মায়ের স্তনে অতিরিক্ত দুধ থাকে, তারাই হিউম্যান মিল্ক ব্যাংকে দুধ দান করতে পারবেন। যে নবজাতকের জন্মের পরপরই মা মারা গেছেন বা যাদের মা অসুস্থতা বা অন্য কোন কারনে সন্তানকে দুধ খাওয়াতে পারছেন না, সেই নবজাতকরা এ ব্যাংক থেকে দুধ পানের সুযোগ পেয়ে থাকবে। হিউম্যান মিল্ক ব্যাংকের আমদানি পশ্চিমা দুনিয়া থেকে।

পশ্চিমা সমাজ ব্যবস্থা তাদের এ জাতীয় ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করতে বাধ্য করেছে। পশ্চিমা দুনিয়ায় সামাজিক বন্ধন ভেঙে চুরমার হয়ে গিয়েছে। তাদের সাথে তাল মিলিয়ে চললে আমাদের সমাজ ব্যবস্থাও ভেঙে চুরমার হয়ে যাবে।

ইসলামী সমাজ ব্যবস্থা আর পশ্চিমা সমাজ ব্যবস্থার মধ্যে বিস্তর ব্যবধান রয়েছে। ইসলামী সমাজ ব্যবস্থায় অনৈতিক, অমানবিক, অশ্লীল কোন পথ পদ্ধতির অনুপ্রবেশের সুযোগ রাখা হয়নি। অনুপ্রবেশের সব ছিদ্র বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। ইসলামী সমাজে প্রতিটি নাগরিকের দায়ভারও নির্ধারিত। পিতা, মাতা থেকে শুরু করে শিশু, নারী, বৃদ্ধ, অসহায়, অসুস্থ, এতিম ও প্রতিবন্ধি সবার দায়িত্বভার কারো না কারো উপর দেয়া আছে। দায়ভার পুরনে দায়িত্বশীলদের অনুপস্থিতির বেলায় রাষ্ট্রের উপর তাদের দায়ভার বর্তায়। বায়তুল মাল থেকে রাষ্ট্র তার নাগরিকের প্রয়োজন পুরনে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করবে। ইসলামী রাষ্ট্রে কেউ অভিভাবকহীন, আশ্রয়হীন হয়ে পড়ে থাকতে পারে না।

ইসলাম যেভাবে সামাজিক বন্ধনকে সুদৃঢ় রাখার প্রতি জোর দেয়, তদ্রুপ জোর দেয় সামাজিক বন্ধনকে পবিত্র, স্বচ্ছ ও কালিমামুক্ত রাখার প্রতিও। যে সব উপায় উপকরণ, পথ ও পদ্ধতি অবলম্বনের ফলে সামাজিক বন্ধনের পবিত্রতা, স্বচ্ছতা বিনষ্ট হওয়ার সমূহ সম্ভাবনা দেখা দেয়, তা থেকে দূরে থাকতে বলেছে ইসলাম। একজন মুসলমানের সে সব পথ ও পন্থা পরিহার করা ঈমানের দাবী।

মুসলিম সমাজ থেকে পশ্চিমা সমাজের চিত্র সম্পূর্ণ বিপরীত। পারিবারিক ও সামাজিক বন্ধন পশ্চিমা সমাজে ছিন্ন বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। তাদের সমাজে চলে অবাধ যৌনাচার। যে সব কর্মকাণ্ডের কারণে সামাজিক পবিত্রতা বিনষ্ট হয় তা তাদের সমাজে প্রতিনিয়ত ঘটে থাকে। যে সমাজে বিবাহবহির্ভূত সম্পর্ক দোষনীয় নয়, যে সমাজে অবাধ যৌনাচারের বৈধতা থাকে সে সমাজে জন্ম নেয়া মানবশিশুর জন্য হিউম্যান মিল্ক ব্যাংকের প্রয়োজন থাকতে পারে।

হিউম্যান মিল্ক ব্যাংকে মানবীয় সহানুভূতির আবেগ নিয়ে নারীর দুধ সংগ্রহ, সংরক্ষণ ও বিতরণ করা হবে। বিষয় তিনটি এখানে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। যে কোন একটি অবহেলা কিংবা অব্যবস্থাপনার শিকার হলে এক পর্যায়ে শরীয়তের গুরুত্বপূর্ণ বিধান লঙ্ঘনের পথ সুগম হওয়ার প্রবল সম্ভাবনা তৈরি হবে। কোন শিশু কোন নারীর সংগৃহীত দুধ পান করেছে তা অজানা থাকার কারণে দুধ ভাই বা বোনের সাথে বিবাহ হওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়। যা শরীয়তের দৃষ্টিতে সম্পূর্ণরূপে হারাম।

বিজ্ঞ উলামায়ে কেরাম কঠোর শর্ত সাপেক্ষে মিল্ক ব্যাংকের অনুমতি দিয়ে থাকেন।
* দুধ সংগ্রহের বেলায় পর্দার প্রতি খুবই গুরুত্ব দিতে হবে। সংগ্রহ এবং সংরক্ষণ কাজে পুরুষ কর্মী ব্যবহার থেকে বিরত থাকতে হবে।
* সংগৃহীত দুধ বেচাকেনা করা যাবে না। এটি মানবীয় সহানুভূতির মনোভাব নিয়ে করতে হবে। মানবদুধ বেচাকেনার উদ্দেশ্যে মিল্ক ব্যাংক করা জায়েয হবে না।
* প্রতি মহিলার দুধ স্বতন্ত্রভাবে সংরক্ষণ করতে হবে। কয়েকজনের দুধ একটি পাত্রে রাখা যাবে না। ভিন্ন ভিন্ন পাত্রে সংরক্ষণ করা না হলে ‘হুরমতে রেযায়াতের’ বিধান লঙ্ঘন করা হবে।
* একজন শিশুকে একজন মহিলার সংগৃহীত দুধ পান করাতে হবে। এর ফলে দুগ্ধপান সম্পর্কিয় আত্মীয়তা প্রমাণে সহজ হবে। যদি একজন শিশুকে একাধিক মহিলার দুধ পান করানো হয়, তাহলে ঐ শিশুর রেকর্ডপত্রের সাথে সে সব মহিলাদের রেকর্ড সংযুক্ত রাখতে হবে। মাত্র একবার পান করানো হলেও এভাবেই রেকর্ড সংরক্ষণ করতে হবে।
* যে সব মহিলা থেকে দুধ সংগ্রহ করা হবে তাদের নাম, ঠিকানা সংরক্ষণ করতে হবে।
* যে সব শিশুকে দুধ পান করানো হবে তাদের নাম ঠিকানা সংরক্ষণ করতে হবে।

আমাদের দেশে যেখানে টপ টু বোটাম অব্যবস্থাপনা, অনিয়ম সে ক্ষেত্রে মিল্ক ব্যাংক কতটুকু নিরাপদ, তা কিন্তু গভীরভাবে ভাববার দাবি রাখে। যেসব বিষয়ে সতর্কতা অবলম্বন করা অতীব জরুরি এবং যে শর্তাবলী প্রদত্ত হলো, তা পালন করা জটিলই বটে। এর থেকে উত্তম এবং ঝামেলামুক্ত হলো, সনাতন পদ্ধতি। নবজাতকের দুধের সংকট হলে খালা, চাচী, মামি, ফুফুরাই দুধ পান করাতেন। তাদের অবর্তমানে প্রতিবেশী মহিলারা পান করাতেন। এভাবে দুগ্ধপান করানোর ফলে শরীয়তের বিধান লঙ্ঘনের সম্ভাবনা কম থাকে। একে অপরের জানাশোনা থাকে। তাই এ পদ্ধতিতে শরীয়তের বিধান প্রতিপালনে কোন প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হয় না।

হে আল্লাহ! তুমি আমাদের হেফাজত কর। আমিন।

লেখক: প্রিন্সিপাল- জামিয়া হুসাইনিয়া আরজাবাদ-ঢাকা, সহসভাপতি- বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়া বাংলাদেশ এবং যুগ্মমহাসচিব- জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশ।