Home শিক্ষা ও সাহিত্য আলেমদের একনিষ্ঠ প্রয়াসে বাংলা ভাষায় রচিত হয়েছে বিপুল ইসলামী সাহিত্য

আলেমদের একনিষ্ঠ প্রয়াসে বাংলা ভাষায় রচিত হয়েছে বিপুল ইসলামী সাহিত্য

।। অধ্যাপক ড. আ ফ ম খালিদ হোসেন ।।

সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশের কওমি মাদ্রাসাগুলোতে বাংলা ভাষার অনুশীলন ও চর্চা তুলনামূলক বৃদ্ধি পেয়েছে। ঢাকা ও চট্টগ্রামের বেশ কিছু মাদ্রাসায় দাওরায়ে হাদিস সম্পন্ন করার পর আগ্রহী ছাত্রদের জন্য এক বছর বা দুই বছরব্যাপী বাংলা সাহিত্য, সাংবাদিকতা ও ইসলামী গবেষণা বিভাগ খোলা হয়েছে। প্রাথমিক থেকে নিম্ন মাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত বাংলা ভাষা ও সাহিত্য পাঠ্যতালিকাভুক্ত করা হয়েছে। মাতৃভাষার প্রতি এটা গভীর মমত্ববোধের পরিচয় বহন করে। নিম্ন পর্যায় থেকে দাওরায়ে হাদিস পর্যন্ত ‘শিক্ষার মাধ্যম’ হিসেবে বাংলা চর্চার প্রচলন শুরু হয়েছে বেশ আগে থেকেই।

বাংলা ভাষী কওমি ঘরানার বহু আলেম ছয় দশক ধরে বাংলার চর্চা, অনুশীলন ও প্রচলনের জন্য ব্যাপক চেষ্টা-পরিশ্রম করে আসছেন। এ ক্ষেত্রে মাওলানা শামসুল হক ফরিদপুরী, মুফতি আজিজুল হক, মাওলানা মুহাম্মদ ইউনুছ, খতিবে আযম মাওলানা ছিদ্দিক আহমদ, শায়খুল হাদিস মাওলানা আজিজুল হক, মাওলানা নূর মোহাম্মদ আজমী, মাওলানা মুহিউদ্দীন খান, মাওলানা আমিনুল ইসলাম, মাওলানা আফলাতুন কায়সার, মাওলানা রিজাউল করিম ইসলামাবাদীর নাম সবিশেষ উল্লেখযোগ্য।

পটিয়া জামিয়া ইসলামিয়ার প্রতিষ্ঠাতা মুফতি আজিজুল হক ষাট বছর আগেই ‘বাংলা সাহিত্য ও ইসলামী গবেষণা’ নামে একটি বিভাগ চালু করেন। তারই ধারাবাহিকতায় পটিয়া মাদ্রাসার অন্যতম প্রধান পরিচালক মাওলানা মোহাম্মদ ইউনুছ ইসলামী সাহিত্য ও গবেষণা জার্নাল হিসেবে মাসিক ‘আত-তাওহীদ’ চালু করেন ৪৯ বছর আগে। মাওলানা মুহিউদ্দীন খান সম্পাদিত ‘মাসিক মদীনা’ ছিল এক সময়ে বাংলা ভাষায় দ্বীনি সাহিত্য চর্চার একমাত্র জনপ্রিয় মাধ্যম। মাওলানা নুর মোহাম্মদ আজমী ‘মিশকাত শরিফে’র বঙ্গানুবাদ, শায়খুল হাদিস মাওলানা আজিজুল হকের ‘বুখারি শরিফে’র বাংলা অনুবাদ, মাওলানা আমিনুল ইসলাম কর্তৃক বাংলায় রচিত ৩০ খণ্ডে সমাপ্ত তাফসির গ্রন্থ ‘নুরুল কুরআন’, মাওলানা রিজাউল করীম ইসলামাবাদীর ‘মুয়াত্তা মালিক’-এর অনুবাদ, মাওলানা মুহিউদ্দীন খান রহ.-এর বিপুল অনুবাদ প্রভৃতি ভাষা ও সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছে।

কওমি ঘরানার অনেক আলেম মিডিয়ার জগতে পা রেখেছেন, যা প্রশংসার দাবি রাখে। তাদের মধ্যে অনেকের রয়েছে বিশ^বিদ্যালয়ের ডিগ্রি। এ প্রজন্মের অনেক আলেম বাংলা ভাষায় সাহিত্য চর্চায় এগিয়ে এসেছেন, যা কওমি মাদ্রাসার ছাত্র-শিক্ষকদের মধ্যে বেশ আশার সঞ্চার করে। যেসব আলেম বাংলা ভাষার ব্যাপক চর্চা করেছেন তাদের প্রতি জনগণের রয়েছে গভীর শ্রদ্ধা। দেশের বড় বড় মাদ্রাসা থেকে যেসব নিয়মিত বাংলা মাসিক জার্নাল বের হয়; বাংলা সাহিত্য চর্চা ও দাওয়াতি কার্যক্রমে রয়েছে সেগুলোর তাৎপর্যপূর্ণ অবদান।

এক সময় কিশোরগঞ্জের জামিয়া ইমদাদিয়া থেকে মাওলানা আতাউর রহমান খানের (সাবেক সংসদ সদস্য) সম্পাদনায় একটি বাংলা মাসিক পত্রিকা বের হতো। হাটহাজারী মুঈনুল ইসলাম মাদ্রাসা থেকে ‘মুঈনুল ইসলাম’, ঢাকার ফরিদাবাদ মাদ্রাসা থেকে ‘নেয়ামত’, চট্টগ্রাম দারুল মাআরিফ থেকে ‘আল-হক’, ঢাকার মারকাজুদ দাওয়াহ থেকে ‘আল কাউসার’, ঢাকা মোহাম্মদপুর জামিয়া রহমানিয়া থেকে ‘রাহমানী পয়গাম’, ঢাকা কামরাঙ্গীরচর মাদ্রাসাতুল মদীনা থেকে ‘পুষ্প’, চট্টগ্রাম নাজিরহাট নাছিরুল ইসলাম মাদ্রাসা থেকে ‘দাওয়াতুল হক’, মৌলভীবাজারের বরুনা মাদ্রাসা থেকে ‘হেফাজতে ইসলাম’, সিলেটের দারুল উলুম মাদানিয়া থেকে ‘আল ফারুক’- এসব মাসিক পত্রিকা ভাষার উৎকর্ষ, বিষয়-বৈচিত্র্য ও ভাবগাম্ভীর্যের দিক দিয়ে প্রশংসার দাবি রাখে।

বড় বড় কওমি মাদ্রাসা থেকে প্রতিবছর দাওরায়ে হাদিস সমাপ্তকারীদের উদ্যোগে স্মারক ডায়েরি বের হয় বাংলায়। এতে গুরুত্বপূর্ণ ধর্মীয় নিবন্ধসমূহ প্রকাশিত হয়। বিগত ২০ বছরে কওমি আলেমদের একনিষ্ঠ প্রয়াসের ফলে বাংলা ভাষায় রচিত হয়েছে বিপুল ইসলামী সাহিত্য। আরবি-উর্দু থেকে অনূদিত হয়েছে রেকর্ড পরিমাণ তাফসির, হাদিস, ফিকহ, ইতিহাস, সিরাত ও জীবনী বিষয়ক মৌলিক গ্রন্থ। একজন আলেমের লিখিত বাংলা বানান, প্রমিত উচ্চারণ ও ভাষারীতির ৩০০ পৃষ্ঠার গাইডবুক ‘বানানচর্চা’ বেশ পাঠকপ্রিয়তা পেয়েছে। আরেক আলেমের লিখিত বানান বিষয়ক গ্রন্থও শিক্ষার্থীদের হাতে পৌঁছে গেছে।

শতাব্দীর বিরলপ্রজ ইসলামী গবেষক ও বরেণ্য স্কলার আল্লামা সাইয়িদ আবুল হাসান আলী নদভী ১৯৮৪ সালে বাংলাদেশ সফরকালে কওমি আলেমদের সমাবেশে যে কথা বলেছিলেন তা বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য- ‘বাংলা ভাষার সাধারণ চর্চা এখন আর যথেষ্ট নয়। এ কাজ সবাই করবেন। এখন কিছু মানুষকে বাংলা ভাষার কর্তৃত্ব হাতে নেওয়ার জন্য প্রাণপণ সাধনায় আত্মনিয়োগ করতে হবে। এটা আলেমদের অস্তিত্ব রক্ষার জন্য জরুরি, তেমনি বাংলা ভাষাভাষী মুসলমান ও খোদ বাংলা ভাষার জন্যও অপরিহার্য।

বাংলা ভাষার শোধন, সংস্কার ও সমৃদ্ধির জন্য এ কাজ খুবই জরুরি। কেননা দীর্ঘদিন ধরে বাংলা ভাষার কর্তৃত্ব ইসলামবিরোধী গোষ্ঠীর হাতে; যাদের চিন্তা ও চেতনা এবং জীবন ও চরিত্র কলুষমুক্ত নয়; বরং তারা আকিদা ও চিন্তাগত ভ্রান্তিতে আক্রান্ত। তাদের মাধ্যমে এ ভাষাতেও প্রবেশ করেছে কলুষ ও চিন্তার বিষবাষ্প। এ জন্য বাংলা ভাষায় রূহ ও রূহানিয়াত এবং প্রাণ ও প্রাণময়তা সৃষ্টি ও সঠিক পরিচর্যার জন্য এমন কিছু মানুষকে প্রাণপণ সাধনায় আত্মনিয়োগ করতে হবে, যারা সমুন্নত চিন্তাচেতনা এবং পবিত্র রুচি ও আদর্শের অধিকারী। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যকে ইসলাম বিরোধীদের দয়া-করুণার ওপর ছেড়ে দেবেন না। ‘ওরা লিখবে আর আপনারা পড়বেন’- এ অবস্থা কিছুতেই বরদাশত করা উচিত নয়’।

সত্য কথা বলতে, বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে পারঙ্গম একদল আলেম কলমসৈনিকের আজ বড্ড প্রয়োজন। বাংলা ভাষার চর্চা যদি আলেমরা না করেন, তাহলে কওমি ও মিল্লাতের সমূহ ক্ষতির কারণ হতে পারে। যেসব কওমি মাদ্রাসা বাংলা ভাষা ও সাহিত্য চর্চায় পেছনে রয়েছে, জনগণের প্রত্যাশা হচ্ছে- সময়ের দাবি ও যুগ চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ অনুকূল মনোভাব নিয়ে আরও এগিয়ে আসবেন।

লেখক: অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান, ওমর গণি এমইএস ডিগ্রি কলেজ, চট্টগ্রাম|