Home ফিকহ ও মাসায়েল ইতিকাফের তাৎপর্য, নিয়মাবলী এবং জরুরী মাসায়েল

ইতিকাফের তাৎপর্য, নিয়মাবলী এবং জরুরী মাসায়েল

- উম্মাহ গ্রাফিক্স।

।। মুফতি জাকির হোসাইন কাসেমী ।।

পবিত্র কুরআন মাজীদে মহান আল্লাহ ইরশাদ করেন- “এবং আমি ফরমান জারি করলাম, ইব্রাহীম ও (তৎপুত্র) ইসমাঈলের প্রতি তোমরা পাক পবিত্র রাখ আমার ঘরকে তাওয়াফকারী, ইতিকাফকারী ও রুকু সিজদাকারীগণের জন্য”। (সূরা বাক্বারাহ- ১২৫)।

ইতিকাফ অর্থ কোন স্থানে নিজেকে আবদ্ধ করে রাখা। শরীয়তের পরিভাষায় ইতিকাফ-এর অর্থ হচ্ছে- বিশেষ সময় এক বিশেষ নিয়মে নিজেকে মসজিদে আবদ্ধ রাখা। ইতিকাফ মানুষকে দুনিয়ার ঝামেলা ত্যাগ করার অভ্যাস শিক্ষা দেয়, অল্প কাজের জন্য হলেও আল্লাহর সাথে তার সম্পর্ক জুড়িয়ে দেয়। এতে মানুষের অপেক্ষায় অন্তিমকালের দুনিয়া ত্যাগ করা সহজ হয় এবং দুনিয়ার মুহাব্বতের স্থলে আল্লাহর মুহাব্বত বৃদ্ধি পায়। ইতিকাফকারীর উদাহরণ হচ্ছে, সেই নিরুপায় ব্যক্তির ন্যায়, যে কোন মহান ব্যক্তির দরবারে হাত পেতে থাকে এবং বলে, যে যাবৎ না আমার হাজাত পূর্ণ করা হয়, এ দরবার ত্যাগ করব না।

ইতিকাফ তিন প্রকার- ওয়াজিব, সুন্নাত ও মুস্তাহাব। (১) ইতিকাফ করার জন্য মান্নত করা হলে তা পূর্ণ করা ওয়াজিব এবং সেই ইতিকাফ রোযা সহকারে হতে হবে। (২) রমযানের শেষ ১০ দিন ইতিকাফ করা সুন্নাতে মুয়াক্কাদা। একবার ছাড়া নবী করীম (সা.) এটা বারবার করেছেন। তবে আমাদের ফকীহগণ এটাকে সুন্নাতে মুয়াক্কাদায়ে ক্বিফায়াহ বলেন। অর্থাৎ মসজিদের মহল্লার অধিবাসীদের মধ্যে কেউ তা করলে অপর লোকেরা গোনাহ হতে বেঁচে যাবে। আর কেউই না করলে সকলেই গুনাহগার হবে।

(৩) ওয়াজিব ও সুন্নাত ইতিকাফ ছাড়া অপর ইতিকাফ মুস্তাহাব। এটা স্বল্প সময়ের জন্যও হতে পারে। সুন্নাত ইতিকাফ রমযানের ২০ তারিখ সূর্যাস্তের পূর্বে মসজিদে প্রবেশ করবে এবং রমযানের শেষ তারিখে সূর্যাস্তের পর, অর্থাৎ- ঈদের চাঁদ দেখা গেলে মসজিদ হতে বের হবে। মসজিদে অবস্থানকালে চুপ করে না থেকে নফল নামায, কুরআন তিলাওয়াত বা আল্লাহর যিকির করা উচিত। একেবারে চুপ থাকা বা দুনিয়াবী কথা বলা, উভয়টাই নিষেধ। পাঞ্জেগানা মসজিদ, যেখানে নিয়মিত জামাত হয়, সেখানে ইতিকাফ করা জায়েয। তবে জুমাআর মসজিদে করা উত্তম। স্ত্রী লোক আপন ঘরে একটি স্থান ঘিরে নিয়ে তথায় ইতিকাফ করবে।

আরও পড়তে পারেন-

‘ইবাদুর রাহমান’ বা আল্লাহর প্রিয় বান্দাদের বিশেষ ১২টি গুণ

কোভিড-১৯ মহামারী এবং ইসলামের শিক্ষা: ফরহাদ মজহার

আদর্শবানরূপে নিজেকে গড়তে চাইলে চার গুণাবলী অর্জন করতে হবে

‘হিজাব’ করোনাভাইরাস প্রতিরোধে গুরুত্বপূর্ণ সহায়তা করে: মার্কিন গবেষক!

বিশ্বকে প্রবলভাবে নাড়িয়ে দিয়েছে করোনাভাইরাস

হযরত আয়েশা (রাযি.) হতে বর্ণিত আছে যে, নবী কারীম (সা.) বরাবর রমযানের শেষ ১০ দিকে ইতিকাফ করেছেন, যে যাবত না আল্লাহ তাআলা তাঁকে উঠিয়ে নিয়েছেন। এবং তার পর তাঁর বিবিগণ ইতিকাফ করেছেন। (বুখারী ও মুসলিম)।

হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রাযি.) বলেন, দানের ব্যাপারে রাসূল (সা.) ছিলেন মানুষের মধ্যে সর্বাপেক্ষা দরাজ দিলের। আর তার এই দরাজদিল বেড়ে যেত রমযানে সর্বাপেক্ষা অধিক প্রত্যেক রাতে হযরত জিব্রাইল (আ.) তার সাথে সাক্ষাত করতেন। এবং তিনি নবী করীম (সা.)কে কুরআন পাক শুনাতেন। যখন তাঁর সাথে জিবরাইল (আ.) সাক্ষাত করতেন, তার দান বর্ষণকারী বাতাস অপেক্ষাও বেড়ে যেত। (বুখারী ও মুসলিম)।

হযরত ইবনে আব্বাস (রাযি.) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূল (সা.) ইতিকাফকারী সম্পর্কে বলেছেন যে, গুনাহ সমহ হতে বেঁচে থাকা এবং তার জন্য নেক কাজ করা। (মিশকাত, ইবনে মাজাহ)। হযরত ইরবাজ ইবনে সারীয়া (রাযি.) বলেন, আমি রাসূল (সা.)কে বলতে শুনেছি, যে ব্যাক্তি আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের উদ্দেশ্যে একদিন ইতিকাফ করবে আল্লাহ তাআলা জাহান্নাম হতে তাকে তিন খন্দক দূরে রাখবেন। যার দূরত্ব আসমান হতে যমীনের দূরত্বের চাইতেও বেশী। (তাবরানী, বায়হাকী)।

শরীয়তের পরিভাষায় ইতিকাফ বলা হয় ইতিকাফের নিয়্যাতে মসজিদে অবস্থান করা এবং যে সকল কাজ মসজিদে সম্পাদন করা সম্ভব নয় (যেমন) প্রশ্রাব-পায়খানা, ওয়াজিব গোসল ইত্যাদি) শুধু মাত্র এগুলো ছাড়া অন্য কোন কাজের জন্য মসজিদ থেকে বের না হওয়া ইতিকাফ। ইতিকাফ সম্পর্কিত কয়েকটি মাসআলা নিম্নে বর্ণিত হলো-

১। রমযানের শেষ ১০ দিন ইতিকাফ করা সুন্নাতে মুয়াক্কাদায়ে কিফায়াহ। বড় শহরবাসী প্রতি মহল্লার একজন এবং ছোট গ্রামের প্রতি বস্তি থেকে একজন করে ইতিকাফ না করলে এলাকার সকল লোক সুন্নাত পরিহারের দায়ে দায়ী হবেন। যদি একজনও ইতিকাফ পালন করে, তবে এলাকার সকলের পক্ষ হতে সুন্নাত আদায় হয়ে যাবে। কাউকে বিনিময় দিয়ে ইতিকাফে বসালে গুনাহ থেকে রক্ষা পাওয়া যাবে না।

২। ইতিকাফকারীর জন্য একেবারে নিরব থাকা আবশ্যক নয় বরং; মাকরুহ। কারো সমালোচনা করা এবং ঝগড়া ফাসাদ ও অহেতুক গল্প গুজব থেকে বিরত থাকা আবশ্যক।

৩। ইতিকাফের নির্দিষ্ট কোন ইবাদত নেই। নামায, তিলাওয়াত, ধর্মীয় গ্রন্থাদির পঠন এবং ইচ্ছা অনুযায়ী যে কোন ইবাদত করতে পারা যাবে।

৪। যে মসজিদে ইতিকাফ করা হয়েছে তা যদি জামে মসজিদ না হয়, তবে জুমার নামাযের জন্য অনুমান করে উক্ত মসজিদ থেকে এতটুকু সময় হাতে নিয়ে বের হতে হবে, যেন জুমা মসজিদে পৌঁছে সুন্নাত আদায় করে খুতবা শুনতে পারা যায়। তার পূর্বে পৌঁছলেও ইতিকাফ নষ্ট হবে না।

৫। কোন ব্যক্তির যদি এমন ব্যবসা-বাণিজ্য থাকে, যা ছাড়া তার দৈনন্দিন খরচ নির্বাহ হয় না, তখন ইতিকাফকারী মাল উপস্থিত করা ছাড়া বেচা-কেনা করতে পারবে।

৬। পেশাব-পায়খানা থেকে ফেরার সময় পুকুরে ওযূ করতে যা সময় লাগে, ঐ সময়ে ওযূ না করে শরীরের প্রশান্তির জন্য গোসল করে নিলে কোন অসুবিধা নেই।

৭। ঘর থেকে খাবার আনার জন্য কেউ না থাকলে ইতিকাফকারী নিজেই ঘর থেকে খাবার নিয়ে আসতে পারবে, অথবা খেয়ে আসতে পারবে। তবে প্রয়োজনের অতিরিক্ত সময় ব্যয় করতে পারবে না।

৮। প্রাকৃতিক অথবা শরয়ী প্রয়োজন ব্যতীত স্বল্প সময়ের জন্যও মসজিদ থেকে বের হলে ইতিকাফ ভঙ্গ হয়ে যাবে। চাই ইচছাকৃত হোক কিংবা ভুল ক্রমেই হোক। এমতাবস্থায় ইতিকাফ ক্বাযা করা ওয়াজিব।

৯। রমযানের শেষ দশদিনের ইতিকাফ করতে হলে বিশ তারিখের সূর্যাস্তের পূর্বেই মসজিদে প্রবেশ করতে হবে এবং ঈদের চাঁদ দেখার পর মসজিদ থেকে বের হতে হবে।

১০। ইতিকাফকারীর জন্য জুমার দিনের গোসল অথবা শুধুমাত্র শীতলতা বা প্রশান্তি লাভের উদ্দেশ্যে গোসলের জন্য মসজিদ থেকে বের হওয়া জায়েয নয়। (জাওয়াহিরুল ফিক্বাহ- ১/৩৮৩)।

১১। অনুরুপ জানাযার নামায, রোগী দেখা, পানাহার, নিদ্রা যাওয়া ইত্যাদির উদ্দেশ্যে বের হলেও ইতিকাফ ভঙ্গ হয়ে যাবে। (বাদায়ে)।

১২। ইতিকাফকারী ভুলবশতঃ যদি মসজিদ থেকে বের হয়ে যায়, তবুও ইতিকাফ ভঙ্গ হয়ে যাবে। (শরহে তানবীর দ্রষ্টব্য)। ইতিকাফকারী যদি বিনা ওজরে ভুলবশতঃ মসজিদ থেকে অল্প সময়ের জন্যও বের হয় এবং ঘুরাফিরা করার নিয়্যাতও না থাকে, তবুও ইতিকাফ ভঙ্গ হয়ে যাবে। (দুররে মুখতার- ২/৪৪৫, আহসানুল ফাতওয়া)।

১৩। শরয়ী প্রয়োজনে ইতিকাফকারী মসজিদ থেকে বের হতে পারবে। যেমন, জুমার জন্য এবং নির্ধারিত মুয়াজ্জিনের উপস্থিতিতেও আযান দেওয়ার জন্য বের হওয়া। (দুররে মুখতার- ৩/৪৪৫, আহসানুল ফাতাওয়া- ৪/৪৯৮ পৃষ্ঠা)।

১৪। নফল ইতিকাফের ক্বাযা করা ওয়াজিন নয়। কেননা নফল ইতিকাফ অবস্থায় মসজিদ থেকে বের হওয়ার ফলে শুধু ভঙ্গ হয় না। বরং তখনই তা নিঃশেষ হয়ে যায় কোন ব্যক্তি যদি নির্দিষ্ট অথবা অনির্দিষ্ট সময়ের জন্য ইতিকাফের মান্নত করে এবং সে মান্নতের কোন এক সময়ের ইতিকাফ ভঙ্গ হয়ে যায়, তাহলে নতুনভাবে আবার পূর্ণ ইতিকাফ ক্বাযা করা ওয়াজিব। কারণ মান্নতের মধ্যে ধারাবাহিকতা রক্ষা করা ওয়াজিব। রমযানের শেষ দশকের সুন্নাত ইতিকাফের মধ্যে যদি কোন একটি, ইতিকাফ ভঙ্গ হয়ে যায়, তাহলে শুধুমাত্র ঐদিনের ইতিকাফ ক্বাযা করা ওয়াজিব। ভেঙ্গে যাওয়ার ফলে সে ইতিকাফ নফলে পরিণত হয়ে যায়। একদিনের ক্বাযা চাই রমযানের মধ্যে হোক বা রমযানের বাইরে হোক। নফল রোযার সাথে যখনই হোক আদায় করতে হবে। (আহসানুল ফাতওয়া ৪/৫০১, দুররে মুখতার ২/৪৪)। কিন্তু পূর্ণ দশদিনের ইতিকাফ ক্বাযা করা উত্তম। (ফাতওয়ায়ে রহীমিয়া- ৫/২০৬ পৃষ্ঠা)।

১৫। যদি ইতিকাফকারী প্রাকৃতিক প্রয়োজন (প্রশ্রাব-পায়খানা) ইত্যাদি সম্পন্ন করার জন্য বাইরে যায় এবং তখন পায়খানা খালি না থাকে, তাহলে বাইরে অপেক্ষা করা জায়েয আছে। (আহসানুল ফাতাওয়া- ৪/৫০১ পৃষ্ঠা)।

১৬। ইতিকাফকারীর জন্য মসজিদের এক কোণে পর্দা ইত্যাদি দিয়ে স্থান নির্ধারিত করা মুস্তাহাব। কারণ এর দ্বারা নিজের সতর হিফাযত করা ছাড়াও অন্যান্য সুবিধাদি রয়েছে। হুযুর (সা.) এর জন্য চাটাই এর কক্ষ তৈরী করার প্রমাণ রয়েছে। এটা বিদআত নয়। কিন্তু ইতিকাফকারীকে এদিকে অবশ্যই লক্ষ্য রাখতে হবে যে, প্রয়োজনের অতিরিক্ত জায়গা ব্যবহারের কারণে যাতে নামাযীদের কোন ধরনের অসুবিধা না হয় এবং কাতার সোজা করতে ব্যঘাত না ঘটে। (শরহে মিশকাত- ৪/৩২৯, তা’লিকে সাবআ-২/৪১৫, ফাতাওয়ায়ে রহীমিয়্যাহ- ৫/২০৫ পৃষ্ঠা)।

১৭। প্রাকৃতিক ও শরয়ী প্রয়োজন ব্যতীত অন্যান্য কারণে মসজিদ থেকে বের হলে ইতিকাফ ভঙ্গ হয়ে যাবে। যেমন- পানিতে ডুবন্ত কিংবা অগ্নিতে জ্বলন্ত ব্যক্তির সাহায্যার্থে মসজিদ থেকে বের হওয়া আবশ্যকীয় কর্তব্য হয়ে পড়ে, কিন্তু বের হলে ইতিকাফ ভেঙ্গে যাবে। (ফাতওয়ায়ে রহীমিয়া- ৫/২০৮ পৃষ্ঠা)।

১৮। ইতিকাফকারী ব্যতীত মসজিদের ভিতরে ইফতার করা মাকরুহ। কিন্তু যদি মসজিদের ভিতরে প্রবেশের সময়ে বা যখনই স্মরণ হবে তখন নফল ইতিকাফের নিয়্যাত করে নেয়, তাহলে মসজিদের ভিতর ইফতার করতে পারবে। (আলমগীরি-৬/২১৫, ফাতওয়ায়ে রহীমিয়া- ৫/২০৫)।

ইফতার করতে হৈ হল্লা এবং চেঁছামেছিতে মসজিদের মর্যাদা ক্ষুণ্ন করা এবং মসজিদের বিছানাদি (মুসল্লা) নষ্ট ও এলোমেলো করা মাকরুহে তাহরিমী থেকে মুক্ত নয়। (শরহে মুনিয়্যা- ৫৬৭ পৃঃ দ্রষ্টব্য)।

লেখকঃ মুহাদ্দিস- জামিয়া মাদানিয়া বারিধারা ঢাকা, খতীব- তিস্তা গেট জামে মসজিদ টঙ্গী, গাজীপুর, উপদেষ্টা- উম্মাহ ২৪ ডট কম এবং কেন্দ্রীয় অর্থসম্পাদক- জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশ। ই-মেইল- muftijakir9822@gmail.com

উম্মাহ২৪ডটকম: আরএএম

উম্মাহ পড়তে ক্লিক করুন-
https://www.ummah24.com

করোনা আক্রান্ত হয়ে যেসব অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয়েছিলেন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী