Home ইতিহাস ও জীবনী ইতিহাসের ধুলোকালি: ভুলিয়ে দেয়া ইতিহাস আর ভুল বুঝানো ইতিহাস

ইতিহাসের ধুলোকালি: ভুলিয়ে দেয়া ইতিহাস আর ভুল বুঝানো ইতিহাস

আপনি আজ যদি ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস দেখেন, সেখানে দেখে মনে হবে, শুধু হিন্দু ধর্মাবলম্বিরাই স্বাধীনতা সংগ্রাম করেছে। আপনি দেখবেন, যারা জেল খেটেছেন তাঁদের মধ্যে নাম আছে গান্ধী, নেহেরু, মতিলাল, সুভাষ বোস, কৃষ্ণ মেনন, সরোজিনী নাইড়ু, অরবিন্দ, চিত্তরঞ্জন; তাঁদের নাম। যারা প্রাণ দিয়েছেন তাঁদের নামের তালিকায় দেখবেন, ক্ষুদিরাম, বাঘাযতীন, প্রফুল্ল চাকী, বিনয়, বাদল, দীনেশ, ভগত সিং, প্রীতিলতা, সূর্যসেন। সন্ত্রাসবাদী দলের মধ্যে নাম আছে অনুশীলন আর যুগান্তরের। ইতিহাসে যাদের নাম উল্লেখ আছে অবশ্যই তারা আমাদের সম্মানীয়। কিন্তু এই তালিকায় কোথাও কোন মুসলমানের নাম নেই কেন? মুসলমানেরা কি ছিল না স্বাধীনতা সংগ্রামের সেই লড়াইয়ে? খুব ছিল। তবে তাঁদের নাম নেই কেন? কারণ, সেগুলো সযত্নে মুছে ফেলা হয়েছে।

১৭৫৭ থেকে ১৯৪৭ এই একশো নব্বই বছরে হাজার হাজার মুসলমান স্বাধীনতা সংগ্রামী জীবন দিয়েছেন, জেল খেটেছেন। কোলকাতা সিটি কলেজের ইংরেজী বিভাগের প্রধান ও রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিজিটিং প্রফেসর শ্রী শান্তিময় রায়কে এক প্রবীণ কংগ্রেসি বলেছিলেন, “স্বাধীনতা সংগ্রামে মুসলমানদের ভূমিকা ছিল বৈরি”। এই ঘটনা শান্তিময় রায়কে বিচলিত করে দেয়। পরবর্তীতে তিনি “ভারতের মুক্তি সংগ্রাম ও মুসলিম অবদান” নামে এক গবেষণা মূলক গ্রন্থ রচনা করেন। সেখানে উঠে আসে সব বীরত্বের কথা, যা চেপে রাখা হয়েছিল এবং এখনো হচ্ছে।

আপনাদের সাথে শুধু কয়েকটা শেয়ার করছি।

হাকিম আজমল খাঁ ছিলেন সর্ব-ভারতের কংগ্রেসের প্রেসিডেন্ট। সেই সময়ের বিখ্যাত চিকিৎসক। দিল্লীর বাইরে গেলে ফি নিতেন সেই সময়ে এক হাজার টাকা। গরীবদের কাছে থেকে কোন পয়সা নিতেন না। কংগ্রেস নেতা হিসেবে জেল খেটেছেন বহু বছর। নেহেরুর চাইতে তো কম না। সর্বভারতীয় কংগ্রেস সভাপতি হওয়া সত্ত্বেও তাঁর নামটাও ভারতের ইতিহাসে নেই। এমনকি মওলানা আজাদ যে জেল খেটেছিলেন, সেই ইতিহাসও নেই।

খাজা আব্দুল মজিদ, ইংল্যান্ড থেকে ব্যারিস্টারি পাশ করেন। নেহেরুর সমসাময়িক কংগ্রেস নেতা। তিনি ও তাঁর স্ত্রী দু’জনেই জেল খেটেছেন বহু বছর। কোথাও এটার উল্লেখ নেই।

নেতাজী সুভাষ বসুর ডান হাত ও বাম হাতের মতো ছিলেন, আবিদ হাসান এবং শাহেনেওয়াজ খান। এদের নাম আছে কোথাও? তাঁর রাজনৈতিক সংগ্রামে আর আজাদ হিন্দ ফৌজে ছিলেন, আজিজ আহমেদ, লেফটেন্যান্ট কর্নেল জেড কিয়ানি, ডি এম খান, আব্দুল করিম গনি, কর্নেল জিলানী। ইতিহাসে এঁদের কারোর নাম নেই।

অমৃতসরের জালিয়ানয়ালাবাগের যে ম্যাসাকারের কথা আমরা জানি, সেটা কার গ্রেপ্তারের প্রতিবাদে হয়েছিল? সেটা হয়েছিল কংগ্রেস নেতা সাইফুদ্দিন কিচলুর গ্রেপ্তারের প্রতিবাদে। তিনি ছিলেন অতি জনপ্রিয় নেতা। জনতা তাঁর গ্রেপ্তারের সংবাদে ফুঁসে উঠেছিল। জার্মানি থেকে ব্যারিস্টারি পাশ করে আসা সাইফুদ্দিন কিচলুকে যাবজ্জীবন দ্বীপান্তরে পাঠানো হয়। জালিয়ানোয়ালাবাগের নাম জানি, সেখানে ম্যাসাকার হয়েছিল সেটা জানি, জেনারেল ডায়েরের কথা জানি- যিনি গুলি চালানোর আদেশ দিয়েছিলেন। কিন্তু যিনি এই প্রতিবাদের প্রাণপুরুষ ছিলেন, সেই ব্যারিস্টার সাইফুদ্দিন কিচলু ইতিহাসের পাতা থেকে একদম হাওয়া। অদ্ভুত নয়?

আমরা গোপন সন্ত্রাসবাদী দল অনুশীলন যুগান্তরের কথা জানি, যেখানে মুসলমানদের প্রবেশ নিষিদ্ধ ছিল, কিন্তু ইনকেলাবি পার্টির কথা জানি না। তাঁদের নেতা ছিলেন পাহলোয়ান শিশু খান। পাহলোয়ান শিশু খান ইংরেজ বাহিনীর সাথে সম্মুখ যুদ্ধে শাহাদাত বরণ করেন। শিশু খানের নাম ইতিহাসের কোথাও এখন নেই।

ক্ষুদিরাম কিংস্ফোর্ডকে হত্যা করতে গিয়ে ব্যর্থ হয়েছিলেন। কিংস্ফোর্ডের বদলে ভুলে দু’জন ইংরেজ নারী নিহত হয়। ক্ষুদিরাম আমাদের কাছে বীর। কিন্তু মুহাম্মদ আব্দুল্লাহ কলকাতা হাইকোর্টের বিচারপতি নরম্যান যিনি অনেক স্বাধীনতা সংগ্রামীকে নিষ্ঠুরভাবে প্রহসনমুলক বিচারে ফাঁসির আদেশ দিয়েছিলেন, তাকে একাই কোর্টের সিঁড়িতে অসমসাহসে প্রকাশ্য দিবালোকে হত্যা করেন ১৭৭১ সালের ২০শে সেপ্টেম্বর। কিন্তু মুহাম্মদ আব্দুল্লাহ ইতিহাসে স্থান পান নাই।

বীর বিপ্লবী শের আলীর কথা না বললে আজকের লেখা অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। বৃটিশ বিরোধী আন্দোলনের জন্য তাঁর ১৪ বছর জেল হয়। শের আলী আন্দামানে জেল খাটছিলেন। এমন সময় কুখ্যাত লর্ড মেয়ো আন্দামান সেলুলার জেল পরিদর্শনে আসে। শের আলী সুযোগ বুঝে বাঘের মতোই রক্ষীদের পরাস্ত করে তাঁর উপরে চাকু হাতে ঝাঁপিয়ে পড়েন। লর্ড মেয়ো আন্দামান জেলেই শের আলীর চাকুর আঘাতে মৃত্যুবরণ করে।

শের আলীর দ্বিতীয়বার বিচার আরম্ভ হয়। বিচারে ফাঁসির রায় হয়। শের আলী বীরের শহীদি মৃত্যুবরণ করেন ফাঁসির কাষ্ঠে ঝুলে। অথচ কি আশ্চর্য, শের আলীর মতো মহান বীরের স্থান ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে হয়নি।

ঠিক এমনিভাবে ভুলিয়ে দেয়া ইতিহাস, আর ভুল বুঝানো ইতিহাস নিয়ে আরেকটা বই আসছে গার্ডিয়ান থেকে, ইতিহাসের ধুলোকালি নামে। কাজ চলছে।

অনেক কাজ বাকি আছে, লিখতে তো ইচ্ছে হয় অনেক কিছু, কিন্তু কবে শেষ হবে কে জানে।

[ঢাকা, ১৫ মার্চ, ২০১৮]