Home প্রবন্ধ-নিবন্ধ কুরবানী-কুরবানীর পশুর চামড়া বনাম কালো সিণ্ডিকেট

কুরবানী-কুরবানীর পশুর চামড়া বনাম কালো সিণ্ডিকেট

।। হাফেজ মাওলানা আবূ সালেহ ।।

‘কুরবাতুন’ আরবী শব্দ-মূল থেকে কুরবানী শব্দটির উদ্ভব। ‘কুরবানী’ শব্দটি বাংলা-উর্দূতেই অধিক ব্যবহৃত হয়। আরবী শব্দ ‘কুরবাতুন’ বা ‘কুরবুন’ এর অর্থ হলো নিকটবর্তী হওয়া বা নৈকট্য লাভ করা। অন্যদিকে ‘কুরবানী’ শব্দটি ব্যবহার হয় উৎসর্গ করা, আত্মত্যাগ অথবা আল্লাহর রাহে আত্মনিবেদন করার অর্থে। দক্ষিণ এশিয়ার মুসলমানরা ‘কুরবানী’ শব্দটি যিলহজ্জ মাসের ১০-১১-১২ তারিখে আল্লাহ তাআলার নির্দেশ এবং রাসূল (সা.) এর নির্দেশনা মোতাবেক নির্দিষ্ট হালাল পশু জবেহ করাকেই বোঝেন। যদিও হাদীসের ভাষায় এই কুরবানীকে বলা হয়েছে উদহিয়্যাহ।

উল্লেখ্য, এইভাবে পশু জবেহ করা যেহেতু একটি বিশেষ অর্থনৈতিক ওয়াজিব ইবাদাত, আর ইখলাছের সাথে এই ইবাদত আদায় করার দ্বারাও আল্লাহর নৈকট্য অর্জন করা যায়, সে কারণে প্রচলিত ‘কুরবানী’ শব্দটি নৈকট্য অর্জন অর্থের সাথে সামাঞ্জস্যপূর্ণ।

মূলত: যিলহজ্ব মাসের ১০ তারিখ থেকে নিয়ে ১২ তারিখ সূর্যাস্তের পূর্ব পর্যন্ত এই সময়ের মধ্যে যে মুসলিম, নর-নারী, সুস্থ, ঋণমুক্ত, বালেগ ব্যক্তি (জীবন ধারনের অন্যান্য প্রয়োজন পুরণ করার পর) সাড়ে ৫২ তোলা রূপা অথবা ঐ পরিমান রূপার মূল্যের মালিক হবে এরূপ প্রত্যেক ব্যক্তির জন্য কুরবানী করা ওয়াজিব।

একই পরিবারে যদি একাধিক বালেগ (ছেলে-মেয়ে-স্ত্রী-পরিজন) ব্যক্তি ঐ পরিমান বাড়তি সম্পদের মালিক হন, তাহলে তাদের প্রত্যেককে নিম্নতম একটি গরু-মহিষ কিংবা উটের সাত ভাগের একভাগ অথবা একটি খাশী, ছাগী, ভেঁড়া কিংবা দুম্বা আল্লাহর রাহে কুরবানী করা বাঞ্ছনীয়। এরূপ পরিবারের কেবল একজন কুরবানী করার দ্বারা অন্য জনের কুরবানী আদায় হবে না। বরং তারা গুনাহগার হবেন ওয়াজিব পরিত্যগ করার কারণে। (জাওয়াহিরুল ফিক্বহ)।

এ বিষয়ে একখানি বিশেষ হাদীসে রাসূলে কারীম (সা.) ইরশাদ করেছেন- কুরবানীর নির্দিষ্ট দিনে আল্লাহ তাআলার দৃষ্টিতে (অন্যান্য ফরজ ওয়াজিব আমলের পর) নির্দিষ্ট হালাল পশুর গলায় ছুরি চালিয়ে রক্ত প্রবাহিত করার চেয়ে পছন্দনীয় কোন কাজ নেই। (মিশকাত-তিরমিযি)

আরও পড়তে পারেন-

ওজন দরে গরু ক্রয় করে কুরবানী করা জায়েয হবে কি?

রাসূলুল্লাহ (সা.)এর দাম্পত্য জীবনে খাদিজা (রাযি.)এর ভূমিকা

কুরবানী এলেই তাদের পশুপ্রেম বেড়ে যায়!

ইসলামে কুরবানীর বিধান সুস্পষ্ট: এর বিকল্প অন্য কিছুতে হতে পারে না

বিদেশনীতিতে প্রবল ধাক্কা খেল ভারত

অপর হাদীসে রাসূল (সা.) হুঁশিয়ারী দিয়ে বলেছেন, যেসব ব্যক্তি কুরবানী করতে সক্ষম হওয়া সত্ত্বেও কুরবানী করলো না, তারা যেন আমাদের ঈদগাহে (ঈদের নামায পড়তে) না আসে! অতএব, যেসব বুদ্ধিজীবি ব্যক্তি অথবা মনগড়া মানসিকতা লালনকারী পন্ডিতগন মনে করেন, এ বছর করোনা  মহামারীর সময় ব্যপকহারে কুরবানী করলে ভাইরাস ব্যপকহারে ছড়িয়ে পড়বে, সুতরাং এবছর কুরবানীর পশু খরিদ করার টাকা ত্রাণ হিসেবে দিয়ে ‍দেওয়াই শ্রেয়, অথবা এবার কুরবানী না করাই উত্তম; তারা উপরে উল্লিখিত দুইখানী হাদীসের দিকে যেন গভীরভাবে লক্ষ করেন।

উল্লেখ্য, আত্মরক্ষা কিংবা শারীরিক সুরক্ষার বিষয়কে আমাদের মাথায় রাখতে হয় জীবনের সকল ক্ষেত্রেই। সুতরাং কুরবানী উপেক্ষা করার বিষয়টি কোনো ভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। যারা সক্ষম তারা কুরবানীও করবেন, ত্রাণও প্রদান করবেন। স্বাস্থ্য নিরাপত্তা বজায় রেখেই করবেন।

আমরা একটু আগেই উল্লেখ করেছি, প্রচলিত শরঈ কুরবানী একটি ওয়াজীব ইবাদত। এই ইবাদাত তখুনি আল্লাহর দরবারে কবূল হওয়ার যোগ্য হবে, যখন আমরা তা কেবলমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্যই সুন্নাহ মোতাবেক আদায় করবো। অন্যের সাথে প্রতিযোগিতা, লোক দেখানো, কিংবা নিরেট সামাজিকতা রক্ষার নিয়তে কুরবানী করলে তা কবূল হবে না। যেমন, এক হাদীসে বর্ণিত হয়েছে- আল্লাহ তাআলা তোমাদের শরীর কিংবা ধন-সম্পদের দিকে দৃষ্টি দেন না। তিনি দেখেন তোমাদের অন্তর এবং তোমাদের আন্তরিকতা সমৃদ্ধ আমল। (তিরমিযি-মেশকাত)

এরপর আসি কুরবানীর চামড়া প্রসঙ্গে: কুরবানীর পশুর গোশত যেমন কুরবানীদাতা এবং অন্যরা খেতে পারেন, তদ্রুপ কুরবানীর চামড়াও চাইলে কুরবানীদাতা নিজে ব্যবহার করতে পারেন, চাইলে অন্য কাউকে হাদিয়া দিতে পারেন। তবে কুরবানীর পশুর চামড়া বিক্রি করা হলে তা কেবল গরীব, মিসকিন, ইয়াতীম, অসহায়দের হক হয়ে যায়। কুরবানীদাতা অথবা কোনো ধনী ব্যক্তি তা ভোগ করার অধিকার রাখেন না। (জাওয়াহিরুল ফিক্বহ্)।

লজ্জাজনক হলেও সত্য, কয়েক বছর যাবৎ এই বাংলাদেশে কুরবানীর পশুর চামড়া নিয়ে নির্মম কারসাজী চলছে। পরিকল্পিতভাবে একাধিক সিন্ডিকেট কুরবানীর পশুর চামড়ার দাম নিয়ে অশুভ খেলা খেলছে। রাষ্ট্রীয়ভাবে এই খেলা বা কারসাজী বন্ধ করার কোনো উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে না। বরং এই খেলা খেলে, গরীব, মিসকীন, এতীম, অনাথ, অসহায়দেরকে ক্ষুধার জ্বালায় ভোগানো হচ্ছে।

এ বছরও অপ্রত্যাশিতভাবে ঐ অপকর্মটি করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। কেননা, একটি বড় সাইজের গরুর কাঁচা চামড়ার মূল্য নির্ধারণ করা হয়েছে ৪-৬ শত টাকা মাত্র; যা নিতান্তই নগন্য। অথচ বিদেশে কাঁচা চামড়ার দাম এর চেয়ে অনেক বেশি।

 এই করোনাকালে অভাব অনটনের যাতাকলে পিষ্ঠ গরীব দুঃখীদের ক্ষুধা নিবারণ, তাদের অন্যান্য ভরণ পোষণ, চিকিৎসা এবং শিক্ষা-দীক্ষার জন্য বিশেষভাবে কুরবানীর চামড়ার মূল্য কাজে লাগানো যেত, যদি শক্ত হাতে অসৎ সিন্ডিকেট ভেঙে দিয়ে চামড়ার মূল্য বাড়ানো হতো।

তাই সুস্থ বিবেকসম্পন্ন, গরীব হিতৈষী দীনদার মুসলমানদের দাবী, অতি দ্রুত অসাধু সিন্ডিকেট চুরমার করে দিয়ে প্রতিটি কুরবানীর গরুর কাচা চামড়ার মূল্য নিম্নতম আড়াই হাজার টাকা করা হোক। যেমন ৪/৫ বছর আগে ছিলো।

সুতরাং এই মহান নেক কাজে আমরা সকল সুধীজনের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। সেই সাথে দাবী জানাচ্ছি, স্বাস্থ মন্ত্রণালয় ও স্বাস্থ অধিদপ্তরের অসৎ সিন্ডিকেটের মতো সকল অসৎ, হারাম অর্থলোভী সিণ্ডিকেট ভেঙে দেয়া হোক।

– হাফেজ মাওলানা আবূ সালেহ, বিশিষ্ট সাহিত্যিক, গ্রন্থপ্রণেতা, সিনিয়র শিক্ষক- জামিয়া মাদানিয়া বারিধারা-ঢাকা।

উম্মাহ২৪ডটকম:এমএমএ

উম্মাহ পড়তে ক্লিক করুন-
https://www.ummah24.com

দেশি-বিদেশি খবরসহ ইসলামী ভাবধারার গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে ‘উম্মাহ’র ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।